বাবা মা

বাবা মা

আমার জন্মের দ্বিতীয় দিন আমার কোন এক আত্মীয়া আমাকে হাসপাতালে দেখতে এসে বলেছিলেন ” মেয়া হইসে তাও আবার কালা” আম্মু খুব কান্না করছিলো। শত হলেও মায়ের কাছে মেয়ে খুব সুন্দর। বাবা এই নিয়ে বেশ প্রতিবাদ ও করেছিলেন শুনেছি । এখনো আম্মু এই গল্প বলতে গেলে কেঁদে দেন।

আমার যখন বয়স ৩ .. তখন আম্মু আমাকে নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের কোন এক দোকানে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পরার জন্য জামা কিনতে নিয়ে গেসিলেন। আমার পছন্দের একটা জামা দেখিয়ে দোকানদারকে বলছিলেন ” ভাই ঐ জামা টা দেখান” দোকানদার বলছিলো ” এইটা অনেক দামী জামা আপনে কিনতে পারবেন না।” তৎকালীন সময়ে ১২০০ টাকার ঐ জামা আম্মু আমাকে কিনে দিসিলেন তার মাটির ব্যাঙ্ক ভেঙ্গে। কারণ জামা টা আমার পছন্দের ছিলো।

একটু বড় হইসি পরে আমার খেয়াল আছে একদিন আমাকে এক আত্মীয় বলতেছে। “পড়াশুনা কর ঠিক মত। এমনেই কালা। বিয়ার সময় বাপের ২ লাখ টাকা বেশি লাগবে। পড়াশুনা না করলে লাগবে ৫ লাখ” ঐ দিন আব্বু বলছিলো ” আমার মেয়ের একদিন এমন পজিশন হবে পোলা নিজে যৌতুক দিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।” স্কুল আমার বাসা থেকে প্রায় ২০ মিনিটের হেটে যাওয়ার রাস্তা ছিলো। আব্বু আম্মু কে রিক্সা ভাড়া দিত তাকে স্কুলে আসার জন্য। আম্মু পায়ে হেটে আসতো আর সেই টাকা দিয়ে ছুটির পর আমাকে শাহলম ভাই এর চটপটি কিনে খাওয়াইতো।

আমি যখন কালো অথবা ডার্ক কালার পরতাম আশে পাশের মানুষ আম্মুকে বলতো “মেয়েটার গায়ের রং দেখে জামা পড়াইতে পারো না?” আম্মু বলত” আমার মেয়ে যা পরে তাতেই সুন্দর” আমার এস এস সি পরীক্ষার সময় যখন বাবার দোকান ভেঙ্গে দিলো বিনা নোটিশে আমার আত্মীয়রা বললেন ” এই বছর পড়া বন্ধ রাখো। পারলে ভালো পোলা দেখে বিয়ে দিয়ে দেও। ” আব্বু বলসিলো “গায়ের রক্ত বিক্রী করে হলেও মেয়ের পরীক্ষা দেওয়াবো।” ২ জন স্যার কোচিং এ আমার বেতন ও রাখতেন না।

বাবার অনেক দিন ঘরে বসে থাকার সময় আমার মায়ের ভরা মাস। সে প্রেগনেন্ট। আমি রাত জেগে পড়ি..
আম্মু রাতের খাবার টা একটু কম খেয়ে আমার জন্য উঠায়া রাখতেন যাতে আমি রাত জেগে খিদা লাগলে খেতে পারি। আর বাবা !! তার কথা বাদ ই দিলাম। কি না করসে। কিন্তু আমাকে কখনো অভাব বুঝতে দেয় নাই।
সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে গেছে।

আমাকে প্রাইভেট কলেজে ভর্তি করেছে, আশ পাশের মানুষ বলেছে ” আপনাদের এমন অভাবের মধ্যে মেয়েটাকে আবার প্রাইভেটে ভর্তি করার কি দরকার ছিলো” আম্মু বলছে “ও আমাদের সম্পত্তি। ওর পিছনে খরচ করবো না তো করবো কার পিছনে”? আমি যখন যখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি তারা আমাকে বুঝানোর পরও বেশ ঘাউরামি করছি। সেখান থেকে আমি প্রতারিত হইছি। ফেরত আসছি তারা আমাকে হাসি মুখে এক্সেপ্ট করছে।

আশ পাশের মানুষ যা ইচ্ছা তাই বলছে আমার মা সেই আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিছে আমার জন্য। আমার রাগ আমার গর্জন সব আমার বাসার মানুষ শুনছে। আমাকে ঠান্ডা করছে। আমার মা কে আমি ছোট থাকতে খুব ভয় পাইতাম। ৩ ভাই বোনের মধ্যে পড়াশুনা আর দুষ্টামির জন্য আমি সবচেয়ে বেশি মাইর খাইছি। এখন কেন যেন সে আমাকে ভয় পায়। আমি এখনো মাঝে মাঝে তার সাথে চিৎকার চেচামেচি করি। হুম এখনো করি।

বাবা তো আমারে এত ভয় পায় মনে হয় সে আমার ১০ বছরের বাচ্চা আর আমি তার মা আমি তাদের থেকে একটু দূরে গেলে টের পাই তারা আমার জন্য কি। আম্মু আমাকে যখন দিনে কয়েকবার ভিডিও কল দিয়ে বলে “দেখ এইটা কিনসি সেটা করসি “আমি শত কাজে থাকলেও তার ফোন রিসিভ করে তার এগুলা দেখি।মাঝে মাঝে কাজের চাপে একটু বিরক্ত হই কিন্তু বুঝতে দেই না।

এক সময় আমি আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলতাম, আজ কতটা বছর আম্মু কে আমি সেধে টাকা দেই। আমি এখনো শপিং এ গেলে নিজের জন্য একটা জামা কিনলে আম্মুর জন্য সাথে আরেকটা কিনি। আজ আমি যা আজ আমি যেখানে সেখানে উঠতে তো তারাই আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে। নাহলে সমাজের নানান যন্ত্রনায় কই যে হারায়া যাইতাম আল্লাহ ভালো জানে। আমার অনেক শান্তি লাগে যখন আম্মু বান্ধবীদের সাথে বলে ” আমার মেয়ে আমাকে এইটা দিছে। ভাবী সুন্দর না?”

আমার মা মাঝে মাঝেই বাইরে খাইতে ডিমান্ড করে। মাঝে মাঝে ঘুরতে যাইতে ডিমান্ড করে। মনে হয় সে আমার মেয়ে আমি তার মা। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আল্লাহ আমাকে সেই তৌফিক দিসে। অন্তত ছোট ছোট ডিমান্ড হলেও সেগুলা পূরণ করতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ ইসসসস আমি বুঝাইতে পারবো না,কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমার খুব শান্তি লাগে যখন আব্বু মানুষ কে বলে ” আমি তো নিজের টাকায় লাস্ট কবে কিছু নিজের জন্য কিছু কিনসিলাম ভুলে গেসি। সব আমার মেয়ে আমার জন্য কিনে আনে।”

হুম এই শান্তি কোটি টাকা দামী। মাঝে মাঝেই মানুষ বলে আমাকে। “বাসায় টাকা দেও কেন? নিজেরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।” আমি বলি “আমার ভবিষ্যৎ তো এরাই। যারা আমাকে অতীতে সবাই ছেড়ে যাওয়ার পরও সসম্মানে বুকে টেনে নিয়েছে..আমার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার বেতনের সিংহ ভাগ তাদের কে দিতে চাই এতে আমাকে যে যা বলুক একদম আফসোস নাই। ”

কেন যেন খুব লিখতে ইচ্ছা করলো। সব সময় প্রেম ভালোবাসা নিয়ে লিখি। আব্বু আম্মু দুইজনই আমার ইয়া লম্বা লম্বা লেখা শুরু থেকে শেষ টা পরে। তাদের জন্য আজ খুব মায়া লাগতেছে। আমার জন্য যা করছে ওরা আমি তার ১০০ ভাগের ১০ ভাগও এখনো করতে পারি নাই। ইচ্ছা আছে বেঁচে থাকলে ইন শা আল্লাহ করবো।

তারা আমার কালো হওয়াকে এক্সেপ্ট করেছে। তারা আমার বারবার হেরে যাওয়া তে কোন প্রেসার না দিয়ে হাত ধরে টেনে উঠাইছে। আমার মাথার উপর আসমান এর পর এরা আমার সবচেয়ে বড় ছায়া। ভালোবাসি তোমাদের অনেক বেশি। খুব বেশিই বেশি। আমার জীবন টা মোটেও ফুলসজ্জায় গড়ে উঠে নাই। কষ্ট কে খুব কাছ থেকে দেখসি আমি যা আমার দুই ভাই এখনো দেখে নাই। দোয়া করি না দেখুক। কিন্তু কষ্টের মধ্যে এই কালো কৃষ্ণকলিকে বাবা মা হাত ছাড়ে নাই।

এক মুহুর্তের জন্যও না। আমার অনেক কাছের মানুষ গুলা হয়ত আমার অনেক কষ্টে উঠে আসার গল্প জানে না। এখনের সো কল লাক্সারিয়াস লাইফ দেখে। আমি যা আমি আমার আব্বু আম্মুর কারনে। বিলিন হতে দেয় নাই.. উঠে দাড়াতে সক্ষম করছে তারা আমাকে। আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।

মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করি। মাফ ও চাই। আল্লাহ যেন আমাকে মাফ করে দেয়। সবাই বাবা মা কে ভালোবাসুন। তাদের চেয়ে ভালো আপনাকে আর কেউ বাসবে না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত