অসুখ

অসুখ

সেদিন মায়া আর আমি অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলছিলাম, এক পর্যায়ে ওর বাসার কথা উঠে এলো। তারপর নানান কথা হলো। আমাকে বলল মায়া কিভাবে ওর মামাবাড়ি যেতো। ওর মামাবাড়ি ছিলো পুরাতন জমিদার বাড়ি। প্রচুর ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ওর মামাবাড়ি। ওইখানে দারুণ একটা দীঘি আছে। এবার আমাকে নিয়ে যাবে সেটাও বলল। ওর মামারা এখন ঢাকা থাকে। তবে যখন গ্রামে যায় সবায় মিলে যায়। তারপর বেশকিছু দিন থেকে তারপর আবার ফিরে আসে। যখন গ্রামে যায় তখন অনেক মজা করে ওরা, তাছাড়া সারাবছর এর জমির হিসাব নেয়। কতটুকু টাকা কৃষক দিয়েছে তার হিসাব করে। অনেক গরীব গৃহস্থ আসে যারা সাহায্য পেলেই মনখুলে দো’আ করে।

তো একবার মায়ার মামারা ওর বাবারা গিয়েছে সবায় মিলে একটা কাঙালি ভোজের আয়োজন করছে। তো গ্রামে যারা প্রবীণ বৃদ্ধ আছে বা যারা গরীব মানুষ তারাও এসেছে খাবার খেতে। খাবার পর আবার কিছু টাকাও নিয়ে যান। মায়ার বাবা তাদের আবার শাড়ি লুঙ্গি উপহার দিচ্ছিলেন। এসব কথা বলার সময় মায়া একটু হেসে নিলো তারপর আবার বলতে শুরু করলো “জানো একবার আমিও উনাদের সাথে খেতে বসেছিলাম, যদিও বাবা কিছু বলেনি তবে মায়া রাগ করেছিলো” তখন আমার কাজিন রা মিলে উনাদের সবকিছু আগিয়ে দিচ্ছিলাম। অনেক লোক এসেছিলো।

একবার কী হলো জানো, সবায় মিলে আমরা সেই বড় দীঘি দেখতে গেছি। কত বড় সেই দীঘি। অবশ্য আমাদের জন্য একটা বড় লঞ্চ ভাড়া করছিলো। আমরা সবায় মিলে ঘুরছিলাম। ছবি তুলেছিলাম অনেক। তারপর আমরা ওই দীঘির মাছ দিয়ে খাবার খেয়েছিলাম। পরে মামা কোত্থেকে একটা ছাগল কিনে এনে একজন বাবুর্চি কে দিলো উনি ছাগল কে মাংস বানিয়ে রেঁধে খাওয়ালেন। দারুণ স্বাদ হয়েছিলো। সেই পিকনিক ছিলো আমাদের শেষ পিকনিক। এরপরে বাবার ব্যস্ততা বেড়ে গেলো আমাদের আর যাওয়া হলোনা। তবে আপুকে বলেছিলাম যাবার কথা উনি বললেন “না থাক পরে” তারপর আর কেউ গ্রামে যেতে চায়না। সবায় ব্যস্ত বুঝলে। তবে তোমাকে আমি নিয়ে যাবো এবার। মায়ার এসব কথা শুনে আমার বেশ ভালোই লাগছিলো।

অন্য একদিন মায়ার সাথে আবার কথা হচ্ছে রাতে, আবার উঠলো মায়ার মামার বাড়ির গল্প। এবার মায়া আমাকে অদ্ভুত একটা কথা বলল, যে কথা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি যতটুকু জানি ধনিদের টাকার অভাব নেই। সীমাহীন টাকা। তাহলে তাদের মনে দুঃখ থাকার কথা না। এরপরেও যদি কারও মনে দুঃখ থাকে তবে তা বিলাসিতা বলা চলে।

মায়া আমাকে আবার বলতে শুরু করলো, গ্রামে এখন ওদের জমিদার বাড়ি যিনি দেখাশোনা করেন। তিনি হচ্ছেন মায়ার চাচাতো মামা। উনি নিজেও বেশ টাকাপয়সার মালিক। উনাদের কোনো অভাব নেই। তবে উনার মনে অনেক দুঃখ। আর এই অসুখ বা দুঃখ দূর করার জন্য এমন কিছু নেই যা উনি করেননি। মানে বড়বড় সাইকোয়াট্রিস্ট থেকে শুরু করে অনেক বড়বড় ডক্টর, কবিরাজ থেকে শুরু করে কত বড়বড় আলেম পর্যন্ত উনার রোগ ধরতে পারেননি। আর এরফলে উনার মনে কোন সুখ নেই। উনার মনে কোন সুখ নেই এজন্য উনার জমিদার বাড়ি কেউ যেতে চায়না।

মায়ার কাছে চেয়ে উনার একটা ছবি নিলাম আমি। বেঁটেখাটো মানুষ, মাথায় ঝাঁকরানো চুল। জোড়া ভ্রু, মুখের বাম পাশের তুলনাতে ডান পাশে বেশিই মাংসল। চোখ দুটো কোটরে বন্দি থাকলেও তার দৃষ্টি সবসময় সুক্ষ্ম। দেখে অবশ্য বিচক্ষণ মন হচ্ছে। ইনার মতো একজন লোকের মনে অসুখ। উনার সমস্যা আসলে কোথায়?? পরে অবশ্য আমি জানতে পারলাম যারা উনার ট্রিটমেন্ট এর জন্য এসেছিলো সবায় অঢেল টাকাপয়সা নিয়ে গেলেও কোন কাজ করতে পারেন নি। এজন্য উনি এখন আর কারও কাছে যাবেননা ভেবেছেন। উনি উনার বাকি জীবন এইভাবে চালিয়ে দিবেন ভেবেছেন। কারণ উনি নিজের আত্মসম্মান কারও কাছে খোয়াতে চান না। শতহোক উনার পিতা বা প্রপিতামহ জমিদার ছিলেন। একটা বংশগত আভিজাত্য তাদের আছে।

উনার সিদ্ধান্ত অবশ্য ভালো। কারণ এর আগেও অনেক টাকা ব্যয় করেছেন, কেউ তার তোগের ওষুধ দিতে পারেন নি। উলটা উনার থেকে অনেক টাকা খসিয়েছেন। এজন্য উনি ভাবছেন পারলে নিজেই নিজের চিকিৎসা করবেন। এর আগে যারা উনাকে রোগী বলে অনেক টাকাপয়সা নিয়েছেন তারা সবায় ফাঁকি দিয়েছেন। নানান ফরমায়েশ করেছেন, নানান ওষুধ খাইয়েছেন তাতে অবশ্য কোন কাজ হয়নি। যা রাগ তার আশেপাশেই যেতে পারেননি।

দুইজন সাইকিস্ট এক সাথে নিরীক্ষা চালিয়েছেন তাতেও কোন কাজ হয়নি শেষ বলেছিলেন “আপনি একবার দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসুন ওইখান পরিবেশ আপনার মনে প্রশান্তি এনে দেবে” উনি একবার দার্জিলিং গেলেন। পাহার দেখলেন রিসোর্টে থাকলেন কোন কাজ হলোনা। উনি ফিরে এলেন একবুক হতাশা আর কালো মুখ নিয়ে। উনার সাথে সবসময় একজন রক্ষী থাকে। একজন উকিল থাকে। আর একজন হিসাবরক্ষী। উকিল সবসময় জমিজমা নিয়ে থাকেন। আর হিসাবরক্ষক থাকেন কার কতটুকু পাওয়া, কে দেনাদার এবছর কতটা উৎপাদন হলো। কতটা আয় হলো, এসব। উনার কোনো অভাব নেই। যারা উনার সাথে থাকেন তারা সবায় বিশ্বস্থ এজন্য উনাকে বাড়তি চাপ নিতে হয়না। উনার রোগ ধরা; সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। তবুও জমিদার বলে কথা।

এসব কথা মায়া বেশ মন খারাপ করেই বলছিলো, আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম “আচ্ছা আমাকে একটু ভাবতে দাও আর আমি উনার সাথে একটু কথা বলি তারপর দেখা যাবে” মায়া শুনে “হ্যাঁ” বলল। তবে এই কথাতে মায়া কে পুরোপুরি খুশিনা তা আমি ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম। মাস দুয়েক পর, একদিন মায়া আবার আমাকে বলল “শোনো একটা খুশির সংবাদ আছে” কথাটা বেশ আহ্লাদে গদগদ হয়েই বলল, আমি কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললাম।

“বেশ তো বলো শুনি” তখন মায়া আমাকে বলল যার সারমর্ম হচ্ছে “আমি বাসার সবায় কে রাজি করায়ছি এখন আমরা মামাবাড়ি যাবো। আমি আমি বলেছি তুমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, আর তাতে সবায় রাজী হলো এখন তুমি অনেক টা অন্ধের নড়ির মতো শেষ ভরশা” মায়ার কথাগুলো শুনে একটা চাপা হাসি দিলাম। তারপর তাকে বললাম “হুম বেশ কঠিন কাজ, তবে আমি আত্মবিশ্বাসী আমাকে একটু সময় দাও তারপর দেখো” তারপর একদিন মায়া ওদের গাড়ি নিয়ে আমার মেসের সামনে এসে হাজির, আমার সবকিছু আগে থেকেই গোছানো ছিলো। মায়ার সাথে আগামী কয়েকদিন থেকে আসবো এজন্য মেসে মালিক কে বলে দিলাম।

পাশাপাশি আমি আর মায়া বসে যাচ্ছি। মায়া বেশ লাজুক মেয়ে। মোবাইলে অনেক বেশি কথা বললেও আমার সামনে এলে একদম চুপচাপ থাকে। আমার চোখের দিকে তাকাতেও অবশ্য বেশ লজ্জা পায়। তো আমি তার হাত টা ধরে বললাম “কী মহারাণী খুব খুশিখুশি লাগছে যে” মায়া বলল “আহা বুঝোনা এবার তুমি মামাকে সুস্থ করতে পারলেই আমাদের বাসা থেকে মেনে নেবে” আমি শুনে বললাম “ওরে বাবা তুমি এত দূর ভেবে ফেলেছ বাব্বাহ, তাহলে তো তোমাকে পাবার জন্য হলেও মামাকে সুস্থ করতে হবে” বেশ বড় একটা জার্নি। পথের মাঝে খাবার খেতে হলো। ড্রাইভার সাহেব রেস্ট নিলো।

মায়াও দুদণ্ড আমার কাধে ঘুমিয়ে নিলো। তারপর জানালা দিকে যখন শেষ বিকাল দেখা যাচ্ছিলো, গোধূলি যখন চারপাশ মায়া তখন ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইশ দেখো, দেখো চারপাশ কত সুন্দর” এরপরে আবার আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো, আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে কত শহর ছাড়িয়ে, নদী পার হয়ে। এরপরে গভীর রাতে আমরা পৌঁছালাম সেই বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার সময় বুঝতে পারলাম আমরা কোন বড় বাড়িতে প্রবেশ করেছি। রাতে লাইট দিয়ে সাজানো চারপাশ। আমি তো মাথাউচু করে চারপাশ দেখছি। বড়বড় গাছ, একটা বড় পুকুরপাড় চোখে পড়লো, তার পাশে আবার ফুলের বাগান হয়তো আছে তাজা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে নাকে। দুজন লোক এসে আমাদের ব্যাগপত্র নিয়ে গেলো। তাদের সালাম আদব দেখে বোঝায় যাচ্ছে জমিদার বাড়ির খাস কাজের লোক।

আমরা যখন সিড়িতে উঠেছি তখন অন্য একজন লোক এসে আমাদের নিয়ে গেলো, মায়া আমাকে বলল “আমার শরির ভালো না এজন্য উনার রুমে যেতে হবে” বড়বড় সব ছবি টাঙান ঘরের চারপাশে। সুন্দর ঝকঝকে তকতকে চারপাশ। চাকরেরা চারপাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, কোন দায়িত্ব পাবার সাথে সাথে যেন তা পালন করবে। উপরের তলার একটা রুমের দিকে আমাদের নিয়ে গেলেন।

শুয়ে ছিলেন একজন ভদ্রলোক, আমি আর মায়া তাকে সালাম দিলাম। ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তাগড়া জৌয়ান লোক। মুখের কাঁচাপাকা দাড়ি। নাকের নিচে একটা রাজকীয় সরু গোফ। মাথার চুলগুলো বেশ। হাতে নানানরকম আঙটি আর ঘরের চারপাশে একটা রকিং চেয়ার, তামাকের নল, আর তারপাশে কিছু ছবি টাঙানো। মায়া তার কাছে এগিয়ে গেলো। উনি মায়াকে বেশ যত্ন করে বুকে টেনে নিলেন। তারপর তারা বাপ-বেটির মতো গল্প করতে শুরু করলো। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, আমি সম্মানসূচক একটা মৃদু হাসি দিলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে দুবার ভ্রুকুটি করে তাকালেন। তারপর আমাকে বসতে বললেন। উনার দৃষ্টি যেন প্রকাণ্ড উত্তাপের মাঝেও একটা তীক্ষ্ণ তীরের মতো সূচালো। জমিদার মানুষ বোকাসোকা হবার কথা না।

সে রাতে আমাদের খাবার দিলো ওখানকার বাবুর্চি যারা ছিলেন। তারপর বড়বড় মাছের মাথা, দেশি মুরগি, দুরকম মাংস, নানান রকম ছোটমাছ। সবমিলিয়ে এক রাজকীয় খাবার। যার স্বাদেই পেট ভরে যাবার কথা। খাবার খেলাম অনেক আয়েশ করে, তারপর এনে দিলো মুন্ডামিঠাই। সেসব খাবার পর মায়ার সাথে গেলাম একটা বারান্দাতে যেখানে দোলনা রাখা আছে, মায়া আমাকে বলল “এখানে ছোটবেলা এসে খুব মজা করতাম, আমার প্রিয় বারান্দা ছিলো এটা। আর উপরের ঘরে একটা দারুণ পড়ার ঘর আছে আমি প্রিয় বই দিয়ে সাজিয়ে রাখতাম। তুমিও অনেক বই পাবে আমার রুমে। এখনো সুন্দর সুন্দর কিছু বই দিয়ে ঠাসা সেসব বুকশেলফ।

মায়া এবার আমার কাছে বসে তার মামাবাড়ির নানান গল্প করতে শুরু করলো। আমরা শহর থেকে এসেছি শুনে একজন চাকর এসে বলে গেলেন “বাবু সালাম নিবেন, আপনাদের কিছু লাগলে আমাকে বলবেন, আমি পাশের ঘরে থাকি” বলে চাকর লোকটা বেশ সুন্দর একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। বাহ চারপাশের মানুষ এতো ভালো অথচ মায়ার মামার মনে শান্তি না থাকার কারণ কী?

পাশে একজন লোক বাশি বাজাচ্ছেন আর তার সাথে গান করছেন অন্য কেউ। তাদের গানের গলাও ভারি মিষ্টি, মায়া আমাকে বলল “ওই যে গান শুনছো, ওরা আমার নানার আমল থেকেই এখানে গান করে। তাছাড়া আমরা সবায় যখন এখানে আসি উনারা গান শুনিয়ে যাই, তাছাড়া আমার মামা নিজেও মন ভালো করার জন্য গান করে। আবার উনি মাঝেমাঝে এখানে মঞ্চনাটকের আয়োজন করে। সবমিলিয়ে এই গ্রামের মানুষের ভালো রাখেন মামা। কিন্তু জানো মামা নিজেই ভালো থাকেনা। এই নিয়ে আমার নিজেরো খুব খারাপ লাগে। একজন লোক এসে আমার আর মায়ার রুম দেখিয়ে গেলো। আমরা দুজন রাতে ঘুমাতে গেলাম। আমি আমার মোবাইল ল্যাপটপ সব চার্জে দিলাম। তারপর একটু শান্তির ঘুম। বিছানাপত্র বেশ পরিষ্কার। আর রুমটাও অনেক সুন্দর পরিপাটি। এখানে কাজের কোন ভুল নেই। সবায় একদম চারপাশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে।

সকালে মোয়াজ্জেম সাহেব আযান দিলেন, পাশেই মসজিদ এজন্য আযানের ধ্বনি তে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি জেগে উঠলাম ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর মায়াকে কল দিয়ে জাগালাম। মায়াকে নামাযে যেতে বলে আমি মসজিদের দিকে আগাচ্ছি, বাড়ির সামনে যেতেই কিছুলোক আমাকে সালাম দিলো। তারপর উনারা আমাকে মসজিদে নিয়ে গেলো। সুন্দর মতো নামায পড়লাম। উনাদের বাচনভঙ্গি বেশ আদবের সাথে। আমি একটা অপূর্ণতা খুঁজে পেলাম তখন।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার সময় দেখি কজন চাকর উঠে ফুলগাছে পানি দিচ্ছে কেউ। কেউ ঝাড়ু দিচ্ছে। কেউ আবার চেয়ারটেবিল পরিষ্কার করছে। সবায় দায়িত্বপরায়ণ। কর্তব্যনিষ্ঠ। মায়ার মামার এখনো উঠার নাম পেলাম না। আমাদের একজন লোক এসে খাবার খেতে যেতে বললেন, মায়া আমাকে নিয়ে গেলো, সকালেও দারুণ কিছু খাবারের আয়োজন। তারপর কফি খেতে খেতে মায়াকে বললাম “তোমার মামা কী একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে??” মায়া বলল “হুম” তারপর মায়াকে নিয়ে আমরা হাটতে বের হলাম চারপাশ টাতে। সকালে চারপাশ একদম পবিত্র আর সুন্দর নির্মল বাতাস। যেন সুভাষীত করছে চারপাশ। একটা লাল টুকটুকে গোলাপ নিয়ে মায়ার হাতে দিয়ে কানের কাছে বললাম “ভালোবাসি” মায়া মুচকি হেসে দিলো তারপর আমাকে বলল। “আমিও ভালোবাসি”

দুদিন পর মায়ার মামা সুস্থ হলেন, আমাদের সাথে ঘুরতে বের হলেন, সবায় মিলে ঘুরলাম। সবায় তো মায়ার মামাকে সালাম দিয়ে পাগল করে দিলেন। উনি শুধু মাথা নাড়ালেন। গ্রামের মানুষ গুলো যেন পুতুলের মতো সাজানো। তাছাড়া সবায় বেশ সুখেই আছে। এখানে শিক্ষার জন্য একটা স্কুল অবশ্য আছে। আমি সেদিন মায়ার সাথে স্কুলে গেলাম। ওইখানকার প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বললাম। উনারা আমাদের পেয়ে বেশ খুশি হলেন। তাছাড়া উনারা বললেন বেশকিছু কথা, “আমাদের স্কুলে যদি আরও শিক্ষক থাকে ভালো হতো, আমাদের স্কুলে বড় একটা ভবন দরকার, তাছাড়া মানুষ জন তাদের ছেলেকে শিক্ষার আলোতে দিতে চান না, তারা মনে করেন আমাদের যা সম্পদ আছে তা দিয়েই আমার ছেলে/মেয়ে ভালো থাকবে কেন শিক্ষিত হবে?” এরপরে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম।

মায়ার সাথে আমি কিছু আলোচনা করলাম মায়া অবশ্য কিছুটা বুঝতে পেরেছে। তবে এখানকার মানুষ খুব সংখ্যক আছে আছে যারা মসজিদ মুখী। আমি কয়েকদিন থেকে মসজিদে যেতাম। ওখানকার হুজুরের সাথেও আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হলো। আমি উনাকে বললাম যে, “গ্রামের মানুষের ভেতর ধার্মিকতা না থাকার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন??” উনি মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করেছেন। উনার জ্ঞানের অভাব নেই। উনি আমাকে এমন টা বললেন যে “এই গ্রামের মানুষ গুলো মূর্খ আর বির্বর হাতেগোনা কয়েকজন আছে যারা নামাজি। আর সবায় আছে গান বাজনা আর ঢর্মিয় গোঁড়ামি নিয়ে” আরও অনেক কথা হলো উনার সাথে। গ্রাম কেমন, গ্রামের মানুষ কেমন, গ্রাম নিয়ে উনার কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা আছে নাকি। উনি আমাকে বেশকিছু সুন্দর পরামর্শ দিলেন। পরে অবশ্য আমি বাড়ি ফিরলাম। এবং মায়াকে অনেক কিছু বোঝালাম।

একদিন আমি শুয়ে আছি মায়া আমাকে বলল, “শোনো মামা আমাদের সাথে কথা বলতে চান, আর উনি আমাদের সাথে গল্প করতে চান আগামীকাল রাতে” আমি বেশ হেসে বললাম “বাহ ভালো তো” পরেরদিন মায়া আমাকে ডেকে নিলেন তার মামার কাছে, মামা আগেই বসে ছিলেন আমাদের জন্য। আমি যাবার পর উনি আমাকে বসতে বললেন, তারপর আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললেন বেশকিছু কথা।

মামা – গ্রাম কেমন লাগছে তোমাদের??

আমি- হ্যাঁ খুব সুন্দর সাজানো গোছানো গ্রাম। অবশ্য সবই আপনি করেছেন। শুনেছি ওনাদের মুখে।

মামা- তুমি পড়ালেখা করো কোন বিষয়ে??

আমি- মনোবিজ্ঞান নিয়ে। মানুষের মনের উত্তান, পতন, মানুষের মনের সুখ আর দুঃখ নিয়ে কাজ করা আমাদের বিষয়।

মামা- ও আচ্ছা এর আগে যারা এসেছিলো তাদেরি মতো তুমি? তবে তারা তো এসে কাজ করেছিলো আমাকে নানান প্রশ্ন করে। কিন্তু তুমি কিছুই করলে না যে??

– শোনেন মামা, আমিও কাজ করছি! এই যে আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এটাই মূলত আমার কাজ। আর আপনার মনের মাঝে যে অসুখ টা আছে তা আপনার মুখে শোনার থেকে আমি নিজেই যদি বুঝে নিতে পারি তবে ভাল চিকিৎসা হবে। আচ্ছা বলেন মামা, এই বয়সে আপনার কী তেতো ওষুধ খাওয়া মানাবে?? একদম নাহ। এখন আপনার মানাবে বাকি জীবন হাসিখুশি কাটানো। শুনেছি মামি আর মামাতো ভাই সবায় ঢাকা থাকেন আর আপনি গ্রাম আর গ্রামের মানুষ কে দেখাশুনা করছেন। তাদের ভালো মন্দ সবকিছুর হিসাব মেলাচ্ছেন। তাদের বিপদের দিনে আপনি পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কজন এমন ভাবে বলুন?? আর জমিদারি সে তো আপনাদের পৈতৃক নতুন নাহ, এজন্য প্রজাদের দেখভাল করার দায়িত্ব আপনার কাঁধে।

মামা- বাহ তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলো দেখি। তো আমার অসুখ যাবে তো??

– মামা এটা কোনো অসুখই না! এমনি একটা আস্তরণ আপনার মনে দাগ কেটে আছে।
– কিরকম!
– সেটা অনেকটা (রুম থেকে সবায় কে বের করে দিলাম) মনে করেন মামা, আপনি কোন পাপের কাজ করেছেন।

আপনি না জেনেবুঝে করেছেন। আর আপনার বিবেক এজন্য আপনাকে ঘুমাতে দিচ্ছেনা, শান্তি দিচ্ছেনা। মানে হচ্ছে আপনি ভালো মানুষ এজন্য আপনার বিবেক আপনার সাহায্য করছে, যদি আপনি খারাপ মানুষ হতেন তবে আপনি ভালো থাকতেন পাপ কাজ করার পরেও।

আবার মনে করেন মামা, আপনি কোন এক হতাশার মাঝে আছে। আপনার সব আছে তবুও কেন?? এইসব ভ্রান্ত ধারণার কারণে। মানে হচ্ছে আপনাকে এর আগে যারা মেডিসিন দিয়েছে তা হলো শুধু ওষুধ। কিন্তু তা আপনার জন্য পর্যাপ্ত ছিলোনা। এখন আমি আপনার জন্য একটা ওষুধ এনেছি। আপনার ঘরেই ছিলো। অনাদরে অনাসৃত অবস্থায় আজকে আমি তা দেখেই বুঝলাম, এই ওষুধে আপনার কাজ হবে মামা।

– বলো কী আমার ঘরেই আমার ওষুধ ছিলো??
– মামা মনের সুখ দুনিয়ার শেরা সুখ। আমি খেয়েছি/ না খেয়েছি তা বড় নয়।

আমি ভালো আছি সুখে আছি তা অনেক বড়। এবার ভাবুন মামা, আপনার এতো থাকার পরেও কেন আপনার অসুখ। আসলে মামা আপনি অতিরিক্ত ভেবে ফেলেন কোন বিষয় নিয়ে। আপনি বারবার ভুলে যান “আমি আপনি মানুষ” কেন জানি আপনি ভুলে যান আমরা মাটির মানুষ। এতো থাকার পরেও কিসের অপূর্ণা মামা??

হ্যাঁ মামা অপূর্ণা আছে তবে তা হচ্ছে সম্পদ বা টাকার নয়। তা হচ্ছে ঈমানের, আখলাক খোদাভিতীর। মামা আপনি অসুস্থ কেন জানেন?? আল্লাহর তায়ালার রহমত আপনার উপর ছিটেফোঁটা নেই। কেন নেই?? মামা আপনি নামায পড়েন না। বেনামাজি কে আল্লাহ অপছন্দ করেন। মামা আপনি শুধু ঈদে মসজিদে যান। মামা কেন ভুলে যান এসব কিছু হারিয়ে যাবে কিন্তু মরতে হবে আমাদের সবায় কে। মামা এর কারণে আপনি অসুস্থ।

মামা আপনি গ্রামে গানের আয়োজন করেছেন কিন্তু দ্বীনের পথের জন্য মাহফিল এর আয়োজন করেননি। শিশুরা স্কুলে যাবে আপনি তার উপর জোর দেননি। মামা আপনি এই গ্রামের মাথা, আপনাকে আগে ভাবতে হবে। শুধু আপনি উচ্চবংশীয় বলে আপনার সন্তান ঢাকাতে বড় স্কুলে পড়বে আর গ্রামের মানুষ পড়বেনা তা না মামা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। মামা তার সাথে ইসলাম ফরজ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি নামায পড়েনা। যে কোরআন পড়েনা। যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেনা।

আল্লাহ তাকে অসুস্থ রাখেন। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ তাকেই ভালোবাসে যে আল্লাহকে ভালোবাসে। মামা আপনার ওষুধ ওই মসজিদ। আমি কছম কেটে বলতে পারি আগামী ৪০ দিন আপনি নামায পড়বেন ৫ওয়াক্ত তারপর তাহাজ্জুদ এর নামায পড়বেন। এবং আপনার গ্রামের সব মানুষ কে কড়াভাবে বলবেন নামায পড়তে। নাহলে তার শাস্তির বিধান হবে। দেখবেন আল্লাহ এই কারণে জান্নাত এনে দেবে। সুখের রাজা চলে আসবে। এর থেকে ভালো ওষুধ আর নেই। যেখানে আল্লাহর কালাম নেই। সেখানে সুখ আসবে কোথা থেকে?? মামা আপনি আল্লাহ কে ডাকুন। আর ওইসব রোগটোগ কিচ্ছুনা। যারা এসেছিলো সবায় টাকা খাবার জন্য এসেছিলো। আপনি সুস্থ কেন আপনি ওষুধ খাবেন কেন মামা?

মামা আপনি আজ থেকে আপনার ওই বিরাট বাড়িটি একবার পবিত্র করে নিন হুজুর ডেকে। তারপর আগামীকাল থেকে হুজুরের কথামতো সবায় চলবেন। উনি আপনাদের জান্নাতে নেবেন। উনি আপনাদের সুখ দেবেন। দুনিয়ার আর কেউ পারবেনা। শুধু নামায পাড়বে, আর ওই পবিত্র আল্লাহর ঘর পারবে। মামা আপনি আর বসে থাকবেন না। এমন মন মরা মন খারাপ মানায় না আপনার। আপনি প্রাণ খুলে হাসবেন। ফজরের নামায পড়ে নির্মল বাতাসে আপনি দ্বীর্ঘস্বাস ছাড়ুন তারপর দেখুন কতটা ভালো লাগছে। আর কত পবিত্র লাগছে। ইশ মামা এটা কোন রোগই না। আমি দুদিন বাদে চলে যাবো। আর খোঁজ নেবো। আমার ধারণা সবকিছু বদলে যাবে সবকিছু।

আমি সবার সাথে কথা বলেছি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক কিংবা মসজিদের ঈমাম যারা ভালো মানুষ তারা এই গ্রাম কে ইসলামি গ্রাম বানাবে। সব কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, আর কূটনীতি দূর হবে এই সুন্দর গ্রাম থেকে। এ যেন পুতুলের মতো গ্রাম মামা। পরেরদিন সকালে দেখি মামা সবায় কে নির্দেশ দিলো গ্রামে আজ বিকালে সবায় যেন জমিদার বাড়িতে আসে। তারপর স্কুলের শিক্ষক আর মসজিদের ঈমাম আসে। তারপর সবায় একত্রিত হলে উনি আমার বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করে। আর গ্রামের মানুষ গুলো মেনে নেয়। অবশ্য ওইদিন থেকেই সবায় মসজিদ মুখি হয়।

কয়েকদিন পরের কথা আমরা এখন ঢাকাতে মামাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। আমিও মায়ার সাথে অনেকদিন জমিদার বাড়িতে থেকে দারুণ কিছু কাজ করতে পেরে ধন্য মনে হচ্ছিলো। তারপর অবশ্য আমি আমার পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মায়ার সাথে সম্পর্ক ঠিক থাকলেও ওর মামার খোঁজখবর তেমন রাখা হয়না। একদিন মায়া আমাকে বলল, “শোনো মেঘ আগামীকাল তুমি সন্ধায় আমার বাসায় আসবা তারপর রাতে ডিনার করে মেসে যাবা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, বাবা আসতে বলেছেন” কী ভেবে যেন আমিও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। তারপর এ কথা সে কথা নানান কথা। মায়ার সাথে পরেরদিন দেখা করলাম তারপর সন্ধায় ওদের বাসায় গেলাম। আমাকে সবায় আপ্যায়ন করলো। ওর ওই মামাকে দেখে আমি তো অবাক। বড়বড় চুল আর নেই। রাজকীয় গোফ নেই। সুন্দর দাড়ি রেখেছেন। সুন্নতি পাঞ্জাবী আর পাজামা পরেছেন। তাছাড়া হাতে তসবি আর মাথায় টুপি, আমি তাকে হ্যান্ডসেক করতে চাইলে উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উনার হাসিহাসি মুখ দেখে আমি খুব মুগ্ধ হলাম। অনেক ভালো লাগল আমার।

ওই রাতেই খাবার টেবিলে বসে মায়ার বাবা আমার খোঁজখবর নিলেন, তারপর উনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন বলে একটা দাবী জানালেন। আমি যেন অবাক থেকেই অবাক হলাম। মায়ার মামা অবশ্য এসব করেছেন উনার হাসিমুখ দেখেই আমি বুঝলাম।

এরপরে আমি আমার বাবা মা কে বললাম। বাবা মা এলেন। মায়াকে দেখে আম্মার তো খুব পছন্দ! আম্মা তার নিজের মেয়ের মতো করে নিলেন তারপর এঙ্গেজড করে দিলেন। এ যেন স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে ভালোবাসার মানুষ কে কাছে পাওয়া। আর মামা আমাকে বললেন “সেই ভাঙ্গাচোরা মসজিদ ভেঙ্গে ওখানে ৩ তলা মসজিদ হচ্ছে, আর স্কুলে ভেঙ্গে ৫ তলা হচ্ছে। তার পাশেই একটা হসপিটল করা হচ্ছে। তোমার পড়ালেখা শেষ হলে স্কুলে মায়া জয়েন্ট করবে আর তুমি হসপিটলে আমার গ্রাম কে আমিও স্বর্গীয় গ্রাম বানাতে চাই” এই কথাগুলো যেন আমার কানে স্বপ্নের মতো ভাসতে শুরু করছে। সব অসুখ যেন দুঃখের নয়। কিছু অসুখ জান্নাত এনে দেয়…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত