সেদিন ছুটির দিনের বিকেলে আমি আমার সাঙ্গো পাঙ্গো অর্থাৎ আমার পাড়াতো বান্ধবীদের নিয়ে মাঠের কোণে কামিনী গাছের নিচে বসে ফুটবল খেলা দেখছিলাম। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত ফুটবল ম্যাচ খুব দারুণ ভাবে উপভোগ করছিলাম। বিবাহিত ভাইগণ বেশ ভালো খেলছিল। অবিবাহিত দলটাকে বেশ দূর্বল মনে হচ্ছিল। আসলে বউয়ের দোয়া বলেও একটা ব্যাপার আছে। যে যুগ এসেছে প্রেমিক প্রেমিকাদের তো কোনো ঠিকানা নেই, আজ এর তো কাল ওর, অবশ্য এটা আমার ধারণা। তাই ঠিকানাবিহীন সম্পর্কের দোয়া বোধ হয় আল্লাহ্ কবুল করেন না।
বিবাহিত দল একটা গোল দিয়েছে কিন্তু অবিবাহিত বালক মার্কা তরুণরা পনেরো মিনিটেও তা পরিশোধ করতে পারেনী। বল সারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। ফুটবল আসলে আমার প্রিয় খেলা। একটা বল নিয়ে এত জন কামড়া কামড়ি করে আর খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়রা ধুপধাপ পড়ে যায় বলেই হয়ত এটা আমার প্রিয় খেলা। অবিবাহিত দলের একটা ছেলেও বেশ ভালো খেলছিল। ঐ ছেলেটা বিবাহিতদের একটা গোল খাওয়াবে খাওয়াবে ভাব হঠাৎ ছেলেটা বলটাকে লাথি না মেরে পাশের সহখেলোয়াড় কে কষে একটা লাথি মারলো। আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারলাম না যে, সে এটা কেনো করলো!
ফলাফল যা হবার তাই হলো, দু জনই একটা বড় সড়ো আছাড় খেলো। যাই হোক ডাক্তারের মত দৌড়ে সেখানে গেলাম, যদিও আমি ডাক্তার নই কিন্তু কৌতুহল বসতো গেলাম। গিয়ে দেখি ছেলেটার চশমাটা ইন্তেকাল করেছে। বাহ্! এমন সুপারহিট দৃশ্য দেখে তো আমার চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো। আমি কিছু না বলে থাকতেই পারলাম না। আসলে আমি চমকপ্রদ কোনো দৃশ্যে টাস্কি খেয়ে হা হয়ে থাকতে পারি না তাই বললাম-
-“এই চশমুদ্দীন তুই চোখে ভালো দেখিস না তাহলে খেলতে কেনো এসেছিস? কোন্ হতচ্ছাড়া তোকে খেলতে অনুরোধ করেছে রে?”
কাঁনা মানে অন্ধরা ঠিক যে ভাবে দেখার চেষ্টা করে ঠিক সেভাবেই ক্যাবলা কান্ত চশমুদ্দীন চশমা ছাড়াই আমাকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেখতে পেলো কি না ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু সে চোখ টিপ টিপ করে আমাকে দেখার চেষ্টা করেই চলেছে। বড্ড অসহায় প্রাণী মনে হলো ছেলেটাকে কিন্তু আমার দয়া মায়া কিচ্ছু হলো না। বুঝি না কেনো যে আমার মনে দয়া মায়ার পরিমাণ এতটা কম বা কিনচিত কেনো!
পরদিন বিকেলে মাঠে গিয়ে দেখি ঐ চশমুদ্দীন মাঠের কোণে ঐ কামিনী গাছের নিচে বসে আইসক্রীম খাচ্ছে। সে খাওয়ার কি ছিরি! বাচ্চাদের মত চেটে চেটে খাচ্ছে। মনে হচ্ছিল কেজিতে পড়া কোনো বাচ্চা বসে বসে আইসক্রীম খাচ্ছে। আর আমার বসার যায়গাটাকে এমন ভাবে দখল করে আছে যেনো ওটা ওর বাপের যায়গা। দেখেই আমার খুব রাগ হলো তাই খুব তাড়া তাড়ি ওর সামনে থেকে চলে এলাম। আসলে আমি ভীষণ রাগী টাইপের মেয়ে, রাগ হলে চিৎকার না করলে ভাল্লাগে না।কিন্তু ঐ কাঁনার সাথে চিৎকার করার মুড ছিল না আমার। এর একটা বিশেষ কারণ হলো ঠান্ডা লেগে আমার গলা বসে গেছিল তাই হয়ত ঐ চশমুদ্দীনকে বাধ্য হয়েই মাফ করলাম। আসলে আমার এই সব মাফ টাফ করতে অসহ্য লাগে।
এরপর থেকেই রোজ চশমুদ্দীন ঐ রেজিষ্ট্রি করা যায়গায় বসে থাকে আর হরেক রকমের বাচ্চাদের খাবার খায়। যেমন- ক্যাটবেরী, চিপস,আইসক্রীম, ললিপপ, ঝালমুড়ি আরো নাম না জানা অনেক কিছু। জানি না ওর এসব খাওয়া দেখে আমার কেনো এত রাগ হয়! মূলত আমার রাগ হবার জন্য বড় সড়ো কোনো কারণের দরকার হয় না। হুদাই রেগে মেগে পায়চারী করাটা আমার স্বভাব। আর এই জঘন্য স্বভাবের জন্য পাড়ায় আমার বেশ বদনাম আছে। পাড়ার ছেলেরা যে অগচরে আমাকে গুন্ডী আপা ডাকে সেটা আমি জানি। এসব নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আম্মু বলে এমন স্বভাবের মেয়েকে কে বিয়ে করবে? সবে এস.এস.সি. পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি, এখনো বালিকা বালিকা একটা ভাব আছে আর এর মধ্যেই বিয়ে নিয়ে খোটা! আমিও আম্মুকে বলে ছিলাম যে,
-“বাল্য বিবাহ নিয়ে কথা বললে তোমাকে পুলিশে দেবো”
আমার কথা শুনে আম্মু কোনো রূপ ভয় না পেয়ে রেগে গেছিল। মনে মনে ভেবে ছিলাম আম্মু বোধ হয় সিংহ রাশির রমনী। অবশ্য আমি জানি না যে, মেয়েরা সিংহ রাশির হয় কি না। কিন্তু ঐ চশমুদ্দীন যে কন্যা রাশির হবে সে ব্যাপারে আমি শিওর। মনে মনে ভাবি ঐ চিকনা তালপাতার সেপাই এত খাবার রাখে কই? একদিন দেখি ঐ আবুল্যা চশমুদ্দীন ফুচকার দোকানে দাড়িয়ে এত্ত বড় হা করে ফুচকা খাচ্ছে আর দোকানী কে বলছে-“মামা একটু বেশী টক দিয়েন!”
ছেলেরা মেয়েদের মত টক খায় এই ব্যাপারটা আমি মানতেই পারি না। ওর টক খাওয়া দেখে চরম রকমের অসহ্য লাগছিল। পরের দিন ওকে মাঠে বসে থাকতে দেখে ভাবলাম ওর খানা পিনা নিয়ে কিছু বক্তব্য ঝেড়ে আসি, আর সহ্য হচ্ছে না আমার। যথারীতি গেলাম সেখানে, বাবুকে কিছু বলবো হঠাৎ দারুন একটা ফুলের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল। মনে মনে বললাম, আহ্! কি সুইট গন্ধ! কোথা থেকে আসছে? কামিনী গাছে তো ফুল নেই, তাহলে? আবিষ্কার করলাম ঐ চশমুদ্দীনের চুল থেকে গন্ধটা আসছে। ঐ ক্যাবুল্যা মফিজ মাথায় এমন ভাবে তেল দিয়েছে যে, মনে হচ্ছে গোবর দিয়ে কেউ উঠোন লেপেছে। আহা কি দারুণ দেখাচ্ছে তাকে! আবার মুখে একটা ললিপপ। এমন চমকপ্রদ দৃশ্য দেখে আমি ভুলেই গেলাম যে ওকে আমি আসলে কি বলতে এসেছি।
আমি চশমুদ্দীন কে জিজ্ঞেস করলাম-” বাচ্চাদের মত ললিপপ খাচ্ছিস, আবার মেয়েদের মত মাথায় তেলও তো দিয়েছিস দেখছি, তা কি তেল মাখা হয়েছে?” সে আমাকে টাস্কি খাওয়ার মত উত্তর দিল-” ঘরে বাপ ভাই নাই, ছেলে দেখলেই ইফটিজিং শুরু করেন, গুন্ডা গুন্ডা ভাব দেখান, লজ্জা নেই নাকি এ পাড়ায়?” ওর কথা শুনে আমি তো হা আর আমার সাঙ্গোরাও। আমার সাথে আমাদের গোটা পাড়ার নামে অপবাদ! এই প্রথম শুনলাম পাড়ারও লজ্জা থাকতে হয়। আর পাড়া আবার নির্লজ্জও হয়+ এই প্রথম আমি টাস্কি খেয়ে হা করে দাড়িয়ে আছি আর সে খুব ভাব নিয়ে মনযোগ সহকারে ললিপপ চেটে চলেছে। আমি মনে মনে সিনেমার একটা ডায়লগ ছাড়লাম-“কুল বেবী কুল” তবুও আমি কুল হলাম না। কোনো মতে রাগ কন্ট্রোর করে বললাম-“এই চশমুদ্দীন তোর নাম কি রে?”
সে বেশ ভাব নিয়ে বললো-“লেবু” আমি তো অবাক! মানুষের নাম আবার লেবুও হয়? বললাম-“দেশে কি এতোই নামের আকাল ছিল যে তোকে সব্জির ঝুড়ি থেকে নাম ধার করতে হবে?” সে আর কিছু বলার প্রয়োজনই বোধ করলো না। সরাসরি ইগনোর করলো আমাকে। ওর সাহস দেখে রাগে আমার মাথা পুরাই হট হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে যদি ঝড় হতো আর সেই ঝড়ে যদি গাছের একটা ডাল ভেঙে ওর মাথায় পড়তো তাহলে খুব ভালো হতো। মনে মনে আল্লাহ কে বললাম-“হে আল্লাহ সারা এলাকায় না হোক এই কামিনী গাছে অন্তত একটা বড় সড়ো ঝড় প্রয়োগ করো” রাগের ঠ্যালায় ওকে ওকে অপমান করার চেষ্টা করলাম।
আমি-“তো আপনি কি লেবু? কাগজি লেবু, বাতাবী লেবু, চায়না লেবু নাকি কমলা লেবু?”
নো উত্তর, আরে ওয়াহ! চুপ থেকে রীতিমত আমাকেই অপমান করলো! একদিন কলেজ থেকে বান্ধবীদের সাথে কফিশপে গিয়ে দেখি ঐ চশমুদ্দীন তার বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ব্ল্যাক শার্ট, মাথায় তুলে রাখা সানগ্লাস আর ঝরঝরে চুলে চশমুদ্দীন কে বেশ ঝাক্কাছ লাগছে। পাঙ্কু পাঙ্কু ড্রেসআপ আর চশমা ছাড়াই চশমুদ্দীন? সব চেয়ে বিস্ময়কর হলো ওর হাতে আইসক্রীম বা ললিপপ নেই, আছে একটা কফি মগ। আমাকে দেখেও সে না দেখার ভান করলো, ভাব খানা এমন যেনো আগে কখনোই সে আমাকে দেখেনী,আর যেনো দ্বিতীয়বার তাকানোর মত তেমন সৌন্দর্য্যও আমার মধ্যে নেই। সে ভাব দেখাকগে, তাতে আমার কি? কিন্তু আমার চোখ বার বার ওর দিকেই চলে যাচ্ছে কেনো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। অবাধ্য চোখের অত্যাচারে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন বিকেলে সে আবার মাঠে বসে কি যেনো খাচ্ছিল, চানাচুর হবে হয়ত। এমনিতেই ওকে দেখলে আমার রাগ হয়, খাদ্য হাতে দেখলে রাগ ডাবল হয়ে যায়। আমি মাঠে গিয়ে ওর সামনে দাড়াতেই সে বলল-“চানাচুর খাবে?” ওর কথা শুনে আমার মেজাজ তেলের মত ফুটতে শুরু করলো। এই পেটুক ছেলেটা আমাকেও পেটুক ভাবতে বসেছে নাকি? আমি ওর মত অতো খাই খাই মার্কা নই। সে হঠাৎ বলে বসলো-” এই তুমি না বেশ সুন্দর, তোমার নাম কি?” ওর কথা শুনে আমি তো অবাক বনে হারিয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম-“কে কোথায় আছিস রে আমি হারিয়ে গেছি, আমাকে খুঁজে বের কর তাড়াতাড়ি!”
আমি বললাম-“আমার নাম পটল, আলু, বেগুন বা ঢেঁড়স নয়”
সে-“তাহলে কি ফুলকপি তোমার নাম গুন্ডা আপা?”
বলেই সে অপমান জনক একটা হাসি ছেড়ে দিলো। আমার মেজাজ এবার এত্তো খারাপ হলো যে মনে হচ্ছিল ওকে গাছের ডালের ঝুলিয়ে রাখি তারপর ডালটা কেটে দিই। মনে মনে বললাম-“কুল বেবী কুল” তবুও যেনো হতচ্ছাড়া হাটখুরে কুল আসছিলই না। আমার মনে হচ্ছিল ঐ চশমুদ্দীনের সব চুল গুলো টেনে ছিড়ি তার সাথে ওর কান দুটোও। চুল আর কানবিহীন ওকে কেমন লাগবে চোখ বন্ধ করে সেটা কল্পনাও করে নিলাম। সেদিন সারা রাত আমি জেগে কাটিয়ে ছিলাম। সারা রাত শুধু ভেবেছি ওকে কি করে শিক্ষা দেয়া যায়। ওকে শিক্ষা না দিলে আমি বোধ হয় বাঁচবোই না এমন একটা পরিস্থিতি আমার।
পরদিন সে যখন বিকেলে মাঠে এসে বসে ছিল তখন আমি আমাদের বুয়া কারিনাকে সাথে নিয়ে মাঠে গেলাম। আমাদের বুয়ার নাম রমেলা কিন্তু সে কারিনা ভক্ত তাই আমি ওকে কারিনা বলেই ডাকি। বেচারী বেশ খুশি হয়। আসলে ওকে খুশি করার জন্য আমি ওকে কারিনা বলে ডাকি না। কাউকেই খুশি করতে আমার ভাল্লাগে না। ওর রমেলা নামটা আমার একদম পছন্দ নয় আর সিনেমার নায়িকাদের কাজের লোক ভাবতে বেশ লাগে। কারিনা যখন ঘর মোছে তখন আমি নায়িকা কারিনাকে কল্পনা করি, বলিউড হিরোয়িন আমার ঘর মুছতেছে। এই দৃশ্যটা আমাকে আনন্দিত করে।
কারিনাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে জোর করে ঐ চশমুদ্দীনকে কারিনার সাথে ছবি তুললাম। ছবি উঠানোর সময় কারিনা নায়িকাদের মত ভঙ্গিমা করছিল কিন্তু মফিজটার সেকি ছটফটানি, কি কি সব বলছিল-“ভালো হবে না কিন্তু, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, তোমরা মেয়ে নাকি অন্য কিছু, দেখে নেবো ইত্যাদি ইত্যাদি।”
ছবিটা তুলার পর মনে মনে খুব শান্তি পেলাম। আর ঐ চশমুদ্দীন টাস্কি খেয়ে হা হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর যখন ওর জ্ঞান ফিরলো তখন সে আমাকে যা কিছু বললো তাতে আমিই টাস্কি খেলাম-“তুমি নারী নামের কলঙ্ক, তোমাকে যে বিয়ে করবে তার জীবণটা ছার পোকা হয়ে যাবে, তার জীবণ পোস্টমর্ট্যাম হবে, তার জীবণটা আগুনের সমুদ্র হবে, তার জীবণ অক্সিজেন বিহীন হবে, হ্যান হবে ত্যান হবে ইত্যাদি” মনে হচ্ছিল সে ক্লাশ টু এ পড়ে আর মুখস্ত ছড়া বলছে সে। আমি ওর দুঃখটা বুঝলাম তাই হট হলাম না। যাবার সময় সে বলে গেলো-“শাড়ী পরবে সাথে চুরিও, তাহলে মেয়ে মেয়ে লাগবে আর মনটাও তাহলে মেয়েদের মতই মায়াবী হবে, না হলে তোমার কখনো বিয়েই হবে না”
সে চলে গেলো কিন্তু এ কি বলে গেলো? আমার কানে স্কুলের ঘন্টার মত কথা গুলো ঢং ঢং করে বেজেই চলেছে। মনে হচ্ছিল আমি কি তবে মেয়ে নই? সত্যিই আমাকে কি কেউ বিয়ে করবে না? সে না করুকগে, আই ডোন্ট কেয়ার। সেলোয়ার কামিজ কি তাহলে মেয়েরা পরে না? আমি ছোট বেলা থেকে কখনই শাড়ী পরিনী। অতো বড় শাড়ী কোথায় আটাবো এই সব নানান ভাবনায় শাড়ী ছুয়ে দেখা হয়নী। কিন্তু বেশীর ভাগ ছেলেরাই শাড়ী খুব পছন্দ করে জানি। বাট আমার এই সব ভাল্লাগে না। আর ছেলেরা পছন্দ করে বলেই হয়ত আমার ভাল্লাগে না।
পরদিন বিকেলে চশমুদ্দীন আর মাঠে এলো না। বুঝলাম গতকালের টনিকে সে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনী নিশ্চয়ই! মনে হয় ওর জ্বরসহ ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেছে, কারিনার সাথে ছবি উঠা বেচারা হজম করতে পারেনী বোধ হয়। এই সব ভেবে বেশ ভাল লাগছিল। হঠাৎ একটা বালক বয়সী ছেলে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেলো। ছেলেটা এক রকম ভয়ে ভয়েই আমার হাতে চিঠিটা দিয়েই দৌড়ে চলে গেলো। ওটাকে চলে যাওয়া বললে ভুল হবে, আসলে সে পালিয়ে গেলো। হাসিই পেলো, সবাই আমাকে এত ভয় পায় কেনো সেটা আসলেই করার মত কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো আমাকে কে চিঠি দেবে? খাম হাতে অনেক ভেবেও আমি বুঝলাম না যে, আমাকে আবার কে চিঠি লিখে পাঠাবে। চিঠিটা খোলার কোনো আগ্রহ নেই আমার তাই ডায়নিং টেবিলে রেখে রুমে চলে এলাম। কারো ইচ্ছে হলে পড়বে। আমার আম্মু আমার রুমে এসে বললো-“এই যে মিস টাইগার প্রেম পত্র কেউ ডায়নিং টেবিলে রাখে তা এই প্রথম জানলাম” আম্মুর মুখে প্রেম পত্র শুনে যতোটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশী রাগ হলো
আমি-“কি ফালতু কথা বলছো আম্মু?”
সে-“তাহলে নিজেই দেখে নে”
আমি-“ধুর আমার এসব পড়তে ভাল্লাগে না, চিঠি বোধ হয় ভুল ঠিকানায় এসেছে, তাই ওটা পাশের বাসায় দিয়ে এসো যাও”
সে-“চিঠি সঠিক ঠিকানাতেই এসেছে রানী সাহেবা”
আমি-“তাহলে ওটা মনে হয় কারিনার চিঠি”
সে-“মোটেও এটা কারিনার চিঠি নয়”
আমি-“তাহলে ওটা তোমার চিঠি”
সে-“আজব আজব কথা বলা তোর স্বভাব সেটা আমি জানি তাই বলে এই বয়সে কেউ আমাকে প্রেমপত্র লিখবে এটা কোনো বিশ্বাস যোগ্য কথা হলো?”
আমি-“লিখতেই পারে, যে যুগ যামানা পড়েছে, তাতে অসম্ভব বলে কিছু নেই”
সে-“চিঠিতে তোর নাম লেখা আছে বুঝলি?”
আমি-“তাই নাকি? আচ্ছা পড়ে শোনাও”
আম্মু অবাক হলো না কারণ জানেই আমি এমন ননসিরিয়াসই। আম্মু বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে রোমান্টিক স্বরে পড়তে শুরু করলো। মনে হলো চিঠিটা আম্মুকেই লিখেছে আম্মু- “নাম না জানা মেয়ে, আমি খুব সাহসী নই, আর দশটা ছেলের মত আমি তোমার সামনে দাড়িয়ে সরাসরি বলতে পারি না যে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ পাড়ার ছেলেদের কাছে শুনলাম তোমার নাম ‘অনীতা’ । খুব সুন্দর নাম তোমার। কিন্তু পাড়ার ছেলেরা তোমার অগচরে তোমাকে গুন্ডী আপা বলে।
তোমাকে খুব ভাল লেগে ছিল সেই প্রথম দেখা থেকেই। প্রথম তোমাকে দেখে ছিলাম ঝাপসা চোখে, তোমার খোলা চুল গুলো বাতাসে উড়ছিল। মনে হচ্ছিল তখন ঐ চুল গুলো যদি একটি বার আমার দুটি চোখ ছুয়ে যেতো তবে হয়ত আমি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পেতাম। সেদিনের পর থেকে তোমাকে দেখার জন্যই আমার এই কামিনী তলে বসে থাকা আর তোমার অ্যাটেনশন পাবার জন্যই এত আয়োজন।
একটি ফুল হাতে যদি দাড়াতাম তবে কি তুমি আসতে আমার সামনে? আসতে না, কিন্তু ললিপপ মুখে নিয়ে বসে ছিলাম বলেই তো কাঙ্খিত রানীর আগমণ ঘটে ছিল। আমার ভাবনার দেশে তোমার বিচরণ কতটা সেটা বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। আর আমি তোমাকে তা বোঝাতেও চাই না। আমি তোমাকে বলবো না যে, আমাকেও তোমার ভালবাসতে হবে। ভালবাসা আসলে জোর করে হয় না। আমি একাই তোমাকে ভালবেসে ভষ্ম হতে চাই। সয়নে স্বপনে জাগরণে তোমার খেয়ালে থেকেই ভাল থাকতে চাই অনীতা।
শাহেদ” চিঠিটা পড়ে আম্মু আনন্দিত হলো। আসলে কেউ আমার প্রেমে পড়ার সাহস পায় না। এই প্রথম কেউ আমার প্রেমে পড়েছে তারপর আবার প্রেমপত্রও দিয়েছে, সেটা দেখে আমার আম্মুর ঈদ লেগেছে মনে হলো। আমি আম্মুর আনন্দের সাথে যোগ দিতে পারলাম না, আসলে এই সব অনুভূতি আমার নেই। খুশির চোটে আম্মু বললো-“আজ রাতে তোর পছন্দের কাচ্চি বিরিয়ানী রান্না করবো” মনে হচ্ছে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আম্মুর এই সব ভাব ভঙ্গিমা দেখে আমার হাসিই পেলো। বুঝলাম ঐ লেবু নামক চশমুদ্দীনের নাম শাহেদ।
এরপর থেকে আর কখনোই আমি ঐ শাহেদ নামের চশমুদ্দীনকে দেখিনী। ওর ঐ আবেগ মাখা আর দাম্ভীক চিঠিটা আমার মনটাকে বোধ হয় নড়িয়ে দিয়ে ছিল। এই আমি অনীতা আনরোমান্টিক একটা মেয়ে, আমার মাঝে প্রেমের কোনোই নির্যাস নেই। ভালবাসাকে আমার কাছে বয়সের একটা অপ্রাপ্ত অনুভূতি ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না। সেখানে ঐ চশমুদ্দীনের এই চিঠিটা নেহায়েত দামহীন। তবে আমি ওকে কামিনী তলায় বসতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। অজানা কারণে বার বার বান্দায় গিয়ে দাড়াতাম, যেখান থেকে কামিনী গাছটা দেখা যায়। বোধ হয় আমি ওকে মিস করার মত কিছু একটা অনুভব করছিলাম।
কিন্তু আমার এই আনরোমান্টিক মানুষিকতায় সেটা বেশী দিন পাত্তা পায়নী। তাই ওর খোঁজ করিনী কখনো। তবে মাঝে মাঝে তাকে বেশ মনে পড়তো। মনে মনে ভাবতাম ভালোই যখন বেসে ছিল তাহলে আর কখনো কেনো সে সামনে এলো না? উত্তরটা অবশ্য নিজেই নিজেকে দিয়ে ছিলাম- ভয়ে হয়ত আর আসেনী সে। বুয়ার সাথে শাহেদের সেই ছবিটা মাঝে মাঝেই আমাকে যাতনার সুচ ফুটাতে শুরু করে ছিল। চশমার ভেতরে থাকা তার চোখ দুটোতে অসহায়ত্বের সীন দেখতে পেতাম। আর এই সব ব্যাপার আমার কাছে অসহ্য লাগে তাই তার ছবি গুলো ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়ে ছিলাম।
পাঁচ বছর পর আমার জীবণে কনে দেখা উৎসবটা বাড়া বাড়ি রকমের চলছিল। প্রতি সপ্তাহেই প্রায় দু চার জন আমাকে দেখতে আসতো। কিন্তু আমার বিবাহে কোনো আগ্রহ ছিল না। একটা ছেলেকেও আমার পছন্দ হয় না। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি! সবার পছন্দ হয় আথচ আমার হয় না! বাসায় সবাই আমাকে ভিলেনের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করলো। সবার হাব ভাব দেখে মনে হয় আমি বড় সড়ো কোনো ভিলেন। আমার দ্বারা ভালো কিছু হয় না, আর বিয়ের মত শুভ কাজ তো নয়-ই। তাই আমাকে সবাই ভিলেন ভিলেন ভাবতে শুরু করলো। সে করুকগে, যার সাথে সারাটা জীবণ কাটাবো, এমন কি মরার পর যদি জান্নাত বা জাহান্নামে যাই তবে তার সাথে যেতেই বাধ্য থাকবো আর সেই মানুষটা মনের মত হবে না এটা তো হতে পারে না। তাই আমি নির্দিধায় রিজেক্ট করতে থাকলাম। এক দিন আম্মু একটা ছবি টেবিলে রেখে বললো-“ছেলেটা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, খুব ভালো ছেলে। আপনার যদি মর্জি হয় রানী সাহেবা তবে ছবিটা রেখে গেলাম একবার দেখে নিয়েন”
আমি আম্মুর কথা শুনেও শুনলাম না। ধ্যাত্তেরি! এই সব কাঁনা বকদের ছবি দেখে হবে কি? পরদিন সকালে মেঝেতে পড়ে থাকা ছবিটা আমার দৃষ্টি আটকালো। নেভীব্লু শার্ট আর সানগ্লাসে চোখ ঢাকা এবং স্টাইলিস্ট দাড়ি, মিডিয়াম স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যের সাথে হাইটের ম্যাচিং আছে। বয়সও খুব বেশী নয়, সব মিলে বেশ হ্যান্ডসাম ম্যান মনে হলো। কিন্তু একটু একটু চেনা চেনা লাগছিল। মনে হলো কোথায় যেনো দেখেছি। যাই হোক অতীতে কোথায় কাকে কখন দেখে ছিলাম সে সব ভেবে ব্রেইনে চাপ দিতে চাই না। ছেলেটা দেখতে ভালো আর পজিশনও ভালো তাই রাজীই হয়ে গেলাম বিয়েতে।
এবার কনে দেখা পর্ব শেষ হয়ে বিবাহ পর্ব শুরু হলো। এর মধ্যে হবুবরের বাবা মা এলেও সে এক বারও এলো না। শুনে ছিলাম ছুটি পায়নী তাই নাকি আমাকে দেখতে আসেনী। তারপর বিবাহটাও হয়ে গেলো। বিদায়ের আগে কাঁন্না কাটি পর্ব শুরু হলো, মূলত কাঁন্না কাটি পর্বে আম্মু আব্বু কেঁদে কেঁদে অস্থির। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি! এত কষ্টই যখন পাবে তারা তাহলে বিয়ের জন্য এত উঠে পড়ে কেনো লেগে ছিল? আমি তো বিয়ে করবো, বিয়ে করবো বলে পাগল হইনী। এখন কেঁদে কেটে আমাকেও ইমোশনাল করে ফেলছে।
কারিনাও কোথা থেকে যেনো দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে বললো- “তোমারে ছাড়া আমার দিন ক্যামনে কাটবো আফা?” আমি কাউকেই শান্তনার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কাঁন্না কাটি পর্ব শেষ করে বিদায় নিয়ে শ্বশুর বাড়ী যাবার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে বসে আমি আমার বরকে স্ব-শরীরে দেখলাম। “কুল অনীতা কুল” বরের বেশে আমার পাশে বসে আছে চশমুদ্দীন। একটা সানগ্লাস আর এক গোছা দাড়ি আমাকে চিট করলো! কি যুগ এলো, আজকাল কিপটে ছেলেরা শেভ করার পয়সা জমায় আর দাড়ি না কেটে বলে স্টাইল। এমন স্টাইলের কপালে ঝাটা মারি। তবে আমার বরটা কিন্তু খারাপ হয়নী সেটা ভেবেই মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু শাহেদের সাহস দেখে অবাক হলাম, আমার মত রাগী মেয়েকে কি বুঝে বিয়ে করলো কে জানে!
শ্বশুর বাড়ীতে পৌছার পর তার অতীতের আচরণের বিন্দু মাত্র চিহ্নও দেখতে পেলাম না। শ্বশুর বাড়িতে সবাই ওকে যে ভাবে নমো নমো করছে দেখলাম তাতে তো মনে হচ্ছে আমি টাইগার হলে সে লায়ন।
এই রে, এই ছেলে বোধ হয় আমাকে টাইগার থেকে ক্যাট বানিয়েই ছাড়বে মনে হচ্ছে….