অফিস থেকে ফেরার পথেই একজন মহিলা সামনে এসে বলতে লাগলো ভাইসাব শুধু তিনশো টাকা দিলেই হবে,আমি সারাটা রাত আপনার সাথে কাটাবো।আজকে একটাও কাস্টমার পাইনি। তাই এই বাচ্চাটাকেও কিছু খাওয়াতে পারিনি।আমার বাচ্চাটা আজকে কিছু খায়নি,দয়া করুন ভাইসাব।
আমি কিছু বলছি না দেখে মেয়েটি আবার বলতে লাগলো আচ্ছা দুইশ টাকা দিন।আমি অপলক চেয়ে রইলাম মহিলাটির দিকে,,,না মহিলা নয় একটা মেয়ে,হুম ঊনিশ কি বিশ বছরের একটা মেয়ে।তারপর তাকে তিনশত টাকা দিয়ে চললাম আমি তার পিছু পিছু।হুম মেয়েটি বাচ্চাটার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আমাকে নিয়ে একটা বাসায় ঢুকল। বাসায় গিয়ে বসে পড়লাম আমি একটা চেয়ারে।কেন জেনো শুনতে ইচ্ছে করছে এই পতিতার জীবনের গল্পটা।তাইতো বসে আছি সময় নিয়ে,,, প্রিয়ন্তী বার বার ফোন দিয়েই যাচ্ছে।বলেছে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। কিন্তু আমি এখনও বাহিরে ভালোবেসেই বিয়ে করেছি পাগলীটাকে।রাগ,অভিমান লেগে থাকে প্রত্যেকটা দিন। হয়তো এই ভাবেই ভালোবাসাটা বৃদ্ধি পায়।ফোন ধরছি না দেখে সে এখনও রাগ করে বসে থাকবে,থাকুক না একটু রাগ করে।
তা নাম কি আপনার।মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।মেয়েটি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল, হয়তো এর আগে কেউ তার নাম জানতে চায়নি।বৃষ্টি নাম আমার, আর পিচ্চিটার নাম হচ্ছে শ্রাবনী। আপনার স্বামী কোথায়?? কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বড় একটা নিশ্বাস পেলে বলতে লাগল,জানেন ভাইসাব খুব গরীব ঘরে জম্ম হয়েছে আমার।টাকার অভাবে লেখা-পড়াটাও করতে পারিনি।ষোল বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা।অল্প বয়সে বিয়েটাও মেনে নিয়ে ছিলাম আমি।
কারন বাবা- মা নামক মানুষ গুলো ছিলো না আমার।রাস্তার এক ফকিরের কাছেই বড় হয়ে উঠা এবং তাকেই বাবা বলা।জানেন ভাইসাব মানুষটি না আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে,নিজে না খেয়ে আমাকে খাইয়েছে।তিনি যত তাড়াতাড়ি পারেন আমাকে বিয়ে দিতে চান,কারন আশেপাশের মানুষ গুলো যে বড্ড খারাপ। তারা সব সময় বাজে কথা বলত আমাকে নিয়ে।তাইতো আমার দ্বিগুণ বয়সী একটা মানুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন ।বিয়ের পরে জানতে পারলাম মানুষটি নাকি আগেও একটা বিয়ে করেছেন।কিছুদিন ভালোই গিয়েছিলো দিন গুলো,কিন্তু তার পরেই আবার কেমন যেন হয়ে গেল। রাতে মদ খেয়ে এসে হাত তুলত আমার গায়ে।সহ্য করেই দিন গুলো পার করে দিচ্ছিলাম খুব করে।
আমার অন্ধকার আকাশ টাকে গাড অন্ধকারে রুপ দিয়ে মানুষটি আরও একটা বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসল।আমার আকাশটা কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল।আমি বার বার তার রং খুজতে গিয়েও পারিনি, ব্যার্থ হয়েছি।তার কিছু দিন পরেই মানুষটি আমাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দিলো। যেই মানুষটির কাছে যাবো সেই মানুষটিও আর বেঁচে নেই।আমার বিয়ের সপ্তাহ তিনেক পরেই তিনিও চলে গেলেন ঐ তারাদের মাঝে।হুম বাবা নামক মানুষটি আমার আর নেই।
তারপর কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম রাস্তায় আর স্টেশনেই।স্টেশনের ময়লার পাশেই এই পিচ্চি টাকে পেলাম।ভগবানের কি লীলা দেখুন না ভাইসাব আমার মতো রাস্তায় দিন কাটানো মানুষটির কাছে আরেক জনকে পাটালো তিনি।সেদিন মনের অজান্তেই হেঁসে ছিলাম,,,,অনেক শব্দ করেই হেঁসে ছিলাম।আমার হাঁসির পাণে চেয়ে সেদিন পিচ্চিটাও হেঁসে ছিলো।তারপর ওকে নিয়েই জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লাম।এখন আর স্টেশনে পড়ে থাকি না,,,,এখন আমাকেও ভাবতে হয় নিজেকে নিয়ে নয় এই পিচ্চিটাকে নিয়ে।তাইতো মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ খুঁজি। কয়েকটা দিন চলে গিয়েছিলো ঠিক মত,,,,এই পিচ্চি টার জন্য এখন আর কেউ কাজ দিতে চায়,,,তারা বলে আমি নাকি কাজ পাকি দি।
সেদিন কেন যেনো এই দু’চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল জানেন ভাইসাব।হয়তো মিথ্যা অপবাদ দেয়াতে। প্রিয়ন্তী বার বার ফোন দিয়েই যাচ্ছে,আমার কেনো যেনো তার ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছে না।আমার মনে শুধু এখন একটা জিনিষই চাইচে এই মেয়েটির জীবনের গল্পটা শুনতে,,,,আমি জানি প্রিয়ন্তী আমার উপর রাগ করে থাকতে পারবে না।কারন সে যে আমাকে বিশ্বাস করে, তার জীবনের চাইতেও অনেক বেশিই বিশ্বাস করে।হয়তো এই বিশ্বাস থেকেই আমার প্রতি তার ভালোবাসার জম্ম হয়েছে।
বিশ্বাস,ভালোবাসা সব পূর্ণতার মাঝেও একটা অপূর্ণতাও আছে আমাদের।আর সেটা হল একটা বাচ্চা।আমি জানতাম প্রিয়ন্তী কোনো দিন মা হতে পারবে,,তারপরও কেন যেনো মাঝে মাঝে খারাপ লাগে আমার,হয়তো আমার চেয়ে বেশি প্রিয়ন্তীর কাছেও লাগে।আমাদের বিয়ের চার বছর সাত মাস চলে, এই নিয়ে এখন আর ভাবি না আমি বা ভাবতে দি না প্রিয়ন্তীকে। প্রিয়ন্তীকে ফোন দিয়ে শুধু চিন্তা না করতে বললাম,বাসায় এসে সব বলব বলে ফোনটা রেখে দিলাম আমি।জানি তারপরও পাগলীটা আমায় চিন্তা করবে।
তারপর থেকেই এই পথ বেঁচে নেয়া।এখন আমি একজন পতিতা।হুম পতিতা। এই শব্দটা কেনো যেনো আমার কানে বার বার বাজতে থাকে।মনে পড়ে আমার মায়ের কথা।এই সমাজ আমার মাকে বাঁচতে দেয়নি,বাঁচতে দেয়নি এই সমাজের মানুষ গুলো।সমাজের মানুষ গুলো বড্ড খারাপ,বড্ড খারাপ। জানো বোন,, আমার বাবা যখন আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ। তখন ও অত কিছু বুঝতাম না আমি,শুধু আমার মুখে দুমুঠো ভাত দেয়ার জন্য পাগলীটা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করত।কিন্তু এই কাজটা নাকি পতিতাদের কাজ,এই সমাজ আমাকে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে সমাজের মানুষ গুলো। মানুষ গুলোর অপমান সহ্য করতে না পেরে চলে গিয়েছিলো আমাকে ছেড়ে।একটি বারও ভাবেনি আমার কথা।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে,আজ কেনো যেনো আমার চোখেও পানি জমতে শুরু করেছে। যাবে বোন আমার সাথে।মেয়েটি কিছু না বলেই কাঁদতে লাগল।আমি জানি না এই কান্না সুখের না দুঃখের। আমি চাইনা আমার মায়ের নেয় তোমার জীবন টাও নষ্ট হয়ে যাক,নষ্ট হয়ে যাক এই পিচ্চিটার জীবনও।
চললাম এই বোনটিকে নিয়ে।আমি জানি আজ প্রিয়ন্তী আর অভিমান করে থাকতে পারবেনা আমার উপর।এই পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যাবে সব।এই বোনটির মাধ্যমেই না হয় আমার মায়ের অভাবটা পূরণ করব।এই দু’জনের মাঝেই না হয় পূর্ণতা পাবে আমার আর প্রিয়ন্তীর সংসার।