মায়ার সংসার

মায়ার সংসার

কি হল এদিকে এসো আমার টাই টা খুঁজে পাচ্ছিনা। রাফির চিৎকার শুনে মায়া দৌড়ে এলো। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় রাফি হুলুস্থুল বাধায়।যতই সবকিছু গুছিয়ে ওর সামনে রাখনা কেন,মানুষটার চেচামেচি না করলে ভাললাগেনা। এই সময় মায়ার এমনিতেই অনেক কাজ থাকে।সবার নাস্তা দিয়ে রাফির দুপুরের খাবার গোছানো,শ্বাশুড়ির ওষুধ খাওয়ানো।তাছাড়া ওর দেবর আর জা দুজনই চাকরি করে।ওরা চলে গেলে ওদের ছেলেকে রাখতে হয়।তাই মায়া সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করে।কিন্তু রাফি প্রতিদিনই ঝামেলা বাধায়।

নিজের জিনিসটা একটু খুঁজে নিতে পার না? তাহলে বিয়ে করেছি কেন?কথাটা বলেই রাফি মায়ার গালে আলতো ছোঁয়া দেয়। মায়া জানে রাফি ইচ্ছা করেই অফিসে যাওয়ার সময় এমন করে।সারাদিন সংসারের সব কাজ করতে করতে রাফিকে ঠিকমত সময়ই দেয়া হয়না।বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠার পর রাফি যাতে ওকে না ডাকে তাই রাতেই ওর সবকিছু গুছিয়ে রাখে।কিন্তু রাফি ও কম কিসে? ইচ্ছে করে সবকিছু উল্টাপাল্টা করে মায়াকে ডাকে।

রাফি চলে যাওয়ার পর প্রতিদিন মায়া শ্বাশুড়ির কাছে বকা শোনে। কি করে সংসার কর বুঝিনা বাপু।স্বামীর জিনিসপত্রগুলো ঠিকমত গুছিয়ে রাখতে পারনা?স্বামীকে নিজের আঁচলে বাঁধবে কি করে?তোমার মত বয়সে পুরো সংসার সামলেছি।তার উপর চার চারটা ছেলেমেয়ে।তাও বুঝতাম যদি একটা ছেলেপুলে থাকত। এতক্ষন শ্বাশুড়ির কথা শুনে মিটিমিটি হাসছিল মায়া।তবে এখন ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছে।সত্যিই ত সন্তান ছাড়া কি পুরুষ মানুষকে বেধে রাখা যায়?

সালেহা বেগম তার বড় ছেলের জন্যে মেয়ে দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠেছিলেন।এত মেয়ে তবু তার মনের মত যেন একজন ও না।হঠাৎ ঘটক একটা মেয়ের খবর দিল।মেয়ে দেখতে যেয়ে তো সালেহা বেগম বেজায় খুশি।এই মেয়ে একদম তার মনের মত।মেয়ের নামটাও সুন্দর,মায়া।মায়ায় পারবে সবাইকে মায়ার বাধনে বেধে রাখতে। রাফি বরাবরই মায়ের বাধ্য ছেলে।মায়ের পছন্দে ওর দ্বিমত ছিলনা।তবুও মেয়ে দেখতে গেল।মেয়ে দেখে ওর ও ভীষণ পছন্দ হল।কি মায়া ভরা চোখ দুটো!দেখলেই আপন মনে হয়।

মায়া যেমন দেখতে সুন্দরি। তেমনি ওর মনটাও সুন্দর। তাই অল্পদিনেই শ্বশুর বাড়ির সবার মন জয় করে ফেলল।শ্বশুর, শ্বাশুড়ি মায়া ছাড়া কিছুই বোঝেনা।আর রাফি? সেতো বউকে চোখে হারায়।অফিসের সবাই রাফিকে নিয়ে আলোচনা করে।কি এমন আছে ভাবির মধ্যে?একটা দিন ও রাফিকে অফিসের পরে আটকে রাখা যায়না।রাফি একবার ওদের এনিভার্সারিতে ওর কলিকদের বাড়িতে দাওয়াত দেয়।সেবার সবাই মায়াকে দেখে আর ওর রান্না করা খাবার খেয়ে ঠিকই বোঝে রাফি কেন এমন করে।

মায়া আর এ বাড়ির বংশধর আনতে পারবেনা এটা জানার পর হঠাৎ করে পুরো পরিবারের চেহারাটা বদলে গেল।শুধু রাফিই আগের মত ছিল।কারন ওই জানত দোষটা মায়ার না।আসলে দোষটা কারোরই না।হতে পারে যেকোন সময় মিরাকল ঘটে যেতে পারে।তবে এসব কথা তো আর সবাইকে বলা যায়না।আর আমাদের সমাজে প্রচলিত সত্য হচ্ছে সন্তান না হওয়ার কারন নারী।অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর জন্যে দায়ী থাকে পুরুষ।

ভাগ্যের উপর সবকিছু সপে দিয়ে মায়া সংসার করতে লাগল। এরমধ্যে ওর দেবর রাতুল একদিন ভাবিকে ডাকল।মুখ কাচুমাচু করে জানালো একটা মেয়েকে ওর খুব পছন্দ।ওর নাম নীলা।অনেকদিন থেকেই দুজনের সম্পর্ক। কিন্তু ইদানিং ওর বাবা উঠে পরে লেগেছে নীলার বিয়ে দেয়ার জন্যে।এদিকে রাতুলের ও এখনো কোন চাকরি হয়নি।মায়া চিন্তায় পরে গেল।শ্বাশুড়ি মাকে বললে নিশ্চিত বকা শুনতে হবে। তাই ও রাফিকে বলল।কথাটা শুনে রাফি ভীষণ রেগে গেল।

নিজেই চলে ভাইয়ের টাকায়।আবার বিয়ে করার শখ। মায়া রাফিকে অনেক বোঝাল।এই বয়সের ছেলে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে?তার চাইতে বিয়ে দেয়ায় ভাল।বিয়ে হলেই হয়ত রাতুলের চাকরি করার তাগিদ বাড়বে। রাফি মা বাবার সাথে কথা বলে ওদেরকে রাজি করাল। রাফির টাকায় এই সংসার চলে।তাই বাবা মা ওর কথার বাইরে যায়না।তাই ছেলে যখন বিয়েতে রাজি হল তখন আর সালেহা বেগম না করলেননা।

নীলাদের বাড়িতে যেয়ে সবার মন ভেংগে গেল।এমন পরিবারে রাতুল কিভাবে সম্পর্কে জড়াল তা কারো মাথায় ঢুকল না।তবে নীলাকে দেখে সবার পছন্দ হল।কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা।আর কথাও বলে সুন্দর করে।ভাগ্য ভাল সালেহা বেগম আসেননি।রাফি আর মায়া এসেছে।সালেহা বেগম এলে তক্ষুনি বিয়ে ভেংগে দিতেন।এরপর রাফি আর মায়া অনেক বুঝিয়ে বাবা মাকে বিয়েতে রাজি করায়।

বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম নীলা খুব বেশি কথা বলতনা।সারাক্ষন মায়ার সাথে সাথে থাকত।মায়া যা বলত তাই করত।সালেহা বেগম বিয়েতে রাজি হলেও নীলাকে খুব একটা পছন্দ করতেননা।নীলার উপর উনার ওই একটা বিষয়েই রাগ ছিল।এমন নিচু বংশের মেয়ে কি পারবে এ বাড়িতে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে? তারপর সংসারটা উনি মায়ার হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।মায়াও যেন নিজের মনের মত করে সংসার করছিল।সবার মনের ইচ্ছা পুরন করতে করতে কখন যে নিজের ইচ্ছাটা হারিয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি মেয়েটা।

এর মধ্যে রাতুলের চাকরি হয়েছে।সেও এখন সংসারে টাকা দেয়।এতদিন রাফির টাকায় সংসার চলত।এমনকি নীলার সব প্রয়োজন ও রাফি মিটিয়েছে।স্বামীর চাকরি হওয়ার পর থেকে নীলা কেমন বদলে যেতে লাগল।এখন আর চুপচাপ থাকেনা।হুটহাট বাইরে চলে যায় মায়াকে বলেও না।মায়া জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে চলে।

রাতুলের প্রথম বিবাহবার্ষিকীটা খুব ঘটা করে পালন করা হয়।যদিও রাফি কখনোই ওর বিয়ের দিনটা বিশেষ ভাবে পালন করেনি।ওর মনে হয় এসব অপচয়।কিন্তু ভাইকে কিছুই বলতে পারলনা।অনুষ্ঠান শেষ সবাই বাড়ি চলে যেতেই নীলা অসুস্থ হয়ে পড়ল।বারবার বমি করতে থাকল।সবাই ভাবল খাবারে কোন গন্ডগোল ছিল।পরদিন ও যখন বমি কমল না তখন রাতুল ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল।

নীলা প্রেগনেন্ট এই খবরটা শোনার পর থেকে পুরো বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গেল।সালেহা বেগম যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন।পারলে তিনি নীলাকে মাথায় তুলে রাখেন।মায়া ও ভীষণ খুশি হল।যাক এতদিনে এ বাড়িতে বংশধর আসছে।যদিও কয়েকদিনেই ওর খুশি ম্লান হয়ে গেল।সালেহা বেগম কিছুতেই নীলার কাছে মায়াকে যেতে দিচ্ছেননা।এমনকি নীলার দেখাশুনার জন্যে তিনি একজন মহিলা রাখলেন।মায়া প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝল।মায়ার বাচ্চা হয়না।তাই ওর ছোয়ায় নীলার ক্ষতি হতে পারে এই ভাবনায় হচ্ছিল উনার।

রাতে মায়া ডুকরে ডুকরে কাঁদে।পাশে শুয়ে থাকা রাফিও সেটা বুঝতে পারে।কিন্তু ও মায়াকে কোন শান্তনা দিলনা।ও চায় মায়া নিজে থেকেই একদিন এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে শিখবে।নীলার বাচ্চা হওয়ার কিছুদিন আগে ও বাপের বাড়ি চলে যায়।যদিও সালেহা বেগমের ইচ্ছা ছিলনা।তবে রাতুল বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছে।

নীলার ফুটফুটে একটা ছেলে হল।নাতির মুখ দেখে সালেহা বেগম খুশিতে কেঁদে ফেললেন।তিনি কিছুতেই নাতিকে ও বাড়িতে পাঠাবেননা।কিন্তু নীলা না আসার জন্যে নানা বাহানা শুরু করে।ওর নিজের ঘরে এটাচ বাথরুম নেই তাই ওখানে গেলে অনেক কষ্ট হবে।সালেহা বেগম নিজের ঘর ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি ফেরেন।এ বাড়িতে দুটো ঘরের সাথে এটাচ বাথরুম।একটাতে মায়ারা থাকে।আরেরটাতে শ্বশুর শ্বাশুড়ি থাকে।শ্বাশুড়ির ঘর ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে মায়া আঁতকে ওঠে।সে নিজেই নিজের ঘরটা ছেড়ে দেয়।শ্বাশুড়ি হয়ত মনে মনে এটাই চেয়েছিল।

রাফি বাড়ি ফিরেই চায় মায়া ওর পাশে একটু বসুক।দুটো মনের কথা বলুক।কিন্তু মায়া যেন সংসার করতে করতে রাফির কথাই ভুলে গেছে।আজ বাড়ি ফেরার আগে তাই রাফি মায়াকে কল করল। অনেকদিন দুজনে কোথাও যাওয়া হয়না।চল না একটু ঘুরে আসি। ভেবেছিল মায়া না করবে।কিন্তু ও রাজি হল। তৈরি হয়ে শ্বাশুড়ির ঘরে যেয়ে দেখল উনি শুয়ে আছেন। আম্মা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এই সময়ে কোথায় যাবে? আপনার ছেলে যেতে বলেছে।কোথায় আমি জানিনা। কোথায় আর যাবে নিশ্চয় ডাক্তারের কাছে।এখন আর ডাক্তার গুলায়ে খাইলেও লাভ নেই।এত বছরে যখন কিছু হলনা আর কবে হবে? মায়া আর দাঁড়াল না।এসব কথা শুনতে আর ভাললাগেনা।

দুজনে কিছুক্ষন ঘুরে বাইরে খেয়ে মায়া আর রাফি বাড়িতে ফিরল।অনেকদিন পর অনেকটা সময় দুজন। নিজেদের মত করে কাটাল।বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মায়া শ্বাশুড়ির ঘরে গেল।যা ভেবেছিল তাই হয়েছে।নীলা মাকে ওষূধ না খাইয়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে।নীলাকে যত দেখে মায়া,তত অবাক হয়।এ বাড়িতে এসে কেমন মায়ার পিছন পিছন ঘুরত।কিন্তু আয়াশ পেটে আসার পর থেকে কেমন বদলে গেল।ছেলেটাকে মায়ার কোলে দিতেও চাইত না।রাতুলের জন্যে হয়ত কিছু বলতে পারেনি।অথচ এই ছেলে বড় মা ছাড়া কিছুই বোঝেনা।বাচ্চারা যেখানে আদর পায় সেখানেই থাকতে চায়।আয়াশের যখন ৩ বছর বয়স তখন নীলার ও চাকরি হল।ও ছেলেকে দেখার জন্যে একটা কাজের মেয়ে রেখেছিল।কিন্তু আয়াশ কিছুতেই মেয়েটার কাছে যায়নি।এমনকি ও খাবার দিলে খেত ও না।শেষমেশ বাধ্য হয়ে নীলা মায়াকে আয়াশের দায়িত্ব দিল।

রাফি বাড়িতে ফিরে প্রতিদিনই কিছুটা সময় বাবা মায়ের ঘরে কাটায়।আজ ও গেল। মায়া শুয়ে পড়েছিল।চোখটা লেগে এসেছিল।কিন্তু রাফি ঘরে না আসায় শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে গেল।দরজার কাছে যেতেই ওর পা আটকে গেল।রাফি আর ওর মা কথা বলছে। আমি চাই তুই আবার বিয়ে কর।আমি তোকে এভাবে দেখতে পারছিনা। কিন্তু মা আমি ত ভাল আছি। এটাকে কি ভাল থাকা বলে।ছোট ভাই পরে বিয়ে করে বাবা হয়ে গেল।আর তুই কিনা বাজা বউ নিয়ে বসে আছিস। মা প্লিজ থামো এসব কি বলছ?মায়া শুনলে কষ্ট পাবে। বউয়ের কষ্টের কথা ভাবলি আর মায়ের কষ্টের কথাটা ভাবলিনা? দরজার কাছ থেকে সরে এক দৌড়ে মায়া নিজের ঘরে চলে গেল।

সারারাত রাফি বিছানায় এপাশ ওপাশ করল।মায়া জেগেই ছিল।কিন্তু কোন সাড়াশব্দ করেনি।পাছে রাফির কাছে ধরা পরে যায়।পরদিন সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই হচ্ছিল।শুধু মায়ার মনটা বড্ড বিক্ষিপ্ত ছিল।সকালে নীলা অফিসে যাওয়ার সময় বলছিল ওর শরীর ভাল না।তাই সন্ধ্যায় ও ফিরলে মায়া চা নিয়ে যাচ্ছিল দুজনে একসাথে খাবে আর নীলার শরীরের খবর নেবে।কিন্তু ওদের ঘরের দরজায় যেতেই ওর পা আটকে গেল।নীলা আর রাতুল কথা বলছে।রাতুল খুব উত্তেজিত ছিল।বারবার বলছিল এখন ও বাচ্চা চায়না।কিছুদিন আগে রাতুলের চাকরিটা চলে গেছে।এখন নীলার টাকায় কোন মতে সবকিছু ম্যানেজ হচ্ছে।কিন্তু এই মূহুর্তে বাচ্চা নিলে নীলার পক্ষেও বেশিদিন চাকরি করা সম্ভব হবেনা। তখন ওদের ছেলেটার কি হবে?তাছাড়া বাচ্চা হতে যে খরচ সেটাও বা কে দেবে? মায়া আর ওদের ঘরে ঢুকলনা।নিজের ঘরে যেয়ে চুপচাপ বসে থাকল।রাফি ফিরলে ওকে সব বলল।রাফির ও কথাটা শুনে খারাপ লাগল।কিন্তু প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে।রাতুল যতই ওর ভাই হোক সে নিজের জীবনের যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।রাফি তাতে নাক গলানোর কে?

কয়েকদিন ধরে নীলার মনটা খারাপ।পারতপক্ষে ও বাড়ির কারো সাথে কথা বলছেনা।অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে থাকে।মায়ার খুব খারাপ লাগছে।অনেক ভেবে ও নীলার সাথে কথা বলতে গেল।নীলা তখন ছেলেকে পড়াচ্ছিল। তোমার শরীরের কি অবস্থা নীলা? এই তো ভাল। কয়েকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা। আমাকে কিছু বলতে ভাবার কি আছে ভাবি? সেদিন তোমার আর রাতুলের কথাগুলো আমি শুনে ফেলেছি।ইচ্ছা করে শুনিনি।তোমার জন্যে চা নিয়ে আসছিলাম। মায়ার কথা শুনে নীলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

জানো নীলা বিয়ের এক বছর পর থেকেই আমরা একটা বাচ্চার জন্যে চেষ্টা করছি।প্রথম প্রথম প্রতিমাসেই অপেক্ষা করতাম হয়ত কোন সুখবর পাব।কিন্তু একটা সময় পরে আমরা আর অপেক্ষা করতামনা।আমি জানি অপেক্ষা করে কোন লাভ হবেনা।নীলা বোন আমার এমন ভুল করনা।বাচ্চাটাকে মেরে ফেলনা।আমার মত অনেক মেয়ে আছে যারা প্রতিমাসে অপেক্ষা করে।আর তুমি না চাইতেই পাচ্ছ।আমি কথা দিচ্ছি রাতুলের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের সব খরচ আমি দেব।ভেবনা তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে নেব।আমার বাবার বাড়ি থেকে প্রতিমাসে বাড়ি ভাড়া বাবদ বেশ কিছু টাকা পাই।কিন্তু ওগুলো ব্যাংকেই পড়ে আছে।তোমার ভাইয়ার টাকায় আমাদের ভালভাবে চলে যায়।তাই টাকাগুলো দিয়ে এতদিন কিছুই করিনি।কিছুদিন না হয় একটা ভাল কাজে টাকাটা খরচ হল।হয়ত ভাবছ তোমাদের দয়া দেখাতে চাচ্ছি।কিন্তু না।

আসলে আয়াশ যখন আমাকে বড় মা ডাকে আমার মনটা তৃপ্ত হয়।আরো একজন যদি আসে আমাকে বড় মা ডাকার জন্যে সেটা যে কতটা আনন্দের সে আমি তোমাকে বোঝাতে পারবনা।চোখের সামনে তোমাকে দেখব একটু একটু করে একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনবে।এই দেখা থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না। আমরা দুজন মিলেই না হয় ওকে মানুষ করব।প্লিজ নীলা,,, নীলার চোখদুটো পানিতে ছলছল করছে।যেকোন মুহুর্তে উপচে পড়বে।মায়া আর দাঁড়াল না।হয়ত মেয়েটা আবেগে যা তা কান্ড করে ফেলবে।দরজায় দাড়িয়ে রাফি সবই শুনল।মায়াকে খুঁজতে এসে ও সব শুনেছে।সত্যি আজ ওর গর্ব হচ্ছে মায়ার মত একটা মেয়েকে জীবনসংগী হিসেবে পেয়ে।

কয়েক মাস পরেই রাতুলের একটা চাকরি হয়েছে।নীলা ওর চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে।মায়া আর নীলা মাঝে মাঝে দুপুর বেলা বিছানায় শুয়ে গল্প করে।মায়ার প্রশ্নের কোন শেষ নেই।বাচ্চাদের মত একের পর এক প্রশ্ন করতেই থাকে। আচ্ছা নীলা ও নড়াচড়া করলে তোমার ভয় করেনা? ওকে নিয়ে হাটতে তোমার কষ্ট হয়না? আচ্ছা ওর ক্ষুধা পেলে কি তুমি বোঝ? আচ্ছা ও দেখতে কার মত হবে? আবার মাঝে মাঝে নীলার পেটে হাত রেখে বাচ্চার অস্তিত্ব বোঝার চেস্টা করে।মায়ার কাণ্ডকারখানা দেখে নীলা হেসেই খুন।

এমনি এক দুপুরে নীলার প্রসব বেদনা শুরু হয়।নীলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।নীলার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়।মেয়েকে কোলে নিয়ে মায়া বসে আছে।কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মেয়েটা। তুলার মত নরম ওর শরীর।মায়া বারবার ওকে ছুঁয়ে দেখে।জন্মানোর পর থেকে মেয়েটা শুধু ঘুমাচ্ছে।সালেহা বেগম পাশে বসা।হঠাৎ আয়াশ বলে উঠল আমার বোনের নাম কি আম্মু? নীলা বলল ওর নাম ওর মা-ই রাখবে।

সালেহা বেগম পুত্রবধুর দিকে তাকালেন।এ আবার কেমন কথা? ওর কোন মায়ের কথা বলছ? আম্মা ভাবি ওর মা।আমি তো শুধু এতগুলো দিন ওকে পেটে রেখেছি মাত্র।এখন ভাবির আমানত ভাবিকে ফেরত দেব। নীলার কথায় মায়া ছলছল চোখে তাকালো। এসব কি আবোল তাবোল বলছ নীলা। আমি ঠিকই বলছি ভাবি।এই মেয়ের উপর আমার কোন দাবি নেই।এই মেয়ে তোমার।তোমার জন্যেই ও পৃথিবীর আলো দেখেছে।আমাকে শুধু মাঝে মাঝে তোমার মেয়েটাকে একটু আদর করতে দিও।

মায়া আর নীলা কাঁদছে। সালেহা বেগমের চোখেও পানি।তবে তা লজ্জার।নিচু বংশের মেয়ে বলে যাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন, আজ সেই মেয়েই শেখালো তাকে অনেক কিছু।অবশ্য এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে মায়ার জন্যে।অথচ এই দুটো মেয়েকেই তিনি নানাভাবে অপমান অপদস্থ করেছেন।আজ সেসবের জন্যে বড্ড আফসোস হচ্ছে তার।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত