সেদিন বিকেলে আমার ঘুম ভাঙে অঞ্জলির ফোনে। দেখা করতে চাচ্ছে আমার সাথে। অঞ্জলির কলে একটা বিশেষত্ব আছে। আমার ফোনে অনেকেরই ফোন আসতে পারে, আমার অফিসের কলিগ অথবা ঊর্ধ্বতনদের কেউ বা বাড়ি থেকে । তবে অঞ্জলির কল আসলে কিভাবে যেনো ফোনের স্ক্রিনে না তাকিয়েই বুঝতে পারি এটা ওর কল। বিশেষত্ব ওর কলের নাকি আমার নিজের সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।
অঞ্জলির সাথে মাস দুয়েক ধরে একবারও দেখা হয়নি। ও বেশ কয়েকবার চেয়েছিলো, আমি ইচ্ছে করেই দেখা করিনি। তবে সেদিন করলাম। আমাদের দেখা হলো অঞ্জলির ভার্সিটির ক্যাম্পাসে। কাগজী ফুল গাছটার নিচে লালরঙা ইটের বেঞ্চির উপর অঞ্জলি বসে আছে। আগে ওর সাথে দেখা করার সময় প্রতিবারই ওর চোখে মুখে কেমন হাসি ফুটে থাকতো। তবে এবার ওর মুখ একদম স্থির। ভাবলেশহীন একটা মুখ। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। একটা মৃদু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো?” আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। আমি চুপ করে রইলাম। অঞ্জলিই জিজ্ঞেস করলো, “একটা ভালো খবর আছে। জানো? “ভালো খবর! কার জন্য! আমার না তোমার! “আমাদের দুজনের জন্যই।” উত্তর দিলো অঞ্জলি। ওর উত্তরে এবার অবাক হলাম আমি। গত ক’মাসে আমাদের দুজনের জন্য কোনো ভালো কিছু ঘটেনি। সামনেও ভালো কোনো খবর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
“আমার বাগদান হয়ে গেছে, এই যে হাতে আংটি। সামনের সপ্তাহেই বিয়ে।” অঞ্জলির কথাটা পুরোপুরিভাবে বিশ্বাসযোগ্য। আমি জানতাম খুব শীঘ্রই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। ওর মতো নিখাদ সোনাকে পাবার জন্য অনেক ভালো ছেলেই অপেক্ষা করছে। “তা ঠিক বলেছো। তোমার বিয়েটা আমাদের দুজনের জন্যেই ভালো খবর। অবশেষে আমাদের এই সমস্যার একটা দিক হলো।” বললাম আমি। “আমাদের সম্পর্কটা তাহলে তোমার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছিলো? আসলে তা হবারই কথা, কম কাঠ খড় পোড়াওনি তুমি।” অঞ্জলির এমন প্রত্যুত্তরে একটা হোচট খেলাম, কথাটা এভাবে বলা উচিত হয়নি আমার।
” না! আসলে আমি সেভাবে বলিনি। আমাদের এ সম্পর্কটা আমার কাছে সবসময় খুবই মূল্যবান ছিলো। তবুও আমরা তো এক হচ্ছি না সেটা জানার পরেও এই কয়টা দিন একটা আশার মধ্যে ছিলাম। এই আশাটাও মনে খুব জটিলতা সৃষ্টি করতো। তোমার বিয়ের পর এই আশা আর জটিলতাটা আর থাকবে না।” একপ্রকার চুপ হয়ে গেলো অঞ্জলি। নিরবতা ভেঙে অঞ্জলি নিজেই জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা! তোমার নতুন কোনো চাকরি হয়নি?” খানিকটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে উত্তর দিলাম, “আমার বর্তমানে যে চাকরীটা আছে তার বেতনে তোমাকে নিয়ে বেশ সুন্দর ভাবেই দিনকাটানো যাবে। কিন্তু তোমার ফ্যামিলির এই বেতনে হবে না।” “হুম! আমি জানি।” কথাটা বলেই আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো অঞ্জলি। তিন মাস আগে অঞ্জলির বাবার কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যাপারটা তাকে বলেছিলাম। আমার আর অঞ্জলির সম্পর্কের কথা শোনার পর উনার মুখে খুবই স্বাভাবিক একটা ছাপ দেখলাম। যেনো তিনি এমনটাই চাচ্ছিলেন অথবা আমাদের সম্পর্কটা তিনি মেনে নিয়েছেন। তবে তার কথাগুলো ছিলো ঠিক তার বিপরীত, যখন তিনি আমার পেশা আর বেতনের পরিমানটা জানলেন।
আমার মতো পরিস্থিতিতে থাকা কোনো ছেলের কাছেই কোনো বাবা চাইবেন না তার মেয়েকে বিয়ে দিতে। আমিও নাকি চাইতাম না, যদি আমি তার জায়গায় থাকতাম তাহলে বুঝতে পারতাম। এখন নাকি আমি আবেগ আর নিজের স্বার্থের উপর আছি তাই বুঝতে পারছি না। অঞ্জলির বাবার কথাগুলো ছিলো ঠিক এইরকম। সেদিন উনার কথাগুলো খুব ভালোভাবেই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। সাথে সাথে একটা কনফিউশন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ছত্রিশ হাজার টাকার বেতনে নিজের পরিবারের সাথে নিজের বউকে রাখতে পারবো না? এতো কি প্রয়োজন হতে পারে একটা মেয়ের? অঞ্জলি এখনো নিশ্চুপ। “তবে তুমি চাইলে আমরা নিজেরাও বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু তোমার তাতে…!” খুব শক্তভাবেই বললাম কথাটা। “নাহ! তার দরকার নেই। নিজেরা বিয়ে করা আর পালিয়ে বিয়ে করা একই কথা। ‘পালানো’ শব্দটা কেমন যেনো অপরাধ টাইপের লাগে।” ” নিজের মুখেই কতো রকমের কথা বলো?” ওর বিরুদ্ধেই প্রশ্নটা ছুঁড়লাম।
অঞ্জলি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েদের দীর্ঘশ্বাস শুনলে ছেলেদের বুকে সত্যিই একটা জটিল কিছু অনুভব হয়। সে সম্পর্কে যেই হোক, হোক সে অপরিচিত কেউ। অঞ্জলির দীর্ঘশ্বাসে আমিও এমনই কিছু অনুভব করলাম। ” জানো! সবসময় আমি আমার পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী চলেছি, সবসময়। আচ্ছা! সবসময় যদি তাদের কথা অনুযায়ী চলি তাহলের নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কবে চলবো? ” অঞ্জলি বললো। তীব্র মেজাজে উত্তর দিলাম আমি, “একমুখে এতোরকমের কথা বলবে না। বুঝতে কষ্ট হয় আমার।”
“সরি! আসলে তা না। পালিয়ে বিয়ে করা সম্ভব না। কেনো সম্ভব না তা বলবো না। তুমি বুঝে নিও। না বুঝতে পারলে হয়তো পরে নিজেই জানতে পারবে অথবা বুঝতে পারবে।” লুকোনো রকমের উত্তর পেলাম অঞ্জলির থেকে। তবে কেনো সম্ভব না তা নিয়ে আর ঘাটিনি। সোজা জিজ্ঞেস করলাম, “আজ দেখা করতে চাইলে কেনো?” “দাঁড়াও, বলছি। তবে তোমার সাথে আজ না, অনেক আগে থেকেই দেখা করতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি ব্যস্ততা অথবা ব্যস্ততার অযুহাতে দেখা করোনি। অবশ্য আজকের দেখা করতে চাওয়াটা আগের দিনগুলোর চাওয়ার থেকে আলাদা।”
আমি মৃদু হেসে বলার চেষ্টা করলাম, “আসলেই ইচ্ছে করে দেখা করিনি।” খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো অঞ্জলি, “আমি জানতাম তুমি ইচ্ছে করে দেখা করোনি। আচ্ছা তোমার কাছে এখন কতো টাকা আছে?” অঞ্জলির প্রশ্নটাতে বেশ অবাক হলাম। দুই বছরের সম্পর্কে ও কখনো আমাকে এমন প্রশ্ন করেনি। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “একথা কেনো জিজ্ঞেস করছো?” “তুমি না জিজ্ঞেস করলে? কেনো দেখা করতে চাচ্ছিলাম?” “হ্যা, জিজ্ঞেস করেছিলাম। ” “আমার একটা উপহার লাগবে তোমার থেকে।” জিজ্ঞেস করলাম, “হুট করে নিজে থেকে চাইলে যে?” “আজকের পর থেকে আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই একটা উপহার নিতে চাচ্ছি, যেনো সবসময় আমার কাছে থাকে।”
অঞ্জলির কথার ফলে সত্যিই মনের মধ্যে হাল্কা ওলটপালট অনুভব হচ্ছে। ভালাবাসাটা জানান দিচ্ছে বোধ হয়।
স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, “এগার’শ টাকা আছে, এতে হবে মনে হয়। ” গিফট দিচ্ছো তুমি, এতে হবে কিনা তুমিই জানো।” বলতে বলতে মৃদু হাসলো অঞ্জলি। খুব বেশি দামি কোনো উপহার দেইনি অঞ্জলিকে। ও চেয়ে বসেছিলো আমার হাতে থাকা সস্তা ঘড়িটা। সেটাই দিয়েছিলাম। আমি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ব্যাপারটা ফিল্মি টাইপের হয়ে যাচ্ছে। তাই না?” “তা হোক! আমার এটাই পছন্দ।” অঞ্জলি হেসে উত্তর দিলো।
“তোমার বিয়েটা কবে যেনো?” আমার প্রশ্নে অঞ্জলির হাসিটা উবে গেলো।
“এইতো সামনের সপ্তাহে। কেনো? বিয়েতে আসবে নাকি?”
“নাহ, আত্মসম্মান বলতে আমারো কিছু আছে।”
“হ্যা তা তো বটেই।”
অঞ্জলি উদাস হয়ে আছে। আমিও এখন উদাস হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। আমরা দুজনই এতক্ষন যথেষ্ট স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে অঞ্জলির পক্ষে মনে হয় এখন আর স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ওর চুলের পাশ থেকে চোখ বুলিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশ অনেকটা নীল। সাদা মেঘের অবস্থান খুব বেশি নয়। এই রূপে আকাশটাকেও উদাস মনে হচ্ছে। মনের সঙ্গে পরিবেশটাও খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। মন খারাপের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। সেদিন আর কথা হলো না। একটা রিক্সা ডেকে অঞ্জলিকে তুলে দিলাম। যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলাম,
“আমার জন্য কি কোনো উপহার নেই?”
” হ্যা, অবশ্যই আছে। তবে এখন না। পরে তুমি পেয়ে যাবে।”
রিক্সাটা অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। ভেবেছিলাম ও পিছনে তাকাবে। কিন্তু তাকালো না। হয়তো কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। মেঘের গর্জন শুনলাম বোধহয়। আকাশটা পুরোটা নীল। এতোটা পরিচ্ছন্ন আকাশে মেঘের গর্জন হয় না। এটা সম্পুর্ন আমার মনের ভুল। রিক্সাটা আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো। তার পরের সপ্তাহেই ওর বাড়িটাকে সম্পূর্ন বিয়ে বাড়ির সাজে সাজানো হয়েছিলো। তবে অঞ্জলি বউ সাজেনি। তীব্র বিষে ছারখার হয়ে গিয়েছিলো অঞ্জলির শ্বাসনালী। অঞ্জলি আমাকে উপহার দিয়েছিলো। একটা তীব্র কষ্ট আর হাহাকার উপহার পেয়েছিলাম আমি অঞ্জলির পক্ষ থেকে।