নিতু

নিতু

শাড়ির শো-রুম টা অতিক্রম করতে গিয়ে হঠাৎ ই একটা শাড়ির উপর চোখ আটকে গেল নিতুর, লাল একটা শাড়ি, অসম্ভব সুন্দর। শাড়ির দিকে তাকাতেই গভির দীর্ঘশ্বাস এর সাথে একফোটা অদৃশ্য অশ্রু ঝরে পড়ল, বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠল। এটাই একমাত্র রঙ যা নিতু সহ্য করতে পারে না, জীবনের রঙ গুলো তো হারিয়ে গেছে সেই কবেই তবু এই রঙ টা চোখে পড়লেই বুকের ভিতরটা তোলপার করে ওঠে, তারাহুরো করেই বেড়িয়ে পরল মার্কেট থেকে। বাইরে ঝিরঝিরি বৃষ্টি হালকা বাতাস শুরু হয়েছে। নিতু একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে পার্কের দিকে রওনা হলো। আজকাল আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হয়না।

নিতুকে দেখলেই ওর মা শাড়ির আচলে চোখ ঢেকে কাঁদেন। নিতু কিছু বলে না ও বরাবরের মতই নির্বাক। কই ওর চোখেতো কখনো জল আসেনা! আর আসবেই বা কেমন করে মৃত মানুষের চোখে কি কখনও জল আসে?
অনুভূতিগুলো তো সেই কবেই মরে গেছে। এ যেন বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। নিতু ভাবছে আজ বৃষ্টিতে ভিজবে। তাতে যদি মনটা একটু হালকা হয়। রিক্সা চলছে আপন গতিতে। বৃষ্টিতে সামনের সব কিছু ঝাপসা লাগছে ঠিক নিতুর জীবন এর মত। কিছুদিন আগেও তো জীবন টা এমন ছিল না।

দুই বোন আর দুই ভাইয়ের সবার ছোট নিতু। বাবা মায়ের চোখের মনি আদরের রাজকুমারি, সবার আদর আর ভালবাসায় মেতে ছিল নিতু দিনগুলো। দেখতে দেখতে এইসএসসি পরিক্ষাও শেষ। ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিং এ ভর্তি হল। আজ সে অনেক খুশি কারন বাবা বলে দিয়েছে এত দূরের কোচিং এ একা যেতে হবে না। ওর বড় ভাই অফিসে যাবার সময় কোচিং এ দিয়ে যাবে এবং আসার সময় চাচাত ভাই রাশেদ তার বাইকে করে রোজ তাকে বাসায় পৌছে দিয়ে যাবে।

রাশেদ এর জব হয়েছে কিছুদিন আগে পুলিশ এর এস.আই পদে। ওর কোয়াটার নিতুর কোচিং এর ঠিক পাশেই। নিতুর তো আনন্দ আর ধরে না রাশেদ এর সাথে রোজ বাইকে আসবে এটা ভেবেই তার অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে, অনেক ভাললাগা কাজ করছে নিজের ভিতরেই। অনেক আগে থেকেই একতরফা ভাবে ভালবেসে আসছে রাশেদকে। ওর জিবনের প্রথম প্রেম প্রথম ভালবাসা সব কিছু জুড়েই ছিল রাশেদ। কিন্তু লজ্জা আর ভয়ে কোনদিন মুখফুটে কিছু বলতে পারেনি। হয়ত সব অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলছিল, হয়ত এই ভালবাসা পূর্নতা পাবার অপেক্ষায় ছিল। দিনগুলো ভাল ভাবেই পার হচ্ছিল ওদের কিন্তু নিতু কোনভাবেই ওর মনের কথা রাশেদকে জানাতে পারছিল না।

হঠাৎ একদিন ওর কল্পনাকেও হার মানিয়ে রাশেদ ফোন করল এবং ওর কোয়াটার রুমে আসতে বলল। নিতুর মনে তখন ঝড় চলতে শুরু করলো। রাশেদ কেন যেতে বলল? কি বলবে ওকে? তারপরও সমস্ত ভয় লজ্জা সংকোচ কে দূরে সরিয়ে নিতু রাশেদের রুমে গেল।

-কেমন আছো?
-ভাল।আপনি?
-আছি কোন রকম। বস, কি খাবে বল?
-কিছুনা। আপনি হঠাৎ এখানে আসতে বললেন! কিছু বলবেন?
-হুম একটা কথা বলার ছিল,থাক পরে বলব।
-পরে না এখনই বলুন।
-আসলে!
-কি হল বলুন না!

রাশেদ হাটু গেরে নিতুর সামনে বসে বলে ফেললো ‘বিয়ে করবে আমাকে?’ ভালবাসি অনেক আগে থেকেই কিন্তু বলা হয় নি।আকশ্মিক ঘটনায় নিতু যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, ওর চোখে জল এসে গেল। এযে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কোন উত্তর খুজে পাচ্ছিল না, কি বলবে নিতু! ঝরঝর করে কেঁদে দিল। রাশেদ বুঝতে পারছিল না কি করবে। আচমকা নিতু জড়িয়ে ধরল রাশেদকে। মনের জমানো কথা গুলো আজিই তো বলার সময়। তোমাকেও ভালবাসি। অনেক ভালবাসি তোমায় অনেক আগে থেকেই।

-পা টা একটু দিবে?
– কেন?
-এত প্রশ্ন কেন করো!

রাশেদ নিজেই নিতুর পা নিজের হাটুর উপর টেনে নিয়ে নিজের পকেট থেকে নুপুর জোড়া বের করে পরিয়ে দিল নিতুকে। আর বললো, অনেক আগে থেকেই কিনে রেখেছিলাম কিন্তু দেয়া হয় নি। আজ দিলাম আমার ভালবাসার প্রথম উপহার।

আজ খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ল নিতু। আজ তার অনেক কাজ আছে। আড়মোড়া ভেঙ্গেই গোসল সেরেই অনেক সুন্দর করে সাজতে বসে পরলো তার মনের মানুষের পছন্দমত। আজ যে তার অনেক প্লান। জীবনের ১৯ টি বসন্ত পেরিয়ে আজ সে অনেক খুশি কারন রাশেদ যে শুধুই তার। হ্যা, হাজার চরাই উৎরাই পেরিয়ে নিতু এবং রাশেদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে মাস খানেক হল। বিয়েতে অবশ্য অনেকেরই অমত ছিল প্রধানত রাশেদের পরিবারের। কেউ এই বিয়েতে রাজি ছিল না কিন্তু ওদের নিখুঁদ ভালবাসাই একে একে সব বাধা পেরিয়ে গেছে। যদিও রাশেদের পরিবার এখনও নিতুকে পুরোপুরি মেনে নেয়নি। তাই দুজনে ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় উঠেছে। দুইটি পাখির একটি নীর যেন ভালবাসায় পরিপূর্ন। এসব ভাবতে ভাবতেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে এসে জানালার পাশে দাঁরালো নিতু।

-হ্যালো রাশেদ!

-সরি, একটু জরুরি কাজে আটকে গেছি।

-ওহ। কখন আসবে তুমি?

-এইতো দুপুরের ভিতরেই চলে আসব, তুমি রেডি হয়ে থেকো। রাগ কোরো না প্লিজ আমি কাজ শেষ করেই চলে আসব।

-ওকে। হ্যালো শোনো।

-হ্যা বলো।

-ভালবাসি।

-আমিও।

ফোন রেখে নিতু আবার সাঁজতে শুরু করল। মনের মত করে সাঁজল সে। লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, খোপায় লাল গোলাপ, চোখে গাড় কাজল আর লাল লিপস্টিকে ওকে লাল পরির মত লাগছিল। আজ যেন ওই আয়নাবতীর ও হিংসে হচ্ছিল ওকে দেখে। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি যাকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস বলা হয়। ভালবাসার কি নির্দিষ্ট দিন ক্ষন আছে নাকি! আপন মনেই হেসে ওঠে নিতু। পাগলটা যে কখন কি করে বসে বুঝা মুস্কিল। সবার মতই আজ সারাদিন ঘুরার প্লান করেছে ওরা।

সময় পেরোতে লাগল। রাশেদ এখনও আসছে না দেখে নিতু অ্যালবাম নিয়ে বসল। যেখানে ওদের পুরোটা মধুর স্মৃতি দিয়ে পরিপূর্ন। বিশ্বাস শ্রদ্ধা কেয়ারিং এ এই কয়েক দিনেই ওদের ভালবাসা বেড়ে গেছে কয়েকগুন। চোখের আড়াল হতেও যেন কষ্ট হয়। অ্যালবামের শেষ পৃষ্ঠাটা ওল্টালো। এদিকে দুপুর হয়ে এল প্রায় অথচ রাশেদ এখনও আসছে না। কিন্তু আসছেনা কেনও! কখনোতো এত দেরি করে না। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল নিতু। মোবাইলটা হাতে নিয়েও কল দিল না, যদি ব্যাস্ত থাকে! হয়ত খুব জরুরি কাজে জরিয়ে পরেছে। নিজের মনকে নিজেই সান্তনা দেয় নিতু।

ঘড়ির কাটায় সময় ৩:৩০ টা। অস্থির হয়ে উঠল নিতু। সময় যে আর কাটছেই না। এত দেরি করার তো কথা ছিল না। হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে ফোন করল রাশেদকে। একি! ফোন সুইস্ট অফ থানায় কল করতে যাবে এর মধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে দরজা খুলতে গেল আর মনে মনে বলল এতক্ষনে আসার সময় হল। ধুর আজ আর কথাই বলব না। দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখল দুইজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে।

-আপনারা?

-আমাদের সাথে চলুন।

-কোথায়?

-হাসপাতালে।

-মানে! কেন কি হয়েছে? রাশেদ কোথায়! রাশেদের কিছু হয়েছে? চুপ করে আছেন কেনও! বলুন কি হয়েছে রাশেদের?

-স্যারের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

সাথে সাথেই সমস্ত পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে এলো। চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল নিতু। বিকেল পেরিয়ে গোধুলি নেমে এসেছে। প্রকৃতিতে, বৃষ্টিটাও থেমে গেছে কিছুক্ষন হল। স্নীগ্ধ একটা পরিবেশ। বাসায় হয়ত এতক্ষনে খোজাখুজি করে চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে সবাই। কিন্তু এসবের প্রতি কোন আগ্রহ নেই নিতুর। যেখানে রাশেদ নেই সেখানে সে ফিরবে কিসের টানে! ৩ টা বছর পেরিয়ে গেল রাশেদ নেই, হারিয়ে গেছে ওই দূর দিগন্তে, হারিয়ে গেছে নিতুর জিবনের সব রঙ।

ধীরে ধীরে পার্কের বেঞ্চটা ছেরে উঠে দাঁড়াল নিতু। শরিরটা আজ পাথরের চেয়েও বেশি ভারি মনে হচ্ছে। পা দুটো শরিরের ভারে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। সারাদিনের ভেজা কাপড়টা শরীরেই শুকিয়ে গেছে। মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা আর কোনও মতেই। শরীর যেনও ভেঙে আসছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী যেন বৃত্তাকারে ঘুরছে আর ও মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ন একা।

ক্লান্ত শরিরটা এলিয়ে পড়ে গেল নিতু, শরিরের তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে, একটা ঘোর যেন ওকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ঝাপসা চোখে চোখ মেলে দেখে রাশেদ হাত বাড়িয়ে ডেকে চলেছে ওকে। নিতু বারবার হাতটা ধরতে গিয়েও ব্যার্থ হচ্ছে। হাতটা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে আর নিতু পাগলের মত অজানা দিগন্তের পানে ছুটে চলছে হাতটা ধরার জন্য বিরবির করে বলছে ‘আমি আসছি রাশেদ আমি আসছি’।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত