“অ্যাই শুনছো! একটু বাজারে যাও না। পোলাও এর চাল আর মুরগি নিয়ে আসো।”
“হঠাত্? কেনো?”
“আনতে বলছি আনবে। এতো কথা কেনো”
“যথা আজ্ঞা মহারাণী। দাও বাজারের ব্যাগ দাও”
“ধরো! আর শোনো সাবধানে যাবে। আবার চা এর দোকানে আড্ডাতে বসে যেও না কিন্তু!”
শ্রেয়ান বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়। আরাত্রিকা শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুঁজে নেয়। ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজাতে হবে। আজকে একটি বিশেষ দিন কি না! কিন্তু শ্রেয়ানের এটা ভুলে গেছে ভেবে খারাপ লাগে। সেটাকে পাত্তা দেয় না। ভাবে বাজার থেকে আসলেই মনে পড়বে। আরাত্রিকা বাগান থেকে কামিনী আর কাঠগোলাপ নিয়ে এসে রুমটা সাজায়। বেড সাইড টেবিলে রাখে রজনীগন্ধা আর গোলাপ। কলিংবেল টা বেজে উঠে। আরাত্রিকা গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখে শ্রেয়াণ ঘেমে একাকার। আঁচল টা কোমরের গুজা থেকে খুলে ঘাম মুছতে মুছতে বললো
“ঘেমে কি হয়েছো! দাও ব্যাগগুলি দাও” আরাত্রিকা ব্যাগগুলি রেখে এসে দেখে শ্রেয়াণ সোফায় হেলান দিয়ে অর্ধবসা অবস্থায় শুয়ে আছে। আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। বেশি ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার দরুণ এরকম হচ্ছে। আরাত্রিকা শ্রেয়ানের মাথায় হাত রেখে বললো “বেশি ক্লান্ত লাগছে? রিকশা নিয়ে আসতে! তুমি বসো আমি তোমার জন্য একটু লেবুর শরবত নিয়ে আসি” আরাত্রিকা যেতে নিলেই শ্রেয়ান আরাত্রিকা এর হাত ধরে আটকে দেয়। তারপর দাঁড়িয়ে আরাত্রিকা কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে
“এতে তো ক্লান্তি দূর হবে না, সুইটহার্ট”
“তাহলে কিভাবে হবে শুনি?”
“বলে দিতে হবে?”
“হ্যাঁ হবেই তো”
“তার থেকে প্র্যাকটিক্যালি করে দেখানো ভালো” বলেই শ্রেয়ান আরাত্রিকা এর একদম মুখের কাছে আসতেই আরাত্রিকা ধাক্কা মেরে বললো “অসভ্য একটা, ছাড়ো” শ্রেয়ান বোধহয় এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো তাই হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলো।
“উঁহু, আমার ক্লান্তি দূর না করলে তো ছাড়ছি না”
আরাত্রিকা আলতো করে শ্রেয়ানের কপালে একটা চুমু খেলো। তারপর আগের চেয়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে যেতেই শ্রেয়ান বললো
“আমি কিন্তু এখানে চাই নি”
“যা দিছি তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো, বুঝলে!”
“সোনা বৌ!?”
“ঢং। কি হইছে?”
“লাল হলে তোমাকে এতো সুন্দর লাগে কেন?”
“টিভি দেখো। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে”
আরাত্রিকা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। পাগলটার এরকম হুটহাট বায়নাগুলো আরাত্রিকার ভিতর অনেক গভীর শিহরণ জাগায়। প্রতিটা হৃদস্পন্দন এর আওয়াজ খুব স্পষ্ট শোনা যায়। লোকে বলে অচেনা অজানা মানুষের সাথে নাকি এক ছাদের নিচে মানিয়ে নেওয়া কষ্ট হয়। আরাত্রিকা ও তাই ই ভাবতো। ওদের বিয়েটা ছিলো পরিবার থেকে ঠিক করা। বিয়ের আগে দু’জন এর মাত্র দু’বার দেখা হয়েছে। প্রথমবার যেদিন আরাত্রিকা কে দেখতে এসেছিলো আর দ্বিতীয়বার পরিবারের অনুমতিক্রমে দু’জনে একটা পার্কে ঘন্টা খানেক ছিলো। কিন্তু লজ্জা কিংবা সংকোচ কাটিয়ে তেমন কোনো কথা বলতে পারে নি।
আরাত্রিকা পুরোপুরি শ্রেয়ানকে না চিনে দেহের অধিকার দিতে চায় নি। যাকে মন দেওয়া যায় না তাঁকে দেহ দেওয়া আর ধর্ষিত হওয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য ছিলো না আরাত্রিকা এর কাছে। কিন্তু শরিয়ত মতে শ্রেয়ান যখন ওর স্বামী তখন আরাত্রিকা তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তো পাপের ভাগীদার হতে পারে না। এইসব হাজারো চিন্তায় যখন আরাত্রিকা ভয়ে ফুলের বিছানায় ঝরা ফুলের মতো নেতিয়ে যাচ্ছিলো তখন শ্রেয়ান ঘরে ঢুকেই আরাত্রিকা কে বললো
“আমার সাথে একটু ছাদে যাবেন?” আরাত্রিকা কিছু না বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আরাত্রিকা শেষ সিড়িটি পার হয়ে যখন ছাদে পা রাখে তখন কিছু সময় এর জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। গোলাপের পাপড়ির জন্য ছাদের ফ্লোরের নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না। আর রেলিং এর চারপাশে শতাধিক মোম। শ্রেয়ান কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো “এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
আরাত্রিকা এখনো কোনো উত্তর দিলো না। আনমনে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলো। একদম রেলিং এর কাছে। শ্রেয়ান আবার ও ফিসফিস করে বললো “আসল সৌন্দর্য তো উপরে” আরাত্রিকা উপরে তাকিয়ে দেখে থালার মতো চাঁদ। আরাত্রিকা খুশিতে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে যখন শ্রেয়ানের জন্য পিছে ঘুরে দেখে শ্রেয়ান হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তারপর আরাত্রিকার দিকে একটা আংটি বাড়িয়ে দিয়ে বললো “তুমি কি আমার বৃদ্ধ বয়সের খুঁটি হবে?” এইবার আরাত্রিকা এর গাল বেয়ে চোখের পানি অঝোরে ঝরতে থাকে। শ্রেয়ান দাঁড়াতেই আরাত্রিকা শ্রেয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ান ও আরাত্রিকা কে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
“কি ম্যাডাম! মাংসের মশলার প্যাকেট এ এমন কি পেলেন যে সেটা হাতে নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে গেলেন?” শ্রেয়ানের কথা শুনে হুঁশ ফিরে আরাত্রিকার। ইতস্তত করে বলে
“কিছু না, তোমার এখানে কি চাই?”
“তোমার মুখ টা না দেখলে ভাল্লাগে না। বেশিক্ষণ আমার চোখের আড়ালে থাকলে অস্থির লাগে”
“এতো ঢং যে পারো তুমি! যাও গিয়ে আমার ছবি নিয়ে বসে থাকো। আমার অনেক কাজ আছে”
আরাত্রিকা রান্না শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখে শ্রেয়ান সত্যি সত্যি আরাত্রিকার ছবি নিয়ে বসে আছে। আরাত্রিকাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলে
“আচ্ছা! সোনা বৌ! তুই কি দিনদিন খালি সুন্দর ই হস?”
“তোমার আজকে কি হয়েছে বলতো?”
“কেনো আমি কি আজ অদ্ভুত আচরণ করছি নাকি? তোমাকে কি শিং দিয়ে গুতা দিছি?”
“শ্রেয়ান!”
“কি হইছে জানু?”
“উফফফ”
“কি গো! ব্যথা পেলে?
“দুষ্টুমি বাদ দাও শোনো, সন্ধ্যায় কিন্তু নীল পাঞ্জাবি টা পড়বে”
“কেনো?”
“কেনো মানে!”
“হঠাত্ কেন পড়বো?” আরাত্রিকার এবার খুব রাগ হয়। মন ও খারাপ হয় ভীষণ। এতোকিছু দেখেও কি শ্রেয়ানের আজকের দিনটার কথা মনে পড়ছে না। আরাত্রিকা আলমারি খুলে দেখে একটা নতুন প্যাকেট। তার ভিতর গাঢ় নীল রঙ সাথে সোনালী কারুকাজ এর একটা শাড়ি। আরাত্রিকা বুঝতে পারছে না এটা কি কোনোদিন শপিং এ গিয়ে কিনেছিলো কি না! তবুও শাড়িটা ভালো লাগায় পড়ে নিলো।
খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে শ্রেয়ানকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো শ্রেয়ান রুমে নেই। টেবিলের উপর একটা চিরকুট “আমার ভালো লাগছে না। আমি পুকুরপাড়ে আছি। মন চাইলে তুমি ও এসো” আরাত্রিকা শাড়িটা ঠিক করতে করতে পুকুরপাড়ে যায়। সামনে তাকিয়ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গাছের ডাল থেকে সুতো দিয়ে বেঁধে বেলুন ঝুলানো। একটা ছোট্ট টেবিলের উপর কেক রাখা। তার পাশে অনেকগুলো কাঠগোলাপ। আরাত্রিকা এগিয়ে যায়। কেকের সামনে দাঁড়াতেই শ্রেয়ান পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে খোপায় বেলি ফুলের মালা পড়িয়ে দিয়ে কানের মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে “পয়ত্রিশ বছর এই অসহ্যকর মানুষটাকে সহ্য করার জন্য অভিনন্দন ও ধন্যবাদ”
আরাত্রিকা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রেয়ান ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে আরাত্রিকা এর সামনে দাড়ায়। তারপর সামনে গিয়ে দেখে আরাত্রিকা ভেজা চোখদুটো বন্ধ করে রোবটমানবীর মতো দাড়িয়ে আছে। পকেট থেকে টিপের পাতা টা বের করে কপালে পড়িয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিতেই আরাত্রিকা শ্রেয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করেই বললো
“এতো ভালোবাসো কেন?”
“তুমি কি চাও কম কম বাসি?” আরাত্রিকা ছেড়ে দিয়ে বললো
“তুই একটা কুত্তা”
“ওমা! কি করছি আমি?”
“সারাদিন এমন ভাব করছিস যেনো দিনটার কথা ভুলেই গেছিস”
“আমি মোটেও কোনো ভাব করি নি। আমার মতো একটা ইনোসেন্ট ছেলের নামে এতোবড় অপবাদ? ধম্মে সইবে না বলে দিলুম”
আরাত্রিকা শ্রেয়ানের বুকে কিল ঘুষি দিতে দিতে হঠাত্ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে বললো “আমাদের যদি একটা বেবি….”
কথা শেষ করার আগেই শ্রেয়ান আঙুল দিয়ে আরাত্রিকার ঠোঁট চেপে ধরে বললো “আল্লাহ্ চায় নি। আমাদের ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাক তাই দেয় নি। দিলে কি এখন তোর সাথে থাকতাম। নাতনি নিয়ে ঘুরতাম। তুই আমার কাছে আসার চান্স ই পেতি না। তখন দেখতি আর জ্বলতি” আরাত্রিকা জানে মানুষ টা আড়ালে সন্তান এর জন্য আফসোস করে কিন্তু ওকে বুঝতে দেয় না। আল্লাহ্র কাছে হাজার শুকরিয়া এমন একজন কে জীবনে পেয়েছে। পরিস্থিতি সামলে নিতে আরাত্রিকা বললো “আর লুচির মতো ফুলতাম তাই না? বুড়ো!”
“খবরদার বুড়ো বলবে না। এখন ও যদি আমি শাহরুখ খানের মতো চুলের কাট দেই না! মেয়েরা আমার পিছে লাইন দিবে” “হুহ! ছাই দিবে” “তা দেক। এই বুড়ি পা টা দিবি একটু?” আরাত্রিকা কিছু বলার আগেই শ্রেয়ান আরাত্রিকা এর পা টা নিজের হাঁটুর উপর তুলে পায়েল পড়িয়ে দিয়ে বললো “ভালোবাসার শিকলে বেঁধে দিলাম কিন্তু”