পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি কেউ এক জন বাতাসে এলোমেলো আমার খুলে রাখা চুলের ছবি উঠাচ্ছে। রাগে তো আমার অবস্থা খারাপ। মনে হচ্ছে ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে সাগরে ছুড়ে মারি। আজব ছেলে! ওর মুখো মুখি দাড়িয়ে আছি তবুও ঠুসঠাস ছবি উঠিয়েই চলেছে! প্রাণের মায়া নেই নাকি? রাগে আমার কথা বেরুচ্ছে না। কষ্টে চোখে জল না এলেও অতি রাগে আমার আবার চোখে জল চলে আসে।
কক্সবাজার এসেছি লেখালেখির নতুন বৈচিত্র্য খুঁজতে, সারা দেশের দর্শনীয় স্থান গুলোতে আমি যাই শুধু এই একটা কারণেই। পড়ন্ত বিকেলে একলা এই সাগর সৈকতে খালি পায়ে হাটছিলাম কিছু একটা অনুভব করার জন্য যা আমার লেখার উপাদান হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এই ফটোগ্রাফার তো মনে হচ্ছে আমার লেখার অন্য রকম একটা উপাদন সৃষ্টি করেই ছাড়বে। আমি কিংকং দৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন বিদঘুটে ফেস সে ক্যামেরাতে আটকাবে না সেটা আমি শিওর। সে ক্যামেরাটা নিচে নামাতেই আমার রাগী মুখটা হঠাৎ হতভম্ব আকৃতি ধারণ করলো।
-নয়না একটু সাইড হয়ে দাড়া
–রবি তুই?
–কেনো আমার মরার খবর পেয়েছিলি নাকি যে এত অবাক হচ্ছিস?
–সেটা কখন বললাম?
–তোর চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে যে, আমি বোধ হয় সদ্য কবর থেকে উঠে এসেছি, এখনো গায়ে কাফন জড়ানো আছে আর তুই ভুত দেখছিস।
–তোর সাথে এ ভাবে দেখা হবে ভাবিনী তাই একটু অবাক হয়েছি
–তো কি ভাবে দেখা হবার কথা ছিল?
–অনেক বছর ধরে তোর সাথে যোগাযোগ নেই তাই জানি না আসলেই কি ভাবে দেখা হবার কথা ছিল।
–নিজের নম্বরটা বদলে ফেলার পর নতুন নম্বরটা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিসনী, তুই প্রেম বিরাগী সেটা জানতাম তাই বলে বিবাগী হবি? যাই হোক বেশ করেছিস।
–ফটোগ্রাফার কবে থেকে হলি?
–কবে থেকে হয়েছি সেটা সেলিব্রেট করার জন্য সেই তারিখটা মনে রাখিনী।
–হঠাৎ তোর জীবণের লক্ষ্য ফটোগ্রাফি কেনো হলো?
–তোর জীবণের লক্ষ্য যে কারণে লেখালেখি হয়েছে ঠিক সেই কারণেই আমার জীবণের লক্ষ্যটাও ফটোগ্রাফি হয়েছে। কি করবো বল আমি তো আর তোর মত লিখতে পারি না, যেটা পারি সেটাই করছি।
–হুম বুঝলাম কিন্তু তুই একা যে? তোর অনু কোথায়?
–অনেক দিন ধরে যোগাযোগ নেই তাই জানি না।
–মানে? নিজের বউয়ের সাথে তোর যোগাযোগ নেই এটা কেমন কথা?
–কে নিজের বউ?
–অনু
–কবে আবার আমি বিয়ে করলাম?
–অনু তো আমাকে ওর বিয়েতে ইনভাইট করে ছিল, আমি শহরের বাহিরে ছিলাম তাই যেতে পারিনী। তবে তুই ইনভাইট করিসনী বলে আমার কিন্তু খুব রাগ হয়ে ছিল রবি
–অনু কি তোকে বলে ছিল যে,আমার সাথেই ওর বিয়ে হচ্ছে?
–এটাতে বলার কি আছে রবি? তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস তাই বিয়ে হবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?
–আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম আর সেটা আমরাই জানি না অথচ তুই সব জানিস?
–তোদের বিষয়টা খুব গোলক ধাঁধা মনে হচ্ছে। তুই কি অনুকে ভালোবাসতিস না?
–নয়না তুই কিন্তু আগে থেকেই জানতি যে, আমি এই সব প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে একদম সিরিয়াস ছিলাম না আর আজো নেই। সেখানে অনুকে ভালোবাসা! হাউ ফানি!
–তাহলে তুই কাকে বিয়ে করেছিস রবি?
–তোর সাথে থেকে থেকে আমিও যে কখন চিরকুমার ব্রততে যোগ দিয়ে ছিলাম তা নিজেও জানি না। আমি রবির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ছেলেটা আমার মত বিরাগী জীবণ কেনো বেছে নিয়েছে?
–কি দরকার ছিল চিরকুমার ব্রততে যোগ দেয়ার?
–কি করবো বল তো নয়না, মনে প্রেম না থাকলে বিয়ে করে লাভ কি? শুধু শুধু জীবণে অশান্তির বীজ বপন করার কি দরকার? এই তো দিব্যি সুখে আছি।
রবির সাথে ঠিক কত বছর পর আমার দেখা হলো সেটা আমার মনে নেই। ইন্টার পাশ করার পর আমরা আলাদা ভার্সিটিতে চলে যাবার পরেও দুই বছর আমাদের যোগাযোগ ছিল তারপর দৃষ্টির আড়াল মনের আড়াল হয়ে গেছিল। তবে সিক্স থেকে ইন্টার পাশ করা পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের বন্ধু ছিল রবি।
রবির সাথে কথা শেষ করে চলে আসতেই সে পেছন থেকে ডাক দিলো,
–নয়ন আমাকে একবারও রুবি ডাকবি না?
ওর কথা শুনে হুট করেই আমার চোখ জলে ভিজে গেলো। এমন হুটহাট চোখে জল আসাটাকে আমার বেঠিক লাগে। এই জল রবিকে দেখানো যাবে না। তাই চোখ মুছে একটা মিথ্যা হাসি মুখে এঁকে ওর দিকে তাকালাম। আর মিথ্যে হাসির রেখা মুখে এঁকেই বললাম-
–এখনো মনে রেখেছিস সেই নামটা?
–তোকে যখন ভুলতে পারিনী তখন তোর দেয়া নামটা কি করে ভুলি বল তো?
–ভালো থাকিস রুবি
–দাড়া নয়ন,একটা কথা জেনে যা। তোকে ক্যামেরাতে বন্দী করেছি। কারো জীবণে তো তুই বন্দী হলি না তাই এই তুচ্ছ জিনিসেই না হয় বন্দী হয়ে থাক চিরকাল।
হোটেলে ফিরে গিয়ে ভেবে ভেবে কিচ্ছু মেলাতে পারলাম না। অনেক বছর আগে আমার ফোন নম্বর বদলে ফেলে ছিলাম। কোনো বন্ধুর সাথেই যোগা যোগ রাখিনী ইভেন রবি আর অনুর সাথেও নয়। ভেবে ছিলাম ওরা সুখে আছে থাক না! কি দরকার ওদের মধ্যে ঢোকার? আমি যখন চিরকুমারী ব্রততে নিমজ্জিত ঠিক তখনই রবি এসেছিল আমার জীবণে নতুন করে। ভুল যায়গায় মন লেন-দেন এর কারণে আমার মনের হাল বেহাল হয়ে গেছিল। অবশেষে দেখলাম এটাকে লেন-দেন বললে ভুল হবে। মন শুধু দেন হয়েছে লেন হয়নী। সজলের সাথে আসলে আমার কখনো ব্রেকআপ হয়নী। সম্পর্ক হলেই না ব্রেকআপ হবে। সম্পর্কই তো কখনো হয়ইনী এমন কি একটা কথাও কখনো তার সাথে হয়নী।
হাইস্কুল জীবণের বন্ধু ছিল অনু, রাখী আর রবি। আমরা এক সাথে এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. পাশ করেছি। হাইস্কুল জীবণ থেকেই রবি সব সময় ফাজলামীতে ওস্তাদ ছিল। আমরা তিনজন মেয়ে বান্ধবীর মধ্যে রবি ছিল একাই ছেলে। তাই আমি ওকে রুবি বলে ডাকতাম। প্রথম প্রথম সে ক্ষ্যাপলেও পরে ওর নামটাই রুবি হয়ে গেছিল। আমি আর রবি ফাজলামীতে সমান সমান ছিলাম। রবি আমাকে নয়না না বলে নয়ন বলে ডাকতো আর কথায় কথায় বলতো এখনো সময় আছে নয়ন আমাকে প্রোপজ কর। এই সব নিয়ে হাসি ঠাট্টায় দিন গুলো বেশ কাটছিল।
আমি হঠাৎ আমাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়ার ছেলে সজলের প্রেমে পড়ে যাই। তখন আমি নাইনে পড়ি। আর সজল কলেজে পড়ে। ছাদে দাড়িয়ে চোখা চোখি প্রেম। ছেলেটাও ফিরে ফিরে তাকায়, আহ্ কি দারুণ মোমেন্টস! মনে হয় যুগ যুগ ধরে ঐ চোখে চেয়ে বার বার নিজের অস্তিত্ব বিলিন করি। সে হাই সাউন্ডে রোমান্টিক গান বাজায়, মনে হয় গানের কথা গুলো সে আমাকে বলতে চায়, বা গানে গানেই সে আমাকে কথা গুলো বলছে এমন টাইপের কিছু। রোজ বিকেলে দু জনার ছাদে যাওয়া যেনো ডিউটি হয়ে গেলো। কি দারুণ অনুভূতি! থেকে থেকে মনের ভেতর একটা খুশির ঢেউ বইয়ে যায়। তার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরে একটা অচেনা ব্যাথা চিনচিন করে উঠে। আজব সেই ব্যাথা, সুখ দুঃখ এই দুটো অনুভূতিতেই ব্যাথার রূপ একই রকম।
সজলদের বাড়িওয়ালার মেয়ে টুম্পা তখন ফোর এ পড়তো, সজল ওর কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করতো। মেয়েটা আবার সেসব কথা আমাকে বলতো। সজল নাকি আমার কথা জিজ্ঞেস করার সময় আমাকে সুনয়না বলে ডাকে। ওদের বাড়িওয়ালার ছেলে রফিক আমার ক্লাশমেট ছিল। যদিও রফিক আবার বেস্ট ফ্রেন্ডের তালিকায় ছিল না কিন্তু সজলরা ওদের বাসায় থাকে সেই সুবাদে রফিকের সাথে যেচে দু একটা কথা বলতাম। কিন্তু হারামী পোলা একটি বারও সজলের নাম মুখে আনতো না।
সজল দিন রাত রফিকের সাথে বসে আমাকে নিয়ে গুজুর গুজুর করতো, সে গুলো শুনে এসে টুম্পা আমাকে বলতো। এই ভাবে চার পাঁচ মাস কেটে গেলো। তবুও মুখে কেউ কিচ্ছু বলতে পারলাম না। সজলের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, তার চশমার ওপাশে থাকা চোখ দুটোতে আমার জন্য একটা ভালোবাসার নদীর জন্ম হয়েছে। তবুও মন চাইতো সজল একটা বার মুখ ফুটে বলুক যে,
-“নয়না আমি তোমাকে ভালোবাসি”
অপ্রকাশ্যেই ভালোবাসার বয়স এক বছর হয়ে গেলো। এক দিন হঠাৎ স্কুল থেকে ফিরে দেখি সজলদের বাসার সামনে ট্রাক দাড়ানো। টুম্পার থেকে শুনলাম সজলের বাবার ট্রান্সফার হয়েছে ওরা আজ চলে যাবে। আমি সেদিন স্কুল ব্যাগ ফেলে দৌড়ে ছাদে গেলাম। দেখলাম সজল দাড়িয়ে আছে। আমার ছলছল নয়নে আমি সজলকে ঝাপসা দেখছি। তবুও দেখতে পাচ্ছি ছেলেটার চোখ দুটোও জলে ঝাপসা হয়ে আছে। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল-
–“সজল আমি তোমাকে ভালোবাসি প্লীজ তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা!”
বলা হলো না, বলতে পারলাম না। দুটো মানুষের দুটো মন, চাপা কষ্ট আর চাপা ভালোবাসাকে ভেতরেই চেপে হত্যা করে দাড়িয়ে থাকলাম। সজল নির্বাক চেয়ে থেকে চলে গেলো। মনে হলো তার অনেক কিছুই বলার ছিল কিন্তু বলে আর কোনো লাভ নেই সেটা বুঝেই হয়ত কিছু না বলেই চলে গেলো। তবুও কিছু একটা বলে তো যেতে পারতো! বলতে তো পারো যে,
–“নয়না তুমি অপেক্ষা করো আমি এক দিন ঠিক আসবো, আমি আসবোই শুধু তোমার জন্য! আমি আসবো নয়না তোমার জীবণে আবার নতুন করে!” কিন্তু সে নির্বাক চোখের জলে কি বুঝিয়ে গেছিল তা আমার অপরিপক্ক মনটা বুঝে উঠতেই পারেনী। সেই ভাষাটা আজো আমার বোধগম্য হয়নী।
সন্ধ্যায় সজলরা চলে গেলো, সেই থেকেই শুরু হলো আমার জীবণের নতুন অধ্যায়। ছয় মাস কেটে গেলো নিজেকে সামলে নিতে। আমাদের বাসার টেলিফোন নম্বরটা সজল জানতো তবুও কখনোই সে ফোন করেনী। আসলে এই ভালোবাসাটা যে এক তরফা ছিল সেটাই বহু ভাবে প্রমানিত। তাই মন লেন দেন নয় ওটা ছিল শুধু মাত্র মন দেন।
সামনে এস.এস.সি. এক্সাম,ওয়ান সাইডেট লাভ বড্ড যন্ত্রণা দায়ক; এগুলো যে জীবিত রাখতে নেই সেটা কি করে যেনো মনটা বুঝে গেছিল তাই মনের ভেতরের সব অনুভূতি গুলোকে কবর না দিয়ে পুঁতে দিলাম।
এস.এস.সি. পাশ করার পর কলেজ জীবণেও রাখী, অনু আর রবি আমার পাশেই থেকে গেলো। আমিও জীবণটাকে স্বাভাবিক করে নিলাম। হাসি ঠাট্টা ফাজলামী করে দিন গুলো কাটাতাম শুধু মাত্র একটি মানুষকে ভুলে থাকার জন্য। যদিও সেটা ভুলে যাওয়া হয়নী। ওকে ভুলেই যদি যেতাম তবে প্রেমবিরাগী হতাম না। বিয়ে করে সংসারীই হতাম।
কলেজ জীবণে এসে রবির ফাজলামীর রঙ রূপ বদলে গেলো। ছেলেটা ভেরী জলি মাইন্ডের ছিল আর সারাক্ষণ ফাজলামী করে লাভিউ লাভিউ করতো। আমি সেটা সব সময়ই ঠাট্টা হিসেবেই নিয়েছি ইভেন আমার সব ফ্রেন্ডরাই রবির ফাজলামীকে কখনোই সিরিয়াস ভাবে নেয়নী।
ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে রাখী ওদের পাড়া পরশীর প্রেমে পড়ে গেলো। চিঠি আদান প্রদানসহ ক্লাশ কামাই করে মুভি দেখতে যাওয়া, রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো সব মিলে রাখীর জীবণটা প্রেমময় হয়ে গেলো। ওদিকে দেখতাম অনু রবির প্রতি বেশ দূর্বল। কিন্তু রবি সেটাও ফাজলামীতে এড করে নিয়ে ছিল। অনুও সিরিয়াস ভাবে কিছুই বুঝাতে চাইতো না। তাই আমরা কেউই তা সিরিয়াস ভাবে নিইনী। আর ভালোবাসলেই বা কি ক্ষতি? এক দিন রবিকে বললাম-
–অনু বোধ হয় তোর প্রেমে পড়েছে রে রুবি, যাহ্ তুই ফাঁইসা গেছস মাইনকার চিপায়
–পড়তে দে, পড়তে দে, পড়ে পড়ে এক দিন অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক উঠে দাড়াবে।
–বলিস কি রুবি? ওর ভালোবাসাকে এই ভাবে লুটিয়ে ফেলে রাখবি?
–তুই আমাকে ভালোবাসিস নয়ন?
–কি আজগবি কথা বলছিস রাম ছাগল? জানিস না যে, আমার এই সব প্রেম টেম আসে না?
–হাহা জানি তো, এমনেই টেস্ট করলাম যে, তুই সুস্থ হই গেছস নাকি?
–অনু তোকে ভালোবাসে আর সে এবং তার ভালোবাসা একদম সুস্থ।
–কিন্তু আমি তো তোকে ভালোবাসি নয়ন, আলাভু
–কি ফালতু কথা বলিস? সত্যি সত্যিই তুই আমার প্রেমে পড়ে গেছিস নাকি রুবি?
–হাহা আরে নাহ, প্রেম করতে চাইলে বহু আগেই প্রেম করতে পারতাম। তোর মত আমারও এই সব আসে না।
–কেনো তুইও কি আমার মত অনুভূতি গুলোকে পুঁতে রেখেছিস নাকি?
–তুই তোর অনুভূতি গুলোকে কেনো পুঁতে রেখেছিস নয়ন?
–হাহা আরে এমনিই বললাম, আসলে আমার এই সব প্রেম টেম ভাল্লাগে না
–হাসি দিয়ে গোপন কষ্ট যে আড়াল করে রাখিস সেটা রবি বুঝতে পারে। সব ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু কর নয়ন।
–কার সাথে শুরু করবো? তোর সাথে রাম ছাগল? হিহি
–অমা! এটা বলছি নাকি? আমার এই সব প্রেম টেম কারর ইচ্ছা থাকলে সেই 1971 সালেই করতাম বুঝলি পেত্নী
–এই জন্যই তো তোরে এত্তো ভাল্লাগে
–কিহ্ এই জন্য আমারে তর ভাল্লাগে? তর মত খারাপ পঁচা মাইয়া আমি আর দুইডা দেখি নাই।
–ক্যারে? আমি আবার কি করলাম?
–কিছু না, যাহ এখন বাড়ি গিয়া ঘুমা
এই ভাবেই আমাদের ইন্টারের দুটো বছর কেটে গেলো। আমি বুঝতে পারতাম যে, রবি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু আমি আর রবি দু জনেই সেটাকে ঠাট্টা দিয়ে ঢেকে রাখতাম। মাঝে মাঝে ওর কথা শুনে পুঁতে রাখা অনুভূতি গুলো জেগে উঠতে চাইতো। সজলের প্রতি বিরহ বেদনা গুলো ধপ করে মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠতো। আমি আবার তা ধামা চাপা দিতাম। অনু রবিকে ভালোবাসে সেটা অনুর কাছাকাছি থেকে বুঝতে পারাটা কঠিণ কোনো বিষয় নয়। তাই বুঝেই গেছিলম। কিন্তু এটা মেনে নেয়াটা কেনো জানি না আমার পক্ষে কঠিণ হয়ে গেছিল।
অনু যদি রবির প্রতি দূর্বল না হতো তবে হয়ত আমি কখনোই রিয়্যালাইজ করতাম না যে, রবিকে আমার ভালো লাগে আর সেই ভালো লাগাটা অনেকটাই ভালোবাসার কাছাকাছি চলে গেছে। রবি অন্য কারো হয়ে যাবে এটা ভাবতেই যেনো আমার কেমন লাগতো। কিন্তু আমি যে বিরাগী জীবণটা বেছে নিয়েছি সেখানে এই ধরনের অনুভূতি মানায় না। আমি সজলের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চাইনা আর সজলকে ভুলতে প্রতিষেধক হিসেবে অন্য কাউকে জীবণে জড়াতেও চাই না। আমি জানি আমি দূরে চলে গেলে রবি হয়ত একদিন অনুকে ঠিক ভালোবাসবে তাই ইন্টার পাশ করার পর ইচ্ছে করেই আলাদা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ছিলাম। প্রথম দু বছর ওদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও দু’বছর পর থেকে তা আর ছিল না।
আমি লেখালেখির জগতে ঢুকে গেলাম। এটাই সব কিছু ভুলে থাকার মহাষৌধ। পুঁতে রাখা ভালোবাসাকে ভুলে থাকার জন্য এত কিছু! আশ্চর্য্য ঘটনা! দু’ জন মানুষই ভবঘুরে জীবণ বেছে নিয়েছি। আজ বুঝতে পারছি রবির এই ভবঘুরে জীবণটার জন্য আমিই দায়ী। আমি প্রেম বিরাগী বলে সে সিরিয়াস ভাবে ভালোবাসার কথা বলতে সাহস পায়নী। কিন্তু আমারই বা কি করার ছিল? ভেবে ছিলাম সে অনুকে নিয়ে সুখেই আছে। আমার এই রস কষবিহীন শুষ্ক জীবণে আমি যে কাউকেই জড়াতে চাইনী।
মনে মনে ডিসাইড করলাম আমার এই লেখালেখির একলা জগতে এবার রবিকে সঙ্গী করবো। তাই কোনো ভাবেই রাতটা কেটে গেলেই ভোর বেলা আমি যাবো রবির কাছে। রবি নিশ্চয়ই এখনো আমাকে ভালোবাসে! কাল সিরিয়াস ভাবে ওকে প্রশ্ন করবো, যদি আগের মত ফাজলামী করে উত্তর দেয় তবে ওর গালে ঠাডিয়ে একটা চড় বসিয়ে বলবো- ” রবি আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। তুই আমার বাকী জীবণ পথের সঙ্গী হবি?” রবি নিশ্চয়ই খুশিতে কেঁদে ফেলবে! ওর কাঁন্না দেখে আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো তো? এই সব নানান ভাবনায় রাত গভীর হয়ে গেলো তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনী। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাহিরে বেরুতেই হোটেল বয় আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো-
–ম্যাম খুব ভোরে একজন লোক আপনাকে এটা দিতে বলে চলে গেছে
আমি বুঝতে পারলাম না যে, এই অচেনা জায়গায় আমাকে লেটার কে পাঠাবে। যাই হোক খুলে দেখি- “নয়ন তোকে দেখে সেই কলেজ জীবণের মত অনুভূতি অনুভব করলাম। জানিস নয়ন সেই ছোট বেলা থেকেই আমি তোকে ভালোবাসতাম। এত বছর পর তোর মুখোমুখি হয়ে জানলাম যে, আমি তোকে আজো ভালোবাসি। তোর মত অনুভূতি গুলো পুঁতে রেগে বৈরাগী জীবণ বেছে নিয়ে ছিলাম। আজ সেই পুঁতে রাখা অনুভূতি গুলো আমার সামনে এসে বার বার বলছে, রবি তুই নয়নাকে ভালোবাসিস। আমি কি করি বল তো নয়ন? তোর বিরাগী জীবণে কোনো কালেও তুই আমাকে তোর পাশে রাখতে চাসনী তাই সাহস করে তোকে কিছুই বলা হয়নী।
যখনই তুই আমাকে প্রশ্ন করেছিস আমি তোকে ভালোবাসি কি না, তখনই ভয়ে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি সব। আর বুঝেই বা কি করবি? তোর অনুভূতি গুলো তো পুঁতেই রেখেছিস। ভেবে ছিলাম সকালে তোর সাথে দেখা করে বলবো- ” নয়ন আমি তোকে আজো ভালোবাসি রে, তুই আমাকে তোর বাকী জীবণ পথের সঙ্গী করবি?” কিন্তু বলা হলো না, আর কখনো বলা হবেও না। বুকের ভেতরে তোর জন্য জমা রাখা ভালোবাসা গুলো দিন রাত যাতনায় যাতনায় আমাকে গ্রাস করে ফেলবে তবুও আমি নিজের জন্য কিচ্ছু করতে পারবো না। যাই হোক চিঠিটা পাবার পর হয়ত আমার প্রতি তোর খুব খুব রাগ হবে। আমাকে ঝাড়ি মারার জন্য ফোনটা হাতে নিবি তাই নম্বরটা বদলে এই সাগর সৈকত ছেড়ে চলে গেলাম। ভালো থাকিস রে নয়ন, খুব ভালো থাকিস। রবির নয়নের তারা হয়ে যে তুই সারা জীবণ থেকে গেলি তার বিশ্লেষণ রবির কাছে নেই রবি”
গোটা চিঠিটা স্পষ্ট দেখে পড়তে পারলাম না। প্রথম লাইনেই অশ্রু এসে চোখ ঝাপসা করে দিয়েছে। আমি হোটেলে আমার রুমের দরজার সামনে রবির চিঠিটা বুকে নিয়ে বসে পড়লাম। আজ সব কাঁন্নার বাঁধ ভেঙে গেছে তাই আজ কাঁদতে বারণ নেই। আমি হাউ মাউ করে কাঁদছি। চিঠিটাকে এমন ভাবে বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছি যে,মনে হচ্ছে এটা কোনো অমূল্য সম্পদ। হঠাৎ মাথায় কেউ হাত রেখেছে অনুভব করলাম। চোখ খুলে মুখটা উপরে তুলতেই দেখি রবি। আমি ওকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো
–আমার চিঠি পড়ে কাঁদছিস কেনো নয়ন? তোর কি হয়েছে? আমি ওকে কিচ্ছু বলতে পারছি না, আমার স্বর আটকে আছে। আর অজবুত রাম ছাগলটা এমন একটা ভাব করে তাকিয়ে আছে যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না। আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম-
–বান্দর কুত্তা বিলাই শিম্পাঞ্জী আমারে চিঠি দিছস ক্যা?
–তোর রিয়্যাকশন দেখার জন্য দিছিলাম। আর আড়ালে দাড়াইয়া তোর রিয়্যাকশন দেখতে ছিলাম। বুঝসই তো যে, স্বভাব বইলা একটা কথা আছে
–কি রিয়্যাকশন দেখতে চাই ছিলি রাম ছাগল?
–যেইডা দেখতে চাইছি সেইডা দেইখ্যা ফ্যালাইছি। শোন তুই আবার ঐ চিঠির কথা গুলান সত্যি ভাবস নাই তো?
রাম ছাগলটা আবার ফাজলামী শুরু করেছে। ওকে শেষ একটা উচিত শিক্ষা দেয়া উচিত তাই দেরী না করে ঠাডিয়ে ওর বাম গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। সে হাত দিয়ে গাল ধরে রেখে বললো-
–চোখে দেখতে পাস না ডাকু নারী, আমি এখন বড় হইছি? তুইও তো বড় হইছস, এই বয়সেও মারা মারি করস? আমি ওর ডান গালে ঠাডিয়ে আরেকটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম-
— এই রাম ছাগল আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। তুই আমার বাকী জীবণ পথের সঙ্গী হবি? রবি ডান হাত দিয়ে বাম গাল আর বাম হাত দিয়ে ডান গাল ধরে রেখে আতঙ্কিত স্বরে বললো-
–হবো
আমার চোখ আবার জলে ঝাপসা হয়ে গেলো। রবি গাল ধরেই হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে। তারপর সে আতঙ্কিত স্বরেই বললো-
–একটা কথা বলবো নয়ন?
–বল
–যদি বলি সঙ্গী হবো না তাহলে কি তুই আবার মারবি নাকি ডাকুরানী?
–মারবো না, খুন করবো
–আরেকটা কথা ছিল
–বল
–আমি কি ফডু তোলা ছাইরা দিমু?
–ক্যারে?
–অন্য মাইয়ার ছবি তুললে আবার তুই পিডাইবি না তো?
ওর কথা শুনে এবার আমি ভেজা শিক্ত নয়নেই হাসতে শুরু করলাম। আর রাম ছাগলটা মুগ্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো-
–তোর পুঁতে রাখা সুপ্ত অনুভূতি গুলো মুক্তির আনন্দে চারপাশে নেচে চলেছে, তুই দেখতে পাচ্ছিস নয়ন? সেই তুই আমার জীবণে এলিই, খালি খালি এতটা বছর ডোবায় নির্গত করলি, আসলেই তুই খুব একটা সুবিধার নয়। জানি না আমার বাকী জীবণের কি হবে!
–বাকী জীবণ তোকে আমার উপন্যাসের নায়কের মর্যাদা দান করবো। হিহি
আমরা দুটি ভবঘুরে মানুষ ঘরবাঁধবো সেই আনন্দে সত্যিই আজ আমার সুপ্ত অনুভূতি গুলো বাহিরে এসে ডানা মেলেছে।