আকাশের সাথে আমার বিয়ে পারিবারিক ভাবেই হয়! তখন সদ্য অনার্স পাশ করে পড়ালেখার বন্দি জীবন থেকে মুক্তি লাভ করেছি! কিন্তু মুক্ত থাকতে পারি নি বেশি দিন! ‘বিয়ে ‘ নামক এক চিরস্থায়ী বন্ধনে আবার বন্দি হতে হলো কিছু দিনের ভিতরেই! আমি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে! সুতরাং বিয়ের আগ পর্যন্ত কোনো ছেলের সাথে প্রেম – ভালোবাসায় জড়াই নি! জড়ানোর ইচ্ছে আমার ছিলো না! বিয়ে নিয়ে প্রতিটা ছেলে মেয়ের ই অনেক স্বপ্ন থাকে! কিন্তু তার চাইতেও বেশি থাকে ভয়, সংশয়! নতুন মানুষটি কেমন হবে? তার সাথে কি মানিয়ে চলতে পারবো? সে কি আমাকে বুঝবে? আমাকে অবহেলা করবে না তো?
এই রকম হাজার টা চিন্তা, ভয় আর সংশয় থাকে! কিন্তু ছেলেদের চাইতে মেয়েদের সেই চিন্তাটা আরো বেশি থাকে! অচেনা পরিবেশে একটা অপরিচিত মানুষের সাথে জীবন যাপন করতে হবে! কেমন হবে সেই মানুষটি? অন্য সবার মতো আমিও এসব নিয়ে বিয়ের আগে ভাবতাম! কিন্তু বিয়ের রাতেই আমার সব সংশয় দূর হয়! যেহেতু পারিবারিক ভাবেই বিয়ে সেহেতু বিয়ের আগে শুধু আকাশের একটা ফটো আমাকে দেওয়া হয়েছিলো! মা-বাবার পছন্দ করা পাত্র! ফটো হাতে নিয়ে আমার রুমের দরজা বন্দ করে আকাশের ফটোর দিকে তাকিয়ে অনেক ভাবলাম! দেখতে তো বেশ স্মার্ট! কিন্তু আচার – ব্যবহার, চরিত্র কেমন হবে কে জানে? বিয়েতে আমি মত দিলাম! মত না দেওয়ার কোনো কারন ছিলো না! দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো! আরো কিছু দিন পর পূর্বনির্ধারিত বিয়ের দিন এলো! আমাদের পরিবারের প্রথামত ঝাঁক ঝমক ছাড়াই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো!
বর- কনে কে যখন একসাথে বসানো হয় তখন আড় চোখে একবার দেখেছিলাম আকাশের চেহারা! মাথা নিচু করে বসে থাকায় ভালো করে দেখতেও পারি নি! তারপর আকাশের বাসায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়! মেয়েলি অনেক গুলি আচার অনুষ্ঠানের পর রাতে ফুল দিয়ে সাজানো একটা রুমে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়! রুমে পা দিয়েই বুঝলাম এটাই আমার বাসরঘর! আমি রুমে বসে আছি! অনেক গুলি মেয়ে আমার চারপাশে বসে গল্প করছে! হাসছে, ঠাট্টা করছে! আমি তো আর কথা বলতে পারবো না! তাই চুপ! এক সময় পুরো বাসা নিরব হয়ে এলো! ননদেরা রুম থেকে চলে গেলো! আমি বুঝলাম এবার আকাশ আসবে! কিছুক্ষন পর ই আকাশ প্রবেশ করলো! আমি পা ছুঁয়ে সালাম করলাম! তারপর আকাশ পালঙ্কে গিয়ে বসলো! আমাকেও বসতে বললো! আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো– শোনো মেঘলা, আমার কোনো মেয়ে বন্ধু কখনো ছিলো না! আপনি কি আমার বন্ধু হবেন?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! একটা মানুষ এতো সহজ ভাবে কিভাবে কথা বলতে পারে? আর বাসর রাতে যেখানে বউ এর উপর অধিকার খাটায় সেখানে অনুরোধ? তাও বন্ধুত্বের? এই কথা গুলি শুনে একটা ভালো লাগা কাজ করলো! আর বর যখন কোনো বউ এর কাছে বন্ধত্বের প্রস্তাব দেত তখন দুনিয়ার কোনো মেয়েই সেই প্রস্তাব এড়াতে পারে না! আমিও পারলাম না! আমি বললাম– কেনো নয়? আর আমি যেহেতু আপনার স্ত্রী সেহেতু আপনি না বলে তুমি বললেই খুশি হবো!
আকাশ হাসলো! তারপর বললো– তাই নাকি? তবে যে আমাকেও তুমি করে বলতে হবে! আমি বললাম তাই হবে! তারপর দুজনে অনেক গল্প করলাম! জীবনের গল্প, নিজেদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা সব! আকাশ খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে! আমি আকাশের সাথে আজ ই প্রথম কথা বলছি! কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা কত কাল ধরে পরিচিত! গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো! তারপর একসময় আকাশ বললো– অনেক রাত হয়েছে! আর তুমি অনেক ক্লান্ত! ঘুমিয়ে পড়ো! আর আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পালঙ্কে উঠে বালিশ নিয়ে আমার বিপরীত দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়লো! আমিও শুয়ে পড়লাম! আর নিজেকে এতো সুখী মনে হলো যে চোখ দিয়ে দু ফুটা জল গড়িয়ে পড়লো!
কারন — আমি একজন স্বামী নয়, বন্ধু পেয়েছি! যে আমার উপর অধিকার না খাটিয়ে বন্ধত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে! এবং বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে! এসব নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবে ভেবেই কেটে গেলো! ঘুমে দু চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো! গতরাতেও কিন্তু ঘুমাতে পারি নি! কিন্ত রুমে তখনো লাইট জ্বলছে! ঘুমানোর সময় আলো সহ্য হয় না! তাই লাইট বন্ধ করতে উঠলাম! শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়েই চোখ পড়লো আকাশের দিকে!
আমার বিপরীত দিকে মুখ করে আমার থেকে এক হাত দূরে শুয়ে আছে! ফর্শা চেহারা! লম্বা খাড়া নাক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি! লম্বা পাঁচ ফিট ছয় সাত ইঞ্চি হবে! এক কথায় সুদর্শন! মনের অজান্তেই আমার মুখে একটা হাসির ঝলক।খেলে গেলো! হ্যা– আমি এমন টাই ত চেয়েছিলাম! লাইট বন্দ করে জিরো ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম! ঘুম ভাঙ্গলো! মনে হচ্ছে ভুমিকম্প হচ্ছে ! কিন্তু না! চোখ খুলে দেখলাম– আকাশ ঝুকে আমার মাথার নিচের বালিশ ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে– মেঘলা , এই মেঘলা, আরে উঠো না? আবার ও একটা ভালো লাগা কাজ করলো! যাক গায়ে হাত দেয় নি! বালিশ ধরে ঝাঁকাচ্ছে! যদিও আমার গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার ১০০ % আছে!
আমি ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে বললাম– কি? এখনো তো ই সকাল হয় নি? আকাশ বললো– আরে, ফজরের আজান হয়ে গেছে! নামায পড়বে না? বাহ- আকাশ শুধু বেশ ভদ্র ই নয়! নামাযী ও! তারপর উঠে অজু করে নামাজ পড়লাম! ঘুমে দু চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো! আমি আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম! আবার ঘুম ভাঙ্গলো আকাশের ডাকে! উঠে দেখি আকাশ মিটি মিটি হাসছে! তারপর বললো– সু প্রভাত! আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আট টা বেজে গেছে! নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো! উঠেই ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখি আকাশ বসে আছে! আমাকে বললো– মা ডাকছেন, চলো নাস্তা করবে!
