2nd Marriage

2nd Marriage

আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৯। তখন আমি সবে অনার্স ভর্তি হয়েছি। আশেপাশের সবাই বলছিল এত জলদি কেন বিয়ে দিচ্ছে আমায়। কারন আমি খুবি লক্ষী একটা মেয়ে ছিলাম আর পড়াশুনায় ভালো । এলাকার ছোট থেকে বড় সবাই খুব ভালোবাসতো আমায়। তাদের হয়তো ধারনা ছিল আমার বিয়ে হলেই পড়াশুনা চুলোয় যাবে। আসলে ভালবাসা থেকে তাদের এই চিন্তা। মার ও ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা শেষ করে আমি চাকরি করবো, বড় হব। কিন্ত এত জলদি বিয়ে আমি যে অমত ছিলাম তা কিন্ত না। আমার মা ভীষণ কড়া মানুষ ছিল। সারাটা জীবণ চাপে রাখছে আমায়। মনে মন ভাবছিলাম বিয়েটা হলেই আমি মুক্ত।

আমার মামার এক বন্ধু এই সম্মন্ধটা আনছে। ছেলে খুবি ভালো, চাকরী করে । ৫ বোনের একমাত্র ভাই। তাছাড়া বোনেরা সব শ্বশুরবাড়ি। কোন ঝামেলা নেই। ছোট্ট পরিবার। কিচ্ছু চায় না তারা। আমাকে এত তারাতারি বিয়ে দেওয়ার আরো একটা কারন হচ্ছে- ছেলের মা নেই। তো জ্বালানোর ও কেও নাই। একটা শ্বশুর,ছোট্ট সংসার।

মা প্রথমে রাজি হয়নি। মামা, মামীরা বোঝানোর পর রাজি হয়েছিল। তবে আমার মায়ের একটাই অনুরোধ ছিল —
আমাকে যেন তারা বিয়ের পরও পড়াশুনা করায়। শ্বশুরবাড়ির মানুষ তাতেও রাজি হলো। মামী আমাকে জিজ্ঞেস করলো কোন পছন্দ আছে কিনা। আমি সেখান থেকে চালে এসেছিলাম লজ্জায়। তো এর মধ্যে আমাকে দেখতে এলো তারা। তাদের পছন্দ হয়েছে আমাকে। ছেলে সেদিন আসে নি। ছেলে নাকি আমায় আগেই দেখেছে। দেখতে দেখতে আমার বিয়েটাও হয়ে গেল। মোটামুটি ধুমধাম করেই। মামারা তাদের সাধ্যমত সব করেছে। কোন কমতি রাখেন নি। আমি খুব খুশিই ছিলাম।

বিয়ে তাই বাড়ি ভর্তি মেহেমান ছিল। আমার ভালোই লেগেছিল। সবাই আমায় খুব আদর করতো। একমাত্র ভই বৌ তাই হয়তো। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সবাই চলে গেল। সারা বাড়িতে আমি একা। উনি অফিসে যেতেন। শ্বশুর বাবা সকালে বের হতো দুপুরে আসতো গোসল করে নামাজ পরতে যেত এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাতো। উঠে বিকালে বাইরে যেত একেবারে এশার নামাজ পরে বাড়িতে আসতো। আমার না ভাল্লাগতো না। একা একা। কথা বলার কেও নাই। তো বিয়ের পরের দিনগুলো সত্যিই ভালোছিল। আমরা দুজন মিলে সময় পেলেই বাইরে ঘুরতে যেতাম।

আস্তে আস্তে আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু হলাম। ও ওর সব কথা আমাকে বলতো। আমিও বলতাম। ওর পরিবার, বোন, আত্মীয়, আর ওর মার ও আবীরের বয়স যখন ১০ তখন ওর মা মারা যায়। কথাটা বলে না মুহুর্তেই ও স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি না ব্যাপারটা বুঝেছিলাম। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। একটু পর দেখি ওর চোখে পানি। আমি দেখবো বলে ও ওপাশ হয়ে চোখ মুছলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এত অল্প বয়সে মা হারানোর কষ্টটা আমার কেনো কারোরি বুঝার কথা না। যার যা সেই বুঝে। আমি ওকে ঘুরিয়ে বললাম আচ্ছা আবীর আমি যদি মায়ের মত মারা যাই আপনার আগে আপনি কি আবার বিয়ে করবেন। ও না এ কথাটা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিল। আমি ও ওর কান্না দেখে কেদে দিলাম।

ও আমায় জড়িয়েই কান্না জড়ানো গলায় বললো প্লিজ তুমি আমার আগে মরবা না। আমি জানি একটা পরিবারে মা কতটুকু ইমপর্টেন্ট। আমি ওকে ছাড়িয়ে ওর চোখ মুছে দিলাম বল্লাম আরে আমি তো এমনিই বলেছি, আচ্ছা বাবা মরবো না। খুশি সে রাতে আবীর আমায় শক্ত করে সারা রাত ধরে রেখেছিল। ভয় পেয়েছিল মনে হয়। যে আমাকে ছাড়লেই আমি মরে যাবো তো আমার না খুব কষ্ট হত সংসারটা সামলাতে। কোন কাজই পাড়তাম না। আমরা সময় পেলেই বাইরে বেরাতে যেতাম। বাবা তখন বাসায় একা থাকতো। সৌজন্যবোধ থেকে কখনো হয় তো বলতাম বাবা আপনিও চলেন আমাদের সাথে। শুধুই বলার জন্য বলা। নতুন বিয়ে করেছি ঘুরাঘুরি স্বাভাবিকই। তো বাবা হাসি দিয়ে বলতো

‎: তোমরাই যাও।

‎আমার শ্বশুর খুবি ভালো মানুষ। কোনদিন আমাকে কোন কাজের হুকুম দিত না। সব নিজে করার চেষ্টা করতো।
‎ ‎আমার দিনগুলো চলছিল ভালোই। তো বিয়ের ৬ মাসের মাথায় আমি প্রেগন্যান্ট। আবীর তো সেই খুশি। আমার এক্সপেশন না দেখেই বললো আমার একটা মা চাই। বলেই আমার হাতদুটো মুঠোকরে চুমো খেল। আমার তো পুরাে দুনিয়াই আন্ধকার কোন কাজই পারি না এর মধ্যে এখবর। খুব কান্না পাচ্ছিল। তবে ওকে খুশি দেখে ভালো লাগছিলো। খুব কষ্টকরে কোনমতে রান্না করতাম। নিজের খেয়াল রাখারই লোক লাগে। অন্যের খেয়াল রাখব কিভাবে। আবীর অফিস থেকে ফিরে আমার খুব কেয়ার করতো। আমার না খুব মায়া লাগতো ছেলেটা সারাদিন কষ্ট করে এসে আমার এত্ত কেয়ার করে।

অবশেষে মা হলাম আমি। তখন আমার বয়স পুরো ২০ বছর। ১দিন কমও না বেশীও না। তবে কষ্টের বিষয় আবীরকে আমি মা দিতে পারিনি। আমার একটা ছেলে বাবু হয়। আমার আর আমার ছেলের জন্ম তারিখ একটাই। শুধু সালটা আলাদা। ১৯৯৩ আর ২০১৪ মা দিতে না পারায় আবীর এতটুকুও মন খারাপ করেনি। এরি মধ্যে অনর্স ২য় বর্ষের পরীক্ষা। পড়াশুনাও করতাম টুকটাক। সারাদিন খুব পেরেশানিতে কটতো আমার। ও বাসায় ফিরে আমাকে হেল্প করার ট্রাই করতো। জীবণটার সমার্থক শব্দ তখন আমার কাছে ছিল প্যারা। তবুও দিন শেষে আবীর যখন আমার কষ্টে ব্যাথিত হতো, তখন না সব কষ্ট কোথায় যে যেত। ওর এই সমব্যাথি মনোভাব আমাকে পরের দিনের কাজ করার শক্তি যোগাতো। তখন আমি বুঝতে পারি স্বামী মানুষটা সহধর্মীর চেয়ে সহমর্মি হওয়াটা কত্ত জরুরী।

তখন আমি এটাও বুঝতাম শ্বাশুরী কি জিনিস। এর পর না বাবাকে আমি লক্ষ করতাম। মানুষটা কত্ত একা। সঙ্গী হারিয়েছে ২০ বছর হতে চললো। একদিন আমি রুম থেকে বেরিয়ে দেখি বাবা খাবার খাচ্ছে। সেদিন আমি গরুর গোশত রান্না করেছিলাম। ভাজি দিয়ে খাওয়া শেষ তরকারি নিবে। বাথরুম থেকে এসে পানি নিতে গিয়ে দেখি বাবা জমাট বাধা তরকারিই নিচ্ছে তাও আমাকে বলছেনা একটু গরম করে দিতে। আমি বললাম বাবা দিন আমি গরম করে দেই। বাবা ভাত হাতে অপেক্ষা তরকারির জন্য। মনে মনে একটু রাগ হয়েছিলাম। কেন আমায় বলে না।

অনেকদিন পর ব্যাপারগুলো আমার চোখে পড়লো যেদিন বাবার ব্যাকপেইন হলো। বয়স বেড়েছে, তাই হয়তো। আমি মুভ নিয়ে বাবার ঘরে গেলাম। দিলে ব্যাথা কমবে। আমি বাবাকে বললাম বাবা মুভ দিলে ব্যাথা কমে যাবে। বাবা তো দিববেই না। আবীর রাগ করায় দিতে রাজী হলো। বাবার সে কি লজ্জা ব্যাথাটা কোমরে ছিল। কিছুক্ষণ মালিশ করতেই বাবা বললো থাক বৌ আর লাগবে না। আমি বুঝেছিলাম বাবা যে আনিজি ফিল করছে। বাবার সেদিন জ্বরও ছিল। মনটা খুব খারাপ আমার। শ্বাশুরীর কথা ভেবে। তিনি থাকলে বাবার কষ্টটা হয়তে কম হতো। এর পর থেকে না আমার বাবার জন্য খুব মায়া হতো। মা যখন মারা যায় বাবার বয়স তখন কতই হবে ৩৫-৪০। আচ্ছা কত বছর হলে মানুষের জৈবিক চাহিদা থাকেনা কেও বলতে পারো?

জৈবিক চাহিদা না হয় বাদই দিলাম। মনেরও তো একটা চাহিদা থাকে। আমার যত কষ্টই হতো- আবীর আসার সময় হলে দৌড়ে গিয়ে দড়জা খুলতাম অন্য সময় দড়জা খুলতো বাসার পিচ্চিটা। আবীরের খাওয়ার সময় অযথা বসে বকবক করতাম। সারাদিন কি করলো, না করলো। আমি কি করলাম না করলাম। প্রতি শুক্রবার ১২-১ টা ওর রূপচর্চা চলতো। কতো কতো দিন গামছা দিয়ে মুখ পেচিয়ে বাথরুম গিয়েছে আবীর, তার কোন হিসেব নেই। বাবা দেখে ফেলবে বলে। আর বাবা তাকে দেখতাম বাথরুমে ছোট্ট টুলটাতে বসে পা ঘসার পাথরটা দিয়ে পা ঘষতো। কারন আমি চাইলেও তার পা টা ঘষে দিতে পারতাম না। কারণ আমি তার ছেলের বৌ। প্রায় আমি বাথরুমে ঢুকে আবীরের শরীর মেজে ঘষে গোসল করিয়ে দিতাম। মা থাকেলও হয়তো বাবাকে এমনি করে গোসল করিয়ে দিত।

আমার এত এত ভাবনার উৎগিরণ হলো সেই দিন। যেদিন আমার শ্বাশুরী মায়ের মৃত্যু বার্ষীকি ছিলো। সারাদিনে একবারও না। সেদিন আমি আলমারীর তোলা একটা জামা নামিয়ে পরেছিলাম। স্নো – পাউডারও মেখেছিলাম মুখে। বাইরের কত্ত মানুষ আসবে এটা ভেবে। আপন মা হলে হয়তো এমনটা পারতাম না। বিকালে মিলাদ হয়ে রাতের খাবারের আয়োজন। ৯ টার মধ্যে পুরো বাড়ি ফাকা। সেদিন রাতে আমি বাবাকে খাবার খেতে ডাক দিতে গিয়ে দেখলাম বাবার মনটা বোধয় ভালো নেই। আমায় বললো আজ নাকি খাবে না।

ব্যাপারটা আমি হালকা ভাবেই নিয়েছিলাম। কার প্রায় রাতেই বাবা খাবার খায় না। আমি আর আবীর খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবীর ঘুম আমার না ঘুম আসছে না। কেমন আবোল তাবোল চিন্তা ঘুরছে। রাত ২.৩০ মিনিট। বাবার ঘটের দড়জাটা খোলা। লাইটটাও জ্বালানো। ভাবলাম এতো রাতে লাইট জ্বালানো। ঘরটাতে উকি দিয়ে দেখি বাবা এখোনো সজাগ। পা দুটো নিচে রেখে খাটের উপর বসা। কি যেন ভাবছে। একটু দাড়ালাম আমি।

‎কিছুক্ষণ পর পর নাক টানছে। মনে হচ্ছে কান্না করেছে কিছুক্ষণ মাত্র। আমার না মুহূর্তেই কান্না চলে আসলো। আমি বাবার জায়গাতে নিজেকে বাসালাম।আমি আআছি আবীর নাই । আমি না ভাবতে পারছিলাম না। আমি বাথরুমে গিয়ে কল ছেড়ে অনেক্ষণ কাদলাম। মনে হচ্ছিল আমি হয়তো বাচতে পারতাম না এত কষ্ট নিয়ে। কিন্তু বাবা এই কষ্টটা নিয়ে পার করেছে একে একে ২১ টা বছর…

আমি রুমে আসলাম। কান্না যেন থামছেই না আমার। আমার কান্নায় আবীরের ঘুম ভেঙে গেল। বললো কি ব্যাপার কি হয়েছে তোমার। আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। মুখটা যেন চেপে আসছে আমার। আবীর আমাকে ওর বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। আমি শুধু এটুকুই বলেতে পরেছিলাম…

: আপনার আগে যদি আমি মরা যাই, প্লিজ আপনি ২য় বিয়েটা করবেন…..

সেই আমি যেই আমি বলতাম ২য় বার যদি বিয়ে করেন আমি মরার পর আমি ভুত হয়ে এসে দুজনেরই ঘার মটকে দিব। বলেই আবার কান্না শুরু। সে রাতে আবীরও কেঁদেছিল, আমার সাথে।

আমাদের সমাজ কিংবা আমরা এ জিনিসটা মানতে পারি না। তাদের কান্নার পানি গুলোও হয়তো বাষ্প হয়ে উরে যায়। কিন্তু এই মানুষগুলোর কষ্ট আমাদের অজানাই থেকে যায়। যাদের জন্য তাদের এই সিদ্ধান্ত আমরা তারা কতটুকু সময় দেই / দিতে পারি তাদেরকে ? প্রশ্নটা তাদের কাছেই রইলো—-

The End

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত