নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের টুকরোগুলো পেটকাটি-চাঁদিয়ালের মতো উড়তে উড়তে শেষমেশ গোঁত্তা খেয়ে আরব সাগরের জলে প’ড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়। চকিতে চোখের সামনে ভেসে উঠল ছেলেবেলার মাঠ, বিশ্বকর্মা পুজো, ঘুড়ি-লাটাই আরও কতো মিষ্টি মুহূর্ত। নীল সাগর, সবুজ মাঠ, লাল সূর্য-সবকিছু একাকার হয়ে ঘোর লাগায় চোখে, মনে জাগায় শিহরণ।
– কী ভাবছিস আনমনে?
আচমকা ঘোর কাটে অনুমিতার। রফিক এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। ও রফিককে ইশারায় বাইরেটা দেখায়।
– ওয়াও! আর্চিস গ্যালারি…।
রফিক স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে কাচের জানলার ধারে। অনুমিতা রফিকের হাত ধরে, চোখ রাখে বাইরে। নীরবতার কয়েক পল কাটে দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দে। রফিক উদাত্ত কণ্ঠে জয় গোস্বামীর কবিতা ধরে।
– “আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করল কৌতূহলে”
অনুমিতা সঙ্গত করে।
– “এই ছেলেটা
নাম কী রে তোর?”
– “আমি বললাম,
ফুসমন্তর!
মেঘবালিকা রেগেই আগুন,”
– “মিথ্যে কথা!
নাম কি এমন হয় কখনও?”
– “হোয়াটস দেয়ার ইন দ্য নেম?”
নামে কী যায়-আসে! অনুমিতা উচ্ছ্বসিত।
– এটা কিন্তু আউট অব দ্য বক্স।
– কথাটা শাশ্বত। তবু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শেক্সপিয়র কি একথা লিখতে পারতেন?
– মানে? অনুমিতা ভ্রূ নাচায়।
– মানেটা খুব পরিষ্কার অনু। বর্তমান পৃথিবীতে “রফিক” নামটাই সংশয়ের জন্য যথেষ্ট নয় কি? যে কোনও মুহূর্তে নামের পাশে ব’সে যাবে আইএসআইএস! অর্থাৎ জুটে যাবে জঙ্গি তকমা!
অনুমিতা কোনও উত্তর দিতে পারে না। অদ্ভুত নি:স্তব্ধতায় ছেয়ে যায় ঘর।
– লুক মাই বিলাভেড রোজ, তোর আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ কী জানিস? আমার নাম! এই যন্ত্রণা সারাটা জীবন কুরে কুরে খাবে আমাদের।
অনুমিতা রফিকের হাত চেপে ধরে।
– স্টপ ইট রফি। প্লিজ শাট ইওর মাউথ আপ!
রফিক হাসে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অনুমিতাকে।
– ফর গডস সেক… হোল্ড ইওর টাঙ অ্যান্ড লেট মি লভ!
সে অনুর কানে কানে বলে।
– চাল তোলো গো মাসিপিসি লালগোলা-বনগাঁয়…
– ধ্যাৎ! তুই একটা যা তা।
গোয়ার সন্ধ্যা বড়ো মায়াবী। এলইডি, এলসিডি-র ভিড়ে ঠাসাঠাসি গ্লো-শাইন, বারের ভেতর থেকে ছিটকে আসা ওয়েস্টার্ন মিউজিক, বিদেশিদের ইভনিং ওয়াক, ঝাঁ চকচকে চওড়া রাস্তা কিম্বা সি ব্যাংক– সবেতেই একটা ফেস্টিভ মুড আছে। রফিক আপন মনে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে গুনগুন করতে থাকে।
– ভালোবাসায় আলো আশায় তোমাকে চাই… এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই…
কিন্তু চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না! যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ল গোয়ার রাস্তায় প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ। নিয়ম বড়ো বালাই। হাঁটতে হাঁটতে ও আড়চোখে অনুমিতাকে দেখল। চোখাচোখি হতেই হাসি ফিরিয়ে দিল। ওর আর অনুর মাঝেও নিয়মের চোখ-রাঙানি! চাইলেই তো আর লাল গোলাপ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত অফ শপ থেকে ভদকা কিনল রফিক। অনুমিতা খেল পানিপুরি। তারপর রেস্তোরাঁ থেকে রুমালি রুটি আর চিকেন টিক্কা কিনে ওরা পা বাড়াল কোলভা বিচ রিসর্টের দিকে।
– রফি, ঐ দ্যাখ ফুল-মুন! আজ পূর্ণিমা রে…তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধায়িছে…।
গাইতে গাইতে আবেগে ভেসে যায় অনুমিতা। রফিক হাতের পেগটা শেষ ক’রে অনুর দিকে তাকায়। ওর চোখ দুটো চকচক ক’রে ওঠে।
– পূর্ণিমার চাঁদ… পূর্ণিমার চাঁদ আমার হাতের মুঠোয়! কে যেন বলেছিল ঝলসানো রুটি… বোগাস! এ কী! তোর গ্লাসটা তো ফাঁকা… দাঁড়া…
রফি ভদকা ঢালে অনুমিতার গ্লাসে। এগিয়ে যায় ওর কাছে।
– নে ধর।
– থ্যাংক ইউ!
অনু হাসে। হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় গ্লাস। আলতো চুমুক দেয়। হাই তোলে।
– রফি! তুই খু-উ-ব ভালো…এই! আমার অনারে একটা কবিতা শোনাবি? বাট, অন্যের কবিতা না। একেবারে ওরিজিনাল রফিক আসলামি চাই।
রফিক জানলায় চোখ রাখে। হারিয়ে যায় ভাবনার চোরাস্রোতে।
– চাঁদ কথা দিয়েছিল আমার ঘরে আসবে
আজও আসেনি সে।
চাঁদ বলেছিল আমায় ভালোবাসবে
তবু ভালোবসেনি যে!
বুকে আমলাশোল ছুটে ছুটে মরি
দ্বীপ থেকে দ্বীপে…
আজ গ্যালাক্সি কাল মিল্কিওয়ে ধরি
জন থেকে জনান্তিকে!
অনু রফিকের কাঁধে মাথা রাখে।
– অ-সা-ধা-র-ণ! নাম কী হতে পারে?
– কাস্ট আওয়ে।
– বাহ, চমৎকার। আমরা প্রায় সকলেই জীবনের কোনো না কোনো দিক থেকে থ্রোন আওয়ে। তাই না রফি?
রফিক অনুর চোখে চোখ রাখে। অনু ব’লে চলে।
– এই যেমন আমি, অনুমিতা চ্যাটার্জি-আমাকেই দ্যাখ না! একটা চনমনে চিরহরিৎ গাছকে কী অবলীলায় নিয়মের কাঁটাতারে বেঁধে দেওয়া হলো, অনুষ্ঠান ক’রে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভূত-ভোজনের মধ্যে দিয়ে! আর আমি-লড়াই ক’রে, সেবা ক’রে, ফল দিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে নিজে মরছি তিলে তিলে। আমার স্বপ্ন, ভালোবাসা, লক্ষ্য-সবটাই কি “দাস ক্যাপিটাল”? প্রতিদিন একটু একটু ক’রে “রক্তকরবী”র অংশ হয়ে উঠছি। হাঁপিয়ে উঠছি সিস্টেমের জাঁতাকলে সহবাসে শীৎকারে! তবু অশান্ত বুকে খুঁজছি রঞ্জনকে। এখানে নন্দিনীরই প্রাণের বড়ো আকাল। এ অরাজক সমাজ সংসার আমার কাছে ঘোর নষ্টনীড়! এই রকম মাৎস্যন্যায়ের মাঝে তুই এলি অভাগীর জীবনে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না রঞ্জন! আমাকে নিয়ে উল্টেপাল্টে খেল… I বাঁচা আমায়…আমি মরব, তোর বুকে মাথা রেখে…
একটা বড় হাই তোলে অনু। ওর চোখদুটো ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে।
কেমন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা খেলা করতে লাগল গোটা ঘরজুড়ে। রফিক সহসা কোনও কথা বলতে পারল না। সিগারেট ধরিয়ে জানলায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। চোখ রাখে বাইরে। গোয়া শহরটা যেন ধীরে ধীরে রোমানিয়া হয়ে উঠছে!
– মিরচা এলিয়াদ!
অস্ফুটে ঠোঁট নাড়ে রফিক। অনু চোখের জল মুছে তাকায় ওর দিকে।
– লা ন্যুই বেঙ্গলি!
– কী বলছিস রফি?
– সাল উনিশশো তেত্রিশ। রোমানিয়ান লেখক, দার্শনিক মিরচা এলিয়াদ লিখলেন “লা ন্যুই বেঙ্গলি”। এক বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বাঙালি মেয়ের নিষিদ্ধ প্রেম। শুরু হলো হৈ চৈ। চারদিকে ছি: ছি: রব উঠল মিরচার বিরুদ্ধে।
– ফাক অফ দিস সোশ্যাইটি! এক ছাদের তলায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করলে এরা সার্টিফিকেট দেয়। অথচ একটু শান্তির খোঁজে ব্যালকনিতে পা রাখলে সেটা অবৈধ হয়ে যায় সবার কাছে। আমি এই সমাজকে স্বীকার করি না। যে যোগ্য আমি তার কাছে চলে যাবো। যে লড়াই ক’রে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করবে তারই হবে যোগ্যতমের উদ্বর্তন… দ্রৌপদী শুধুমাত্র তার।
কথা শেষ ক’রে অনু রফিকের কলার চেপে ধরে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। এ যেন যোগ্যতমের পুরস্কার। কিছুক্ষণ একে অপরের মধ্যে ডুবে থাকার পর রফিক বলে,
– তুই এবার থেকে কবিতা ট্রাই কর।
– পাগল! ওটা আমার দ্বারা এ-জীবনে হবে না।
অনুমিতার সপ্রতিভ উত্তর। কিন্তু রফিক নাছোড়বান্দা।
– E=mc2…মনে আছে?
– প্লিজ রফি! এখন আর ফিজিক্স কপচাস না।
– থিওরি অফ রিলেটিভিটির সূত্র…
-– নট লিসনিং টু ইউ!
– মোদ্দাকথা হলো অণুর মধ্যে কী পরিমাণ শক্তি নিহিত আছে সেটা ধারণাতীত!
– গো টু হেল!
– আরে বাবা তুইই তো অনু। সো ট্রাই টু ব্রিড পোয়েট্রি।
– ওহ, রফি…ইউ মেড মি ক্রেজি!
রফিকের পিঠে আছড়ে পড়ল আলতো ঝাপট। সে, খালি গ্লাস দুটো টেবিলে রাখল। তারপর বোতল হাতে অনুমিতার দিকে তাকাল। অনু বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে আলুথালু বেশে কোঁকড়া চুলে। রফিক এক ঝলকের জন্য তসলিমা নাসরিনকে দেখতে পেল! নারীর অধিকারের পক্ষে অনুমিতার সওয়াল-জবাবে বুঁদ হয়ে রইল সে।
– তোর কাছে প্যারাসিটামল হবে?
অনুমিতা ঠোঁট নাড়ে। রফিক এগিয়ে যায় ডিভানে রাখা ব্যাকপ্যাকের দিকে।
– ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
আলতো হাই তুলে প্রশ্ন করল অনুমিতা।
– প্যারাসিটামল আনতে, ব্যাগে আছে।
– থাক… আর আনতে হবে না। এদিকে আয়।
রফিক খাটের পাশে দাঁড়ালো।
– বল।
অনু রফিকের হাত ধরে বিছানায় টানে। ওর শরীর থেকে একটার পর একটা পোশাক খুলতে থাকে উন্মত্তের মতো। উদম রফিককে ঠেসে ধরে বুকে। ফিসফিস ক’রে বলে,
– ফুটপাথে হা-ঘরে হ্যাংলা, মন তবু জীবন মানে জি-বাংলা! এখনও বুঝলি না…
অনু ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে, ঝিমোয়। রফিক স্থির থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে ওর আঙুলগুলো পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে ছাড়াতে থাকে অনুর শাড়ি, ব্লাউজ, অন্তর্বাস।
– সর্বিট্রেট… তোমায় নতুন ক’রে পাবো ব’লে হারাই ক্ষণে ক্ষণ… তোমায় ছুঁতে চাওয়া এই মন নি:স্তব্ধ অনুক্ষণ…
কথা শেষ হয় না অনুর। নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় রফিক। গভীর থেকে গভীরতর শব্দ। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল! প্রাণপণে টেনে তোলে অনুকে। অনু এলিয়ে পড়ে। ঠোঁটের কোণে লালা। গা ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। রফিকের কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিচে নেমে আসে। সে অনুর পোশাক ঠিক করতে থাকে।
– অনু! এই অনু… কী হয়েছে তোর? কথা বল… এই অনু!
সর্বশক্তিতে ওকে ঝাঁকাতে থাকে। পায়ের তালু দু’হাতে ঘষতে থাকে পাগলের মতো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই অনুর পা ছেড়ে দেয়। তন্নতন্ন ক’রে খোঁজে গোটা ঘর। শেষে বিছানায় পড়ে থাকা জিনসের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একশো ডায়াল করতে গিয়েও থমকে যায়। ছুটে যায় বিছানায়। উত্তেজিত রফিক বালিশটা টেনে অনুকে ঠিক ক’রে শোওয়াতে যেতেই ওর বুকের ভেতরটা ধড়াস ক’রে উঠল! বালিশের নিচে ট্যাবলেটের পাতা…খালি! Zolpidem Ambien…! রফিক ধপ ক’রে ব’সে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে। ওর কানে বিসর্জনের বাজনা বাজছে! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ঢাকের বোল-ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন! রফিক শান্ত হয়ে ব’সে থাকে অনুমিতার হিমশীতল শরীর আঁকড়ে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ঠোঁটদুটো। বিড়বিড় ক’রে আওড়াতে থাকে,
– ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ… নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়: … ন হন্যতে হন্যমানে ন শরীরে!
রফিক অনুমিতার চোখে চোখ রাখে। মণিদুটো পাথরের মতো স্থির! পরক্ষণেই টালমাটাল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। ওর দৃষ্টি শূন্য। শেষরাতে হোটেলের দরজা খুলে বাইরে বেরোয়। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া সমস্ত চরাচর নি:স্তব্ধ! ঘুমন্ত শহরকে পিছনে ফেলে সে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে বালির ওপর দিয়ে। মিশে যায় নীল নির্জনে।