আমি আর আকাশ একসাথেই ডাইনিং রুমে গেলাম! গিয়ে দেখি শ্বাশুড়ি আম্মা নাস্তা সাজিয়ে বসে আছেন! আর শ্বশুর আব্বা সোফায় বসে পেপার পড়ছেন! আমাকে দেখেই বললেন– এসো মা! আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম! এক সাথে সবাই নাস্তা করলাম! আর এই তিন জন মানুষের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম! শুনেছি– বিয়ের পর দিন নব বধুরাই চা তৈরি করে, নাস্তা বানায়! কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি নিজেই এসব করে আমার অপেক্ষা করছেন! নাস্তা শেষে আমার শ্বাশুড়ি বললেন–এসো মা,তুমি ত এ বাসাতে নতুন! তাই চলো– সব গুলি রুম দেখিয়ে আনি! আমার হাত ধরে সারা বাসা ঘুরে দেখালেন! এবং নিজের সম্পর্কে বললেন! ছয় রুমের একটা সুন্দর গোছানো বাসা! আমার শ্বশুর রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা!
পেনশনের টাকায় এখানে জমি কিনে বাসা বানিয়েছেন! জায়গাটা একেবারে শহরের মধ্যে নয়! আবার শহরের বাইরেও নয়! তারপর রান্না ঘরে নিয়ে গেলেন! সব কিছু সাজানো গুছানো! আমার শ্বাশুড়ি পাক্কা গৃহিণী! সব দেখে আমি খুব খুশি হলাম! যেমন টা আমি চেয়েছি সব কিছু তেমন ই! দুপুরে বাবা এলেন! আমার শ্বশুর এর সাথে অনেক গল্প করলেন! তারপর বিকেলে চলে গেলেন! এভাবেই আমার বিবাহিত নব জীবন শুরু হলো! আমার শ্বাশুড়ি আমাকে আমার মায়ের চাইতেও বোধ হয় স্নেহ করেন! আমি দেরীতে উঠার জন্যে প্রায়ই আম্মুর বকা খেতাম! কিন্তু ছেলের বউ হওয়া সত্বেও আমাকে কখনো দেরীতে উঠার জন্যে কিছু বলেন নি!
উনি খুব সহৃদয়া! সব কিছু বুঝেন! আমার কখনো মনে হয় নি যে উনি আমার মা নন শ্বাশুড়ি! আর আমার শ্বশুর আব্বাও আমার বাবার মতো রিটায়ার্ড করলেও কাজে ব্যস্ত থাকেন সব সময়! নিয়ম মাফিক জীবন যাপন করেন! সকালে উঠে পত্রিকা পড়েন! হাটতে বের হন! লেখালেখি করেন! একটা এনজিও তে সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন! আর আকাশ? আমি জীবনে কোন পূণ্য করেছিলাম জানি না! কারন একজন ভালো বন্ধু ও আদর্শ স্বামী পেয়েছি! আকাশ একটা জব করে! মোটামুটি ভালো বেতন পায়! সব সময় হাসি মুখে থাকে! কখনো মন খারাপ করতে দেখিনি! ফজরের ওয়াক্তে জেগে উঠে আমাকেও ডেকে তুলে! তারপর ফ্রেশ হয়ে এক সাথেই নামাজ পড়ি!
আমি কিন্তু ঘুম পাগলী! নামাজ পড়েই ঘুমে দু চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়! আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি! আকাশ পার্কে হাটতে বের হয়! তাদপর ফিরে আসে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে! পার্কে ফুল গাছের অভাব নেই! শরতের সাত সকালে আকাশ যখন শিশির ভেজা শিউলি ফুল হাতে নিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আর হাসি মুখে বলে সু প্রভাত! তখন মনে হয়– এই ফুল হাতে দাঁড়ানো হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে হাজার জনম কাটিয়ে দেওয়া যাবে! তারপর এক সাথেই সবাই নাস্তা করি!
সবচেয়ে মজার কথা হলো- আমি, আকাশ, আমার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি সবাই রান্না করতে পারি! কিন্তু ঘুম পাগলি বিধায় সকালের রান্না করতে পারি না! শ্বাশুড়ি ই সকালের রান্না করেন! আমি অনেক মানুষ দেখেছি! কিন্তু আকাশের মতো কাউকে দেখিনি! নিজের কাজ নিজেই করে! কখনো অন্যের সাহায্য নিতে চায় না! এই একটা ব্যাপারে আমার হিংসে হয়! আমি চাই আকাশ তাঁর কিছু কাজের ভাগ আমাকেও দিক! কিন্তু আকাশ কখনো নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে চায় না! আবার খুব ভালোও লাগে! নিজেই নিজের সব কিছু গুছিয়ে নেয়! সকালে আকাশ অফিসে চলে যায়! শ্বশুর আব্বা চলে যান এনজিও তে! আমি আর শাশুড়ি আম্মা বাসায় থাকি! কাজ খুব একটা করতে হয় না!
আমার সারা দিন কাটে বই পড়ে, ঘুমিয়ে, ডাইরি লিখে, ছবি একে! আর শাশুড়ি আম্মা আমার সাথে গল্প করেন! কখনো বা বেড়াতে যান উনার বান্ধবী আর আত্মীয় দের বাসায়! এভাবেই আমার দিন কাটে! একটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি! আকাশ বই পাগল! ওর নিজস্ব একটা লাইব্রেরি আছে! যার বর্তমান মালিক আমি! আকাশ যখন অফিস থেকে ফিরে আসে খেয়ে দেয়ে রুমে এসে বসে তখন আমি আজকের পড়া গল্পের কাহিনী শুনাই! আসলে মানুষ যখন কোনো কিছুতে সুখ পায় তখন অন্য কাউকে না জানালে শান্তি পায় না! আমিও তাই! যত গুলি গল্প পড়ি সব গুলি আকাশ কে শুনাই! আকাশ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে! আর অবাক হওয়ার ভান করে! আমি পুরু গল্প বলে যখন বলি তুমি পড়ে দেখবা? আকাশ হেসে হেসে বলে পড়বো! আমি বলি এনে দেই বইটা? বলে দাও!
সেই বইটা যখন এনে দেই আকাশ তখন আরো অবাক হয়ে বলে এই বই? ও, এটা ত আমি পড়ে ফেলেছি! আর তখন ই আমার মনে পড়ে যে এটা আকাশের লাইব্রেরি! আর আমি যাতে বিরক্ত না হই সে জন্যেই মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনে! মিষ্টি খুনসুটি, আর বই নিয়ে কৃত্রিম ঝগড়া ও হয় মাঝে মাঝে! আমি যখন রেগে যাই তখন আকাশ রণে ভঙ্গ দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে! কে যেনো বলেছো– রাগলে মেয়েদের আরো সুন্দর দেখায়! আকাশ বোধ হয় তাই দেখে! আরো মজার কথা হলো– আমি আমার বান্ধবী দের কাছ থেকে বিখ্যাত বই এর নাম জেনে নিয়ে আকাশকে বলতাম অফিস থেকে ফিরে আসার সময় এই বই টা নিয়ে এসো! আকাশ সেই বই কিনে আনতো! আমি ভাবতাম এ বই নিশ্চই আকাশ পড়ে নি!
আমি যখন আকাশে কে জিজ্ঞেস করি — আচ্ছা, এই বই ও তুমি পড়েছো?
আকাশ হেসে বলে– হ্যা, এসব বই ত অনেক আগেই পড়ে ফেলেছি! না, আকাশ এর সাথে আর পারা যাবে না! কত গুলো বই পড়েছে কে জানে? এবার নতুন পদ্ধতি বের করলাম! আমি কবিতা ভীষন ভালোবাসি! আবৃতি ও করতে পারি!
একদিন আকাশ কে বললাম– কবিতা শুনবে?
আকাশ বললো– কেনো নয়? তবে শুনাবে টা কে?
আমি আর কিছু না বলে– ‘অনামিকা ‘ কবিতা টা আবৃত্তি করলাম! আবৃতি শেষ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে!
আমি বললাম– কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
আকাশ অনুযোগের সুরে বললো– তুমি এতো ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে জানো! এতো দিন এসব থেকে বঞ্চিত হলাম কেনো?
আমি বললাম– তুমি শুনতে চাইলে তবে ত শোনবে?
আকাশ বলল– আর তোমার মধুর কণ্ঠের আবৃত্তি শুনা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না! রোজ একটা কবিতা শুনাবে! বিনিময়ে একটা হৃদয় উজাড় করা সব টুকু ভালোবাসা পাবে!
আমি বললান– যদি কবিতা না শুনাই তবে কি ভালোবাসা পাবো না?
আকাশ বললো– পাগলি একটা! সব সময় ই পাবে!
আমার জীবনটা আকাশের মতোই বিশাল এক সুখের সাগরে অতিবাহিত হচ্ছিলো! আমার কোনো শখ কখনো অপূর্ন রাখে নি আকাশ! ঋতুভিত্তিক ফুল, মিষ্টি হাসি, অফিস থেকে ফেরার পথে কোনো গল্প বা কবিতার বই বা ছোটখাটো গিফট আমার ডেইলি রুটিনের অংশ হয়ে গিয়েছিলো! সেই সাথে শ্বশুর শাশুড়ির অকৃত্রিম স্নেহ ত রয়েছেই! একদিন মনে হলো আচ্ছা– আমি রোজ এ কবিতা শুনাই! আকাশ এর কাছ থেকে কি কিছুই শুনবো না?
তাই একদিন আকাশ কে বললাম– আকাশ, আমায় তুমি কিছু শোনাবে না?
আকাশ বললো– কি শোনাবো?
আমি বললাম– এই যেমন ধরো কবিতা?
আকাশ বলল — না, তোমায় গান শোনাবো!
আমি বললাম– কি শুনাবে?
বলল– তোমায় গান শোনাবো! আমি একটা জিনিস লক্ষ করলাম’ তোমায় গান শোনাবো ‘ এই কথাটি একটু গানের কলির মতো বলে!
আমি বললাম– এখন ই শোনাও!
আকাশ বললো- না, পরে শোনাবো!
অনেক জোর করেও গান শুনাতে রাজি করাতে পারি নি! সারাদিন ভাবলাম! আকাশকে ত কখনো গান গাইতে শুনিনি! অবশ্য গোছল করার সময় গুন গুন করতে শুনেছি! অবশ্য এটা কবিতাও হতে পারে!
তারপর ও আমাকে প্রায়ই সময় গানের মতো করে বলতো – তোমায় গান শোনাবো! কি সেই গান? কোন সে সুর? নাকি অন্য কিছু? হয়ত কোন এক দিন কানে কানে গানের মতো করে বলবে– তোমায় ভালোবাসি ঘুম পাগলি! ভীষন ভালোবাসি! প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম– সেই গান যেনো আমায় শোনায়! আজ অফিস ঘুমোবার আগে বললাম– শোনো আকাশ, আজ তোমার সেই গান আমাকে শোনাতে হবেই! আজ আর কোনো বাহানা মানবো না!
আকাশ বললো– বললো না, আরেক দিন! আমি বললাম– না, আজ শোনাতে হবেই! আকাশ– কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো — আরে মেগলা, জেদ করো না! কোনো এক মেঘলা দিনে যখন পুরো শহর বৃষ্টিতে ভিজবে , সব পাখিরা ভিজে জবুথবু হয়ে যাবে, জানালার কাছের আতা গাছের সবুজ পাতা বেয়ে যখন পানি টপাটপ পড়বে সেদিন তোমায় গান শোনাবো! আমি একরাশ অভিমান নিয়ে বললাম– শোনতে চাই না তোমার গান! আকাশ মিষ্টি হেসে বললো– মেঘলা দিনে রুমান্টিক পরিবেশে আমার ঘুম পাগলী লক্ষ্মী বউ মেঘলা কে গান শোনাবো! আমি বললাম– সেই দিন আসুক! তখন তোমায় গান শোনবো! না, সেই গান আমার শোনা আর হয় নি! মানুষ যখন প্রত্যাশার খুব বেশি কিছু পেয়ে যায় তখন তাকে কিছু হারাতে হয়!
খুব মূল্যবান কিছু হারাতে হয়! কিন্তু আমার কাছ থেকে আমার পৃথিবী ই যেনো হারিয়ে গেলো! সেদিন বিকেলে ঘুমিয়ে ছিলাম! ঘুম ভাঙ্গলো মোবাইল এর রিংটোন এর শব্দে! আমার বাবা ফোন দিয়েছেন! কল রিসিভ করতেই বললেন — মা আসিফ( আমার বড় ভাই) তোর বাসায় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে! তুই এখানে আয় তো একবার! তোর শাশুড়িকেও সাথে করে নিয়ে আসিস! তোর শ্বশুর এখানেই আছেন! আমি ভাবলাম– আমাদের বাসায় বোধ হয় কোনো ফাংশন আছে! তাই যেতে বলেছেন! আমি ফ্রেশ হয়ে আম্মাকে গিয়ে বললাম– আসিফ ভাই গাড়ি নিয়ে আসতেছেন! বাবা আমাদের যেতে বলেছেন আসিফ ভাই এর সাথে!
আসিফ ভাই আসলেন! আমি শাশুড়ি আম্মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম! আসিফ ভাই মেডিকেল এর দিকে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন! আমি বললাম– ভাইয়া, মেডিকেলে কেনো নিয়ে আসছো? কারো কি কিছু হয়েছে? ভাইয়া বললেন— গেলেই দেখতে পাবি! আমার শরীরের সব রক্ত যেনো ছলকে উঠলো! কার কি হয়েছে?মেডিকেল এ ঢুকেই ভাইয়া শক্ত করে আমার হাত ধরে একটা রুমে নিয়ে গেলেন! সেখানে দেখি– আমার বাবা, শ্বশুর আব্বক, আমার মা , সহ সব সেখানে রয়েছেন! কাঁদছেন সবাই! আর সাদা কাপড় দিয়ে মেডিকেল এর সিটে কাকে যেনো ঢেকে রাখা হয়েছে! বাবা গিয়ে মুখের কাপড় টা সরালেন! যা দেখলাম তাতে মনে হলো আমার মাথা শূন্য হয়ে গিয়েছে! আর কিছু বলতে পারি না!
আবার যখন চোখ খোললাম দেখলাম আমার চারপাশে অনেক মানুষ! না, আর জ্ঞান হারাই নি! উঠে দাঁড়ালাম! আমাকে হাতে ধরে উঠোনে নেওয়া হলো! সারা বাসা মানুষে ভর্তি! পুরুষদের মাথায় টুপি রয়েছে! বাসার সামনেই করার এর উপর সাদা কাপড়ের নিচে আকাশ শুয়ে রয়েছে! আমাকে শেষ বার দেখানোর জন্যে মুখের কাপড় সরানো হলো! একবার শুধু চেয়ে দেখলাম! তারপর মনে হলো– পা আমার ভর সইছে না! এর পরে আর কিছু বলতে পারি না! যখন দ্বিতীয় বার জ্ঞান ফিরলো বুঝতে পারলাম মেডিকেল আছি!সুস্থ হয়ে বাসায় আসলাম! এসেই পুরো ঘটনা শুনতে চাইলাম!
যা শুনলাম– আজ তাড়াতাড়িই অফিস থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছিলো! বৃষ্টি হচ্ছে! হঠাৎ ই একটা মালবাহি ট্রাক ব্রেক ফেইল করে আকাশের ছোট কার টাকে চাপা দেয়! সিটবেল্ট বাধা ছিলো! তাই গাড়ির সাথে আকাশ ও চাপা পড়ে! মেডিকেল এ নিয়ে আসা হয়! কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে আকাশ কে আর বাচানো যায় নি! সেদিন কেনো আকাশ তাড়াতাড়ি বৃষ্টির মধ্যেই ফিরছিলো তার কারন আমি ছাড়া আর কোনো মানুষ জানে না! আকাশ চুপি চুপি বলতো তোমায় গান শোনাবো! সেই গান শোনানোর কথা কেউ জানে না! আমার আর গান শোনা হলো না! আজ বুঝি সেটা কোনো গান ছিলো না!
স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিলো! কিন্তু আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি! সেদিন থেকে– যেদিন টের পেলাম আমার ভিতর আমার ছোট্র সোনা নড়াচড়া করছে! আজ আবার আকাশের বলা কথা গুলি মনে পড়তে লাগলো একে একে! মনে হলো– আকাশ চুপি চুপি বলছে-; তোমায় গান শোনাবো! আমিও দিবা স্বপ্ন দেখতে লাগলাম–আমার ছোট্র বাবুটা ঘুমিয়ে আছে! আর আমি সোনামণির পিঠে হাত রেখে ঘুম পাড়ানি গান শুনাচ্ছি! আর আকাশ চুপি চুপি বলছে- তোমায় গান শোনাবো”।