মারিজুয়ানা

মারিজুয়ানা

মেয়েটা আমাকে কেনই বা গালি দিল সেটা আমি বুঝিনি। বুঝার কথাও না। তবে পরে বুঝেছি ভুল করে এমন হয়ে গেছে। আমাকে একটু আগে ফোন দিয়ে যখন বললো “শালা তোর পা ভাইঙ্গা হাতে ধরাই দিব। ছ্যাচড়ামি করো? মেয়ে মানুষদেরকে কি ভাবিস? মেয়ে মানুষককে মানুষ মনে হয় না? কোন সাহসে আমার বান্ধবীকে ফোন করে যা তা বলছিস? শালা শুয়োর।”

আমার তখন গালি শুনে রাগ হওয়ার কথা বা তার এই ভাবে বলার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা উচিৎ ছিল আপনি এমন করে কেন বলছেন? আর কাকেই বা ফোন দিয়েছেন? আপনি মনে হয় ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন। কিংবা তাকে দুইটা ঝাড়ি দিয়ে বলা উচিৎ ছিল “চড়াইয়া আপনার দাঁত ফেলে দিব উল্টা পালটা আর একবার বললে।মাথা ঠিক আছে? গাজা খেয়েছেন?” কিন্তু আমি এসবের কিছুই করিনি বরং স্বাভাবিক ভাবেই একটু সময় নিয়ে শান্ত হয়ে বললাম “খুব সুন্দর।” ব্যাস এইটুকুই। আমার এই “খুব সুন্দর” বলা শুনে সে একটু চুপ করে থাকলো। আমি বুঝলাম সে অবাক হয়েছে আমার এমন বলা শুনে। কারণ কাউকে কিছু বললে কেউ তো আর এমন করে আমার মত বলবে না। কেউ বলবে কিনা আমি জানি না। তারপর সে বললো “সুন্দর মানে? এই লাজ শরম বলতে কি কিছু আছে? বকা খাওয়ার পরো বলে খুব সুন্দর।কি ভাবা হয় নিজেকে হ্যাঁ? খুব ভালো ভালোই বলছি ফের যদি আমার বান্ধবিকে বিরক্ত করছিস তোরে একদম ফুচকা বানাইয়া খাইয়া ফেলবো।

এটা বলেই সে ফোনটা কেটে দেয়। আমি অনেকক্ষন ভাবলাম এমন করে বলার কারণ কি হতে পারে? কেন আমাকে এমন করে বললো? তারপর আমি অনেকক্ষন হাসলাম মনে মনে আমি “শালা একটা শুয়োর। ফুচকা বানায় আমাকে খাইয়া ফেলবে।” কিন্তু এসব না ভেবে আমি ভাবতে লাগলাম একটা মেয়েরে কণ্ঠ এতো আশ্চর্য/অদ্ভুত হতে পারে আমি আগে কখনো এটা নিয়ে অনুভব করিনি। আমার মাথাটা কেমন করে যেন উঠলো। আমি অনুভব করলাম আমি আলোতে হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি কোন কিছুকে। কিন্তু কি খুঁজছি ঠিক বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা এমন কণ্ঠটার জন্যই কি আমি মেয়েটাকে কিছু বলতে পারিনি? যে মেয়ের কণ্ঠটা এমন চমৎকার তার কি নাম হতে পারে? আমি ভাবলাম, অদ্ভুত ভাবে ভাবলাম। কিন্তু আমার মাথায় কিছুই আসলো না।

মাথায় আসলো বিকেল পাঁচটায় আজকে নিতুকে পড়াতে যেতে হবে। আমি ওকে পড়াই সন্ধ্যা সাত ঘটিকার সময়। কিন্তু গতকাল ওর মা বলে দিয়েছে আজকে যেন বিকেলে পড়াতে যাই। ওরা সন্ধ্যার দিকে একটু বের হবে। ওকে আমি যতবার পড়াতে গিয়েছি একটা বিষয় হলো পড়ানোর সময় ওর মা ঠিক দশ মিনিট পর পর একবার এসে দেখে যাবে। কেন এমন করে দেখে যায় আমি এই বিষয়টা প্রথমে জানতাম না। কিন্তু একদিন নিতু হঠাৎ করে বললো “মা কেন এমন করে দেখে যায় জানেন?” আমি মাথা নেড়ে বলি “না। কেন এমন করে বার বার দেখে যায়?” নিতু একটু হেসে বললো “আমার বাবাও মাকে পড়াতেন।

তার পরেরটা বুঝতেই পারছেন।মায়ের মনে অনেক ভয়।কিন্তু আপনি ভালো পড়ান তো তাই আপনাকে নিষেধও করতে পারে না। এক কাজ করেন আমাকে পড়ানোটা ছেড়ে দেন। কি দরকার এতো সন্দেহের মাঝে থাকার। সন্দেহ অনেক ভয়ানক জিনিস বুঝলেন।তবে একটা কথা বলি?” আমি কিছুক্ষন সময় নিয়ে বলেছিলাম কি? সে মাথা নিচু করে বলেছিল “আপনি একটু লাজুক আছেন। আপনার এই লাজুকতার মাঝে একটা ভদ্রতা কাজ করে। আপনার ভিতরের সত্ত্বার একটা প্রতিচ্ছবি ভাসে। এটা আমার ভালো লাগে। অনেক ভালো।” আমি শুধু দুইটা কাশি দিয়ে বলেছিলাম “রসায়নের রাদার ফোর্ডের পরমাণু মডেল নিয়ে পড়ছিলাম না? কিছু কি বুঝেছো?”

কথা সত্য আমি একটু লাজুক প্রকৃতির। তবে এতোটা লাজুক না। আমি ভাবি যারা কথা কম বলে মানুষের সাথে মিশতে পারে না, ঠিক মত কথা বলতে পারে না। এক কথা বলতে গিয়ে অন্য কথা বলে ফেলে তারা তো লাজুক কিন্তু আমি কি এমন? যদিও এসবের কোন কিছুই আমার মাঝে নেই তবে আমার ভিতরে কেমন যেন একটা অন্যরকম চিন্তা কাজ করে। এই যে, আমি যে কাজটা করছি বা আমি যে কথাটা বলবো সেটা শুনে অপর মানুষ বা মানুষ গুলো কি ভেবে নিতে পারে? আমার কি এমন করে বলা বা কাজটা করা ঠিক হবে? এসবের ভাবনার কারণেই আমি হয়তো একটু লাজুক।ভিন্ন ধরনের লাজুক।

ঘন্টা খানেক বাদে নিতুদের বাসায় এসে নিতুকে যখন আমি পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম হঠাৎ করে নিতু বললো “আজকে না পড়তে ইচ্ছে করছে না।একটা কথা বলি হ্যাঁ?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ও কি বলতে পারে? ও মাঝে মাঝে উদ্ভট ধরনের প্রশ্ন করে। অনেক সময় আমি উত্তর দিতে পারি না। কিছু দিন আগেই আমাকে হঠাৎ করে বললো “জানেন অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের মাঝে একটা ভিন্নতা খুঁজে। ভাবে এবং করার চেষ্টা করে অন্য আরেকটা মানুষের রাতের মেঘ হওয়ার। কিন্তু আমরা কতটুকু পারি? এই পারা আর না পারার মাঝে স্বপ্ন গুলো কেন আমাদের মনে আসে? যে স্বপ্ন গুলোয় আবেগ থাকে, মায়া থাকে, ভালো লাগা থাকে সাময়িকের জন্য। আচ্ছা ভালো লাগায় কি কোন অপবিত্রতা কাজ করে? যদি এটা কাজ নাই করে তাহলে এই ভালো লাগার মাঝে একটা সময় কষ্ট জড়িয়ে যায় কেন?” আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু ভাবতে লাগলাম ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ুয়া একটা মেয়ের মনে এমন প্রশ্ন আসার কারণ কি? অনেক সময়ের পর আমি বলেছিলাম “উত্তরটা তোমার প্রশ্নের মাঝেই আছে। এমন প্রশ্ন অনেক ভাবনা ছাড়া মনে আসতে পারে না। তাই এই প্রশ্নের উত্তরটা তুমি নিজেই ভেবে বের করিও।” সে শুধু হাসছিল।

যাই হোক আমি ওকে বললাম “আজকে পড়তে ইচ্ছে করছে না আমাকে একবার ফোন দিলেই পারতে। কি পারতে না? কিন্তু কি এমন কথা?” সে একটু সময় নিল তারপর ইতস্ততা হয়ে বললো “না, তেমন কিছু না। আমি একটু ভাবুক টাইপের তো নানান প্রশ্ন মনে আসে। আপনি আবার কিছু মনে করবেন না। আজকে সকালে একবার বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি হলেই আমার ভিতরটা আনচন আনচন করে। কি একটা অদ্ভুত বিস্ময়, এই বিস্ময়ের ভাবসম্প্রসারণ বুঝতে বুঝতে আমাদের মানুষের কত রাত পার হয়ে যায়, কত দূর্গম পথ। মন দিয়ে শুনেন এবং উপলব্দি করুন আমি কি বলতে চাচ্ছি ঠিকাছে?” এইটুকু বলেই নিতু থামে। আমি বুঝতে পারলাম ওর ভিতরটা এখন অন্য রকম। এই অন্য রকমের মাঝে অমাবশ্যা হতে পারে কিংবা শরতের কাঁশফুল হয়ে এই ঘরের চারপাশে উড়তে পারে।

আরো একটু সময় নিয়ে নিতু বললো “আমি তখন ক্লাস সেভেন শেষ করে ক্লাস এইট এ উঠেছি মাত্র। আমাদের পাশের এলাকায় সরকারী কোয়ার্টার। ওখানের একটা ছেলে আমাকে প্রায় ফলো করতো। নাম নিলয়। আমি পরে ওর নাম জেনেছিলাম। ওর বাবা সরকারী জব করে। একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম ও আমাদের বাড়ির আশপাশেও ঘুরঘুর করতো। আমার খুব অস্বস্থি লাগতো জানেন। আমি চাইতাম না এসবের কিছু। সেই সময়ে বা এই বয়সে এই গুলা নিয়ে ভাবতাম না আমি। একদিন স্কুল থেকে আসার সময় হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়। থামার কোন নাম নেই। আমি অপেক্ষা করি আর যতদুর চোখ যায় শুধুই দেখি মেঘের আনাগোনা। আমি প্রায় হেটেই চলে এসেছিলাম। স্কুলটা বাড়ি থেকে কাছেই ছিল। কিন্তু শ্রাবণ মাস তো, শ্রাবণের এই অপরুপ সৌন্দর্য আর বৃষ্টির লাবন্যময় বৈচিত্র দেখে আমার মনে লোভ জেগেছিল বৃষ্টিতে ভিজার। কিন্তু আমি ভিজিনি বাবার ভয়ে।

ভিজেছিলাম আরো একটু পর যখন নিলয় ভিজে ভিজে কোথা থেকে হাজির হয়ে আমার সামনে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ভিজতে চাচ্ছো। ভিজবে?” আমি প্রস্তুত ছিলাম না এমন কথার। আমি আর কিছু না ভেবে এই বৃষ্টির মাঝেই ভয়ে ভয়ে দৌড়ে বাসায় চলে আসি। এরপর রাতেই আমার কি জ্বর। আমি স্কুলে তিন দিন যেতে পারিনি। তিনদিন পর যখন ওর সাথে আমার দেখা হলো সে কান্না করে দিয়ে ইতস্তত করে বলেছিল “আমার এমন করে বলা উচিৎ হয় নাই। একদম হয় নাই। তুমি এমন করে দৌড় দিলে কেন? পাবলিক আমাকে যদি মারতো? এই তিনটা দিন তোমার খুব জ্বর। আমি ভিতরে ভিতরে কেঁদেছি। আমার জন্যই এমনটা হয়েছে। তোমাকে এমন করে আমার বলাটা ঠিক হয় নাই তাই না? আমি কি কান ধরে উঠবস করবো?”

সেদিনও আমি ওকে কিছু বলিনি। বাসায় এসে ভাবলাম ওর সাথে কথা বলাই যায়। এরপর আমরা কথা বলতাম। আমাদের কথার সময়টা খুব কম ছিল। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে যতটুকু সময় পেতাম হেটে হেটে ঠিক ততটুকু কথা বলতাম। কিন্তু এই কথা বলাটা এমন করে বিসর্জন হয়ে যাবে আমি জানতাম না। ওর বাবার ট্রান্সফার হলো। যেদিন চলে যাবে তার আগের দিন সে আমাকে বললো “আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবা?” জানেন সে সময়ে আমার কোন অনুভূতিই হচ্ছিল না। শুধু একটু খারাপ লেগেছিল। আমি হাসি দিয়ে বলেছিলাম “পৃথিবীটা গোল। নিশ্চয় দেখা হবে এবং কথা হবে। মন খারাপ করার কিছু নেই।মন দিয়ে পড়বে। যেখানে যাচ্ছো সেখানে হয়তো আমার থেকে দেখতে ভালো একজন পেয়ে যাবে।” এটা বলেই আমি খুব হাসছিলাম। কিন্তু ও খুব রাগ করে আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। সেই যে গেল আর কোন যোগাযোগ নেই। আমি পরে একটু একটু করে বুঝতে পেরেছিলাম তখনের এই একটু খারাপ লাগা আস্তে আস্তে আমার মনে সেটা অনেক বড় হতে লাগলো।

নিতুর কথা শুনে আমি অনুধাবন করি ইট পাথরের এই শহরে প্রতিচ্ছবি গুলো কেমন। নিতু দীর্ঘশ্বাস নেয়। সেই দীর্ঘশ্বাস জানিয়ে দেয় মনের ভিতরের জায়গা গুলো এখন ঘুণে খাওয়া পোকার মত। সে আমার চুপ থাকা দেখে বললো “আমার এসব ছাইপাস কথা শুনে নিশ্চয় মনে মনে আমাকে পাগল বলেছেন। মানুষ তো। মানুষের জীবনে কত কিছু হবে। কিন্তু এসব এখন ভাবি না। অল্পের মোহে আবেগতাড়িত হয়েছিলাম। এই জন্যই আপনাকে মাঝে মাঝে উদ্ভট ধরনের প্রশ্ন করি। বৃষ্টি আসলেই না আমার এসব মনে পড়ে। আচ্ছা কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি এই জন্যই লিখেছিলেন আজি বাদল ঝরে, মোর একেলা ঘরে হায় কী মনে পড়ে, মন এমন করে আমি এবারো নিতুকে প্রতিভাষ জানাতে পারলাম না। আমি শুধু বললাম “তুমি খুব ভয়ংকর ভাবে কথা বলো। তোমার কথা গুলো অনেক অদ্ভুত টাইপের। আমি তাহলে আজ উঠি?” সে শুধু হাসলো অদ্ভুত ভাবে হাসলো। সত্য কথা কি ওর হাসিটা ওর কথার মতই অদ্ভুত।

দিন গুলো এখন কেমন দ্রুত কেটে যায়। তবুও চলতে হয়, দিন গুনতে হয়। আমি বাবার রুমে যাই। আব্বার এই সময়টা পত্রিকা পড়ার সময় বা চুপ করে বসে থেকে মায়ের মুখ দিয়ে কবিতা শোনার সময়। আমার বাবাটা অন্যদের থেকে আলাদা। আমার বা্বাও প্রেম রসিক টাইপের। মাঝে মাঝে আমার এই বাবাই আমাকে বলে “জীবন গুলো এখন কেমন যেন। আগের মত প্রাণ নেই। ভালোবাসা গুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সেই চিঠির যুগ হারিয়ে গেছে। আমাদের জীবনে একটা চিঠি পাওয়া মানেই ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। কত অপেক্ষা চিঠি কখন আসবে। সেই অপেক্ষা জানান দিত মনের ভিতরের মোহ গুলোকে। তোমাদের এই যুগে ভালোবাসা গুলো খুব সহজে পেয়ে যাও। তোমার মায়ের ভালোবাসা পেতে তোমার মায়ের পিছনে আমার তিন বছর ঘুরতে হয়েছে। রাতের ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। ভালোবাসা হচ্ছে একটা আবেগকেন্দ্রিক বিষয়। এখনকার ভালোবাসা গুলো কেমন যেন।”

আমি অনুধাবন করি আমি হয়তো এখনো ঘুমিয়ে আছি এসবের থেকে। হয়তো চোখ মেললেই উজ্জল আবেগকেন্দ্রিক ভালোবাসা দেখতে পাবো। দেখতে পাবো বৃষ্টি হয়ে কেমন করে এই ভালোবাসা টুপটুপ করে ঝড়ে পড়ে। এই ঝড়ে পড়ার মাঝে আমি তাকে জানাবো মেঘ গুলো কেমন। আজ হয়তো এই মেঘ দেখার মত কেউ নেই। যখন আলোর সিড়িটা আঁধারেও খুঁজে পাবো, তার দেখা পাবো তখন জানাবো আমার চিবুকের মাঝে জমে থাকা হাজারো গল্পের কথা।আমি রুমের দরজার কাছে এসে দেখি বাবা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মা, বাবার পাশে বসে কবিতার বই এর দিকে তাকিয়ে কবিতা শোনায়। আমিও চুপ করে দরজায় হেলান দিয়ে কবিতা শুনি। নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতা আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন? মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে, নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে, নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে…

এই ভালোবাসা গুলো দেখলে আমার বুকের ভিতর কেমন করে যেন উঠে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। মায়ের কবিতা বলা না শুনে বাবা কোন দিন ঘুমায় না। আমি প্রায় ভাবি মায়ের কিছু হলে আমার ভালো বাবাটার কি হবে? আমি রুমে চলে আসি। চোখের কোনে পানি মুছি। ঝিম মেরে বসে থাকি।

বসে থাকতে থাকতেই রাত যখন একটু গভীর হলো সেদিনের মেয়েটার কথা মনে পড়লো “আমাকে ফুচকা বানিয়ে খেয়ে ফেলবে।” তাকে কি একবার ফোন করা উচিৎ ছিল আমার? আচ্ছা মেয়েটার নাম কি “নীল রঙ্গা বৃষ্টি নাকি পূর্ণিমার মৃত্যু?” আমি নিজেকেই নিজে গাধা ভাবি। এমন নাম কি হতে পারে? এ কেমন নেশা মাখানো কণ্ঠ। বার বার তার বলা কথা গুলো আমার কানে ধেয়ে আসে। আমার মস্তিষ্কে একটা প্রভাব ফেলে। মানুষের অনুভূতিতে যখন কাউকে খুঁজে বেড়ায় অথবা ভিতরের আবেগ গুলো শিশিরের মত বেয়ে বেয়ে পড়ে তখন মনের ভিতর একটা নেশা ধরে যায়। নেশার বিপরীত নাম তো মাদক।

আমি কি এই কণ্ঠে মাদকাসক্ত হয়েছি? পৃথিবীতে অনেক মাদক বা নেশা আছে। আমি ভাবতে লাগলাম অদ্ভুত রকম ভাবে ভাবতে লাগলাম হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা নাম আসলো “মারিজুয়ানা”। যুক্তরাষ্ট্রে “গাজা” কে মারিজুয়ানা বা ক্যানাবিস বলে। আচ্ছা মেয়েটার নাম মারিজুয়ানা হলে কেমন হয়। নেশার মত এই মেয়ের কণ্ঠটা আমার ভিতরে একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। এসব ভাবতেই মনে হলো মারিজুয়ানাকে একটা ফোন দেই। অনেকক্ষন পর আমি ফোন না দিয়ে ওকে একটা টেক্সট করলাম। এতো রাতে ফোন দেওয়া বিষয়টা সুখকর হবে না। কিন্তু আমি কি লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবু আমি লিখলাম…

প্রিয় মারিজুয়ানা,
নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন এই নামটা শুনে। আপনার নাম জানা নেই তাই এই নামটা আমারই দেওয়া। মারিজুয়ানা এক ধরনের নেশার নাম। আপনার কণ্ঠটা নেশার থেকেও ভয়ংকর সেটা কি আপনি কখনো উপলব্দি করেছেন? এই লেখাটাকে একটা ছোট চিঠি ধরে নিতে পারেন। আপনাকে এই চিঠি লেখার কারণটা একটু পরে বলছি। আমার বাবা সেকালের মানুষ। নীল খামে মোড়ানো চিঠি যে পায়নি সে কি করে বুঝবে চিঠির অনুভূতিটা কেমন এর ভাবার্থটা কেমন। আমিও এসব বুঝিনা। কিন্তু জানেন সেকালের মানুষের এই চিঠিই ছিল ভালোবাসা নিবেদন। আমি আপনাকে ভালোবাসার কোন চিঠি লিখছি না। আমি এমন চিঠি লিখতেও পারি না। আমার বাবা, আমার মায়ের সাথে প্রেম করার সময় এক হাজার ত্রিশটা চিঠি মাকে দিয়েছিল। একটু অবাক হবেন এটা শুনে যে, সব চিঠি দিয়ে আমার মা বাইন্ডিং করে একটা বই এর মত বানিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। বিষয়টা খুব অদ্ভুত তাই না?

এবার আপনাকে এই চিঠি লেখার কারণটা না হয় বলি। আমি কখনো ভাবিও নাই আমি কাউকে এমন একটা চিঠি লিখবো। আপনি সেদিন আমাকে ফোন করে অনেক কিছু বলেছেন। যে মানুষটাকে আপনি কথা গুলো বলতে চেয়েছেন সেই মানুষটা আমি নই। হয়তো নাম্বার ভুল হয়েছে। তবে আমি কিছু মনে করিনি বিশ্বাস করুন। আমার কি কিছু মনে করার উচিৎ ছিল? কিন্তু আমি পারিনি। আপনাকে জানানোর আর কিছু নেই। আমি জাহেদ আপনাকে কখনো ফোনও করবো না নিশ্চিত থাকুন এবং ভালো থাকুন মারিজুয়ানা। লেখাটা সেন্ড করেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।নিজেকে একটু এখন হালকা লাগছে। খুব সকালেই উঠে শাটল ট্রেন ধরে আমাকে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে যেতে হবে।

অদ্ভুত ব্যাপার এই শাটল ট্রেনে যখন চড়ি তখন সবুজ বৃক্ষ, কাশফুল আর মানুষের জীবন যাত্রা গুলো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। কেন যেন মনের ভিতর কোন ক্লান্তির আভাসও ছুতে পারে না। যতবার দেখি ততবারই মনে হয় এটা একটা সতেজতার জীবন। এসব কারণেই কি শাটল ট্রেনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বলা হয়? নাকি অন্য কোন কারণ আছে। আমি ঠিক জানি না।

মিরাজের সাথে যখন দেখা হলো তখন সে জানালো “দোস্ত আহমেদ স্যারের ক্লাসটা আজকে হবে না। স্যারের মেয়ে সুসাইড করেছে।” আমি অবাক হয়ে একটু জোড়েই বললাম “কিহ?” আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। তারপরো মিরাজ বললো “ও নাকি ডিপ্রেশনে ছিল বুঝছিস? অথচ আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। সুসাইড করার আগে সুসাইড নোট লিখে গিয়েছে এটা শুনেছি। একবার কি যাবি স্যারের বাসায়?”

আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। আমি যতবার স্যারের মেয়েকে দেখেছি হাসিখুশিই দেখেছি। কিন্তু এই হাসির মাঝে অন্য কিছু লক্ষ্য করেছিলাম। মন থেকে যে হাসিটা আসে সেটা আমি খুঁজে পেতাম না। স্যারের মেয়ে এই ভার্সিটিতেই পড়তো। তবে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছিল না। স্যারের মেয়ের নাম ফারিয়া। আমি এই ফারিয়াকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম “আমরা যে ভাবে চলি, যেমন করে অন্য দশটা মানুষের সাথে হেসে যাই, অন্যকে হাসাই, তাদের সঙ্গ দেই, পড়ালেখা, কাজ সব কিছু করি কিন্তু আমাদের মন কি ঠিক সেরকম ভাবে চলতে বা সে রকম করতে বলে? আমরা কি মনকে উপেক্ষা করে সমাজ এবং সমাজের লোককে দেখানোর জন্য তাদের সাথে মিথ্যে অভিনয় করে চলি, কথা বলি, হাসি?” সে অনেকক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল “জাহেদ ভাইয়া আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে এমন কথা গুলো কেন বললেন?” আমি শুধু হেসেছিলাম তারপর বলেছিলাম “মনকে শক্ত রাখো। আমার মন বলছে তুমি ঠিক নেই। ঠিক বলেছি কি?”

ফারিয়া কিছু না বলে আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। আমি ভাবি ডিপ্রেশনও কি এক ধরনের অসুখ। ক্যানসারের মত ভয়ংকর অসুখ? মানুষের মস্তিষ্ককে এটা প্রবেশ করে দূর্বল করে দেয়। একটা ডিপ্রেশনে আসক্ত মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই অন্য আর দশটা মানুষের মত জীবন যাপন করবে। খাবে, ঘুমাবে, কাজ করবে, বাসার মানুষের সাথে হেসে কথা বলবে। কিন্তু তার মনের ভিতর চলবে অন্য কিছু। এটা ভিতরে ভিতরে শেষ করে দেয়। কিন্তু আমরা আশেপাশের মানুষরা কেউ অনুভব করি না। তারপর একদিন আমরা খবর পাই সে আত্মহত্যা করেছে। কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার একটা মানুষ আমাদের সাথে চলাফেলা করে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাবে অথচ আমরা কেউ উপলব্দি করতে পারি না কেন? কেন?

এসব মৃত্যুর চারপাশে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। অনেক খারাপ লাগে। আমি ভাবি রাতের অন্ধকারে পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে যায় তখন মানুষ কি নিয়ে বেশির ভাগ চিন্তা করে? এই চিন্তার মাঝে কেন এমন একটা অসুখ মনের ভিতর বাসা বাধে? এর ঠিক দুদিন পর রাতের খাবার খাওয়ার পর আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। এমন মেসেজ পাবো আমি আশাও করিনি…

প্রিয় জাহেদ,
প্রথমে আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাকে সেদিন এমন করে বলাতে। আপনার এমন মেসেজ পেয়ে আমি পরে আমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে সব কিছু বুঝতে পেরেছি। আসলে আমার বান্ধবীর নাম বিথি। ওকে কিছুদিন ধরে একটা আননোন নাম্বার থেকে বিরক্ত করছিল। বিষয়টা যখন আমাকে বললো, আমি বলেছিলাম নাম্বারটা আমাকে সেন্ড কর। ও নাম্বারটা আমাকে দিতে ভুল করেছে। কিন্তু খুব আশ্চর্য হয়েছি আপনি আমাকে কিছু বলেননি। কেন বলেননি তার কারণ আপনি উল্লেখ করেছেন। আমি আপনাকে একবার ফোন দিতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু মনের সংকোচের কারনে দেওয়া হয়নি এবং যা বুঝেছি তা হলো আপনার সাথে কথা বললে আপনি আমার কণ্ঠের প্রতি আরো দুর্বল হয়ে যাবেন। তা হতে দেওয়া যাবে না। সত্যি কি আমার কণ্ঠটা আপনার ভালো লেগেছে?

আপনার বাবা মায়ের কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। তাদেরকে আমার সালাম জানাবেন। একটা কথা বলে রাখি আমি আসলে খুব রাগি একটা মেয়ে। যখন রেগে যাই তখন মনে যা আসে বলে ফেলি। এই বলার মাঝে আশেপাশের মানুষ কে কি ভাবলো এসব নিয়ে আমি ভাবি না। তবে আমার মনটা অনেক বড়। আমার একটা ভালো গুন হচ্ছে আমি মানুষকে অল্পতেই বিশ্বাস করে ফেলি।

আপনি আমার নাম দিয়েছেন “মারিজুয়ানা”। আপনার মনে কি আর অন্য নাম আসেনি? তবে নামটা পছন্দ হয়েছে। আমার ব্যাপারে তেমন কিছু বলার নেই। আমার ভালো নাম হচ্ছে “ইসরাত জাহান”। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। প্রথম বর্ষে। ডিপার্টমেন্ট আর কি বিষয় নিয়ে পড়ছি সেটা অজানা থাক। জানেন আমার খুব ভালো লাগে এখানের মল চত্বর দিয়ে যখন আমি হেটে যাই। রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া ফুল মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে। ফুল তো প্রবিত্রতার প্রতীক। এই সুন্দর আর তার পবিত্রতা আমাদের মানুষের মনে ক্ষণিকের জন্য পরম তৃপ্তি আর একটু শান্তি দিলে ক্ষতি কি বলুন। কিন্তু আজকাল আমার মন ভালো নেই। কেমন যেন বিষণ্ন বিষণ্ন লাগে। সেদিন আপনার এমন মেসেজ পেয়ে ভালো লেগেছে। ভালো থাকুন জাহেদ।

আমি বার বার এই মেসেজ বা চিঠিটা পড়তে থাকি। অদ্ভুত ব্যাপার এই চিঠি বার বার পড়ার পরো আমার বিরক্ত লাগছে না কেন? আমি “মারিজুয়ানা বা ইসরাতকে” কল্পনা করতে লাগলাম। ও দেখতে কেমন হতে পারে? আচ্ছা ও যখন কথা বলে তখন ওর চুল গুলো মুখের সামনে আসে? ও কি তখন খুব সাধারণ ভাবেই হাত দিয়ে চুল সরিয়ে কানে গুজে দেয়? ব্যাপারটা সাধারণ হলেও অনেক ভয়ংকর যারা এই ব্যাপারটা অনুভব করতে পারে। আমি ভেবেছিলাম ওকে সেদিন সেই চিঠি লেখাটাই আমার শেষ চিঠি। কিন্তু এখন ভাবছি ওকে আমার আর একটা চিঠি লিখা দরকার। জানা দরকার ওর মন কেন বিষণ্ন হয়ে থাকে। তারপর দিনই আমি ওকে আর একটা চিঠি লিখলাম…

প্রিয় মারিজুয়ানা, আপনাকে কেন যেন মারিজুয়ানা এই নামেই ডাকতে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ আমাকে চিঠির উত্তর দেওয়ার জন্য। আমরা মানুষ। মানুষের মন আছে বলেই অনেক কিছু ভাবতে পারি, খারাপ লাগা, ভালো লাগা বুঝতে পারি। একটা কথা কি জানেন আমাদের মানুষের মন মুহুর্তেই বিষণ্ন হয়ে যেতে পারে কিন্তু ভালো লাগাটা খুব সহজে মনের ভিতর প্রবেশ করে না। রাত যত গভীর হয় আমাদের মানুষের মনও আরো বিষণ্ন হয়। “লুইস ক্যারল” একটা কথা বলেছিলেন “জীবনকে সহজভাবে নিতে জানলে জীবন কখনো দুঃসহ হয়ে ওঠে না” কিন্তু সত্য কথা হলো আমরা জীবনকে কখনো সহজ ভাবে নিতেই পারি না। আপনার মন খারাপের কথা জেনে আমি দ্বিতীয় চিঠিটা লিখতে বাধ্য হয়েছি। যার কণ্ঠটা এমন চমৎকার তার মন খারাপ হওয়া কি মানায়? কিন্তু মন খারাপ তো আর মানুষ চিনে না, মন বুঝে না। তাই সে যে কারোই মনে প্রবেশ করতে পারে। আমি এই কয়েকদিনে অনেক ভেবেছি যার কণ্ঠটা এমন লাবণ্যময় তার হাসিটা কেমন হবে? তার হাসিরটা কি মেঘের পর যে রোদটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তার মত?

মারিজুয়ানা দুঃখিত আপনাকে এবং আপনার হাসি নিয়ে এমন করে ভাবার জন্য। আপনাকে একটা ছোট গল্প বলতে ইচ্ছে করছে। এটা গল্প হলেও সত্য। যদিও এই গল্পটা আপনাকে জানানো কোন প্রয়োজন নেই। তারপরো বলছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার সময় একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের পরিচয় হয় ট্রেনে। যতক্ষন ছিল ততক্ষন অল্প স্বল্প কথা হয়েছিল। তারপর স্টেশন থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ছেলেটা ভয় আর সাহস নিয়ে মেয়েটাকে তার মোবাইল নাম্বারটা দিয়েই সোজা হাটা দেয়। ছেলেটা অনেক অপেক্ষায় থাকে একটা বার ফোন আসবে। কিন্তু আসে না। সব সময় মোবাইলটা চেক করে কোন ফোন আসছে কিনা। ছেলেটা আশা ছেড়েই দিয়েছিল। তবে ফোন আসলো ঠিক একমাস পর। অবাক হয় এতোদিন পর কেনই বা আসলো? তারপর তাদের কথা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এভাবে চারটা বছর চলে যায়। এই চার বছরের মাঝে ছেলেটা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে শুধু দু বার মেয়েটার সাথে দেখা করেছিল তাও অল্প সময়ের জন্য।

অবাক হবেন তারা কেউ কাউকে ভালোবাসি কথাটা বলেনি। এরপর একদিন ছেলেটা তৃতীয় বার মেয়েটার সাথে দেখা করলো। হঠাৎ মেয়েটা বললো “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?” ছেলেটা চুপ করেছিল। তার অনেকক্ষন পর ছেলেটা শুধু সমরেশ মজুমদারের একটা কবিতা বলেছিল “এই যে আমি তোমাকে দেখছি, দেখে মন ভরে যাচ্ছে, না দেখতে পেলে বুক টনটন করে, বেঁচে থাকাটা বিবর্ণ হয়ে যায়, এই অনুভূতি কি ভালোবাসা নয়?” এই যে গল্পটা বললাম এই গল্পটা আমার মামা আর মামির। আপনার মন কেন বিষণ্ন জানতে ইচ্ছে হলো। খুব ভালো থাকুন মারিজুয়ানা। এই চিঠি সেন্ড করার পর মারিজুয়ানা খুব দ্রুত আমার কাছে চিঠি লিখলো…

প্রিয় জাহেদ আপনার কাছ থেকে এমন চিঠি পেয়ে আমি নিজেকে সেই সত্তর বা আশি দশকের মানুষ মনে হচ্ছে। আমার খুব ভাবতে ভালো লাগছে এমন চমৎকার চিঠি গুলো আমাকে দিচ্ছেন। আর আমি কিছু মনে করিনি। যদিও আপনি আমার হাসি দেখেননি। তবে সত্য কথা হলো আমার বাবা আমাকে বলে “ইসরাত তোর হাসিটা আমার কলিজায় লাগে মা” জানেন আমার কিছু হলে আমার বাবা বুঝতে পারে। আম্মুও বুঝে। কিন্তু বাবা বেশি ভালোবাসে। বাবার রাজকন্যা তো তাই।

আপনি একটা কথা বলেছেন “মন খারাপ তো আর মানুষ চিনে না, মন বুঝে না। তাই সে যে কারোই মনে প্রবেশ করতে পারে।” বিশ্বাস করুন কথাটা আমার ভীষণ মনে লেগেছে। মানুষের মনে অনেক কারনেই খারাপ লাগা প্রবেশ করে। আমার মন খারাপের কথা জানতে চেয়েছেন। আমার এই লেখাটা পড়ে হাসবেন না কেমন? যদি হাসেন আপনার মুখ আমি সেলাই করে দিব বলে দিচ্ছি।

আমার বারান্দায় বেশ কিছুদিন ধরে একটা হামিং বার্ড পাখি আসে। বারান্দায় ফুল গাছ আছে তো তাই। মধু খেতে আসে। এতো ছোট্ট একটা পাখি কিন্তু কি আশ্চর্য সুন্দর এক রঙিন পাখি। আমি তার সাথে কথা বলি। জানেন ও যখন ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুলের মধু খায় আমার হাসি পায়। ভিতরটা জুড়ায় যায়। কিন্তু এই কয়েক দিন ধরে ও আর আসে না। এই জন্যই আমার মন খারাপ। আচ্ছা ওর কি কিছু হয়েছে বলেন তো? ও কেন আসে না? ভালো থাকুন।

সে আমাকে হাসতে নিষেধ করেছে। কিন্তু এমন করে লিখলে না হেসে পারা যায়? আমি তাকে প্রত্যুত্তর জানাই একের পর এক। সেই প্রত্যুত্তরে থাকে হাজার হাজার কথা। আমি ভাবি এতো কথা মানুষের মনে কি করে জমা থাকে। যে কথা আকাশ সমান। সে কথায় মেঘ উড়ে, বৃষ্টি নামে, মাঝে মাঝে সমুদ্রের গভীর ঢেউ এর শব্দ থাকে। আর এসব মেঘ, বৃষ্টি আর ঢেউ এর প্রতিচ্ছবি গুনতে গুনতে কখন যে আমরা তুমিতে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি কেমন করে দুইটা বছর আমাদের চোখের পলকে উধাও হয়ে গিয়েছে।

আমাকে বিকেলে আগ্রাবাদ যেতে হবে একটু। সেখান থেকেই নিতুর সাথে একবার দেখা করবো। ওর ইন্টার দেওয়ার পর আমি আর ওকে পড়াই না। আজকে কিসের জন্য যেন একবার দেখা করতে বলেছে। বিকেলে দেখার হওয়ার কথা থাকলেও দেখা হলো সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে। টুকটাক খোঁজ খবর নেওয়ার পর নিতু কেমন করে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো “কারো কথার স্পর্শছায়া যদি খুব ভাবায়, ভাসায় তখন বেদনা গুলো মনের ভিতর ঘর বাধে। বলুন বাধে না? সেই বেদনার ঘরে হঠাৎ কথার স্পর্শেরছায়া ঝড় হয়ে হাজির হলে মানুষের কি করার থাকে বলতে পারেন? দুদিন আগে হঠাৎ করে নিলয় আমার সামনে কোথা থেকে হাজির হয়ে বললো “তুমি কি এখনো বৃষ্টিতে ভিজো?” জানেন আমি কিছু বলি নাই। অনেকক্ষন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমি চিনতে পেরেছিলাম তো ওকে। আমার ভিতরটা হাসফাস করছিল।

অনেকক্ষন বাদে ওর গালে একটা চড় মেরে চলে এসেছিলাম। আমার খুব খারাপ লেগেছিল জানেন কথাটা শুনে। আমার নাম্বার কিভাবে যোগাড় করেছিল আমি জানি না। রাতে ফোন দিয়ে বলেছে “তুমি কি ভালো আছো?” আমি কিছু সময় পর বলছিলাম “খারাপ থাকবো কেন?” তারপর ও কেমন যেন বাচ্চাদের মত কান্না করেছে। আমি কি করবো বলুন?” আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম “ভালোবাসার ব্যাপার গুলায় আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এই কয়েক বছরে আমি অসাধারণ কিছু মুহুর্তে সময় পার করেছি। আমাদের আশেপাশের জগৎটা কেমন যেন। তুমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। তোমাকে কিছু বলার আছে আমার মনে হয় না।আমি আজও তোমার এমন কথার উত্তর দিব না। আমি জানি তুমি কি করবে। তবে এইটুকু বলি তোমাদের দুজনের জন্য শুভ কামনা।

আমি মন খারাপ নিয়ে বসে থাকি। কয়েক দিন ধরে ভাবছিলাম ইসরাতের সাথে একবার দেখা করবো। গত পহেলা ফাল্গুনে ওর সাথে দেখা করেছিলাম। বসন্তের প্রকৃতির ছোয়ায় বার বার ওকে দেখছিলাম।বাসন্তি রং এর একটা শাড়ি পরে এসেছিল। ওকে দেখে আমার মনের ভিতর কি যেন হয়েছিল। একটা সময় ও আমাকে বললো “এতো কি দেখো?” আমি শুধু বলেছিলাম “দিনের বেলায়ও আকাশের চাঁদ দেখি। এই দেখার মাঝে ভয়ংকর একটা জাদুকরী স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে তুমি কি বুঝতে পারছো?” সে শুধু হাসছিল আর বলছিল “এমন করে ভাবিও না। পরে কষ্ট পাবা বুঝলা?”

সত্যি আমার কষ্ট লাগছে। ভাবছিলাম ওর সাথে দেখা করে জানিয়ে দিব ওকে নিয়ে আমি কতটুকু ভেবেছি, মনে সাঁজিয়েছি আমার কল্পনা গুলো। প্রায় পনেরো বিশ দিন ইসরাতের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। কথা হয় না বললেই চলে। আমারো একটু ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল। এর মাঝে একবার ফোন দিয়েছিলাম। ওর মা জানিয়েছিল “ও ছাদে সময় কাটাচ্ছে।” আমি “ও আচ্ছা” শুধু এইটুকু বলেছিলাম। পরে মনে করেছি ও পরে একটা বার ফোন দিবে। কিন্তু দেয়নি। একদিন পর আমি নিজেই আবার ফোন দিলাম। রিসিভ করে বললো “পরে কথা বলি?” আমি বুঝতে পারছিলাম ওর কিছু একটা হয়েছে। আমার মন ছটফট করতে লাগলো। এর কিছুদিন পরই আমার কাছে ছোট্ট একটা মেসেজ আসে…

“তোমাকে জানানো হয়নি তার জন্য দুঃখিত।একটা চমৎকার মানুষের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো ঘটা করে। এই যে মেসেজটা লিখছি জানো ওর বানানো ধোয়া উঠা কফি খেতে খেতে লিখছি।সেদিন তুমি আমায় ফোন দিয়েছিলে না? তখন ফারাজ আমাকে কবিতা শোনাচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। তাই বলেছিলাম পরে কথা বলি।তোমার কথা আমি ওকে বলেছি আমার একটা বন্ধু আছে। জানো ঘুম থেকেই উঠে ও আমার দিকে অদ্ভুত মায়াকড়া চোখে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় একটা নীল সুপ্রভাত…

আমি পুরো চিঠি পড়তে পারি না। গলা শুকিয়ে যায়। আমার কান্না আসে। বুকটা ধড়ফড় করে। মনে হচ্ছিল হঠাৎ করে আমার চিবুকের মাঝে কেউ আঘাত করছে বার বার। আমি কাঁপতে থাকি। আমি তো এমনটা আশা করিনি। আমাদের গল্পটা তো এমন না ও হতে পারতো। হঠাৎ করে কেন এমন হলো। আমি অনুধাবন করলাম তাহলে সে কি কখনো একবারো আমাকে নিয়ে ভাবেনি? ভেবেছি কি? আমি ওকে নিয়ে যে কল্পনা গুলো একেঁছি সে কল্পনা গুলো একটা জীবন্ত রুপ দেওয়ার আগেই আমার মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। আমার অনেক কষ্ট লাগে। চোখে জল আসে। এই জলটা কেন যেন মুছতে ইচ্ছে করে না।

এই চোখ ভরা জল আর মন ভরা বেদনা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।ভাবি তার জন্য তবুও আমার মনের ভিতর ভালোবাসা কমে না।প্রিয় মারিজুয়ানা সেই বুক ভরা ভালোবাসা নিয়েই বলছি “তোমার নতুন জীবনটা নীল সুপ্রভাতের মত হোক। তাতে জমা থাকুক বিশাল বিশাল স্বপ, নীল রঙ্গা স্বপ্ন। আমাদের আশেপাশের জগৎটা এমন কেন? যাকে এতো এতো চিঠি লিখলাম, মনের ভিতর যাকে নিয়ে ভাবি, যাকে ধারন করি হঠাৎ করেই আকাশের মেঘ হয়ে যায়। চোখের সামনে ভাসে। এই মেঘ এক সময় চোখের আড়াল হয়। হারিয়ে যায়। আমিও একটা এমন হারিয়ে যাওয়া মানুষ। এমন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে তো ভালোবাসা যায় না…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত