নীরব অনুভূতি

নীরব অনুভূতি

ভার্সিটির ক্লাস শেষে বের হতেই দেখি আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে। এই আবহাওয়াটা যদিও আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরার তাড়া মাথায় নিয়ে রওনা হতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। এই রেহ! ছাতাই তো আনিনি। তাই আর এগিয়েও লাভ নেই। আবার ভার্সিটিতে গিয়ে ঢুকলাম। কোথায় যাব ভাবছি। হঠাৎ মনে হল, আরে ক্লাসে যাচ্ছি না কেন? যেই ভাবা, সেই কাজ। কিন্তু ক্লাসে গিয়েই আমি অবাকের চেয়েও বেশি অবাক হলাম। অবশ্য হাসিও পাচ্ছে খুব! একটা মেয়ের কান্না দেখে যদিও আমার মত ছেলের হাসি পাওয়ার কথা না। তবুও হাসি চাপাতে পারছি না!

–কিরে অরণী, কাঁদছিস কেন?

কোনো রকমে হাসি চাপিয়ে অরণীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। অরণী আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কারণ অরণীর সাথে সাধারণত কেউ কথা বলে না! টানা দুই বছর একসাথে ক্লাস করার পরও আমিও তো ওর সাথে কোনোদিন কথা বলিনি! অবশ্য ও বড়লোকের মেয়ে বলে অনেকে ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কেউই অরণীর সত্যিকারের বন্ধু না।

–জানিস তূর্য, আমাকে না রাজ অনেক বাজে বাজে কথা শুনিয়েছে! আমি এখন কি করব বলতো?

এতক্ষণে আমি অরণীর কান্নার অর্থ খুঁজে পেলাম। রাজ আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে। কথাবার্তায়, চালচলনে কেউই ওর সমান হতে পারবে না। আর অনেক ধনীও। আমি ভার্সিটির সেই প্রথম দিন থেকেই দেখছি, অরণী রাজের পিছনে ঘুরছে। রাজ ওকে তো পাত্তা দিচ্ছেই না, উল্টো যা নয় তাই বলে যায়। ইচ্ছে মত ওকে দিয়ে এটা ওটা করিয়ে নিচ্ছে। ক্লাসের যত এ্যাসাইনম্যান্ট আছে, সব তো অরণীই ওকে করে দেয়। তারপরেও মেয়েটাকে বাজেভাবে গালিগালাজ করে রাজ। শুধু অরণী বোকাসোকা আনস্মার্ট একটা মেয়ে বলে। রাজ পারেও বটে! রাজকেও অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। ও আমাদের ক্লাসেরই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে অর্পাকে পছন্দ করে। অর্পা আর রাজকে প্রায়ই একসাথে ঘুরতে, আড্ডা দিতে দেখা যায়। তারপরেও দেখছি অরণী হাল ছাড়েনি!

–কি বলল রাজ তোকে আজকে?

–আমি আজকে রাজকে আমার মনের কথা, আমার ফিলিংসের কথা সব বলেছি। কিন্তু ও আমাকে কি বলল জানিস? বলেই আবার ফোঁপাতে শুরু করল অরণী।

–আরে বলনা! এত নাটক করছিস কেন?

–ও বলেছে, কোনোদিন পেঁচা দেখেছ? আয়নায় গিয়ে দেখ, তাহলেই দেখতে পাবে! বলে ও আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে হাসাহাসি করেছে। এই বলে অরণী আবার কাঁদতে শুরু করল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি চাপিয়ে বললাম,

–আসলে কি হয়েছে জানিস? আমরা সবাই সবসময় সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে থাকি। যা আমার কোনোদিনই হবার নয়, তার দিকেই হাত বাড়াই। আমাকেই ধর, আমি ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই অর্পার উপরে ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন দিন গেল, তখন নিজে থেকেই বুঝলাম, ওর পিছনে ছুটে লাভ নেই। তাইতো এখন আর ওকে নিয়ে কোন ফিলিংস কাজ করে না।

–কিন্তু আমি যে রাজকে সত্যিই খুব ভালবাসি। আমি ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না আমি আর হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। হাসতে হাসতেই বললাম,

–তাহলে তো তোকে ম্যাডাম ফুলির মত চেঞ্জ হতে হবে। অর্পার মত না হলে তো রাজ তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না..

আমার কথায় দেখলাম অরণীর চোখ চকচক করছে! আমাকে জিজ্ঞেস করল,

–কিভাবে নিজেকে চেঞ্জ করব? বলনা! আমার হাসি এবার আর থামছে না। মেয়েটা আমার মজাকেও যে সত্যি ভাববে, তা কে জানত? কতক্ষণ হাসার পর খুব সিরিয়াস লুক নিয়ে বললাম,

–তোর গেট আপে চেঞ্জ আনতে হবে! তোর এই খ্যাত মোটা ফ্রেমের চশমা আর এই অতি সাধারণ লুক, সব বদলাতে হবে। আমি এবার অরণীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে বললাম,

–তোর চেহারা তো ঠিকই আছে, গায়ের রঙও ভাল। কিন্তু তুই তো একটু সাজিসও না। আর এত লম্বা চুলে বেণী করিস কেন? আসলেই তুই একটা খ্যাতের ডিব্বা!

–আচ্ছা, এগুলো চেঞ্জ করার জন্য কি কি লাগে? আমি এবার আরও সিরিয়াস লুক নিয়ে বললাম,

–সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনার! এবার আমার হাসি আর কোনো বাধাই মানল না। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।

–সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনার? ওরা কি করবে?

–ওরা তোর এই বোকা বোকা ভাব আর বোকা বোকা চেহারা চেঞ্জ করবে। বুদ্ধু কোথাকার!

বৃষ্টি থেমেছে। তাই আমি ওখানে বসে থেকে মেয়েটার বোকা বোকা কথা আর শুনতে চাইলাম না। অরণীকে ওখানে বোকার মত চিন্তিত অবস্থায় বসিয়ে রেখেই আমি হাসতে হাসতে চলে এলাম। কয়েকদিন পর।

অরণী এখন রাজের পিছনে না, বরং আমার পিছনে ঘুরছে। আর সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার মনে হচ্ছে আমি উটপাখির মত গর্তে মাথা দিয়ে মাটি চাপা দেই! কি যে করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ক্লাসের সবাই ভাবছে, অরণী এখন রাজকে ছেড়ে আমাকে ধরেছে। সুমন তো সরাসরি বলেই বসল,

–তূর্য, তোর তো দারুণ লাভ হয়েছে রে দোস্ত!

–কেন দোস্ত?

–আরে ব্যাটা আগে মিষ্টি তো খাওয়া!

–কারণ না বললে মিষ্টি খাওয়াব কিভাবে?

–আরে ব্যাটা এত ধনী একটা মেয়েকে পটাইলি, এখন তো তুই সোনায় সোহাগা!

–ধনী আবার কে?

–আরে আমাদের ক্লাসের ধলা চশমা, অরণী!

–ফালতু কথা বাদ দে। আমি গেলাম। বলে না হয় ওর কাছ থেকে ছোটা গেল, কিন্তু ক্লাসের বাকিরা? ওদের কাছ থেকে কিভাবে পালাব? কি বলব ওদেরকে? আজকে আবার অরণী আমার কাছে এসেছে। আজকে আর পালালাম না। যা হয় হবে,ওর মুখোমুখি হলাম।

— কি চাস তুই?

–এতবার তোকে ডাকি, তোর কি কানেও ঢোকে না নাকি? কানে তুলো দিয়ে রেখেছিস?

–আমি কানে ভালই শুনি। কি বলবি সরাসরি বল।

–সরাসরি বলার জন্যই তো তোর পিছনে এতদিন ঘুরছি!

–আরে বলনা!

–তুই যে সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনারের কথা বলেছিলি, ইটা একটু খুলে বল।

–আগে বল, আমি তোকে এই ব্যাপারে সাহায্য করলে তুই আমাকে আমার ব্যাপারে সাহায্য করবি?

–আচ্ছা করব।

–শোন, আমি যেটা এতদিনে বুঝেছি, তা হল, তোর সবকিছুতেই স্মার্টনেসের অভাব আছে।

তোর চলাফেরা, কথাবার্তায় চেঞ্জ আনার জন্য একটা সাইকিয়াট্রিস্ট আর গেট আপে চেঞ্জ আনার জন্য একটা ফ্যাশন ডিজাইনার লাগবে। এটাই আমি সেদিন বলেছিলাম। কোনোমতে একটা কিছু অরণীকে বুঝিয়ে দিলাম। কারণ আমার এখন দরকার ওর কাছ থেকে দূরে থাকা আর ক্লাসমেটদের বিরক্তিকর হাসাহাসি থেকে বাঁচা। অরণী আমার কথা শুনে বলল,

–সেটা নাহয় বুঝলাম। আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনার কোথায় পাই?

এবার আমি পকেট থেকে আমার চেনাজানা এক আপুর কার্ড বের করে অরণীর হাতে ধরিয়ে দিলাম। আমার চেনাজানা সবার কার্ড আমি সবসময় পকেটেই রাখি। অরণী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। আমি এতদিনে ওর হাসি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটার হাসিটা তো খুব সুন্দর! একেবারে যেন বুকে গিয়ে বিঁধে। আমি অরণীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ শুনলাম ও বলছে,

–কিরে, কিছু বলছিস না যে? আমি বাস্তবে ফিরে এসে বললাম,

–কি বলব?

–জিজ্ঞেস করছিলাম, তোকে কি ব্যাপারে যেন সাহায্য করার কথা বলছিলি। কাজটা কি?

–ও, হ্যা। কাজটা হল, এই এক বছর তুই আমার সামনে ভার্সিটিতে আসতে পারবি না। কোনো দরকার হলে ফোনে কথা বলবি, কিন্তু সবার সামনে কথা বলতে পারবি না। দেখছিসই তো, সবাই আমাদেরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা গুজব ছড়ায়, এতে তোরই ক্ষতি হবে।

–আচ্ছা ঠিক আছে। আর কিছু?

–আমার জন্য এইটুকু করলেই চলবে।

বলে আমার মোবাইল নাম্বারটা অরণীর হাতে দিয়ে চলে আসলাম। রাতে হঠাৎ দেখি আমার মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে লেখা- ‘তুই কি সত্যিই মনে করিস আমি চেঞ্জ হতে পারব?-অরণী’।

কেন যেন ওর প্রতি খুব মায়া হল। মনে হল মেয়েটাকে সাহস দেই। এই মূহুর্তে ওর সাহসের খুব দরকার। আমি ওকে সাহস দিয়ে মেসেজ পাঠালাম, ‘আমার বিশ্বাস, তুই একদিন নিজেকে চেঞ্জ করে খুব সহজেই রাজের মনে জায়গা করে নিবি। তখন দেখবি, তুই না, রাজই তোর পিছে পিছে ঘুরবে!’ অরণী রিপ্লাই দিল, ‘আমার এই বিপদের সময় তোর মত একজন ভাল ফ্রেন্ডের সাহসই আমার খুব দরকার ছিল রে।’

এরপরের দিন থেকে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ক্লাসে স্যার অরণীর রোল ডাকলে একটা বোরকা পড়া মেয়ে এটেনডেন্স দেয়। বুঝলাম, আমার সাথে যাতে দেখা না হয়, তাই অরণী বোরকা পড়া শুরু করেছে! আমি সেদিন বাসায় ফিরে অনেক হাসলাম। এত সহজ সরল মেয়ে আসলে আমি আমার জীবনে এই পর্যন্ত দেখিনি! এর কয়েকদিন পর দেখি অরণী আর কারো সাথেই মিশছে না! সবার থেকেই আলাদা হয়ে চলছে। তিন্নি ওর খুব ভাল ফ্রেন্ড। ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও রেগে বলল,

–ওই ম্যাডাম ফুলির কথা বলছিস? ওকে তো এতদিন আমরা ভালমত চিনতেই পারিনি যে, ও এত দেমাগি! কি হয়েছে জানিস?

–কি হয়েছে?

–অরণী সেদিন এসে আমাদেরকে বলেছে, ও নাকি নিজেকে চেঞ্জ করে ম্যাডাম ফুলি হবে! আমরা কি বলব? হাসতে হাসতেই গড়াগড়ি খাচ্ছি। বললাম, যা কখনো সম্ভব না, তা করার চেষ্টাও করিস না, পস্তাবি। আর তুই হবি চেঞ্জ? আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছিস? ও তখন কি বলল জানিস?

–কি বলল?

–ও বলল যে, আমরা নাকি কেউই ওর দুঃসময়ের বন্ধু না। বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল! ন্যাকা একটা।

আমি তিন্নির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝতে আর বাকি রইল না, অরণী নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছে! কেন যেন এই ভেবে অরণীর জন্য মন খারাপ হতে লাগল যে, এখন থেকে ওকে পুরো একাই চলাফেরা করতে হবে!

একবছর পর।

এত তাড়াতাড়ি যে কিভাবে একবছর পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না! এই বছরটায় অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। অবশ্য এই ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও বারবার কেন যেন অরণীর কথা খুব মনে হয়েছে! ওর সরলতা, প্রথম খেয়াল করা সেই মিষ্টি হাসি, ওর বোকা বোকা কথা, সবকিছুই বারবার মনে পড়তে লাগল। অরণীর এই এক বছরের পুরো একাকিত্বকে ভেবে কেন যেন ওর প্রতি আমার মায়া হতে লাগল। এই এক বছরে যে অরণীর সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ ছিল, তা না। প্রায়ই ওর খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে, সরাসরি না। টেক্সট করে। ওকে সাহস যুগিয়েছি, ওর হতাশা কাটানোর চেষ্টা করেছি। মাঝে মাঝে ওকে মজার কথা বলে হাসানোরও চেষ্টা করেছি। অরণীও কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে মেসেজ দিত।

আজ ভার্সিটি বন্ধ। তাই টিউশনি করানোর জন্য বিকালে বের হচ্ছি, হঠাৎ দেখি মোবাইলে অরণীর মেসেজ এসেছে। সেখানে লেখা- ‘এক বছর পর এখন তো আর তোর আমার সাথে সরাসরি দেখা করতে বা কথা বলতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না!’

আমি এর রিপ্লাইয়ে ‘না’ লিখে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর আর কোনো মেসেজই আসল না! দুইদিন পর। আজ ভার্সিটিতে গিয়ে দেখি একটা নতুন মেয়ে আমাদের ক্লাসে এসেছে! কিন্তু ভার্সিটির কোর্সের মাঝখানে কিভাবে নতুন স্টুডেন্ট ভর্তি হতে পারে, তা আমার মাথায় ঢুকল না। আর এই নতুন মেয়ের চেহারার সাথে কার যে চেহারার খুব মিল আছে, তাও মনে করতে পারছি না!

সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার মনেই হয়তবা একই প্রশ্ন, কে এই স্মার্ট মেয়েটা যে আমাদের ক্লাসের অর্পাকেও হার মানিয়েছে! স্যার ক্লাসে এসে যখন রোল ডাকছেন, সবাই খুব সাগ্রহে মেয়েটার রোলের জন্য অপেক্ষা করছিল। স্যার অরণীর রোল ডাকতেই মেয়েটা এটেনডেন্স দিল! সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আর আমি এতক্ষণে খেয়াল করলাম, হ্যা, এটাই তো সেই অরণী!ও যাই চেঞ্জ করুক, ওর তো চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্লাস শেষে আমি বের হয়ে যাচ্ছি, দেখি অরণী আমাকে পিছন থেকে ডাকছে।

–এই তূর্য, একটু দাঁড়া। আমি পিছন ফিরে বললাম,

–কি বলবি বল।

–আমি তোর সাথে বাসায় যাব। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারবি না?

আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আজকেও সেই এক বছর আগের মতই সবার দৃষ্টি আমার দিকে। কিন্তু সে দৃষ্টিতে এখন আর আগের মত বিদ্রূপ নেই, আছে হিংসা। আমি অরণীকে কিছু বলতে যাব, সেই মূহুর্তে দেখি, রাজ অরণীকে ডাকছে! অরণী প্রায় না শোনার ভান করে আমাকে টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। এরপরের দিনগুলো থেকে দেখা গেল, অরণী সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকে! ক্লাসের সবাই এখন ওকে ফ্রেন্ড বানাতে চায়, ওর সাথে মিশতে চায়, কিন্তু ও কাউকেই পাত্তা দেয় না। এর মধ্যে অনেকে ওকে প্রপোজও করে ফেলেছে। কিন্তু ও সারাক্ষণ আমার সাথেই আঠার মত লেগে থাকে।

আর সবাই আমার দিকে হিংসুটে চোখে তাকায়। আমার অবশ্য ভালই লাগে! কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, ও যদি সবসময়ের জন্য এভাবেই আমার সাথে আঠার মত লেগে থাকত! কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামাল দেই। এটা কখনওই হওয়ার নয়। একে তো আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির, তার ওপরে আবার রাজের জন্যই অরণী নিজেকে পরিবর্তন করেছে। সে রাজকেই পছন্দ করবে, আমাকে কখনোই করবে না। তিন সপ্তাহ পর। রাজ এতদিন অরণীকে কিছু বলার সু্যোগ পায়নি। কারণ রাজ ডাকলেই অরণী আমাকে নিয়ে প্রায় কোনোরকমে পালিয়েছে! আজকে আর রাজের সহ্য হল না। অরণী বের হওয়ার আগেই রাজ বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। যেই অরণী বাইরে বের হয়েছে, অমনি রাজ তার হাত ধরে বলল,

–চল আমার সাথে। অরণী বলল, যাব কিন্তু আমার সাথে তূর্যও যাবে! বলে আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে রাজ যেখানে অরণীকে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে নিয়ে চলল। তারপর রাজকে বলল,

–এবার যা বলার বল, তূর্যকে সামনে রেখেই তোমাকে বলতে হবে। রাজ আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলল,

–আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। তুমি কি আমাকে এখনো আগের মত ভালবাসো?

রাজের কথা শুনে প্রথমদিকে অরণী না করে দিল। কিন্তু রাজ অনেক কাকুতিমিনতি করার পর অরণী শেষ পর্যন্ত রাজি হল। আমি এরপর বাসায় ফিরে আসলাম। কিন্তু এক অদ্ভুত অনুভূতিতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম! রাজের সাথে অরণীর এই প্রেম হয়ে যাওয়ায় আমি খুশিও হলাম, আবার কেমন যেন কষ্টও আমাকে কুড়ে খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কি যেন হারিয়ে গেছে! খুব শূন্য শূন্য লাগছে সবকিছু। আমি কি তাহলে সেদিনই অরণীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, যেদিন প্রথম ওর মিষ্টি হাসিটা খেয়াল করেছিলাম? কিন্তু এখন আর বুঝে কি হবে? আমি তো এতদিন নিজেই নিজেকে বুঝতে পারিনি! যা হওয়ার সব তো হয়েই গেছে। সব শেষ এখন আমার!

অরণীকে এখন প্রতিদিনই রাজের সাথে বের হতে দেখি। আমাকে সময় দেয় না, তা না। ক্লাসে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকে, আর ক্লাসের পর রাজের সাথে। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয়, আমার সাথে অরণীর কাটানো সময়গুলো খুব তাড়াতাড়িই কেটে যায়! এখনো প্রতিদিন অরণীর সাথে মেসেজের মাধ্যমে কথা হয়। ও আমাকে প্রায়ই বলে একটা সুন্দর মেয়ে দেখে প্রেম বা বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু আমি তো ওর মাঝেই আটকে গেছি। অরণীই যে আমার প্রথম আর সত্যিকারের প্রেম, তা কি আমি তাকে কখনো বলতে পারব? নাকি নিজের মধ্যে চেপে রেখেই আস্তে আস্তে নিজেকে নিঃশেষ করে দেব?

এক বছর পর।

আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সবাই যার যার ভালবাসার মাঝে আজ সুখ খুঁজে নিচ্ছে! কিন্তু আমি যাচ্ছি অরণীর বাসায় অরণীর দাওয়াতে। সবাইকেই ও আজকে দাওয়াত দিয়েছে। অরণীর বাবা মা নাকি ওকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। তাই সে আজ সবাইকে ডেকেছে যাতে সবার সামনে রাজের সাথে ওর রিলেশনশিপের কথা এনাউন্স করতে পারে। আমি প্রথমে যেতে চাইনি। কি দরকার আমার কাটা ঘায়ে আরও নুনের ছিটা লাগানোর? কিন্তু শেষ পর্যন্ত অরণীর অনুরোধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

অরণীদের বাসায় গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। এত সুন্দর গোছগাছ বাসা আমি খুব কমই দেখেছি! বাসাটায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অরণীকে দেখতে পেলাম। এত সুন্দর লাগছে ওকে যে আমি চোখই ফেরাতে পারছি না ওর দিক থেকে! এখন আর সেই মোটা ফ্রেমের চশমা ওর চোখে নেই, তার পরিবর্তে এখন লেন্স পরে। শাড়ি পরে খুব সুন্দর করে খোঁপা করে খোঁপায় ফুল গুঁজেছে! এতেই এত অপূর্ব লাগছে ওকে!

আমাকে দেখেই অরণী তার চিরচেনা সেই মিষ্টি হাসিটা আমাকে উপহার দিল, যেটা দেখেই আমি প্রথম ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমিও অরণীর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি হাসলাম। তারপর ওর বাবা মা এল সবাইকে আপ্যায়ন করতে। খুব হাসিখুশি তাঁরা। মেয়ের পছন্দকেই উনারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। একটু পরেই অরণী এল। পাশেই রাজ দাঁড়িয়ে আছে। সে এসে বলল,

–আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালবাসা দিবস। আর তাই আজকেই আমি আমার পছন্দের মানুষের কথা সবাইকে বলতে চাই, যাকে আমি বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। যাকে আমি আমার একাকিত্বের সেই এক বছরে চিনতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি যে তাকেই আমার দরকার! তার চেয়ে যোগ্য আর ভাল ছেলে হয়তবা আমার জন্য কেউই হবে না। যার উৎসাহ প্রদানের জন্যই এতদূর অতিক্রম করে আমি নিজেকে জানতে পেরেছি, নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে পেরেছি। যার হয়ত টাকা নেই কিন্তু মেধা আছে, মানুষকে উপকারের মন আছে..

অরণীর কথাগুলো আমি শুনতে পাচ্ছি কিনা তাও টের পাচ্ছি না, নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আর প্রমাদ গুনছি। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার অরণী আর আমার থাকবে না। রাজের সাথে সুখের সংসার করবে সে, সাথে থাকবে সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা। আর চিন্তা করতে পারছি না আমি, চলে যাব ভাবছি। কিন্তু এখন এতজনের সামনে থেকে কি চলে যাওয়া ঠিক হবে? অরণী আবার বলতে শুরু করল,

–কেউ জানতে চাইবেন না এত কেয়ারিং সে ছেলেটা কে? সে হল আমাদের ভার্সিটিতে আমার ক্লাসেই পড়ুয়া তূর্য! আমি তাকেই ভালবাসি। আমি অরণীর কথা শুনে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! কিন্তু অরণী আমার দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে বলতে লাগল,

–তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছিলে আমি রাজকে ভালবাসি? কিন্তু তুমি ভুল ভেবেছ! আমি রাজকে ওভাবে ভালবাসতে পারিনি যেভাবে তোমাকে ওই একটা বছর ভালবাসা শুরু করেছিলাম! আমি যখন থেকে মানুষ চিনতে শিখেছি, তখনই বুঝেছি, রাজ নয়, তুমিই আমার যোগ্য। রাজ কখনোই আমার প্রেমে পড়েনি, পড়েছে আমার স্মার্টনেসের প্রেমে। আর এটা তো রাস্তার অহরহ ছেলেরাই পড়ে। কিন্তু তুমি ছিলে আমার বিপদে সাহস যোগানোর সত্যিকারের বন্ধু। আমি আমার সেই একাকিত্বের এক বছরেই তোমার প্রেমে পড়েছি, তূর্য। তোমার কি এর বিরুদ্ধে কোনো অবজেকশন আছে? আমি হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালাম। এই বোকা মেয়েটা যে কখন আমাকে ভালবেসেছে, আমি টেরই পাইনি!

আর রাজ? সে তো আমার দিকে তার ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! মনে হচ্ছে আমাকে হাতের কাছে পেলে সে আস্ত চিবিয়ে খাবে! অরণী এসে আমাকে বলল,

–কি হল? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু তো বল! আমি আনন্দে কি বলব খুঁজে না পেয়ে বললাম,

–তুই আমাকে তুমি করে বললি যে?

–এখন থেকে তুমিও তাই করবে। কারণ আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে হবে! বউকে নিশ্চয় ফ্রেন্ডের মত তুই করে ডাকতে পারবে না! ডাকলে তা বেমানান লাগবে।

–কিন্তু আমি কি তোমাকে সুখী করতে পারব?

–সুখ কি শুধুই টাকা-পয়সা দিয়ে হয়? তুমি আমার পাশে থাকলে আমি এমনিতেই সুখী হব। আর বাবা মা তো আমি যাকেই বিয়ে করি না কেন, তাতেই রাজি। কারণ উনারা আমাকে বিশ্বাস করেন। আর আমি তোমাকে।

–আমি কখনোই তোমার বিশ্বাস ভাঙব না, দেখো। বলে অরণীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তিন বছর পর।

–কি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারেন না? জানেন না, আপনি দেরি করে বাসায় ফিরলে বাবু রাগ করে! অভিমানী গলায় অরণীর কথা শুনে হেসে বললাম,

–বাবু রাগ করে নাকি বাবুর মা রাগ করে?

–দুজনেই!

–তাহলে তো রাগ ভাঙাতেই হয়। কিভাবে ভাঙাব?

–যদি বাবুর বাবা সারাক্ষণ বাবুর মায়ের পাশে থাকে তাহলে দুজনেরই রাগ ভাঙবে।

–আছি তো, সারাজীবন থাকব।

বলে অরণীর দিকে তাকালাম। অরণী আমার দিকে তাকিয়ে সেই মিষ্টি হাসি হাসল। যা দেখার জন্য আমি প্রতিনিয়ত ওকে খুশিতে রাখার প্রচেষ্টায় থাকি। এই তিন বছরে অনেক কিছু ঘটেছে আমাদের জীবনে, আর সবই সুখের ঘটনা। অরণী আমার জীবনে আসার পর থেকে যেন সুখে ভরে যাচ্ছে জীবন! আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছি। খুব ভাল বেতন পাই, আর সম্মানও। আর আমার অরণীও কম যায় না! সে এখন একটা কলেজের প্রফেসর। আমাদের এই সুখের সংসারে একটা নতুন অতিথি আসতে চলেছে! এর চেয়ে আনন্দের খবর আর আমার কাছে নেই। সবাই তাই আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে আমাদের বাবুটার জন্য দোয়া করবেন। ও যেন ওর মায়ের মতই সাহসী আর আত্নবিশ্বাসী হতে পারে।।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত