রিয়াদের কোলে মেঘবতি, জলে সিক্ত এক মায়াবিনী। যাকে আজই প্রথম ছুঁয়ে দেখল রিয়াদ। এ অন্য কেউ না, রিয়াদের ঘরের লক্ষী। বিয়ের এতদিন পরও যে মেয়েটার রিয়াদের স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আজ সেই মেয়েটা তার স্বপ্ন পুরুষের কোলে। মচকে যাওয়া পায়ের ব্যাথাটা তার কাছে নিতান্তই ক্ষুদ্র।
রিয়াদের গলা জাপটে ধরে আছে মেঘবতি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। যে অনুভূতির কোন সংজ্ঞা নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। এক বছর যার সাথে একই ঘরে বাস, প্রথমবার তার গলা জাপটে ধরার মাঝে যে ভালবাসার প্রাপ্তি সেটা মেঘবতির চোখের কোণের কয়েক বিন্দু জলে হয়তো প্রকাশ করাটা সম্ভব না। কিন্তু মনের মাঝে কবিগুরুর “আমি পাইলাম তাহাকে পাইলাম”কথাটা বেজে ওঠার মাঝে যে প্রশান্তি সেটা মেঘবতি খুব করে অনুভব করেছিল।
বিয়ে হয়েছে এক বছর হয়ে গিয়েছে মেঘবতির। কিন্তু বিয়ে মানে জীবনের যে পরিবর্তন তার সবটা হয়নি মেঘবতির। শুধু এতটুকু পরিবর্তন হয়েছিল যে,রাতে ঘুমানোর ঘরটা নিজের বাপের বাড়ি থেকে নিজের স্বামীর বাড়িতে হয়েছিল। আর বাসর ঘরে ছোট হয়েছিল নিজের নামটা। মেঘবতি থেকে “মেঘ”।
জীবন মঞ্চের অভিনয়ে পাকা ছিল মেঘ। তাইতো,বিয়ের এতদিন পাড় হয়ে যাবার পরও স্বামীর আদর অথবা শাসন কোনোটাই জোটেনি হতভাগিনীর। তবু তার শুশুর বাড়ি আর বাপের বাড়ির কেউ বুঝতেই পারেনি। আর দশটা মেয়ের মতই ভয় আর নতুন একটা মানুষকে সারা জীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্খা নিয়েই বাসর ঘরে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসেছিল মেঘবতি। হঠাৎ স্বামী উপাধি নিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করে রিয়াদ। যে মানুষটাকে নিয়ে মেঘবতি তার মনে মনে অচেনা অজানা কিছু সুখের জলছবি এঁকে রেখেছিল। এই বুঝি পাশে এসে বসবে, ঘোমটা সরাবে, কেমন আছি জানতে না চেয়েই হয়তো স্বামীত্বের বাহাদুরি দেখাবে। তবে যাই করুক,এতদিন ধরে যার জন্য নিজের সবকিছু নিয়ে এই প্রতিক্ষা সেই মানুষটা যা খুশি করুক,নিজের সবটা উজার করে দেয়ার মানসিকতা নিয়েই বসেছিল মেঘবতি। কিন্তু, মেঘের সব ভাবনাকে ভূল প্রমাণ করে দিয়েছিল রিয়াদ।
ঃ শোনো, তোমার নাম যেন কি?
ঃজ্বী, মেঘবতি।
ঃ এত বড় ডাকনামে তোমাকে ডাকতে পারবনা।
ঃতাহলে, আপনার মনের মত ছোট করে নিন।
ঃহুম,তোমাকে আমি মেঘ বলে ডাকব।
বাসর ঘরে শুধু এতটুকুই কথা হয়েছিল রিয়াদ আর মেঘের। মেঘের হৃদয়ের ভাঙনের ঢেউ সেদিন রিয়াদ খেয়াল করেনি।কারণ সুন্দর করে গোছানো ফুলের বিছানায় এক সাথে শোঁয়েও দুজনের মাঝে কোলবালিশ দিয়ে চীনের মহাপ্রাচীর বানিয়ে রিয়াদ দূরে সরিয়ে রেখেছিল এই মায়াবিনীকে।
কয়েক মিনিটে এত কিছু ভেবে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেঘ। রিয়াদের বুকের মাঝে লুকানো মুখটা থেকে হঠাৎ একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেও রিয়াদ বুঝতে পারে। রিয়াদ থেমে যায়। এই প্রথম রিয়াদ ওর বউয়ের নিষ্পাপ মুখটার দিকে চোখভরা প্রেম নিয়ে তাকায়। মাত্র কিছুক্ষণ আগে,গ্রামের বাড়ির ওঠানে একা একা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা রিয়াদকে সঙ্গ দিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা মচকে ফেলা এই মানবীকে স্বামীত্বের দায়িত্ববোধ থেকে কোলে তোলে নিবে রিয়াদ, দুজনের কেউ ভাবেনি এমন একটা সময় আসবে।
রিয়াদ,মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল শাড়ী পড়া মেঘের উপর বৃষ্টির জল মেঘের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর আগে রিয়াদ এমন করে দেখেনি মেঘকে। রিয়াদের মনে হচ্ছে,এই মেয়ের কোন দোষে সে বিয়ের এই একটা বছর তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আর এই মেঘকেই স্রষ্টা কেমন হৃদয় দিয়েছে যে, এতদিনে তৃতীয় কোনো মানুষকে জানতে দেয়নি তার বিরহ-বঞ্চনা। মেঘ ঘামছে ধরেছে রিয়াদের গায়ে বৃষ্টির জলে লেপ্টে থাকা টি-শার্ট। ক্রমেই ওর নিঃশ্বাস আরও উষ্ণ হয়ে ওঠছে। ওঠান থেকে মেঘকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যায় রিয়াদ। তখন বৃষ্টি প্রায় থেমে গেলেও মেঘ আর রিয়াদের বুকের ভিতরের ঝড়টা যেন বেড়েই চলছিল। ভোর হয়েছে,আজই প্রথম ভেজা চুলের পানি চোখে পড়তে ঘুম ভাঙে রিয়াদের।
ঃএই ওঠো, সকাল হয়ে গেছে। আমি তোমার নাস্তা রেডি করছি,তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আসো। রিয়াদ একটা হেচকা টানে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেই মেঘকে। আলতু করে কপালে একটা চুমু এঁকে দেয় রিয়াদ।
ঃ আমার মেঘ, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি তোমাকে অনেক ঠকিয়েছি।
ঃ এমন করে বলে আমাকে ছোট করে দিওনা। আমার প্রতিক্ষা সার্থক হয়েছে আমি এতেই খুশী।
জানো, বৃষ্টি সত্যিই রুমান্টিক। কারণ, এই বৃষ্টিস্নান আমাকে তোমার কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন ছাড়ো, অনেক হয়েছে এবার খাবার টেবিলে আসো। ক্ষনিকের জন্য অতীতে হারিয়ে যায় রিয়াদ। মনে পড়তে থাকে কেন, কার জন্য এতদিন মেঘকে ঠকিয়েছে। চোখের সামনে অতীতটা ভেসে ওঠছিল রিয়াদের। অনেক সকাল পর্যন্ত ঘুম পাড়ার অভ্যাস ছিল রিয়াদের। কিন্তু সেদিন আদ্রিতার ফোন পেয়ে একটু সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় রিয়াদের।
ঃ হ্যালো,রিয়াদ। আজকে একটু আর্জেন্ট দেখা করতে পারবে?
ঃ কেন? কি হয়েছে? আচ্ছা যাই হোক, আমি নয়টার দিকে আসছি চন্দ্রিমা উদ্যানে।
ওকে রাখছি, বলে ফোনটা কেটে দেয় আদ্রিতা। সকাল নয়টা, চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকটার পাশে বসে আছে আদ্রিতা। দূর থেকেই রিয়াদ দেখতে পায় আদ্রিতাকে। এর আগে কখনও এমন হয়নি। কারণ, সব সময় রিয়াদই আগে এসে আদ্রিতার জন্য অপেক্ষা করে।
ঃ আদ্রিতা, কখন এসেছ তুমি? সবে তো নয়টা বাজ্ল।
ঃ হ্যাঁ, সকালে পুজো দিয়ে, ঠাকুরের পায়ে ছুঁয়ানো ফুল নিয়ে আর দেরী করিনি। শোনো, তোমার মাথাটা একটু নীচু করো, ঠাকুরের ফুলটা তোমার মাথায় একটু ছুঁয়ে দিই।
ঃ কি হয়েছে তোমার? সকাল বেলা আর্জেন্ট ফোন করে আসতে বললে আবার ঠাকুরের ফুল নিয়ে এসেছ।
ব্যাপারটা কিগো?
ঃ রিয়াদ, আমার ওঠতে হবে।
তার আগে কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোনো। রিয়াদ, তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। আমি যদি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে থাকি সেটা তুমি। কারও সাথে যদি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকার বাসনা রাখি সেটা তুমি। আদ্রিতা একদমে শেষ করে কথাগুলো রিয়াদ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আদ্রিতার চোখের দিকে।
ঃরিয়াদ তুমি আমাকে মাফ করে দিও। তোমার আর আমার আলাদা ধর্ম আমাদের এক হতে দিবেনা।আমরা মধ্যবিত্ত। ধর্ম ছেঁড়ে দেয়া মানে, যে বাবা মা আমাকে এত বড় করেছে আমার সেই বাবা মাকে ছেঁড়ে দেওয়া। আবার দুজনের ধর্ম ঠিক রেখেও এক সাথে জীবন সাজানো তোমার আমার দুজনের মধ্যবিত্তসমাজ মানবে না।
স্তব্ধ হয়ে যায় রিয়াদ,কোনো কথা বলতে পারছে না।
ঃরিয়াদ, কালকে আমার বিয়ে। আজকের পর তোমার-আমার আর না দেখা হবে না কথা হবে। যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও বলে আদ্রিতা চলে যেতে থাকে। কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে এসে একবুক যন্ত্রণা আর চোখ ভর্তি জল নিয়ে।
ঃ রিয়াদ, আমি এতটা নিষ্ঠুর কি করে হচ্ছি?
আচমকা রিয়াদকে জড়িয়ে ধরে রিয়াদের ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে দেয় আদ্রিতা। আর বলে যায়,পরের জন্মে দুজন জোর করে একই ধর্ম নিয়ে আসব। ভাল থাকার চেষ্টা করো রিয়াদ। আদ্রিতা রিক্সায় ওঠে যায়। যতদূর দেখা যাচ্ছিল এক মনে তাকিয়ে ছিল রিয়াদ। রাত দশটা,বাসার ছাদে বসে নিকোটিনের ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে রিয়াদ। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ফোনটা বেজে ওঠে রিয়াদের। অচেনা একটা নম্বর থেকে ফোন। ধরতে ইচ্ছে হচ্ছেনা ফোনটা। তবু বার বার ফোনটা বেজে চলছে। অবশেষে, ফোনটা ধরে রিয়াদ,,
ঃ হ্যালো, আপনি কি রিয়াদ ভাইয়া? আমি অরণ্য, আদ্রিতা আপুর কাজিন।
ঃ হ্যাঁ বলুন, কী বলবেন?
ঃ ভাইয়া, আপু সকাল সাড়ে নয়টাই অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।আপু রিক্সায় করে আসছিল আর পিছন থেকে একটা বাস ধাক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যায়।
আপু প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল মাথায়। ভাইয়া,She is no more. প্রচন্ড কাঁদছিল অরণ্য। হাসপাতালের নামটি বলেই ফোনটা কেটে দেয় অরণ্য। অনুভুতি গুলো সজাগ হওয়ার আগেই হাসপাতালে ছুটে যায় রিয়াদ। আদ্রিতার নিথর নীরব দেহটা পড়ে আছে ধবধবে সাদা বিছানার উপর। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে রিয়াদের।বুকের ভিতর যেন ভিসুবিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে ওর।আদ্রিতার নিথর দেহ থেকেও যেন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল রিয়াদ,, “শুনো, ঈশ্বর আমার কথা রেখেছে। তোমার হতে না পারলে কারো হতে চাইনি আমি,সেটাই হয়েছে। আমার বুকটা চিরে দেখো,এখানে শুধু তোমারই স্মৃতি”” সেটাই ছিল শেষ দেখা। চলে যাওয়ার সময় সবাই ভাল থাকতে বলে যায়। কিন্তু ভাল থাকার জন্য সে সত্ত্বার উপস্হিতি দরকার, সেই সত্ত্বাটাই নিরাশ করে যাবার বেলায় এই কথা বলে যায়। তারা হয়তো বুঝেও বুঝেনা যে, কি পেলে মানুষটা ভাল থাকতে পারে।
এই সেই আদ্রিতা যা জন্য নিজের মা-বাবার পছন্দের মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে শুধু ঠকিয়ে গেছে রিয়াদ। চোখদুটো বেঁয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে থাকে রিয়াদের। আজ মনটা নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,”তুমি ভাল থেকো আদ্রিতা” আজ তোমার রিয়াদ ভাল আছে অনেক ভাল আছে। মেঘবতি ওর জীবনে যে শরতের মেঘ নিয়ে এসেছে। রিয়াদের বুকের বিশাল নীলিমায় সেই সাদা মেঘ শুধু সৌন্দর্য্যই বিলিয়ে যাচ্ছে। এই মেঘবতীর মেঘের বৃষ্টিতে বৃষ্টিস্নান এখন রিয়াদের প্রতিদিনের প্রত্যাশা।
ঃকই গো, তোমার হয়েছে। তারাতারি আসো,খাবারতো ঠান্ডা হয়ে যাব।
ঃহুম, আসছি মেঘ—–