তবে আজ মনে হয় নিজেকে বোঝাতে একটু বেশী সময় নিয়ে নিয়েছে সে।তাই ডাইনিং টেবিলে বসে ঘড়ি দেখে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল মুক্তি।কারণ, স্যার আজ অফিসে গেলে প্রথমে তারই ডাক পড়বে ; তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই,আর দেরী না করে ব্যাগে একটা আপেল জলদি করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মুক্তি।দেরী হলে সেদিন সবই মনে হচ্ছে দেরী করিয়ে দেয়।রাস্তায় রিক্সাও কম দেখা যাচ্ছে।
কি ব্যাপার! আবার হরতাল – টরতাল নাকি! নাহ্, তা হবার তো কথা না – মনে মনে ভাবতে লাগলো সে।
আকাশটা কেমন যেন মেঘলা লাগছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে। সাথে সাথে ব্যাগে হাত দিয়ে দেখলো আজ ছাতাটা আনা হয়নি। এরপর কোনমতে একটা রিক্সা পেয়ে জলদি উঠে পড়লো।
এর মাঝে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।
– আহ্ ! কি সুন্দর একটা পরিবেশ।এমন দিনে কারো কি মন চায় কাজে যেতে।
কিছুক্ষণ পর, রিক্সাওয়ালা কিছুটা চেঁচিয়ে,
– ‘খালা, আমার ভাড়াটা দেন তো? ‘
– ‘দেব না কেন, আজব তো! চেঁচিয়ে বলবার কি আছে! খালা কে আপনার? আপা বলেন।’
– ‘জে আফা, আমি অনেকবার কইছি।আপনে তো কিছু কন না, আমি কি করুম! ‘
মুক্তি ভাড়া মিটিয়ে যখন রিক্সা থেকে নামতে নিল আর, ওমনি স্যান্ডেলটা গেল ছিঁড়ে।
ওফফ্! এখন এটাই বাকি ছিল আজকের জন্যে।
মুক্তি তার কলিগ রাসেলকে ফোন দিল।
-‘ ভাইয়া, স্যার কি এসেছেন? ‘
– ‘ না, আজ আসবেন না বোধহয়। একটু আগে ফোন দিয়েছিলেন,আজকের মিটিং ক্যানসিল করতে। উনি অসুস্থ। ‘
মুক্তি এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
যাক বাবা, এবার স্যান্ডেল কেনার সময় পাওয়া গেল।কিছুদূর এগিয়ে একটা দোকান থেকে স্যান্ডেল কিনে এবার, হাঁটতে লাগলো অফিসের পথে।
পেছন থেকে একটা বাইক বার বার হর্ণ দিচ্ছে বার বার।মুক্তি পেছন ফিরে তাকালো না।কারণ, সে তো ফুটপাত দিয়েই হাঁটছে।
– ‘ কি ব্যাপার মুক্তি! এতগুলো হর্ণ দিলাম তুমি তাকাচ্ছো না যে? ‘
মুক্তি চমকে গেল,
– ‘আরে রাহাত!‘
-‘অফিস ফাঁকি দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে।আমাকে কি একটু ডাকা যেত না ম্যাডাম?’
– ‘আরে কি যে বলো রাহাত!অফিসেই যাচ্ছি এখন। ‘
– ‘আজ বিকেলে আমার সাথে এক জায়গায় তোমাকে একটু যেতে হবে।’
-‘আমি জানি, তুমি কোথায় যাবার কথা বলছো।কিন্ত আজ না। আমাকে কটা দিন সময় দাও।আমি নিজেই তোমাকে জানাবো।’
রাহাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তি অফিসে কাজে মন দিল।
রাহাতের সাথে মুক্তির সম্পর্কের শুরুটা ছিল সেই কলেজ জীবন থেকে।এখন যদিও চাকরির কারণে দুজনকে কিছুটা ব্যস্ত থাকতে হয়।তাই, রাহাত আর দেরি না করে বিয়েটা সেড়ে নিতে চায়।তবে মুক্তি এ ব্যাপারে কিছুটা উল্টো।মুক্তির এই নিস্তেজ অভিব্যক্তি রাহাতকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে। মুক্তির জীবনটা ছোটবেলা থেকেই ছিল একটু অন্যরকম।যে সময়টায় সবাই বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত, মুক্তি যেত তার মামার সাথে।যদিও, তার আদরের কোন কমতি ছিল না কারো কাছে।মা, নানু আর মামা – এদের ঘিরেই মুক্তির পরিবার। একটু বড় হবার পর সে জানতে পারে যে, কোন এক দুর্ঘটনায় তার বাবার মৃত্যু ঘটে।আর, মুক্তির দাদাবাড়ির কারো সাথেই ওদের কোন যোগাযোগ নেই।কেন বা কি জন্যে এগুলো আজও বোধগম্য নয় তার কাছে।রাহাতদের বাড়িতে গেলে হয়ত এসব নিয়ে নানান প্রশ্ন করা হবে তাকে।যদিও রাহাত এসব নিয়ে মুক্তির কাছে তেমন কিছু জানতে চায় নি, কিন্ত তারপরও…..
মুক্তি মনে মনে ঠিক করলো আজ বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে।রাতে খাবার পর মুক্তি দুকাপ কফি নিয়ে মায়ের রুমে ঢুকলো, রাহাতদের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলার জন্যে।তবে মায়ের সাথে কথা বলেও তেমন কিছুই হলো না।মায়ের ওই একই কথা,
– ‘ওদের বলে দিস, আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই, ওরা খারাপ মানুষ ব্যাস।এখন যা এখান থেকে। আমার মাথা ধরেছে।’
এটা কেমন কথা। রাহাতের পরিবার যদি মাকে এই প্রশ্ন করে, সে কি একথা বলতে পারবে কখনো।রাগের মাথায় কি সব যে বলে মা!
মুক্তি এবার মামাকে ফোন দিল।মামা কয়েক বছর হলো জাপানে আছেন।তাকে এই ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে বললে হয়ত এড়িয়ে যাবেন না।তবে মুক্তির জানা ছিল না যে,মামাও তাকে নিরাশ করবে।মামা জানালো,
– ‘তোর বাবার কথা আর কি জানতে চাইবে, সে তো আর নেই।আর,দাদাবাড়ির কথা বলে দিস তারা অশিক্ষিত ধরনের লোকজন। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার মতো না।’
মুক্তি আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিল।খুব রাগ লাগছে মামার ওপর।মামার কথা শুনে মনে হয়- মুক্তি আজও সেই ছোট মুক্তিই আছে। একটুও বড় হয়নি!
মুক্তির মা,মিতা পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক।তাই অনেক সকালে তাকে বেড়িয়ে পড়তে হয়।এরপর নানু আর নাতনী একসাথে সকালের নাস্তাটা করে।আজ মুক্তি নাস্তা করে অফিসে গেল না।বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল।কিছুক্ষণ পরে নানু এল মুক্তির রুমে।
-‘ কিরে অফিসে যাবি না? ‘
-‘ না, ফোন করে দিয়েছি। আজ যাবো না।’
-‘ কেন কি হয়েছে, আবার শরীর খারাপ নাকি? ‘
– ‘ না,কিছু না। এমনি।’
– ‘ কি হয়েছে বল আমাকে? ‘
মুক্তি চুপ করে বসে রইল।
– ‘ কি রে বল? ‘
মুক্তি নানুকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
– ‘ওরে বাবা কি মেয়ে রে! ব্যাথা লাগছে, মেরে ফেলবি নাকি! হয়েছে টা কি? ‘
মুক্তি সব কথা নানুকে খুলে বললো।
-‘নানু, রাহাতের কথা না হয় বাদই দিলাম।আমার কি বাবার সম্পর্কে জানার কোন অধিকার নেই?আমি তো কিছুই জানি না বাবার কথা। ‘
– ‘ তুই হয়ত সহ্য করতে পারবি না, তাই তোকে বলা হয়নি।’
-‘মানে !? ‘
এরপর নানুর কথাগুলো সত্যিই মুক্তির জন্যে সহনীয় ছিল না।
-‘একাত্তরের সময় সবাই যখন দেশকে স্বাধীন করার নেশায় মত্ত।তোর বাবা তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে হাত মেলায়।আর নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়।এসব নিয়ে তোর মায়ের সাথেও অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে।তোর তখন এইসব বোঝার বয়স হয়নি।’
-‘মানে, রাজাকার ছিল! নানু? ‘
-‘তোর বাবা মুক্তিবাহিনী কখন কোথায় আছে, এসব খবর ওই দস্যুদের এনে দিত।একদিন তোর বাবা পাশের গ্রাম থেকে তিন-চার জন যুবতিকে ধরে নিয়ে আসে।ওই নড়পশুদের ভোগের জন্যে।আর, তোর মা ঘরটার তালা খুলে মেয়েগুলোকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।এতে তোর বাবা অনেক ক্ষেপে যায় মিতার ওপর।ওকে অনেক মারধোর করে।মিতা হঠাৎ বিছানার ওপর তোর বাবার অস্ত্রটা দিয়ে তাকে গুলি করলো। পরপর তিনটা।’
নানু আর কথা বলতে পারছিল না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।মুক্তি দৌড়ে পাশের রুম থেকে নানু ইনহেলারটা এনে দিল।
-‘ এরপর মিতাকে সাথে নিয়ে আমি আর তোর মামা ঢাকা চলে এলাম। ‘
মুক্তির খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্ত সে আজ কাঁদবে না।কেন কাঁদবে, আর কার জন্যে কাঁদবে!
রাতে মুক্তি কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।মা আর নানু কেউ জোর করলো না ওকে।সকালে মিতা মেয়ের রুমে গিয়ে বসলো।মুক্তি বিছানায় চুপ করে বসে আছে।
– ‘ তোর কি খুব খারাপ লাগছে মা? ‘
-‘ না, মা।খারাপ লাগবে কেন! আমার মা-তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার আবার কষ্ট কিসের।তুমি হয়ত দূর-দূরান্তে গিয়ে যুদ্ধ করো নি।তবে, তুমিও একজন সাহসী যোদ্ধা মা।’
মিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে মেয়ের চোখ মুছে দিল।
-‘ মা আমাকে কি একটু তোমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে।এখানে কেমন যেন ভাল লাগছে না।আর,শোন তুমি কিন্ত একদম টেনশন নেবে না।আমি একদম ঠিক আছি।এই দেখো আমাকে, কিছুই হয়নি আমার।শুধু একটু সবুজ ঘাসের মাঝে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে খুব ইচ্ছে করছে।’
মিতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।আজ, তার আর কোন দুঃখ নেই হয়ত।যে কথাগুলো মুক্তির অজানা ছিল,সেসব জানার পর সে তার মাকে এত বড় সম্মান দিয়েছে। সেই ছোট্ট মুক্তি আজ সত্যিই অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।