কয়েকবার কলিং বেল অনবরত বাজার পর ঘুম ঘুম চোখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে হাজির হলাম দরজার সামনে। এতরাতে দরজাটা খুলার পর আরো বিরক্ত হতে হল। ওপাশে কেউ নেই। বন্ধ করতে যাবো ঠিক তখনি চোখ নিচের দিকে থমকে যায়, দেখলাম একটি খাম পড়ে আছে। সাদা কালো দু’টি রং এর। হাতে নিয়ে দরজা বন্ধ করে চোখ কচলাতে কচলাতে শয়ন কক্ষের দিকে হাটা ধরেছি। খামটা ছিঁড়ে একটি চিরকুট পেলাম। ভিতরে আরেকটি নীল বর্ণের খাম চিরকুটের সাথে।
চিরকুটে লেখা ছিল, ” ভালবাসা চাও? তবে চলে আসো!” আর কিছুই পেলাম না। স্রেফ উপাশে একটা হাসির ইমুজি ছিল! ভিতরের নীল বর্ণের খামটি ছিঁড়তেই একটি ট্রেনের টিকিট পেলাম। বিমানবন্দর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত! এসি সিংগেল কেবিন। সকাল ৬ টায় সময় ট্রেন ছাড়ার। এখন রাত ২.৪৫ মিনিট। এত রাতে এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে কোন উত্তর পাইনি! চোখে আর ঘুম এলোনা, শুধু একরাশ কৌতুহল মনের কোনায়। কে, কে সে?
শুক্রবার, ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। এই একটি মাত্র দিনে নিজের ইচ্ছামত ঘুমাতে পারি। অথচ আজ কেবলই চিন্তা আর চিন্তা! ভোর ৫ টায় টিকেট টা মানিব্যাগ এ গুজে, প্রিয় ল্যাপটপ, সেল ফোন, আর পছন্দের লেখক উইলিয়াম সেক্সপিয়ার এর বিখ্যাত রোমান্টিক উপন্যাস “রোমিও জুলিয়েট।” ট্রেনে উঠতেই কেবিন টা খুজে বের করলাম, ভিতরে প্রবেশ করে একটু চমকে উঠলাম। আবারো একটি খাম। খুলে দেখি একটা চিরকুট। লেখা আছে, “এসেছো তাহলে।”
জানিনা কোথায় যাচ্ছি, কোন অজনায়! তবুও মন বলছে ফিরে এসো। কৌতুহল বলছে আমাকে শান্ত কর। আমি আছি দোটানার মধ্যে! ট্রেন ছাড়ল, কেবিনে শুয়ে খানিকক্ষণ ইন্টারনেট জগতে হানা দিলাম। ভালো লাগছিল না। তাই পড়তে শুরু করলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা, ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি সকাল ৮টা বাজে। আর ট্রেনটাও ষ্টেশনের নিকটে।
নামলাম। কিন্তু কোথায় যাবো? ঠিক নাই। এদিক সেদিক তাকিয়েও কাউকে পেলাম না। ভেবেছিলাম হয়তো রহস্যটার সমাপ্তি ঘটবে। কেউ এসে আমাকে স্বাগত জানাবে। নাহ তেমন কেউ আসলো না। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ছোট্র মেয়ে আমার টি-শার্টের নিচটা ধরে টানছে। দেখেই বুঝে গেছি মেয়ে টার বাস হয়তো ষ্টেশন এর আশেপাশেই।
আমার হাতে একটা চিঠির খাম গুঁজে দিয়ে, আ-আ-আ করে ইশারায় কিছু একটা বলল। ভাষা না বুঝলেও বুঝেছি, মেয়েটা কথা বলতে পারেনা। আর খামটা কেউ আমায় দিতে বলেছে বিধায় আমাকে দিতে এসেছে।
খামটা হাতে ধরিয়ে ইশারায় কিছু বলে চলে গেল, আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলনা। কিছু বলার চেষ্টাও করিনি। পৃথিবীর মানুষ গুলো কি অদ্ভুত। মানুষে মানুষে কত পার্থক্য। ছোট্র মেয়েটি কথা বলতে চেয়েও আ-আ-আ ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি। হয়তো কখনো বলতেও পারবেনা। কিন্তু আমি, আমি বলতে পারলেও, বলার ক্ষমতা থাকলেও কিছুই বলিনি!
খামটা খুলেই একটা চিরকুট পেলাম পূর্বের মতই। তবে এবার একটা ঠিকানা লেখা। কোন একটা সরকারী হাসপাতালের নাম, বিভাগ এবং সীট নাম্বার। আর কিছুনা। ভাবছি ভালবাসার জন্য হাসপাতালে যাবো! হাসপাতাল তো চিকিৎসা করার জন্য যায় সবাই, তবে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কেবল ভালবাসার জন্য। ঠিক ভালবাসা কিনা তাও জানিনা। শুধু অবুঝ মনের কৌতুহল বশত!
রেলষ্টেশন থেকে ৩০ মিনিট ধরে আধুনিক রিক্সায় চড়ে শহরের এদিক ওদিকের উঁচু দালানের গায়ে তাকাতে তাকাতে ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম। কেবিনের সামনে বসে এক অর্ধ বয়সী মহিলা কাদঁছে। কেন কাঁদছে কে জানে! হাসপাতালে তো সবাই অসুস্থ হয়েই আসে। হয়তো তারও কোন আপনজন অসুস্থ! তাছাড়া সরকারী হাসপাতালে প্রতি মুহূর্তে কত মানুষকে ডাক্তার সাহেবেরা যে মৃত ঘোষনা করেন তার হিসেব মৃতদেহের সার্টিফিকেট যেই রেজিস্টার মশাই দেন তিনিই হয়তো সব খাতাপত্রের হিসেব মিলিয়ে বলে দিতে পারবেন! কিজানি।
সেই জন্য উনাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে এড়িয়ে কেবিনে ঢুকে গেলাম। সিট নাম্বার মিলিয়ে গিয়ে দেখলাম সেই সীটে একটি ৬ কি ৭ বছরের ছোট্র মেয়ে শুয়ে আছে। চেহারা গোলগাল। বেশ মিষ্টি। কিন্তু আমি মোটেও এমন কিছু প্রত্যাসা করিনি। ভেবেছিলাম হয়তো অন্য কেউ হবে হয়তো!
আমি তখনো কিছু জানিনা, কে এই ছোট্র মেয়েটি? এভাবেই বা কেন বিছানায় অসুস্থতার বাণ করে শুয়ে আছে। চেহারা দেখে তো মনে ওর কোন অসুখ হয়নি! এত ফুটফুটে, মায়াবী চেহারা।
ঠিক তখনি পাশের সীটের অন্য মহিলাকে দেখতে থাকা একজন নার্স আমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো, “আপনি আয়েশার কি হন?” আমি খানিকটা ইতস্ততভাবে বললাম, “কেউ না।” নার্স এবার হাসি মুখে বলে উঠল, “আপনি আয়েশাকে রক্ত দিতে এসেছেন?”
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি আয়েশার মা বলে খুশিতে চিল্লাচিল্লি করা শুরু করল। আয়েশার মা, আয়েশার মা শব্দটা চারদিকের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানেই আবার ফিরে আসলো। আয়েশা সহ কেবিনে মোট ৫ জন রোগী ছিল। সবাই যেন নিজেদের বিছানা ছেড়ে আমার কাছে এসে আমাকে দেখতে লাগলো। তাদের সবার চোখেই অশ্রু টলমল করছিল। আয়েশার মা এসে কেঁদে কেঁদে বলছে, “কি হয়েছে আমার আয়েশার?”
আমি লক্ষ্য করলাম, উনিই মধ্যবয়সী সেই মহিলা। যে বাহিরে বসে বসে কাঁদছিল। ততক্ষণে আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাচ্চাটার রক্ত প্রয়োজন। আমাকে বাচ্চাটার পাশে দেখে সবাই ভাবছে আমি তাকে রক্ত দিতে এসেছি! কিন্তু আমি……
আমি কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নার্স আমাকে সেই সুযোগ দিল না। হাত ধরে টেনে রক্তের গ্রুপ টেস্ট এর কক্ষে নিয়ে গেলেন। রক্ত নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো “আপনার রক্তে এলার্জি বা কোন ভাইরাস নেই তো?” আমি কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই চুপ থেকে সময়টা পার করছিলাম। আর আমার চারিপাশের অবস্থা বুঝার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
৫ কি ৬ মিনিট পরেই নার্স এসে আমাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে শুয়ে যেতে বললেন। আমি যেন একটা রোবট হয়ে গিয়েছিলাম তখন। তাদের নির্দেশনা মত কাজ করছি। কোন অনিচ্ছা প্রকাশ ও করতে পারছিনা। নার্স আমার ডান হাতে একটা সুঁচ ঢুকিয়ে দিয়ে ১ ব্যাগ রক্ত নিয়ে নিল।
এর আগে কখনো রক্ত দেইনি। ভয় হয়। সুঁচ ঢুকিয়ে কিভাবে রক্ত নিয়ে নেয় অফফ। শুধু একবার মনে আছে রক্তের গ্রুপ পরিক্ষা করেছিলাম, ভার্সিটির ক্যাম্পাসে। যেই মেয়েটি আমার রক্তের গ্রুপ চেক করেছিল সে সম্ভবত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী। চেহারা বেশ।তার সুঁচ ঢুকানোর পদ্ধতি দেখে আমি এমন ভয় পেয়েছিলাম যে, এরপর ৭ দিন জ্বর ছিল আমার। মেয়েটা আমাকে বলেছিল, “আপনার রক্তের গ্রুপটা সচরাচর পাওয়া যায় না। সমগ্র এশিয়ায় কেবল ০৩% মানুষের এই রক্ত। তাই প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর আমরা এখানে ক্যাম করি। যারা সেচ্ছায় রক্ত দিতে চায়, আমরা তা সংগ্রহ করে যার প্রয়োজন তাকে দিয়ে আসি।” আমি কথাগুলো শুনে শুধুমাত্র একটি কথাই বলেছিলাম, “হুম।” আর কিছু বলিনাই। এরপর থেকে যেদিন ক্যাম্পাসে রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম চালাতো আমি সেদিন ক্যাম্পাসের আশেপাশে যেতাম না ভয়ে!
আজ আমি জানতাম না, আমার আর আয়েশার রক্তের গ্রুপ এক। হয়তো সেই কারণে কেউ আমাকে এখানে নিমন্ত্রণ করেছিল। তিনি হয়তো জানতেন আমি কেমন ভীতু ছিলাম, তাই চিরকুটে ভালবাসার নিমন্ত্রণ করেছিল!
এরপর রক্ত দিয়ে কিছুটা সময় বিশ্রাম করে উঠে পড়তেই আয়েশার মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা জুসের বোতল এগিয়ে দিল। এদিকে আয়েশার বাবাও আমার পাশে এসে দাড়ালো। তাদের দুঃসহ দুঃখের কথা শুনলাম অনেক্ষন ধরে।
খানিকটা এমন, আয়েশা তাদের একমাত্র সন্তান। গতবছর আয়েশায় ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর প্রতি ৩ মাস পর পর শরীরের সমস্ত রক্ত বদলাতে হয়। নয়তো আয়েশাকে বাচানো সম্ভব না। তাছাড়া যেকোন সময় আয়েশা মারা যেতে পারে। বছর খানিক ধরে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক থেকে খুঁজে খুঁজে রক্ত জোগাড় করতাম। কিন্তু এইবার কোথাও পাচ্ছিলাম না। আর আয়েশার রক্তের গ্রুপটা এমন যা সহজে পাওয়াই যায় না।
এরপর বেশিক্ষণ হাসপাতালে থাকিনাই। আয়েশার পাশে কিছুক্ষণ বসে চলে এসেছি। বাহিরে বের হয়ে বক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে এসে কিছুক্ষন বসে আছি। কিছুক্ষন পরে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ টা বের করার জন্য হাত দিয়েছি আর দেখি আবারো একটি খাম। এবারের খামটি দেখে আর কৌতুলহ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই খুললাম। খুলে একটি চিরকুট, ময়লা দু’টি ১০০ টাকার নোট এবং একটি ফিরতি টিকেট পেলাম। চিরকুটে লেখা ছিল, “SORRY! ভুল বুঝবেন না।”
এরপর জুমার নামাজ আদায় করে একটা ছোট্র রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে ১২০ টাকার খাবার খাই। এরপরে খুব জলদি রেলষ্টেশন এ গিয়ে দেখি ট্রেন টা দাড়িয়ে আছে। ট্রেনে উঠতে যাবো আর দেখি ঐ বাচ্চা মেয়টা একটা চেয়ারের পাশে নিচে বসে আছে। আমি কয়েকটা ডাক দিলাম। মনে হয়না শুনেছে। পরে বুঝতে পারলাম মেয়েটা কানেও শুনেনা। আমি কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওর হাতে ৮০ টাকা ধরিয়ে দিলাম। প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে কি মনে করে জানি নিল। এরপর আমার ব্যাগ থেকে ইউলিয়াম শেক্সপিয়ারের বই “রোমিও জুলিয়েট” এর প্রথম দিকের একটি সাদা পৃষ্টা ছিঁড়ে ছোট্র করে চিরকুটের মত বানালাম। চিরকুটে লিখলাম, “THANK YOU, কিন্তু ভালবাসা টা পাওনাই রয়ে গেলাম!” মেয়েটার হাতে দিয়ে ট্রেন ধরতে দৌড় দিলাম। জানিনা তার হাতে অাদৌ পৌঁছাবে কিনা!
এখন প্রতি ৩ মাস পর পর নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে ময়মনসিংহ গিয়ে আয়েশা কে রক্ত দিয়ে আসি। যেই ছেলেটা আগে রক্ত দেওয়ার কথা শুনলে ভয়ে পা বাড়াতো না, সে ছেলেটাই এখন রক্ত না দিয়ে থাকতে পারেনা। কিন্তু সেই চিরকুট আর আসেনি। আমি অবশ্য অপেক্ষা করতাম। হয়তো কোন একদিন আসবে একটি চিরকুট, যেখানে লেখা থাকবে, “I LOVE YOU.!” কিংবা সেই একদিন এসে বলবে “আমি চিরকুট ওয়ালি, তোমার কাছে এসেছি। ফিরিয়ে দিও না!” কিন্তু চিরকুট ও আসেনা, চিরকুট ওয়ালি ও আসেনা।
এভাবে পায় তিন বছর কেটে যায়। আমিও রক্ত নিয়মিত দিয়ে আসছি। ততদিনে আমি ভার্সিটি লাইফ শেষ করে সদ্য একটা কাজে যোগ দিয়েছি। একটা বিশাল ফ্লাট পেয়েছি। গাড়ি ও অফিস থেকেই পেয়েছি। কিন্তু নারী এখনো কলালে মিলেনি। হয়তো অপেক্ষা একদিন অফিস থেকে ফিরেছি। খুব ক্লান্ত শরীরে সোফায় এলান দিয়ে ঝিমুচ্ছি আমি। হঠাৎ অনবরত কলিংবেলে আমি বিচলিত। দরজা খুলতেই কেউ নাই। এপাশে ওপাশে কাউকেও দেখলাম না। দরজাটা রাগান্বিত হয়ে বন্ধ করে দিলাম। আবার সোফায় গা এলিয়ে ঝিমাচ্ছি। আর আপন মনে বিড়বিড় করছি, “হয়তো পাশের ফ্লাটের বাচ্চাটা।”
হঠাৎ কি মনে হতেই লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে দৌড়িয়ে দরজা খুলে নিচে তাকালাম। হ্যাঁ, এসেছে। খাম এসেছে। আমার চিরকুট ওয়ালি এসেছিল। খামটা হাতে ধরে এক দৌড়ে লিফটের দরজায় গেলাম। কিন্তু লিফট নিচের ফ্লোরে। উপায় না পেয়ে সিঁড়িতে সর্বোচ্চ গতিতে লাফিয়ে ৬ তলা থেকে নিচে আসলাম। কাউকেই পেলান না। মনে হয় দেড়ি করে ফেলেছি। শরীরটা অবশ হয়ে আসছে! নিজের উপর নিজের ক্ষোভটা বেড়ে যাচ্ছে! হয়তো তখন সাথে সাথে নিচে আসলে তাকে পেয়ে জেতাম! ওখানে দাড়িয়েই খামটা ছিঁড়ে এবার চারটি চিরকুট পেলাম। চারটি আলাদা আলাদা রং এর। লাল, নীল, সবুজ এবং কালো।
কালো চিরকুটটা পড়তে শুরু করলাম, “তোমাকে যে মায়ার বেঁধেছিলাম, আজ সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সে মায়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আয়েশা এখন থেকে আমার কাছে থাকবে। আয়েশার আর কোনদিন রক্তের প্রয়োজন হবে না।” ফোনটা পকেট থেকে বের করে আয়েশার বাবাকে কল দিলাম, আয়েশার বাবা কান্না জড়িত কন্ঠে জানালো “মাত্র ৩০ মিনিট আগে আয়েশা মারা গেছে!” ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল।
তাড়াহুড়ো করে সবুজ চিরকুট টি পড়তে শুরু করলাম..”প্রিয়, যেদিন তোমার রক্তের গ্রুপ তোমাদের ক্যাম্পাসে আমি পরিক্ষা করেছিলাম, সেদিনই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তুমি জানতেনা তোমার রক্তের গ্রুপ আমার রক্তের গ্রুপ এক ছিল। এরপর যতবার তোমাদের ক্যাম্পাসে গিয়েছি, শুধুই তোমাকে খুজেছি। কিন্তু পাইনি!” নীল চিরকুট চোখের সামনে মেলে ধরলাম, “প্রিয়, তুমি জানো? তোমাকে কত ভালবেসে ছিলাম! আমি প্রায়শই তোমাদের ক্যাম্পাসে জেতাম। তোমাকে দেখতাম। তোমার জন্য একটা নীল পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। দেওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি!”
শেষ লাল চিরকুটটি চোখ মুছতে মুছতে সামনে খুলে পড়তে শুরু করলাম, “প্রিয়, তোমাকে নীল পাঞ্জাবি টা দিবো বলে মনে অনেক সাহস সঞ্চার করে তোমাদের ক্যাম্পাসে আসছিলাম। জানো রিক্সা থেকে আমি তোমাকে দেখে রিক্সা সাইড করে দাড়াতে বললাম। কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে একটা লাল প্রাইভেট কার আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। তুমি আমায় দেখলে, কিন্তু কাছে আসোনি। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। নীল পাঞ্জাবিটা আমার রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল! তোমাকে শুধুই দেখলাম, না দেখার বাণ করে চলে গেলে!”
আমার ভিতরটার তখন সব উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এরপর চিরকুটটির অপর পৃষ্টা পড়তে শুরু করলাম,
“এরপর আমার চোখটা বন্ধ হয়ে যায়। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার বাবা মা সামনে কাঁদছে। ডাক্তার বলেছে, শরীরের সব কিছু ঠিক আছে, পায়ের একটা হাড় ভেঙেছে। ১ মাসে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। তাই রক্ত লাগবে। বাবা অনেক খুঁজাখুঁজি করেও পায়নি। আমি বাবাকে তোমার ঠিকানা দিলাম। বাবা গিয়ে তোমার হাত পা ধরলো। তুমি আসলে না! বাবাকে তুমি মিথ্যে বলেছিলে। তুমি বলেছিলে তুমি আসবে, রক্ত দিবে। কিন্তু আসোনি! এরপর আমি ১৫ দিন ছিলাম। তারপর হারিয়ে গেলাম অজানায়।”
আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম। জীবনের কাছে হেরে আজ পরাজিত আমি। আমি যদি সেই দিন যেতাম হয়তো সে বেঁচে থাকতো! আমি খুনি! নিজেকে ধিক্কার জানাতে থাকলাম! চিরকুট ওয়ালির খোঁজ করে একবার ওর কবরের পাশে গিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। ক্ষমাও চেয়েছিলাম। জানিনা আমি ক্ষমার যোগ্য কিনা ! এখন আমি নিয়মিত রক্ত দিচ্ছি। আমার আশেপাশের মানুষদেরও রক্ত দেওয়ার জন্য উৎসা দিয়ে থাকি! চিরকুট ওয়ালি কে তো আর পাবো না, কিন্তু বিনা রক্তে কাউকে হারাতেও দিবোনা।