সঙ্গিনী

সঙ্গিনী

রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি ।দেখলাম রাস্তার পাশে একটি রিকশায় গুটিশুটি মেরে একজন ঘুমিয়ে আছে।এখন যেখানেই যাই আমার হাতে নীল ডায়েরি থাকে।কখন কাজে লেগে যায় তা তো আর বলা যায় না! হঠাৎ মনে হলো নীল ডায়েরি যেন আমার হাত টেনে ধরেছে।এই ডায়েরিটা শত মানুষের হৃদয়ের আনন্দ দুঃখ বেদনার মিলন ক্ষেত্র হয়ে আছে।আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম।কিন্তু লোকটি তো ঘুমিয়ে আছে তাকে তো ডেকে তোলা যাবে না।আমি অনেক ক্ষণ ধরে রাস্তার পাশে বসে রইলাম ।

আমি অপেক্ষা করছি কখন সে ঘুম থেকে উঠবে।তাঁর জীবনের প্রিয় দশটি শব্দ আমার নীল ডায়েরিতে লিখে দেবে।বয়স ষাটের উপরে হবে।এই বয়সে রিক্সা চালিয়ে জীবন যাপন করে।ক্লান্ত দুপুরে একটু বিশ্রাম তাঁর জন্য নতুন করে শক্তি সঞ্চয়।প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ঘুম থেকে উঠে হাত ছোটাছুটি করতে করতে রিক্সার উপর উঠে বসলো।রিক্সার সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে সালাম দিলাম।বিড়বিড় করে সালামের উত্তর দিয়ে রিক্সা টান দিলো।বিনয়ের সঙ্গে বললাম চাচা আপনার সাথে একটু কথা আছে।বললো কোথায় যাইবেন।বললাম না কোথাও যাবো না।প্যাডেল মেরে বললো তাইলে ছাড়েন আমারে যাইবার দেন।

কিন্তু সে আমার কোন কথাই শুনতে চায় না।যা হোক বললাম নীলক্ষেত যাবেন?বললো ত্রিশ টাকা । ভাড়া নিয়ে মুলামুলি করবেন না ।বললাম নীলক্ষেত যেতে কতক্ষণ লাগবে? বললো দশ পনেরো মিনিট । আমি হাতের মুঠোয় টাকাটা দিয়ে বললাম এই পনেরো মিনিট আমার কথা গুলোর উত্তর দেন।একপ্রকার জোর করে রাজি করালাম।অনেক ব্যাখ্যা দিয়ে ডায়েরিটা হাতে ধরিয়ে দিলাম।বললো শব্দ এ আবার কোন ধরণের ঠেয়ার ।আমার তো কোন পছন্দের শব্দ নাই।ডায়েরিটা আমার পায়ের উপর রেখে দিলো।আমি বার বার সময়ের দিকে তাকাচ্ছি দেখি দশ মিনিট বাকি আছে।মাঝে মাঝে আমি খুবই ভেঙ্গে পড়ি।কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো আমি নই।শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার বাসনা পোষণ করি।তাঁর এক কথা সে কেন আমার কাছে গল্প বলবে।কলমটা ডায়েরির মাঝে রেখে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে আছি।মনে মনে ভাবছি আর কোন কথাই বলবো না ।সময় হলে আপনা আপনি চলে যাবে।

অনেকের কাছে এই ডায়েরি নিয়ে ছুটে গেছি।কেউ শব্দ লিখে দিয়েছে কেউ দেয়নি।কেউ নম্বর বুকিং দিয়ে রেখেছে ;সে অমুক নম্বরে তার প্রিয় শব্দ গুলো লিখবে।কিন্তু আজ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই মুরব্বির সাথে একটু কথা বলার জন্য কত অনুরোধ করে চলেছি কিন্তু বার বার সে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ পর আমার বাম পাশে তাকিয়ে দেখি এক ষাটর্ধ্বো বৃদ্ধের গাল বেয়ে শত বছরের অগ্নির স্রোত ধারা দাঁড়ি বেয়ে বেয়ে ঝড়ে পড়ছে।এমন করে এই ভাবে তাকে কাঁদতে দেখবো সে কথা কখনো ভাবতে পারিনি।আমার ভেতটা কেমন যেন যন্ত্রণায় মুষড়ে উঠলো।

পৃথিবীর সব আলো-আঁধার যেন এই বৃদ্ধের মুখে অমানিশার চাদরে ঢেকে দিয়েছে।আমি কোন কিছু না ভেবেই মুখোমুখি বসে তাঁর হাঁটুর উপরে হাত রাখলাম।বললাম চাচাজান আমি কি এমন কিছু বলেছি যার দরুণ আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন।এই দেখুন আমি আপনার পা ধরে বসে আছি ;আমায় ক্ষমা করে দিন।গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো আমার আগের ঘরের ছেলে মেয়েদের কথা মনে করে কাঁদছি।আজ এগারো বছর পর আপনের ধরণের জন্য ছেলে মেয়েদের কথা মনে পড়ে গেল।

শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি এই বৃদ্ধের বুকে কত হাহাকার।গল্প যখন শেষ করলো আমার চোখে তখন জল টলমল করছিল।ডায়েরির ভেতর থেকে কলমটা মাটিতে পড়ে গেল।কলমটি পড়ে থাকবে নাকি উঠাতে হবে সেই বোধ টুকু আমার ছিল না।বর্তমানে একটা বস্তিতে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে এক ছেলে ও মেয়ে নিয়ে আছেন।আয় বলতে সারাদিনে রিক্সা থেকে যে অর্থ আসে এটাই।আর প্রথম স্ত্রীর ছেলে মেয়েদের কথা নাই বা জানলো সবাই।পৃথিবীতে সব কথা কি প্রকাশিত হয়! হয় না।কিছু কিছু কথা শোনা যায় কিন্তু বলা যায় না।বৃদ্ধের গোটা জীবন তাঁর আপনজন থেকে দূরে কাটাতে হবে।তবুও এই বয়সে নতুন স্বপ্নে নোঙর ফেলেছে।সারাদিন শেষে যখন ঘরে ফিরে তখন অপেক্ষায় বসে থাকে এক নারী।যে তাঁর স্বপ্নের সঙ্গিনী ।আমার পাস থেকে যাওয়ার সময় টাকা গুঁজে দিয়ে চলে গেলো।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত