রোবট বয়ফ্রেন্ড

রোবট বয়ফ্রেন্ড

অবনী অনেক্ষণ থেকে অয়নের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের তিন বছরের সম্পর্কের মধ্যে বহুবার অবনী এই রেস্টুরেন্ট এ বসে অয়নের জন্য এভাবে অপেক্ষা করেছে। তবে ঐ অপেক্ষা আর আজকের অপেক্ষার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে।আজকে অবনী অয়নের সাথে একটি সমাধানে যেতে চায়।অবনীর বারবার মনে হচ্ছে এটাই অয়নের জন্য ওর শেষ অপেক্ষা।

ঐ তো অয়ন রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকছে।তার পরনে হালকা নীল রংয়ের শার্ট। অয়ন কী জানে এই রংয়ে ওকে রাজপুত্রের মতো লাগে। অয়ন অবনীর সামনের চেয়ারে সেই চিরপরিচিত ভঙ্গীমায় বসলো। অয়নের দিকে তাকিয়ে অবনীর বুকটা হু হু করে উঠলো। অবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো “অয়ন এখন আমার কী করা উচিত?
অয়ন অনেকটা বিরক্তিপূর্ণ গলায় বললো দেখো অবনী এই মুহুর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। অবনী কথাটা শুনে বিদ্রূপের হাসি হেসে বললো আমি জানতাম তুমি একথাই বলবে।শুধু এখন কেন কোনদিন ও তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

:মানে?
: কিছুনা। (অবনী অয়নের দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিয়ে বললো) এই নাও।
: যা বলার মুখে বলো। এখন কোন চিঠি পড়তে পারবো না।
: পড়া না পড়া তোমার ব্যাপার।আমার যা বলার তা এই চিঠিতে লিখে দিয়েছি।ইচ্ছে হলো পড়ো নয়তো ডাস্টবিন এ ফেলে দাও। এখন আমি চলি।ভালো থেক।

এই বলে অয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অবনী চলে গেল।অয়ন কিছুটা অবাক চোখে অবনীর চলে যাওয়াটা দেখলো।অবনী চোখের আড়াল হলে অয়ন চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো তুমি যখন চিঠিটা পড়তে শুরু করবে তখন হয়তো তোমার জীবনে আমার আর কোন অস্হিত্ব থাকবেনা। খুব অবাক হচ্ছ তাই না? অবাক হওয়ারই কথা।তোমাকে এই চিঠিটা আরো অনেক আগে দেওয়া উচিত ছিল।কিন্তু পারিনি।একজন মানুষ কে চিনা খুব একটা সহজ নয়।এই দেখ না তোমাকে চিনতে চিনতে তিনটি বছর লেগে গেল। চিঠিটা লিখতে গিয়ে বার বার চোখের সামনে তোমার সাথে কাটানো ভালো ভালো মুহুর্ত গুলো ভেসে উঠেছে। তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম।

তুমি নিজেই সেই স্বপ্ন আমার মাঝে বুনে দিয়েছিলে।আমার আর তোমার বিয়ে নিয়ে তোমার মাঝেই সবচেয়ে বেশী উৎসাহ ছিল।তোমার এতো উৎসাহ দেখে আমি তোমাকে বিয়ে পাগলা বলে ডাকতাম।তুমি সবসময় আমার কতো খেয়াল রাখতে।আমার সামান্য মন খারাপ হলে তুমি আমার মন ভালো করার জন্য কত কী না করতে।আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান ভাবতাম। আমাদের সম্পর্কটা কত সুন্দর আর সাবলীল ছিল। কিন্তু যেদিন আমার বিয়ের জন্য আমার উপর আমার পরিবার থেকে চাপ আসতে শুরু করলো সেই দিন এই সম্পর্কের সুর জানি কোথায় কেটে গেল। আমার পরিবারের কাছে তোমার বাবা মা কে পাঠানোর কথা বলায় তুমি যে ভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলে তখনই তোমার চোখ দেখে বুঝেছিলাম তুমি আর যাই করো এ বিয়ে তুমি করবে না।তারপর নানাভাবে নানান অজুহাত তুমি দেখিয়েছ। তোমার প্রত্যেকটা যুক্তি ছিল নড়বড়ে। এমনকি তুমি অনেক স্মার্টলি আমাকে এটা বুঝিয়ে দিয়েছ যে তোমার পরিবারের যোগ্য আমি নই।

সেইদিন বুঝে গিয়েছিলাম তুমি আসলে আমাকে ভালোইবাসো না।আমার জীবনে তুমি ছিলে রোবট বয়ফ্রেন্ড।আমার প্রতি তোমার কোন ভালোবাসা ছিল না,ছিল ভালোলাগার একটা মোহ।আমিও কত বোকা।তোমার মোহ কে ভালোবাসা ভেবেছি। অথচ তুমি কোনদিন ভালোইবাসো নি। শুধু আমাকে কেন তোমার মতো ছেলেরা কাউকে ভালোবাসতে জানে না।তুমি শুধু প্রেম প্রেম খেলা খেলতে জানো মেয়েদের সাথে। আমার জন্য তোমার ভালোবাসা আর একটা সিগারেটের জন্য তোমার ভালোবাসা একই জিনিষ।

আজকের পর হয়তো তুমি তোমার বন্ধুদের কে হাসি মুখে বলবে “দোস্ত পুরাই ব্রেক আপ।প্যারা বন্ধ।” তারপর হয়তো অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। আমার কথা তোমার মনেও পড়বে না। একদম যে মনে পড়বে না তা না।যখন দেখবে তোমার নতুন প্রেমিকা ভালো বারবিকিউ চিকেন বানাতে পারবে না তখন ভাববে, ইস আগেরটা পারতো।যখন তেমার বন্ধুরা তাদের কোন গার্ল ফ্রেন্ডের ছবি দেখাবে তখন মনে মনে ভাববে আমি এর চেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে ডেটিং করেছি।

তোমার সব মনে পড়া আমার রান্নার skill আর আমার চেহারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রতিদিন তোমার একটা ফোনের জন্য আমার ব্যাকুলতা তুমি বুঝবেনা।গত তিন বছরে পাঠানো অসংখ্য মেসেজ হয়তো তোমার কাছে ছেলেমানুষি বলে মনে হবে।তুমি সেই মেসেজগুলো তোমার বন্ধুদের দেখিয়ে বলবে “দেখ আমার জন্য কতো সুন্দরী মেয়েরা পাগল।” আমার ভালোবাসার কোন মর্মই তুমি বুঝবে না।তোমার কাছে তিন বছর প্রেম করার পর ব্রেকআপ আর তিন মাস প্রেম করার পর ব্রেকআপ একই জিনিষ।

তুমি অরুনিতার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছ চার মাস হচ্ছে।অথচ এই কথাটা তুমি আমাকে একবারো বলার প্রয়োজন মনে করনি।তুমি যদি একবার মুখ ফুটে বলতে যে তুমি আমায় ভালোবাস না তাহলে তখনি আমি তোমার আর অরুনিতার মধ্যখান থেকে সরে যেতাম। কিন্তু তুমি তা করনি।আমি তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম। আর সেই তুমি আমায় অন্ধ প্রমাণ করে দিলে।

এই দুই মাস থেকে আমি প্রচন্ড মানসিক চাপে ছিলাম।কেননা আমার পরিবার আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমি সকল কিছু সহ্য করেছিলাম এই ভেবে যে তুমি আমায় ভালোবাস। কিন্তু তখন ও বুঝতে পারিনি যে আমি ভুল ভেবেছিলাম। তুমি আমাকে ঠকিয়ে জিতে গেলে।আর আমি তোমাকে ভালোবেসে হেরে গেলাম।তার জন্য আমার কোন আফসোস নেই। তোমার জন্য আমার এখন করুণা হচ্ছে।একদিন তুমি বুঝবে তুমি পেয়েও কী জিনিষ অবহেলায় হারালে।

জানি না আর কোনদিনও তোমার সাথে দেখা হবে কী না।ভালো থেক সবসময়।আজ থেকে তুমি মুক্ত। গুড বাই রোবট বয়ফ্রেন্ড।” চিঠিটা পড়ে বিদ্রূপে ঠোট উল্টালো অয়ন। সস্তা ডায়লগে পরিপূর্ণ একটা চিঠি।অয়ন নাকি আফসোস করবে। তাও ওর জন্য? হাহ্। অবনী রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে গেল।ওর গলায় কান্না দলা পাকিয়ে আছে।সে চায় না তার এ কান্না কেউ দেখুক। আজ নিজের হাতে সে ভালোবাসার বাধন কেটে দিয়ে এসেছে। যে সম্পর্কের কোন ভিত্তি নেই সে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না।

অবনী বিকেল বেলায় ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অয়নের কথা ভাবছিল। তার তো ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না। তাহলে অয়ন কেন এটা করলো? সেতো আমার একজন ভালো বন্ধু ছিল। আমার জীবনে সে এল বসন্তের মতো।নিজের রংয়ে আমায় রাঙিয়ে দিল। কিন্তু যাবার সময় আমার জীবনের সবটুকু রং মুছে দিয়ে চলে গেল। কী পেল অয়ন এটা করে? কী লাভ হলো তার? এ প্রশ্নের উত্তর অয়নই ভালো দিতে পারবে। না অনেক কেঁদেছি আর না। যে নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যেতে চায় তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াই ভালো। জোর করে আর যাই হোক সম্পর্ক গড়া যায় না। একজন প্রতারকের জন্য আমি আর চোখের জল ফেলবো না। কিছুতেই না।

তিন বছর পর অয়ন আজ নিলীমার সাথে দেখা করতে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে এসেছে। নিলীমা এখনো আসে নি। অয়ন অপেক্ষা করছিল বসে বসে।হঠাৎ সে একটা মেয়েকে রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকতে দেখল। মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথায় যেন দেখেছে মনে হচ্ছে।মেয়েটি যখন তার পাশের টেবিলে এসে বসলো তখন অয়ন চিনতে পারলো। আরে এতো অবনী।অবনীর সাথে একটা এক বছরের পরীর মতো ফুটফুটে মেয়ে। এই মেয়েটা কী অবনীর? হবে হয়তো।

অবনীর বিয়ের খবর সে পেয়েছিল।তখন ওর মনে হয়েছিল যাক ভালোই হয়েছে।কিন্তু আজ অবনীকে দেখে অয়নের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।সে কী একবার গিয়ে জিঙ্গাসা করবে যে অবনী কেমন আছে? ও কী কথা বলবে আমার সাথে? সব দ্বিদ্ধা কাটিয়ে অয়ন অবনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, কেমন আছো অবনী? অয়নকে দেখে অবনী কিছুটা অবাক হলেও সহজ গলায় উত্তর দিল, ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?

: এইতো ভালো। এটা কী তোমার মেয়ে?
: হ্যা।
: দেখতে অবিকল তোমার মতো হয়েছে। তা তুমি একা যে? তোমার হাজবেন্ড আসেননি?
: ও অফিসের কাজে দেশের বাইরে গেছে।
: ওহ। (অয়ন জিঙ্গাসা করবে না ভেবেও জিঙ্গাসা করে ফেললো) তুমি সুখীতো অবনী?
: ( অবনী কড়া ভাষায় উত্তর দিল) তুমি কী ভেবেছ তোমাকে জীবনে পাইনি বলে আমি জীবনে সুখী হবো না?

হ্যা আমি সুখী। তুমি একদিন আমি তোমার যোগ্য নই বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে তার যোগ্য মনে করে এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। সেই দিন যদি তোমার কাছ থেকে এইভাবে প্রত্যাখ্যাত না হতাম তাহলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না যে আমার স্বামী আমাকে কতটা ভালোবাসে।সে আমার জীবনে ভালোবাসার কোন অভাব রাখেনি। সেই দিন তুমি অবহেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে বলে আজ আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি কতটা ভাগ্যবতী। আজ আমি বুঝেছি যে আমি নই তুমিই আমার যোগ্য ছিলেনা। এই সময় নিলীমা কে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে অয়ন অবনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলীমার সামনে গেল। নিলীমা জিঙ্গাসা করলো ঐ মেয়েটি কে?

: আমার ভার্সিটির বন্ধু।
: ওহ।

অয়ন এই প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলো অবনী নিলীমার চাইতে দেখতে সুন্দর। অবনী হাসলে গালে টোল পড়তো।
নিলীমা বসে বসে পা দোলাচ্ছিল। অবনী বসে বসে পা দোলানো পছন্দ করতো না। এই প্রথম অয়নের মনে হলো বসে বসে পা দোলানো একটা বিশ্রী ব্যাপার। নিলীমার সাথে অয়ন ঘন্টাখানেকের মতো ছিল।সে পুরোটা সময়ই অবনীর কথা ভেবেছে।অবনী কী কী পছন্দ করতো,আর কী কী অপছন্দ করতো।আজ অবনীর সকল পছন্দ, অপছন্দের সাথে অয়নের পছন্দ অপছন্দ মিলে যেতে লাগলো।

সন্ধ্যা বেলা অয়ন আনমনে হাটছিল আর অবনীর কথা ভাবছিল। সে কিছুতেই অবনীকে ভুলতে পরছিল না। অথচ সেই তো অবনীকে নিজের হাতে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তাহলে আজ কেন অবনীকে দেখার পর থেকে ওর বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে? কেন বার বার মনে হচ্ছ ওর গলার মধ্যে ভারী কিছু একটা আটকে আছে? তাহলে কী অবনীকে সে ফিরে পেতে চায়? হ্যা চায়। অবনীকে ওর জীবনে ফিরে পেতে চায়। কিন্তু অবনী যে আজ অন্য কারো। যখন অবনীকে হাত বাড়ালেই জীবনে সে পেতে পারতো, তখন তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু আজ যখন সে অবনীকে চাইলেও ফিরে পাবেনা তখন সে নিজের সবটুকু দিয়ে অবনী কে ফিরে পেতে চাচ্ছে। হায়রে মানুষের মন। যখন যা পাওয়া যায় তখন তা পেতে চায়না। কিন্তু যখন তা শত চেষ্টা করেও পাওয়া যাবে না জানে, তখন তা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত