একটা পাগলি আমাকে ভালবেসেছিল

একটা পাগলি আমাকে ভালবেসেছিল

দশম শ্রেণীতে থাকতে এক পাগলির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলাম। আসলে সে পাগল ছিলনা। ছিল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তবুও এলাকার মানুষ মেয়েটিকে পাগলি ভাবত। তার সুন্দর একটি নাম আছে, “তাঞ্জিলা”। যদিও সে নামে তেমন কেউ ডাকতনা। আমি ডাকতাম, খুব দরদ দিয়েই ডাকতাম।

দুধে আলতা গায়ের রং। আমি বলবনা তার চুল শীতল পাটির মত বিস্তৃত। কিন্তু ঘন কালো ছিল সেই চুল। সবচেয়ে বেশী সুন্দর লাগত তাঞ্জিলার বাঁকা ঠোটের ভুবন ভুলানো হাসি। মনে হত এই হাসি দিয়ে মেয়েটি পৃথিবীকে জয় করে নিবে। খুব অল্পতেই হাসত। যেকোন কথাতেই হাসত। একবার মনে আছে, কাঁচা আম কাটতে গিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল কেটে গেল। তাঞ্জিলা তা দেখে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে চেপে ধরেছি। কিন্তু তার হাসি কিছুতেই থামছেনা। আমি কেটে যাওয়া আঙ্গুল চেপে ধরে তার হাসি দেখছিলাম। কত মায়া সে হাসিতে। যে কেউ হবে পাগল, মন চাইবে ভালবাসতে।

তাঞ্জিলার এক বছরের ছোট “তাহমিনা” অামাকে পছন্দ করত। সেটা তাহমিনার আচার আচরণে ফুটে উঠত। কিশোর বয়সের প্রেমটা মূলত ভাললাগাতেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশী। কিন্তু আমার মন বলত তাহমিনা আমাকে খুব করে চাইত। তাঞ্জিলা যখন আমার কাছাকাছি থাকত তখন তাহমিনা এসে তার বোনকে তাড়িয়ে দিত। তাঞ্জিলা আমার কাছাকাছি থাকার অবশ্য একটা কারন আছে। আমার স্কুল ফাঁকি দেয়ার অভ্যেস আছে। একদিন সকালে খুব করে বৃষ্টি পড়ছিল। কি যে ভাল লাগছিল তখন। আসলে বৃষ্টি না, এটা ভেবে ভাল লাগছিল যে আজ স্কুলে যেতে হবেনা।

কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি। স্কুলের যাবার সময় হতে অল্প বাকি। তখনই বৃষ্টি থেমে গিয়ে সূর্যি মামা আকাশে এক ঝিলিক রোদ নিয়ে হাজির হলেন। আর কি? মুখ ভার করে স্কুলে যাচ্ছি। পথেই জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ইচ্ছে করে পিছলা খেয়ে পড়েছি। কাঁদায় স্কুল ড্রেস মাখামাখি অবস্থা। বাড়িতে এসে বলেছি, আম্মু স্কুল ড্রেস ছাড়া স্কুলে যাওয়া যাবেনা। তাঞ্জিলা ছিল সেখানে। ছিল আমার দাদীও। আমার ভাবখানা দেখে দাদী বুঝে গেল গেল এখানে আমি জালিয়াতি করতেছি। দাদীই তখন বলল, “দেখরে নাতি, মন দিয়ে লেখাপড়া কর। নয়তো এই পাগলিকে কিন্তু তোর সাথে বিয়ে দেব।”

তখন তাঞ্জিলা এই কথা শুনে একটা হাসি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। দাদির দুষ্টু মাখা কথা, “দেখছিস তোর হবু বউ লজ্জা পাইছে” আমার ভিতরে তখন একটা আনন্দ কাজ করছিল। মনে হয় পাগলিটাকে আগেই আমার ভাল লাগত। ওর হাসিটা সত্যিই চোখে ভেসে থাকার মত। সেই ঘটনার পর থেকেই তাঞ্জিলা আমার খুব কাছাকাছি ঘুরঘুর করত। এলাকায় গুজবে ছড়াছড়ি। শ্রাবণ পাগোলনির(পাগলির) প্রেমে পড়ছে। দুজন দুজনকে না দেখে থাকতে পারেনা। তাই তাঞ্জিলা বারবার ছুটে আসে শ্রাবণের কাছে।

এই আবেগঘন কথাগুলো আমারনা। আমার সাথের যে শয়তানের নাটাইগুলো ঘুরে, সে বন্ধু নামের বজ্জাতগুলো সুর করে বলত। তাহমিনা আজ সাজগুজ করে হাজির আমাদের বাড়ির সামনে। যেখানে ছোট ছেলেমেয়েরা দাড়িয়াবান্দা খেলে। কোমড় অবধি গড়ে তোলা দেয়ালে বসে বড়ই খাচ্ছিলাম। ঐ প্রান্তে তাহমিনা দাড়িয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দিচ্ছিল। মনে মনে ভাবতেছি, তুই যাতো। গিয়ে তাঞ্জিলাকে পাঠিয়ে দে। যার এক জোড়া বাঁকা ঠোটের হাসির প্রেমে পড়েছি। ভালবেসেছি পাগলির সহজ সরল মনটাকে।

– তাঞ্জিলা আজ থেকে আবারো ঘরে বন্দী। আর আপনাকে বিরক্ত করবেনা।

তাহমিনার মুখে এমন কথা শুনে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ছোটবেলা থেকে তাঞ্জিলাকে ঘরে বন্দী করেই রাখে। তার পাগলামি যখন কমে যায় তখন তাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে আনে। আবার বেেড় গেলে ঘরে বন্দী রাখে। কি এমন পাগলামি করেছে সে? আমার আশেপাশে ঘুরত। মুচকি হাসত। হ্যাঁ, একটা পাগলামি অবশ্য করেছে। একদিন উঠোন ভর্তি মানুষের সামনে তাঞ্জিলা বলে উঠল, ” শ্রাবণ, ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা “কয়বার বলেছিল মনে নেই। তবে সেদিন পাগলির চোখে সত্যিই আমি ভালবাসা দেখেছিলাম। আর সে যে কি অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ছিল কথাগুলো বলে। উঠোনের মানুষ সেদিন এই পাগলি এই পাগলি বলে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বিষয়টা জানতেও পেরেছে এলাকার অনেকে। সেদিন থেকেই তাঞ্জিলা বন্দী।

নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। আমারই কারনে মুক্ত বিহনে উড়া পাখি আজ বন্দী খাঁচায় বন্দী থেকে ছটফট করে। এই সমাজ সংসার অনেক নিষ্পাপ কিছুকেও কখনো কখনো অপরাধী সাজায়। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাঞ্জিলাকে। কতদিন তার ভুবন ভুলানো হাসি দেখিনা।

দীর্ঘ দেড় বছর পর তাঞ্জিলা জেল থেকে মুক্তি পেল। সেদিন তার মুখে কোন হাসি ছিলনা। আচ্ছা, মানুষ বন্দী থাকলে কি তার মনটাও বন্দী থাকে? বন্দী থাকতে থাকতে মনে থাকা মানুষগুলো কি হারিয়ে যায়? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। তার একটা করুন চাহনী ছিল আমার দিকে। সেদিন তারা চলে যাচ্ছিল আমাদের এলাকা ছেড়ে। তার বাবার ট্রান্সফার হয়েছে বগুরায়। হয়তো শেষ দেখা দেখতে এসেছিল আমাকে। তার পিছনেই ছিল তাহমিনা। তার চোখেও বিষাদের ছাপ।

মনে হচ্ছে দুজন মানুষের মন নিয়ে খেলেছি আমি। আমি তাদের কাছে অপরাধী। দুই জোড়া চোখের চাহনি আমাকে খুব করে শাস্তি দিচ্ছিল। ভালবাসার কাঠগড়ায় দুটি মনের কাছে আমি অভিযুক্ত আসামী। সেদিন আমি নিশ্চুপ ছিলাম। অপরাধীরা চুপই থাকে। তাদের চলে যাওয়া দেখে দু’ফোটা অশ্রুজল নেমেছিল গাল বেঁয়ে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত