অনুরক্তি

অনুরক্তি

সেসময় আদিবা পলিটিক্স করত।তুখোড় পলিটিক্স।ক্যাম্পাসে তার বিশাল হাঁক-ডাক।শুনেছি সামনে ছাত্র সংসদে সে বড় পদে থাকতে পারে। তাকে আমি প্রথম দেখি এখানে ভর্তি হওয়ার দিন।আমরা লাইন ধরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে ভর্তির কাগজ জমা দিচ্ছিলাম হটাৎ কোথা থেকে বিশাল এক মিছিল আসল আমাদের সামনে এবং সেখানে লিড দিচ্ছিল আদিবা।

স্লোগানে স্লোগানে তার পুরো মাতাল অবস্থা।সেই তাকে প্রথম দেখা,সেই তার প্রতি প্রথম মজা।সে আমার দু বছরের সিনিয়র।এরপর থেকে তাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখতাম, তাকে একপলক দেখার জন্য তার মিছিল, মিটিং এ কোন কারন ছাড়াই যেতাম।কিন্তু মন থেকে তার পলিটিক্স কে ঘৃনা করতাম। কারন তাদের মোটো ছিল নিয়মের বাইরের মতাদর্শের,নিষিদ্ধ ।ইভেন লেখালেখির সূত্রে তাদের বিরুদ্ধে সবসময়ই আমার কলম চলত।কিন্তু তার প্রতি কখনই একবিন্দু ঘৃনা জন্মেনি আমার মনে। এভাবেই দুবছর নিজের কাছেই আমার ভালবাসা বেড়ে চলল কিন্ত তাকে জানানোর সাহস করতে পারলাম না।

চারুকলার ছাত্র আমি।সামনে এক ইন্টারন্যাশনাল আর্ট কনটেস্টে আমাদের কয়েকজন বন্ধুর একটা এক্সিবিশন ছিল।আর সেসময় ক্যাম্পাসেও তুমুল গন্ডগোল চলছিল। আদিবাদের দল তাদের কি যেন একটা দাবি না মানায় পুরো ক্যাম্পাস অচল এবং সব ডিপার্টমেন্টে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।সমস্যা ছিল না কিছুই কিন্তু একটা জায়গায় আমাদের বড় সমস্যা দাড়িয়েছিল। আমাদের এক্সিবিশনের থিম পেপারগুলো ডিপার্টমেন্টেই ছিল।সেগুলো আমাদের বের করার খুবই দরকার ছিল, না হলে আমরা কাজ করতে পারতেছিলাম না। বাধ্য হয়ে আমি আমার টিমের মেম্বারদের নিয়ে তালা ভাংগার সিধান্ত নেই।

সে অনু্যায়ী আমার পেপার নিয়ে যখন ব্যাক হচ্ছিলাম তখন কই থেকে আদিবা আমাদের সামনে এসে অগ্নিমূর্তি ধারন করল। এবং তার পেছনে অনেকগুলা ছেলেপেলে।আদিবা আমাদের জেরা করতে শুরু করল, কোন সাহসে আমরা তালা ভাঙ্গলাম,আমরা কোন দল করি,কে আমাদের পাঠিয়েছে এসব প্রশ্ন।উত্তরে আমি আমাদের সত্যি কারণটাই বললাম। তারপরো সে আমাদের যাতা কথা শোনাচ্ছিল এবং আমাদের মারার হুমকি দিচ্ছিল। এবার আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই তার মতাদর্শকে আমি মানি না। আমার কি যে হল জানিনা তার সাথে ছেলেপেলে আছে যেনেও তার সামনে গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলা শুরু করলাম,

hey apu,who are u?you are none but a general student like us. Don’t be lofty. You must be a leader of your team but not us.It’s our right to collect our papers from department.So don’t panic.Look at yourself,u just lose your women sight besides politics. Be good with general student.

এই কথাগুলো বলার পর তার ছেলেপেলে আমাকে মারার জন্য অলমোস্ট চলে আসতেছিল। সেসময় আদিবাই তাদের থামায় এবং বলে একে এভাবে শাস্তি দিলে হবে না। একে আরো কঠিন উপায়ে শাস্তি দিতে হবে। এর পর থেকে আমাদের প্রতিটা মিছিল, সভায় তাকে যেন উপস্থিত পাই এই হবে তার শাস্তি এবং সেটা কনফার্ম করার দায়িত্ব তোমাদের।

তারপর থেকেই শুরু হল আমার নিয়মিত হাজিরা।যেখানেই আদিবার প্রোগ্রাম থাকত সেখানেই তার ছেলেপেলে হল থেকে এসে আমাকে নিয়ে যেত। আমিও চলে যেতাম কারন তাকে দেখতে পেতাম। দেখা যাচ্ছে সে স্টেজে দাঁড়িয়ে আমি স্টেজের সামনে এক সাইটে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।ভাষন দেওয়ার মাঝেমধ্যে আদিবা আমার দিকে তাকাতো কিন্তু আমি তার সাথে চোখ মেলাতে পারতাম না। ইভেন আদিবা যখন শহরের বাইরে কোথাও বা ঢাকায় কোন সম্মেলনে যেত আমাকে নিয়ে যেত এবং বাসে তার পাশের সিটে আমাকে বসাত। তার সাথে আমার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হত।

এগুলাকে ঠিক আলোচনা বলা চলে না, বরং এগুলো একপ্রকার ঝগড়াই। কারন সবসমই আমাদের মত ভিন্ন হত। সে যদি তার দলের ভাল দিক বলত পরেক্ষনেই আমি তাদের দোষ টা দেখিয়ে দিতে দেরি করতাম না৷ এভাবে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতে, অনেকটা সময় কাছাকাছি থাকাতে আমরা মনের দিক থেকেও কাছাকাছি চলে আসছিলাম। আমি তো তার প্রতি আগে থেকেই দুর্বল ছিলাম, এবার সেও আমাকে তার ভেতরের কথা জানান দিল। তার সাথে আমার যেদিন ঝামেলা হল,তাকে যেদিন আমি ওভাবে কথাগুলো বলেছিলাম সেদিনি নাকি সে মন হারিয়েছে। এই জন্যেই সে আমাকে সাথে সাথে রাখার ব্যাপারটি ঘটিয়েছিল।আমার আর কি, যাকে মনে মনে বাসনা করেছি সে যদি এভাবে হাত বাড়ায় তবে কি তা ছেড়ে দেওয়া যায়।

শক্ত করে তুলে নিলাম সে হাতের মোলায়েম। এরপর ক্যম্পাসের প্রতিটি ধুলোবালি,শহরের সকল যান্ত্রিকতাকে আমরা আমাদের কথার জানান দিলাম। আদিবা যেমন তুখোড় পলিটিশিয়ান ছিল, তেমনি সে অচিরেই হয়ে উঠল তুখোড় প্রেমিকা। সে সারাদিন আমার সাথে থাকতে চেত।যেকোনখানেই আমরা পাশাপাশি হাটলে সে মাস্ট বি আমার হাত জড়িয়ে ধরে রাখত। আমরা প্রতিদিন রিকশা করে ঘুরতাম। আদিবা শাড়ি পরে আসত। তার চেহারায় কি এক যে মায়া ছিল শাড়ি পড়লে তা কোটি গুন বেড়ে যেত। বাইরের জগতে অসম্ভব বাগপটু,ভয়হীন সেই মেয়ের দিকে যখন আমি তাকাতাম তখন কিন্তু সে লজ্জায় মুখ তুলতেই পারত না, ঘেমে টেমে একাকার । দু চার মিনিট কোন কথাই বলতে পারত না সে। এই বুজি মেয়ে মানুষের আজন্ম স্বভাব।সুন্দর,কোমল,মোহময়!

এভাবেই সপ্নাতুর আমাদের দিনগুলো পার হচ্ছিল।আমি তখনো টুকটাক লেখালেখি চালাতাম।আদিবা আমার কাছে আসলেও তার দলের মোটো কোনভাবেই আমার মন ছোঁয়নি। সেটা ছিল আগের মতই ঘৃন্য।তো রিসেন্ট ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা দিয়ে অনলাইন ফোরামে আমি একটা আর্টিকেল লিখি। এর জন্য আদিবার দলের ছেলেপেলে আমার ওপর খুব ক্ষেপে যায়, এবং আমার সাথে আদিবার মেলামেশাকেও ঠিক ভাবে মেনে নিতে হয়ত পারছিল না তারা।যার ফলস্বরূপ এক সন্ধায় একা পেয়ে আট-দশ জন আমাকে বেদম মারতে শুরু করে।আদিবা কই থেকে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসে এবং চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে তোমরা ওকে ছেড়ে দাও,প্লিজ ছেড়ে দাও।আমি পলিটিক্স ছেড়ে দিব, আমার পদও তোমাদের দিব, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও,ছেড়ে দাও। আদিবাকে ওভাবে আমি কোনদিন কাঁদতে দেখিতে, হয়ত এই ক্যাম্পাসের কেউ কোনদিন দেখেনি।

তারপর কেটে গেছে চল্লিশ বছর।সেদিনের পর রাজনীতি ছেড়ে আদিবা এখন পাক্কা ঘরনী৷ আজো যখন চোদ্দহাজার ছয়শত দিন পর আদিবার দিকে তাকাই, তার চেহারায় সেসময়কার শক্তপোক্ত ভাব,সেই গাম্ভীর্যটা খুজে পাই যদিও বয়সের ভাড়ে সে আজ ওত চঞ্চল নেই।আজও মনে পড়ে সেই সব বিকেলগুলো, শহরের টং দোকানগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া। মনে পড়ে সেই সব গোধূলি বেলা,মনে পড়ে সেই সব গোধূলি বেলায় আদিবার শাড়ি পড়া বিমূর্ত ছায়া। সে আমার ছিল।তার পায়ের আংগুল থেকে তার মাথার চুল সব আমার ছিল,সব আমার আছে,সে আমার।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত