তনুর ডায়েরি

তনুর ডায়েরি

সিএনজি তে স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে আমার কান্না শুরু হলো। লুকিং গ্লাসে বারবার ফিরে তাকাচ্ছে সিএনজি ড্রাইভার। আমি কাঁদতে কাঁদতে হাপিয়ে যাচ্ছি। ড্রাইভার আমায় পানি খেতে সাধছে।

-আপা আপনে সুস্থ আছেন? ভাই কি হয় আপনার?

-হুম ঠিক আছি। আপনি যান।

ভাই!! সিএনজি আলার তথাকথিত এই ভাই এর জন্যই আমি কাঁদছিলাম। তাকে কিছুক্ষণ আগে আমি বাস স্ট্যান্ড এ নামিয়ে এখন বাসায় যাচ্ছি। ওর নাম ইফতি। ইফতির সাথে ঠিক এক মাস আগে পরিচয়। ফেসবুকের হাজারো মজনুর ম্যাসেজের ভীরে একটা ম্যাসেজ আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিলো। আমি সচারচর অপরিচিত কারো ম্যাসেজের উত্তর দেই না। ইফতির একটা অতি সাধারণ ম্যাসেজ আমাকে রিপ্লাই করতে কেন যেন খুব প্যারা দিচ্ছিলো। ম্যাসেজ টি খুব আহামরি না। আমি সুন্দর এমন ম্যাসেজ আমি এর আগেও পেয়েছি। কিন্তু ইফতির ম্যাসেজ কেন যেন খুব স্পেশাল মনে হচ্ছিলো।

আমি রিপ্লাই করলাম “এটা আমার ছবি না। ছবির মেয়েটা সুন্দর ..তাকে পাইলে বলে দিবো আপনি তাকে সুন্দর বলেছেন” একটি রিপ্লাই দেওয়া এরপর ঘন্টাখানেক পর ইফতির পক্ষ থেকে আরেকটি রিপ্লাই। কিভাবে যেন কথাগুলো বেড়ে চলছিলো। আমি ইফতির মেসেজের রিপ্লাই করতাম। সাথে সাথে করতাম। যেখানে থাকতাম যে অবস্থায় থাকতাম। ইনবক্সের বাকী মেসেজ গুলো আনসিন হয়ে পরে থাকতো মাসের পর মাস। একটু একটু করে পরিচয় হচ্ছিলো। আমি ইফতির মেসেজের অপেক্ষা করতাম। ইফতি তখনো আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নাই। সে সুদূর চট্টগ্রামে থাকে। আর আমি ব্যস্ত নগরী ঢাকায়। কেউ কাউকে দেখি নাই। কিন্তু কেমন যেনো একটা মায়া কাজ করে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিটা আমার বেড়েই চললো। এক শুক্রবারে হঠাৎ করেই বলে ফেললাম

– ” গায়ে কি গেঞ্জি আছে?”

– “আছে কিন্তু কেন?”

মেসেজের উপরে যেই ভিডিও আইকন আছে তাতে চেপে দিয়ে দিলাম ভিডিও কল। হুম সেদিন আমরা সামনাসামনি। সেদিন আমরা মুখো মুখি তবে মোবাইলে। আমার মনে আছে ইফতি আমাকে দেখে যেই হাসি দিয়েছিলো সেটা কোন বাচ্চাকে পছন্দের খেলনার দোকানের পাশে নিয়ে যাওয়ার পরের অনুভূতির সমান ছিলো।
হুম কথা বাড়ছিলো। বেড়েই চলছিলো। কখনো কখনো ঘুমে চোখ ভেঙ্গে আসা আমার তাকে বিদায় না দিতে চাওয়ার অদ্ভূত যন্ত্রণা অনুভব করসিলাম। আমি ইফতি কে শুরুতে বলতাম

-আমার সাথে এত কথা বইলো না। প্রেমে পড়ে যাবে।

-উহ! ইফতি এত সহজে প্রেমে পড়ে না।

আস্তে আস্তে তো প্রেমে আমিই পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি ইফতির সাথে কথা না বললে কেমন অস্বস্তি বোধ করতাম। রাত জেগে কথা বলা যে আসলে মানুষকে দুর্বল করে ফেলে আমি আগে থেকেই জানতাম। এ জন্যই ভয় পেতাম রাত জেগে কথা বলাটা। সম্পর্ক মানেই আমার কাছে ভীতি। কিন্তু কেন কিসের জন্য তা কখনো ইফতি কে বলা হয়নি। আমি যখন বুঝতে পারছিলাম ইফতি আর আমি দুজনই দুর্বল হচ্ছি সমানভাবে আমি এটা চাই নাই। এমন টা হওয়ার কথা ছিলো না। আমি ইফতিকে এভোয়েড করা শুরু করলাম। কাজে ব্যস্ত ,ক্লাশ এটা সেটা। রাত হলে ইফতি যখন বলতো ” তনু তোমাকে দেখতে চাই” ম্যাসেজটা পড়েও রিপ্লাই না করে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকতাম।

আমি না ঘুমিয়ে সকালে ম্যাসেজের রিপ্লাই করতাম ” নেট এর ডিস্টার্ব ছিলো। তাই আসতে পারি নাই” আমি ইফতি কে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এভোয়েড করার ..আমার খারাপ লাগসিলো। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না আমার ইফতির সাথে আস্তে আস্তে কথা কমিয়ে দিলাম। কোন লাভ হলো না। ইফতি ঢাকায় চলে আসলো। আমার সাথে দেখা করতে আমি যেটার ভয় পাচ্ছিলাম। আমি ছেলেটার প্রতি দুর্বল এটা যেন ছেলেটা না বুঝতে পারে। প্রথমে চেয়েছিলাম তাকে অজুহাত দিতে। কিন্তু পারলাম না। কারণ ঐ যে আমিও যে দুর্বল হয়ে গিয়েছি। ইফতির সাথে প্রথম যখন দেখা হলো ইফতি আমার জন্য রাস্তায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করসিলো প্রথমবার আমরা মোবাইলে না  প্রথমবার আমরা চোখাচোখি।

সামনা সামনি প্রথমবার টানা চারদিন আমি বলতে গেলে সকাল সন্ধ্যা শুধু তার সাথেই ছিলাম। ইফতি যতক্ষণ আমার পাশে ছিলো আমি না ঘড়ি দেখতাম আর না মোবাইল। প্রয়োজনই ছিলো না। মনে হতো একটা সম্পূর্ণ পৃথিবী আমার সামনে বসা। আমি এখানেই সব পাচ্ছি। ইফতির হাত ঘামায় খুব। ও লজ্জায় আমার হাতটাও ধরতে পারে না। আমার কিন্তু দারুন লাগসিলো ওর ১ হাত আমার ২ হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখতে। ঢাকার বড় বড় রাস্তার নিয়ন আলোতে দুজন হেটে চলতাম। রিক্সায় ঘুরে বেড়াতাম। সিনেমা হলের অন্ধকার আলোয় ইফতি আমার চুল হাতে নিয়ে একটু পর পর ঘ্রাণ নিতো। আল্লাহ জানে কি শান্তি পেতো ছেলেটা। রাস্তা পার হওয়ার সময় হাতটা শক্ত করে যখন ধরে রাখসিলো মনে হচ্ছিলো এই একটা হাত ধরে আজীবন চলা যায়। এই একটা মানুষ যে আমাকে আগের মানুষ টার মত ঠকাবে না। এই ৪দিন ও আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতো।

ইফতি যাওয়ার আগে আমার অনুরোধ ছিলো আমি ওকে বাসস্ট্যান্ড নামিয়ে দিয়ে আসবো। ইফতি মানা করার পরও আমার অনেক অনুরোধ এর পর ইফতি রাজি হলো। সিএনজি তে প্রথমে বাসস্ট্যান্ড নামিয়ে ঐ সিএনজি তে বাসায় ফিরে যাবো আমি। খুব অল্প রাস্তা ছিলো নাকি খুব অল্পতে সময় শেষ হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। ইফতির কাছে তার পরা একটা টি শার্ট চাইলাম। ইফতি তার একটা ব্যবহার করা টি শার্ট দিয়ে গেলো।

বিদায় এর সময় এসেছে। ইফতিকে আমার বিদায় দিতে হবে। কেন যেন ইফতিকে জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললাম ” যায়ো না প্লিজ” জানি ঐ মুহুর্তে এই কথাটা খুবই অবান্তর শোনা যাওয়ার কথা। কিন্তু কেন যে বলেসিলাম জানি না। ইফতিকে বাসস্ট্যান্ড রেখে আসার সময় আমার মনে হচ্ছিলো আমি আমার কি যেন ফেলে চলে যাচ্ছি। আমি ইফতিকে নামিয়ে চলে আসার সময় কাঁদছি। ইফতি কে ফেলে আসার কষ্টে? নাকি ইফতি কে কিছু বলার ছিলো যা বলতে পারছিলাম না আমার বলার ছিলো – “ইফতি আমি পূর্বেও কাউকে ভালোবেসেছি। আমি পূর্বেও কারো জন্য এভাবে কেঁদেছি .. আমি পূর্বেও প্রিয়জন হারিয়েছি .. আমি পূর্বেও হেরে গিয়েছি।

ইফতি আমি ডিভোর্সি .. ইফতি আমি যৌতুকের দায়ে নির্যাতনের শিকার তনু বলছি। যে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়েছে। আমি সেই তনু বলছি যে মরে গিয়েও বেঁচে আছি। ইফতি আমি সেই তনু বলসি যে তোমার মারফতে অনেকদিন পর হেসেছি। আমি এই চারদিন দারুন ভালো ছিলাম। ইফতি আমি সেই তনু বলসি যে কিনা তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি দ্বিতীয় বার ভালোবেসে ফেলেছি যার প্রথম ভালোবাসার গল্পটা ছিলো রক্তাক্ত .. ইফতি আমি সেই তনু বলছি যে কিনা ডিভোর্সি এবং সমাজে যার জন্য কাউকে ভালোবাসা বিশাল বড় গুনাহ” আমি কাঁদছি। ইফতির দেওয়া সাদা টিশার্ট টা জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। বারবার সেই সিএনজির লুকিং গ্লাসে দেখে চলছে ড্রাইভার লোকটা।

আমি ডিভোর্সি তাই সমাজ আমার ভালোবাসা কে সমর্থন করে না। আমি চাইলেও তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না। আমি চাইলেও তোমাকে বলতে পারবো না আমি তোমাকে ভালোবাসি। কত অসহায় আমি। কারণ আমি ডিভোর্সি ..কারণ আমার কোন অধিকার নাই কাউকে ভালোবাসার।

এই ভেবে সারা রাস্তা টি শার্ট বুকি জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি তনু আমার প্রতিদিনের গন্তব্যে আবার আরেকটা বার। হুম হেডফোনে গান বেজে চলছে। “আহারে জীবন আহা জীবন জলে ভাসা পদ্ম যেমন”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত