দরজা খুলে ইরা তার হবু শাশুড়িকে দেখে অবাক হয়ে বললো আন্টি এতো রাতে?
শাশুড়ি : তোমার মা কই?
ইরা: এইতো আছে বাসায়।ভিতরে আসুন।
ইরার বুকে ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। এক সপ্তাহ হয়ে গেল ইরা আর সুহানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ইরাকে সুহান এর মা আংটি পরিয়ে গিয়েছিলেন।আর মাত্র ২৫দিন পর বিয়ে। এর মাঝে এমন কি হল যাতে এতো রাতে সুহানের মা বাসায় চলে আসলো তাও কিছু না বলে..ইরা সুহানের মা আর মামিকে বসিয়ে তার মাকে ডাকতে গেল। সুহানের মামি সুহানের মাকে ইশারা দিয়ে বলছেন,আপা মেয়ের পায়ের দিকে তাকান। তিনি নিক্ষুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইরার পায়ের দিকে। ইরা খুড়িয়ে হাঁটছে।
ইরা: মা, সুহানের মা আর মামি এসেছ।
ইরার মা: এতো রাতে?কিছু জানেনি তো!
ইরা: আমি আগেই বলেছিলাম তাদের সব বলে দেও।
মা: তুই গিয়ে ওটা পরে নে। কি বেপার বেয়ান না বলেই আসলেন?
সুহানের মা: বলে আসলে তো অভিনয় করতে সুবিধা হতো।
ইরার মা: মানে?
সুহানের মা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইরাকে ডাকতে লাগলো।
ইরার মা: আস্তে ডাকুন।ওর বাবা অসুস্থ।
সুহানের মা: রাখেন তো।আপনাদের নামে মামলা করবো।
আমার ছেলেকে প্রতারণা করেছেন আপনারা। ইরা আসলো সুহানের মায়ের সামনে। এখনো সুহানের মা ইরার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইরার মা সুহানের মায়ের চোখের দিকে। ইরা ধীরে ধীরে হেঁটে পাশে এসে বসেছে।
সুহানের মা: ইরা তোমার পা দেখাও তো আমাকে। ইরা চমকে গিয়ে সুহানের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে যা ভয় পেয়েছে তাই ই হয়েছে।
সুহানের মা: কি হলো দেখাও। ইরা আতকে উঠলো। ইরা ডান পা বের করে দেখালো।
সুহানের মা: আরেকটা দেখাও।
ইরা নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে ইরার মা মেয়ের কাঁন্না দেখে নিজেও কাঁন্না করে মেয়েকে বলছে দেখা মা। ইরা বাম পাও বের করে দিল। সুহানের মা পা দেখেই বলে ছি..ছি আপনার মেয়ে পঙ্গু? তাই প্লাস্টিক এর পা পরিয়ে রেখেছেন?
ইরার মা: আমার মেয়ে পঙ্গু নয়।
ওর বাম পা দেড় ইঞ্চি ছোট তাই কৃত্রিম পা পরে হাঁটতে স্বস্তি পায়। সুহানের মামী উঠে বলে,ওই তো প্রতিবন্ধী। দেখছেন আপা আমরা খবর টা তাহলে ভুল পাইনি। মেয়ে প্রতিবন্ধী। আর এই মেয়েকে আমাদের সুন্দর ছেলের উপর গছিয়ে দিতে চেয়েছে।
সুহানের মা: আমার ছেলেকেও ঠকিয়েছে এরা।
ইরার মা: সুহান নিজেই ইরাকে পছন্দ করেছে।
সুহানের মা: আমার ছেলে জানতোনা মেয়ে প্রতিবন্ধী।
জানলে নিশ্চই একে বিয়ে করতোনা। ইরা নিচু হয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছে।এ পানি আজ নতুন নয়। ছোট থেকে পাড়া প্রতিবেশী এই পা নিয়ে ইরাকে অনেক তাচ্ছিল্য ভরা সান্তনা দিত। স্কুলের বন্ধুরা অনেকেই ইরাকে দেড় পা বলে ডেকে লজ্জা দিত। কেউ কেউ পিছনে বসে বলতো,ইস! এই মেয়েকে বিয়ে কে করবে? নিজের প্রতি ই নিজের রাগ হতো ইরার। সুহানের মা ইরার হাত থেকে আংটি খুলে নিল। আর চলে যাবার সময় বললো আমার ছেলেকে যে আংটি দিয়েছেন তা দিয়ে যাব।
“আমিতো বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।সবার অবজ্ঞা শুনে এক সময় নিজেকে তৈরী ই করেছিলাম যে সারাজীবন অবিবাহিত থাকবো।কিন্তু সব ই এলোমেলো করে দিল সুহান। এক বছর যাবত আমায় পাবার জন্য কি না করেছে ছেলেটি। ওর ইচ্ছের কাছে আমি ই হেরে গিয়েছিলাম।আমার ও লোভ হয়েছিল ওই মানুষ কে পাবার।বলেছিলাম,এতোই যদি ভালোবাসেন আমার মায়ের কাছে গিয়ে বলেন। ও ঠিক ই ওর মাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।আমি যে ভুলেই গেছিলাম আমার মত মানুষ কে স্বপ্ন দেখতে নেই “এই ভেবে চোখের পানি ফেলছে ইরার মা ইরার কাঁধে হাত দিয়ে বললো মা কাঁদিস না।
ইরা: মা আমি প্রতিবন্ধী?
মা: চুপ কর, কি বলিস তুই?
ইরা: মা যখন দেখলে আমি এমন অক্ষম তখন কেন আমায় মেরে ফেললেনা?বলে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
মা: তুই যে আমার সন্তান মা।আমার প্রথম সন্তান।আমার কলিজার টুকরা..
ইরা: মা আমার ঘুম পেয়েছে।তুমি যাও এই বলে ইরা শুয়ে পরলো।
“মাঝে মাঝে একা কাদার খুব ইচ্ছে জাগে মেয়েদের তখন কিছু বাহানা দিয়ে সবার আড়ালে যাওয়া ই মেয়েদের ধর্ম।
মেয়েরা প্রচুর কাঁদতে পারলেও তারা লুকিয়ে কাঁন্না করতে স্বস্তি বোধ করে রাত ১টা কলিংবেলের শব্দ।ইরার মা দরজা খুলেই দেখে সুহান।
সুহান: আন্টি ইরা কই?
ইরার মা: কি আংটি ফেরত দিতে এসেছো? সেটা আমায় দিয়ে যাও।
সুহান: ও কই?
ইরার মা: ওর সাথে আর দেখা করতে হবেনা।
সুহান: ৫মিনিট সময় দিন আন্টি।কথা বলেই চলে যাব।
ইরার মা হাত জোর করে বলে,বাবা আমাদের ভুল হয়েছে সেটা মানি দয়া করে ওকে আর অপমান করোনা।
তুমি যাও.. ও ওর রুমেই আছে। সুহান ইরার রুমে গিয়ে দেখে রুম অন্ধকার। আলো জ্বালাতেই ইরা চোখ বন্ধ করে বলে,মা প্লিস আলো নিভিয়ে দেও।আলো আমার ভালো লাগেনা।
সুহান: ইরা সুহানের গলা শুনেই ইরা তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।
ইরা: আপনি?
সুহান: হুম।
ইরা: অপমান করা বুঝি বাকি আছে? করুন আমি লুকিয়েছি তাই অপমান ই আমার কাম্য। আমার মতন মানুষ কারো বউ হওয়া যে পাপ। আমি তো আ-মৃত্যু বোঝা…
সুহান: হয়েছে বলা? ইরা নিজের পা ওড়না দিয়ে ঢেকে নিল।
ইরা: আমায় ক্ষমা করে দিন।আমার উচিৎ ছিল আগেই বলা আমি প্রতিবন্ধী। সুহান ইরার পাশে বসলো, ইরা কাকে তুমি প্রতিবন্ধী বলো? নিজেকে? তুমি স্পেশাল,আর দুনিয়াতে স্পেশাল লোক কেই মানুষ অবজ্ঞা করে। সুহান ইরার পায়ের উপর ওড়না সরিয়ে পা হাতে নিল।
ইরা: পা ছাড়ুন।
সুহান: পা এমন লাল হয়ে আছে কেন?
ইরা: কৃত্রিম পা পরতে পরতে ঘা হয়েছে।
সুহান: কই সেই পা? ইরা খাটের পাশ থেকে সেই পা সুহানের হাতে দিল। সুহান তা দূরে ফেলে দিল।
ইরা: কি করছেন?
সুহান: যে পা হাঁটতে শেখানোর নাম করে ঘা বানিয়ে দেয় সে পা দরকার নেই। মেয়েদের জন্ম কেন জানো?
ইরা: কেন?
বাচ্চা বয়সে বাবার হাত ধরে হাঁটতে এবং প্রাপ্ত বয়সে বরের হাত ধরে হাঁটার জন্য। দেখি উঠে দাড়াও ইরা সুহান এর দিকে তাকিয়ে আছে। সুহান ইরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে হাত দেও। ইরা হাত দিল। সুহানের হাত শক্ত করে ধরে দুজন মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে।
সুহান: ইরা…
ইরা: হুম।
সুহান: এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু হাঁটার জন্য পাবে? ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে মাথা নাড়াচ্ছে।
সুহান: তোমায় আমি ভালোবেসেছি তোমায় দেখে।তাতে তোমার কি আছে বা কি নেই তা বিচার করে নয়।
পুরো তোমাকেই আমার দরকার। মায়ের কথায় কষ্ট পেওনা। মা তোমার দূর্বলতা নিয়ে শুধু আঘাত করেনি।সাথে করেছে আমার দূর্বলতা নিয়ে।
ইরা: আপনার?
সুহান: আমার পুরো দূর্বলতাই তো তুমি।
তোমার দু পা না থাকলেও আমি তোমাকে বিয়ে করতাম। অনেক ইচ্ছে ছিল,সবার থেকে আলাদা একজন কে বিয়ে করবো। আল্লাহ ঠিক তেমন একজন কে আমার জন্য দিয়েছেন।যে আমার উপর অন্ধ আস্থা রাখবে।আমাকে ছাড়া এক কদম পথ চলতে পারবেনা ।ঝগড়া হলেও বলবে, সুহান আমায় আমার বাসায় দিয়ে আসো ইরা হেসে দিল…
সুহাম: দেও।
ইরা: কি?
সুহান: হাত দেও।আংটি পরাবোনা? সুহান ইরার হাতে আংটি পরিয়ে দিল। হাতে চুমো দিয়ে বললো,আর কষ্ট আছে? ইরা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বললো না।
সুহান: তাহলে কাঁদছো যে?
ইরা: আনন্দে।
সুহান: দেখোনা তুমি কি সুন্দর আনন্দে ও কাঁদতে পারো।
কিন্তু আমি পারিনা।অক্ষম আমি মনের দিক থেকে অক্ষম।তাহলে এখন প্রতিবন্ধী যদি বলা হয় তাহলে আমি ই তো প্রতিবন্ধী। তাইনা? ইরা সুহানের বুকে নিজের মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো। সুহান ইরার মাথায় হাত রেখে বলে,পাগলি মেয়ে তোমার কাঁন্না দেখে আমারো কাঁদতে ইচ্ছে করছে,একটু কাঁন্না করা শিখাবে আমায়??? দরজার আড়াল এ দাড়িয়ে ইরার মা ও কাঁদছে।এ কাঁন্না কষ্টের নয়।এ কাঁন্না আনন্দের। অনেকদিন এর জমে থাকা কষ্টে-আক্ষেপ আর অপমানের আজ সমাপ্তি হলো যে…