ভালোবাসার নীড়

ভালোবাসার নীড়

আজ আমার মেয়ে ইতির ৩য় জন্ম বার্ষিকী! বরাবরের মতোই আজকে কেউ কিছু বলছে না, সকালে উঠে চুপ করেই একটু আগে অফিস চলে গেলাম, অনেক বিকেল করে অফিস থেকে আসলাম! আম্মু একটু বকা দিলো, মেয়েটা নাকি সারা দিন আব্বু আব্বু করে কেঁদেছে। আমি বাড়ী যাওয়া মাত্রই ইতি দৌড় দিয়ে এসে বলল, বাবা! আম্মু আসে নি, আমি বরাবরের মতোই উত্তর দিলাম, সে তো দূরে আছে আসবে, তুমি আরেকটু বড় হয়ে যাও। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম।

আমার বউ দোলা! বছর পাঁচেক আগে আমাদের বিয়ে হয়, আব্বুর পছন্দের মেয়ে ছিল তাই আমি আর না করলাম না, তবে উনি যে অনেক ভালো একটা মেয়ে আমার জন্য ঠিক করে রেখেছিলেন সেটা আমি বিয়ের দিন-ই বুঝতে পারি, মহরনা নিয়ে বিয়ের সময় একটু ঝামেলা হয়ে গেছিলো, দোলার এক চাচা সে সব নগদে মহরনা করবে, তাও ১ লক্ষের ওপর!

সত্যি বলতে আমার নতুন চাকুরী আর এভাবে এতো টাকা দেওয়া আমার ও পছন্দ না, যায় হোক, দোলা সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত, করে, অথচ আমি তখন ও তাকে দেখিনি। বিয়ের পরের দিন থেকেই সে এই বাড়ীকে নিজের করে নেয়, আম্মু বিয়ের ৪ দিন পর একটু অসুস্থ হয়ে যায়, ডাক্তার বলে ১৫ দিন বিছানায় থাকতে, এর আগে আম্মুকে কোন দিন দেখিনি যে ১ দিন ও শুয়ে কাটিয়েছে,

দোলা বিয়ের সব প্রোগ্রাম বাদ দিলো, সে বাবার বাড়ী গেলো না, টানা ১৫ দিন সে মায়ের সেবা করলো। আমি আসলে ওর সেবা করা দেখে কেঁদে দিয়েছিলাম। আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা ছিল না, সব সময় সে সবার খোঁজ নিতো, একদিন বলল, যে সে মা হবে! আমি অনেক খুশী হলাম, সব কিছুই ভালোই ছিল। এভাবে ওর মাস পার হতে থাকলো। অফিস থেকে আমাকে ঢাকা বদলী করে দেওয়া হলো, মেজাজ তো সেই খারাপ, কিন্তু প্রমোশন হবে আর দোলা আর আম্মু অনেক বুঝালো, তারপর আমি ঢাকা গেলাম। এভাবে আরও ২ মাস পার হলো। ১৫ দিন পর দোলার বাচ্চা হবে, আর আমি ১ মাসের মধ্যে ছুটি পাবো না, কারণ ১ মাস পরেই আমার প্রমোশন, কিন্তু আমার মন দোলার কাছে।

বাবা-মা বলল, চিন্তা যেন না করে, আর দোলা বলল, সে ভালো আছে, সে হাসপাতালে ভর্তি হলো, তখন আমার মিটিং ছিল। এভাবে বিকেল হয়ে গেলো।

মিটিং শেষ করে দেখছি বাবার ১৫ টা মিসকল, আমি কল করলাম, উনি কিছু বলল না, বলল, যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ী চলে আসো। আমি দ্রুত প্লেনে করে বাড়ী গেলাম! গিয়ে দেখলাম, বাড়ী ভর্তি মানুষ। আর পাগলীটা বারান্দায় শুয়ে আছে, কিন্তু সে আজ আর কথা বলছে না, আর বলছে না তুমি তো ক্লান্ত হয়ে আছো, চা বানিয়ে দিবো? ১ বছর লেগেছে আমার স্বাভাবিক হতে! এক বছর পর আমি আবার চাকুরীতে জয়েন্ট করি, আমার আগের কাজ দেখে আমাকে সময় দেওয়া হয়, বাবা-মা মেয়েটার নাম রেখেছিলো ইতি। আমাদের ভালোবাসার ইতি। মা মাঝে মধ্যে ইতির জন্য বলে যে একটা বিয়ে করতে, কিন্তু আমি মা মরা মেয়েটার জন্য নতুন মা আনতে গিয়ে জীবিত বাবাকে হারাতে চাই না, সৎ মা ভালো হয় এটা খুব কম সময় হয়।

এভাবে আরও ৩ বছর চলে গেলো। ইতিকে এবার স্কুলে ভর্তি করলাম। আবার প্রমোশনের জন্য আমাকে ঢাকা বদলী করা হলো, কিন্তু আমি বললাম আমার প্রমোশন লাগবে না, একবার গিয়ে আমার বউ কে হারিয়েছি, আরেকবার আমার মেয়েকে হারাতে চাই না। কিন্তু সরকারী নিয়ম দরকার হলে ১ মাস থেকে আবার আসতে হবে, কিন্তু যেতে হবে। অনেক দিন পর সে দিন ইতিকে জড়িয়ে অনেক কান্না করলাম, মা ইতিকে বুঝালো যে আমি তার আম্মুকে আনতে যাচ্ছি, আমি ঢাকা চলে গেলাম, গিয়েই আমি আমার চেয়ারম্যান স্যারকে সব খুলে বললাম, প্রয়োজনে আমি ১ লক্ষ টাকা দিবো, আমার বদলী আবার আমাদের নিজ জেলাতে করা হোক। স্যার বলল, কয়েক দিন সময় দিতে।

১৫ দিন পর স্যার আমাকে ২ দিনের ছুটি দিলো। আমি তাড়াতাড়ি আসার জন্য প্লেনে আসলাম, তারপর আমি বাড়ী গেলাম, বাড়ী গিয়ে শুনি এখন ও স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে নি, ঘড়ি দেখলাম, এখন বিকেল ৫ টা অথচ তার দুপুরেই ক্লাস শেষ। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম, আমি সে দিন, আম্মু-আব্বুকে বকা দিলাম, বললাম, আমার মেয়ের কিছু হলে আমি আর এই বাড়ী আসবো না। অনেক খোঁজা খুজির পর দেখলাম, একটা মেয়ের সাথে সে রিক্সাতে আসছে। ইতি আমাকে দেখে, বাবা বলে কোলে চলে আসলো, আর আমি মেয়েটাকে ইচ্ছা মতো বকা দিলাম, যদিও জানতাম না মেয়েটাকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। এই দিকে বাড়ী এসে দেখি, ইতি আমার সাথে কথা বলে না।

আমি- কি হয়েছে আম্মু?

ইতি- তুমি পচা বাবা! তোমার সাথে কথা নাই।

আমি- আমি আবার কি করলাম?

ইতি- তুমি নিজে তো আমার আম্মুকে খুঁজে নিয়ে আসলা না, আর এখন যখন আমি আম্মু পেয়ে গেছি, তখন তুমি আম্মুকে বকা দিয়ে তাড়িয়ে দিলা, আমি তোমার কাছে থাকবো না, আমি আম্মুর কাছে যাবো।

আমি- তোমার আম্মুকে কোথায় পেয়েছো?

ইতি- কেন স্কুলে উনি আমাদের ইংরেজি ক্লাস নেই। তারপর আমাকে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে আমাকে দুপুরে গোসল করিয়ে খাইয়ে দেয়, তারপর আমারা অনেক খেলি তারপর বিকেলে আমাকে এই বাড়ী রেখে যায়।

আমি- আচ্ছা আমি সরি! এই কান ধরলাম, কাল সকালেই তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাবো।

ইতি- বাবা! আম্মুকে এই বাড়ীতে নিয়ে আসবা না?

আমি- আসবো মা! এবার তো কিছু খেয়ে নাও।

পরের দিন আমি ইতিকে নিয়ে স্কুলে গেলাম! আমি মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করলাম, উনি আসা মাত্রই ইতি আম্মু বলে দৌড় দিলো।

আমি-আসলে আমাকে মাফ করবেন, এই পৃথিবীতে এখন সেই আমার সব তাই আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ছাড়াও যে এতো খুশী থাকে এটা কাল রাতে ওর মুখ থেকে শুনতে পারলাম। আপনার নাম কি?

মেয়েটা- দোলা!

আমি- কি? আমার বউয়ের নাম ও দোলা ছিল।

মেয়েটা- জানি! এজন্য ইতি আমাকে আম্মু ডাকে! সে ভাবে আমি তার সেই হারিয়ে যাওয়া আম্মু।

আমি- আপনি কিছু মনে করবেন না।

মেয়েটা- না না! এতো কিউট একটা মেয়ে আপনার! আম্মু ডাক শুনে আমার অনেক ভালো লাগে, এখন সেই আমার বন্ধু! আজ ক্লাস শেষ করে কি তাকে নিয়ে যেতে পারি? আজ আম্মু ওর জন্য বিরয়ানী রান্না করেছে।

আমি- আচ্ছা ঠিক আছে! আমি বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসবো।

মেয়েটা- এই নেন আমার বাড়ীর ঠিকানা।

আমি- ধন্যবাদ।

ইতি- আম্মু বাবা আমাদের সাথে যাবে না?

ইতির কথা শুনে আমি হাঁসতে হাঁসতে স্কুল থেকে চলে আসলাম। দুই দিন থাকার পর আমি ঢাকা চলে আসলাম! এবার আর মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা নাই, বলে এসেছি, যে সে চাইলে ইতিকে নিয়ে রাতেও থাকতে পারে, তবে যেন আমাদের একবার জানিয়ে দেয়। ১ মাস পর আমার প্রমোশন হয়! স্যার সাথে সাথে আমার জেলায় আমাকে বদলী করে দেয়। আমি এখন এই জেলার প্রধান! আমাকে নাকি গাড়ী দেওয়াও হবে। আমি পরের দিন আগে আমাদের জেলার নতুন অফিস গেলাম, তারপর বিকেলে গাড়ী সহ আমি ফিরে আসছি। বাড়ীতে এসেই দেখি, দোলা একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে।

আমি- কি ব্যাপার আপনি?

দোলা- আব্বু আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে আমাকে বিয়ে করে ঢাকায় চলে যেতে চাই।

আমি- হ্যাঁ তো।

দোলা- আমি ইতিকে ছাড়া থাকতে পারবো না ।

আমি-দেখেন আমি জানি আপনি ইতিকে অনেক ভালোবাসেন, আর আমার মেয়েও। কিন্তু তাই বলে আমার মেয়েকে তো দিতে পারবো না। সে ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নাই।

দোলা- আমি আপনার পৃথিবী থেকে ইতিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। আপনাদের এই ছোট্ট পৃথিবীতে আমার একটু যায়গা চাচ্ছি।

আমি- মানে?

দোলা- আমি জানি আপনি আপনার বউকে অনেক ভালোবাসেন, এজন্য আজ পর্যন্ত বিয়ে করেন নি। আমি ঐ আপুর যায়গা চাচ্ছি না, কিন্তু ইতির আম্মু হবার জায়গাটা দেন প্লিজ! মেয়েটাকে এক বেলা না দেখলে আমি কান্না করতে শুরু করি। আমি মেয়েটার কথা শুনে পুরো অবাক!

দোলা- কি ভাবছেন।

আমি- তোমার বাবা মা, এই সমাজ কি সেটা মেনে নিবে?

দোলা- কে কি ভাবছে সেটা আমি ভাবছি না, আমি এখানে সুখে থাকবো।

আমি- ঠিক আছে চলেন!

দোলা- কোথায়?

আমি- আপনার বাবা-মায়ের কাছে, আমাদের বিয়ের অনুমতি নিতে।

দোলার বাবা-মা প্রথমে মানা করলেও ওনারাও ভালো ভাবে জানে যে ওনার মেয়ে আর ইতির কতো সম্পর্ক ভালো। অবশেষে আমাদের বিয়ে সে দিন রাতেই হলো।

রাতে চলে আসার সময় দোলার আব্বু একটা কথা বলল, বাবা! অনেক ভরসা করে তোমার হাতে আমাদের একমাত্র মেয়েকে তুলে দিলাম! তাকে মন থেকে স্ত্রীর মর্যদা দিয়ো। রাতে বাড়ী এসে যেন ইতির খুশী দেখার মতো ছিল। আজ আমার আম্মু এসেছে, এই বলে বলে সে পুরো বাড়ী নাচতে শুরু করলো। আমি বাইরে থেকে রাতে ফিরলাম। দেখলাম ইতি কে বিছানায় শুয়ে দিয়ে দোলা নীচে একটা বিছানা করলো।

আমি- খাটে তিনজন হবে, বড় করেই খাট করা আছে, এই শীতে নীচে ঘুমাতে হবে না।

দোলা- আমি আপনাদের মধ্যে ভাগ বসাতে চাই না।

আমি দোলার সামনে গেলাম! জানো আমি কেন বিয়ে করতাম না যে, আমার মেয়েকে হয়তো সৎ মা ভালবাসবে না, আর বাসলেও সেটা আমাকে দেখানোর জন্য, কিন্তু তুমি একটা অদ্ভুত মানুষ, একটা মেয়ের জন্য বুড়োকেও বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলা।

দোলা- আমি ইতিকে অনেক ভালোবাসি, সে আম্মু বলে ডাকলে আমার অনেক ভালো লাগে। আর আপনি মোটে ও বুড়ো না।

আমি- বিয়ে যখন করেছি, মন থেকেই স্ত্রীর মর্যদা দিবো। তবে ভালবাসতে একটু সময় লাগবে।

দোলা- আপনার ভালোবাসার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করবো।

আমি- এখন চলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত