কৃষ্ণবর্ণ

কৃষ্ণবর্ণ

মেয়েটা কালো। শুধু কালো নয়, যেন একটু বেশিই কালো। এমন একটা মেয়ের সাথেই বাবা যে ঠিক কি কারণে আমার বিয়েটা দিলো বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নও করিনি, আসলে করতে চাইনি এমনটা নয়, প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। ছোট থেকেই বাবার বেশ কড়া নজরেই মানুষ হয়েছি, এখনও তার ব্যতিক্রম নয়। বাবা যেদিন আমাকে বিয়ের কথা বললো সেইদিন বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়েছিলো,

– কিন্তু বাবা…
– আহ্, আমি জানি তোমার লেখাপড়া শেষ হয়নি,

সেটা শেষ হতে আরও সময় দরকার। তুমি এখনও বিয়ের কথা ভাবছো না। সে সব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি সব সামলে নিবো। আর তাছাড়া যদি লেখাপড়ার কথায় বলি তবে বলতে হয়, বিয়ের পরও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া যায়। সব নিজের মনের ইচ্ছা শক্তির উপর। আর তাছাড়া তুমি তো ছেলে মেয়ে নও। আশা করি তোমার আর কোনো অমত থাকার কথা নয়।

সেইদিন বাবার কথায় উচু মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিলো। আমি আর অমত বা এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলিনি।
বাবা তো ঠিকই বলেছে, বিয়ের পরও লেখাপড়ায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই তো আমাদের ব্যাসের ছেলেটা, কি যেন নাম? ওহ হ্যাঁ অনিল। সেও তো বছর খানেক হলো বিয়ে করেছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে অনিল আগের থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছে, সেটা ওর নিজের দোষ। আর তাছাড়া মাকেও তো গল্প করতে শুনেছি। বড় মামা নাকি পড়তে পড়তেই বিয়ে করেছিলো। কই তার তো কোনো সমস্যা হয়নি। আমি অযথায় ভয় পাচ্ছি। আসলে মনের সাহসটাই হলো বড় সাহস। কথায় বলে না যে, বনের বাঘে খায় না ; মনের বাঘে খায়।

নির্দিষ্ট দিনেই বিয়েটা হলো। সবই ঠিকঠাক তবে মেয়ের গায়ের রংটা একটু কালো। একটু নয় ছোট মামা বললো একটু বেশিই কালো। এই নিয়ে ছোট মামা আমার কাছে এসে ফিসফিসানিতে বেশ তীব্র প্রতিবাদ জানালেও বাবা আর বড় মামার কাছে কথাটা বলার সাহস হলো না। সত্যি বলতে কি আমার মনটাও একটু খারাপই হয়ে গিয়েছিল। মানছি যে আমি ততটাও সুন্দর না যে একটা মেয়ের ভালো লাগার সৃষ্টি হবে আমাকে দেখে। তার মানে এটাও না যে আমি দেখতে খুব বাজে। নাহ্ কালো হোক সবাই তো মানুষ। তাই বলে এতটাই?সত্যি বলতে কী এটা মানতে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। প্রতিটা পুরুষই চায়, তার জীবনসঙ্গিনী একটু সুন্দর হোক। এই কথার বিচারে আমার চাওয়াটা খুব বেশি অন্যায় কিছু ছিলো বলে মনে হয় না। সন্ধ্যা থেকেই মনটা বেশ খারাপ। নাহ্, মেয়ে কালো সেটার জন্য নয়। ভাগ্যে যা লেখা ছিলো তাই হয়েছে। বরং বিয়ে নিয়ে যা যা স্বপ্ন বুনেছিলাম সবটাই নিমিষের মধ্যে বিলিন হয়ে গেল এইটা ভেবে। স্বপ্ন যখন পূরণ হয় না তখন একটু আধটু মন খারাপের কারণ ঘটে বৈকি। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। স্বপ্নরা তখন দুরে গিয়ে হাতছানি দিচ্ছে আর বলছে, এবার সময় এসেছে যাবার।

রাত বেড়েছে,ঘরে যাওয়া দরকার। নয়তো নতুন বউ ভাববে তাকে আমার পছন্দ হয়নি বলে আড়ালে থাকছি। সত্যি বলতে কি পছন্দ আমার ছিলও না। কিন্তু যখন বাড়িতে এসে নিজের অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেল বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠেছিল। আমি শুনেছি কালো মেয়েরা রূপবতী নয় বরং মায়াবতী হয়। আমার বউটাও তাদেরই দলে। চোখটা আটকে পড়েছিল ওর কালো মুখের উপর। তার সেই জন্যই বোধহয় লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিয়েছিলো, চক্ষু লজ্জা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য। মাথা নিচু করার সময় যে মৃদু হাসিটা হেসেছিলো সেটাকে কিন্তু আড়াল করতে পারেনি। ঠিকই আমার চামড়ার চোখে ধরা পড়েছিলো। আর সেই সময়টাতেই লক্ষ করেছিলাম, ওর হাসির ফলে কালো গালটায় একটা গর্তের সৃষ্টি হয়েছিলো। যাকে আমরা সাধু ভাষায় টোল বলি। আচ্ছা মেয়েটাকে যদি একটা মোটা ফ্রেমের চশমা পরিয়ে দিই? খুব বিশ্রি লাগবে? নাকি আরও অনেকটা মায়াময়ী হয়ে উঠবে মুখটা? প্রশ্নটা একটা মনের কোণে উঁকি দিয়েছিলো সেই সময়টায়।

ঘরে আসলাম। দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিতেই বুঝলাম রাত বেড়েছে বেশ খানিকটা। এতক্ষণ বাইরে থাকাটা মোটেও ঠিক হয়নি। এই যে এতটা সময় তাকে একা রেখে আমি বাইরে পায়চারী করছিলাম এতে কি রাগ হয়েছে? রাগলে কি মেয়েটার ঠোট কাঁপে? কাঁপলে কিন্তু মন্দ হবে না। কাঁপাকাঁপা ঠোটে একটু শাসন করলেও তো দোষের কিছু নেই।

– একটা চশমা দিবো? একটা চোখে দিয়ে দেখবে নাকি? আমার মনে হয় না যে খুব একটা খারাপ লাগবে।

আমার কথা শুনে যে সে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছে সেটা ওর চাহনিতেই ফুটে উঠেছে। জোড়া ভ্রু! অবাক হলে ভ্রু দুটো কুচকে যায় মেয়েটার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। অবাক যে হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক কতটা অবাক হয়েছে সেটা এখনও অান্দাজ করা মুশকিল। মাঝে মধ্যে বউটাকে এমন অবাক করে দিলে কিন্তু মন্দ হয় না। আর তাছাড়া অবাক তো হবেই, যদি প্রথম কথাটাই এমন উদ্ভট ধরনের হয়ে যায় তবে তো কথায় নেই। কোনো উত্তর আসলো না। হয়তো আমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। হয়তো তার অবাক হওয়ার লগ্ন এখনও কাটেনি। উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা বের করে আনলাম। এটা আমি অনেক দিন আগেই কিনেছি। ভাবিনি এটার ব্যবহার এমন ভাবে হবে।

– নেও চোখে দেও তো। কথাটা বলেই চশমাটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। একবার আমার মুখের দিকে আরেকবার হাতের দিকে তাকাচ্ছে।

– আহ নেও তো, তাড়াতাড়ি চোখে দেও।

কাঁপাকাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। এত কাঁপে কেন হাতটা? সংকোচবোধ? না হয়তো লজ্জায়। লজ্জায় আবার কারও হাত কাঁপে নাকি? জানা নেই তো। চশমাটা আমার হাত থেকে নিতেই ওর হাতের সাথে আমার হাতটা আলতো করে ছুয়ে গেল। আর সেই আলতো ছোয়াতেই শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। এমন করে কেউ ছুয়ে দেয়নি এর আগে। লক্ষ করলাম সেও একটু কেঁপে উঠলো মনে হয়।

– নাহ্ নাহ্ ভয় নেই, সাধারণ চশমা। চোখে দেও। কিছু হবে না।

চশমটা হাতে নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলো তখনই বললাম কথাটা। ওর চোখে চশমা। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে এই সামনে বসা মেয়েটাই যে সবচাইতে বেশি সুন্দর আর মায়াবতী। বাকিটা সব তুচ্ছ। বেশ মানিয়েছে ওকে। কাজল কালো চোখ দুটো কাচের আড়ালো ঢাকা পড়েছে। তাতে যে আরও বেশিই মায়া ছড়াচ্ছে সেই দুটো। ওর মুখটা আস্তে আস্তে নিচু হয়ে গেল। বুঝতে পারছি এ নিচু হওয়া লজ্জায় ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। আমি নিশ্চিত ওর গায়ের রং যদি ফর্সা হতো তবে এত্তক্ষণে ওর গাল দুটো রক্ত বর্ণের মত লাল আভাতে ছেড়ে যেত।

– আচ্ছা আমাকে আপনার ভালো লেগেছে?

এত্তক্ষণে ক্ষ্ণীণ স্বরে প্রশ্নটা করলো। আমার এক বাংলা স্যার বলতেন, কালো মেয়েদের কণ্ঠে মধু থাকে। এতদিন শুধু লোকের মুখেই শুনেছি আজ নিজের কানে শুনলাম। মধু আছে বৈকি! বেশ ভালো মতোই আছে।

– উহু, কেন খারাপ লাগবে কেন?
– নাহ্ মানে আমি কথাটা বলতে গিয়েই থেমে গেল। আমি জানি সে কি বলতে চায়। তাই উত্তরে বললাম,

– সত্যি বলতে কি খারাপ লেগেছিলো। তবে এখন আর সেই খারাপ লাগাটা নেই। বরং আগের খারাপ লাগাটা শতগুনে বেশি হয়ে ভালো লাগাতে এসে ঠেকেছে। কথাটা শুনেই ওর মুখে একটা আলতো হাসি ফুটে উঠলো। আর সেই হাসির চাপে কালো গালে একটা ক্ষতের সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছি অপার দৃষ্টিতে ওর হাসিমাখা মুখটা। এ যেন এক অন্য রকম ভালোলাগা, অন্য রকম ভালোবাসা। যা শত সাদা চামড়ার কাছে হার মেনে যায়। মনে পড়ছে একটা বিখ্যাত লাইন, ” ভালোবাসা যদি হয় তবে কৃষ্ণবর্ণের মাঝেও হয় ”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত