প্রিয় অপ্রিয়

প্রিয় অপ্রিয়

বিয়ে করেছি মাস দুয়েক হবে। এর মাঝে একবারও আমি বাবার বাড়ি যাইনি, আমার বর সিফাত একাই দুবার ঘুরে এসেছে সেখান থেকে। আসলে আমার ইচ্ছেই করেনি যেতে। যে মানুষগুলো আমার মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে, আমার চাওয়ার বিরুদ্ধে এখানে বিয়ে দিয়েছে তাদের সামনে থাকতে ইচ্ছে করেনি আমার। যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে খারাপ ছিলোনা। শুধু পড়াশোনাটা এখনো শেষ করতে পারেনি বলেই ওরা আমাকে জোর করে এখানে বিয়ে দিয়ে দিলো। বাবা নাকি সিফাতকে বলছে “বাবাজি, নীরাকে এবার তুমি সাথে করে নিয়ে আসবে অবশ্যই”, তাই স্বামীর মান রক্ষার্থে আমাকে যেতেই হচ্ছে। স্বামীবেচারা আমার অনেক ভালো মানুষ। আমিও চেষ্টা করি তার মন যুগিয়ে চলতে, সংসারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে, যদিও প্রথমদিকে অনেক কষ্ট হইছিল সবকিছু মেনে নিতে।

আলমারি খুলে যখন শাড়ি চয়েস করছি তখন মনে হলো, শুভ্রর দেয়া নীলশাড়িটাই পড়ে যাই যাতে বাড়ির লোকেরা সেটা দেখে জ্বলে; যাতে ওরা বুঝে যে শুভ্রকে আমি এখনো ভুলতে পারিনি। বিয়েতে রাজি হবার পর থেকে ওদের রাগ দেখলেই একটা পৈশাচিক ভালোলাগা কাজ করতো মনে। সিফাত জানেনা শাড়িটা কে দিয়েছে! শুধু জানে বিয়েতে আমি শাড়িটা গিফট পাইছি, কিন্তু আমি জানি পাগলটা কতকষ্ট করে টিউশনির টাকা কয়েকমাস বাঁচিয়ে সেটা কিনেছে। ছেলেটা এখন কেমন আছে কে জানে! বিয়ের পর থেকে আর কখনো যোগাযোগ করিনি ওর সাথে।
কেমন থাকে থাকুক- জানার দরকার নেই আমার! কারণ আমি আমার স্বামী-সংসারকে মেনে নিয়েছি।

ওর দেয়া হাতঘড়িটার সাথে প্রথম এংগেজমেন্টের আঙটিটাও হাতে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্বামীমহোদয়ের সাথে। দুই আঙ্গুলে দুজনের স্মৃতি সাথে নিয়ে বেরুচ্ছি, যদিও এখন একজনকে সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছি জীবন থেকে।
বাস থেকে নেমে যখন বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশাতে উঠি, তখনি দেখি শুভ্র বসে আছে ওর বাবার দোকানে। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড রাগ আর আক্ষেপে চোখদুটো আমার ওর মুখের উপর থেকে অন্যদিকে সরে যায়। আর ধীরেধীরে ওর সাথে শেষদেখা করার দিনটা ভেসে উঠে চোখের সামনে। সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম, “আমার বাসায় অনেক বুঝানোর পরেও তোমাকে ওরা মেনে নিচ্ছেনা। আমি ওদেরকে রাজি করাতে পারছিনা। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে ভাবতেও পারছিনা। চলো, দুজনে মিলে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই, যেখানে আরকেউ ঝামেলা করবেনা কখনো।”

কিন্তু ও আমার পালানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বলল, “পালিয়ে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি তোমার বাবার পছন্দ করা চাকুরে ছেলেকেই বিয়ে করো আর আমাকে ভুলে যাও। আশা করি, সুখে থাকবে।”
কথাগুলো শুনে আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খাই সেদিন। রাগে গাজ্বালা করতে শুরু করে আমার। তাই বাঁহাতে কষে একটা থাপ্পড় মেরে চলে আসি সাথসাথে। যাকে এতটা প্রিয় ভেবেছি, সে-ই দূরে সরিয়ে দিলো। প্রতারক একটা! রাগে-দুঃখে তাই আমি বিয়ের জন্য হ্যা বলে দিই। “এই, আমরা এসে গেছি। ঘুমিয়ে পড়ছিলে নাকি?”- হঠাৎ শরীরের মধ্যে সিফাতের ধাক্কা পেয়ে বাস্তবে ফিরে আসি। “কিছুটা!”- বলেই দ্রুত বাড়িতে ঢুকে যাই আমি।

অপরদিকে, নীরা যখন রিকশায় উঠছিলো, শুভ্র তখন ওর দিকে তাকিয়ে। নীরাকে দেখে মনে হচ্ছিলো ভালোই
আছে। নীল শাড়িতে যে ওকে অনেক সুন্দর মানিয়েছে তা শুভ্রর চোখে একটুও এড়ায়নি। কিন্তু নীরা খেয়াল করেনি যে শুভ্র ওকে দেখছে। নীরা যখন প্রচণ্ড বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, তখন শুভ্রর চোখটা চিকচিক করে উঠে। নীরা আজ ওর প্রতি বিরক্ত। শুভ্র তো এটাই চেয়েছিলো! তবু চোখ যেন তার বাধা মানেনা। যে মানুষটাকে শুভ্র এতটা ভালোবেসেছে, সে এখন অন্য একজনের সহধর্মিণী।

শুভ্র সেদিন অনেক কষ্টে চোখেরজল আটকিয়ে নীরার সামনে সুন্দরভাবে অভিনয় করেছে। নীরাকে না জানিয়ে সে নীরার বাবার সাথে দেখা করে নীরাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু অনেক বোঝানোর পরেও ওর বাবা রাজি হয়নি বরং বলেছে তাদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে নীরাকে ত্যাজ্য করবে, বাপ-মার কাছে নীরা আর কখনো আসতে পারবেনা। শুভ্র সবরকমের চেষ্টা চালিয়ে গেছে সেখানে। কিন্তু নীরার বাবা ওদের ভালোবাসা মেনে না নিয়ে হাতজোড় করে বলেছে, “আমার মেয়েটাকে তুমি ভুলে যাও বাবা। আমিই তোমার কাছে অনুরোধ করছি ওকে আমাদের থেকে আলাদা করোনা।”

শুভ্র আর নীরার কাছে ভালোবাসার দাবী রাখতে পারেনি, সে নীরার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। নীরাকে সে এতকিছু জানায়নি যাতে নীরা ওকে ভুল বুঝে দ্রুতই ভুলে যেতে পারে। আজকে নীরাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভালোই আছে। ভাল থাকবার জন্যই শুভ্র সম্পর্কে নীরার ভুল ধারণা থাকা উচিত, নইলে মেয়েটা অনেক কষ্ট পাবে। দুদিন আগে যখন বাড়ি আসে, একবারের জন্যও শুভ্রর মনে হয়নি নীরাকে সে দেখতে পাবে! কিন্তু কাকতালীয় ভাবে দেখাটা ওদের হয়েই গেল। কষ্টের মাঝেও নীরাকে দেখে ওর মনে একটু ভালোলাগার সঞ্চার হয়েছে এই ভেবে যে নীরার মন থেকে সে মুছে যায়নি এখনো! পরনের নীলশাড়ি, হাতঘড়ি আর ওদের এংগেজমেন্ট এর আঙটিটা অন্তত সেকথা-ই বলে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত