আমি মৃন্ময়ী। আমি আমার পরিবারের একমাএ মেয়ে।বলতে গেলে সবার খুব আদরের।ছোটবেলা থেকেই বাবা,মা কখনো আমার কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি। খুব ভালো গান গাইতে পারতাম,তাই আমাদের গ্রামে সবাই আমাকে একনামে চিনতো। আর সবাই আমাকে খুব পছন্দ করতো।জানি না কতটুকু ভালো গান গাইতাম। যেহেতু ভালো গান গাইতাম।তাই যেকোন অনুষ্ঠানে সবার আগে আমার ডাক পড়তো। যাই হোক একবার আমাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গান গেয়েছিলাম। সবাই খুব প্রশংসা করেছিল,আমার গান শুনে। স্টেজ থেকে নামার পর বান্ধবীদের কাছে গিয়ে বসলাম ঠিক এমন সময় একটা ছেলে এসে হাজির!!!
_হায় মৃন্ময়ী!! আমি কাব্য।। তুমি তো খুব সুন্দর গান গাও।তোমার সুরের মূর্ছনায় আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রায়।।।
_হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলেন কিভাবে??? আচ্ছা আপনি কে?আপনাকে তো কখনো দেখিনি এই গ্রামে।
_আরে মৃন্ময়ী ও হচ্ছে আমার কাজিন।অনেকদিন পর কাল আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে।
_আচ্ছা ঠিক আছে।আগে বল্লেই হতো। আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কে না কে আবার!!!
_আচ্ছা চল।বাসায় যাই।অনেক সময় হয়ে গেছে।এখন না গেলে সবাই চিন্তা করবে। আচ্ছা চল।
_সেদিন ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।তাই রাতে একটু পড়েই শুয়ে পড়লাম।হঠাত ঘুমে মধ্যে দেখতে পাচ্ছি ওই ছেলেটাকে,ওই কাব্য কে।কোথা থেকে যেন আমার জন্য অনেকগুলো লাল পদ্ম নিয়ে হাজির। আচ্ছা ও জানলো কিভাবে যে লাল পদ্ম ফুল আমার খুব প্রিয়।
ও ফুল গুলো আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।আমিও যেই ফুলগুলো নিতে যাব,অমনি ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।মনে মনে খুব লজ্জা পেলাম এই ভেবে যে একদিনের পরিচয়ে কিভাবে আমি ওকে স্বপ্ন দেখলাম।হঠাত মনে হলো গ্রামের সবাই তো বলে শেষরাতে স্বপ্ন দেখলে নাকি সত্যি হয়।আমি যদিও এগুলো বিশ্বাস করি না তারপরও অনেক কৌতূহল নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম।আর সাথে সাথে বুকের মাঝে ছ্যাঁত করে উঠল।আরে এত দেখছি প্রায় রাতের শেষ ।আমার স্বপ্নটা কি সত্যি হয়ে যাবে নাকি? ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। যাই হোক সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম।উঠে বারান্দায় যেতে যেতে চোখ ছানাবড়া।। একি!!!!আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!!
আমার বান্ধবী আর কাব্য ঠিক এসে হাজির আমার বাসায়।হঠাত রাতের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল।আবার লজ্জা পেলাম।ওদের সামনে যেতে না যেতেই হঠাত কাব্য আমাকে প্রশ্ন করল।কি ব্যাপার তুমি কাল ফুলগুলো নিলে না কেন??ফুলগুলো কি তোমার পছন্দ হয়নি?হঠাত আবার বুকের হার্টবিট টা প্রচন্ড ভাবে বেড়ে গেল,এ আমি কি শুনছি?তাহলে কি ওটা সত্যি ছিল,আর সত্যি হলেও তা কিভাবে সম্ভব? প্রচন্ড ঘামতে শুরু করলাম হঠাৎ।এ কি হচ্ছে আমার সাথে? হঠাত কাব্য বলে উঠল কি ব্যাপার তুমি ঘামতেছ কেন? আরে আমি তো স্বপ্নের কথা বল্লাম।কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম যে তোমাকে আমি পদ্ম ফুল দিচ্ছি আর তুমি নিচ্ছ না। আমি তখন কিছুই বলিনি আমার ব্যাপারে কারন আমিও তো এই একই স্বপ্ন দেখেছি।তারপর সারাদিন ভাবলাম যে এটা কিভাবে সম্ভব।
তারপর থেকে কাব্য আর আমি খুব স্বাভাবিক হয়ে গেলাম।আমার বান্ধবী আর কাব্য আমরা সারাদিন একসাথে থাকতাম,এখানে সেখানে ঘুরতে যেতাম আমি ওকে গান শুনাতাম আর ও মুগ্ধ হয়ে শুনত আর বলত জানো মৃন্ময়ী আমি ঠিক এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করব যে তোমার মত খুব ভালো গান গাইতে পারে।আমি শুধু হাসতাম ওর কথা শুনে কারন ওর কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগত। শুধু রাতটা আর স্কুল টাইম টা আলাদা থাকতাম আর বাকি সারাদিন একসাথে থাকতাম আমরা। রাত গড়িয়ে দিন আর দিন গড়িয়ে রাত।দেখতে দেখতে প্রায় অনেকদিন কেটে গেল।কাব্যর ও যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসলো। কাব্য যেদিন চলে যাবে সেদিন সকালে আমার বাসায় শুধু একটি পদ্ম ফুল নিয়ে হাজির।
ফুলটা আমাকে দিয়ে বল্ল,মৃন্ময়ী তোমাকে ভুলতে পারব না আমি,খুব মিস করব তোমায়।যদি তুমিও আমাকে মিস করো আর আমাকে ভুলতে না পার তাহলে কোন একদিন এই ফুলটা আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।ভাল থেকো মৃন্ময়ী,জানি না আর কখনো দেখা হয় কিনা।জীবনে বেচে থাকার তাগিদে কে কোথায় থাকব বলতে পারি না কিন্তু আমায় মনে রেখ।আমি তোমাকে কোনদিন ভুলতে পারব ন।এই বলে ও চলে গেল।আর কেন যেন কোন কারন ছাড়াই চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরল।হয়ত খুব মায়ায় পরে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য।তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক বছর।আর কখনো কাব্য সাথে দেখা হয়নি এমনকি কথাও হয়নি।মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ত ওর কথা ওর সাথে কাটানো সেই মুহূর্ত গুলোর কথা।দিন যায় দিন আসে।সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।একসময় অনেক বিয়ের অফার আসতে লাগল আমার জন্য। তখন বুঝতে পারলাম যে আমি বড় হয়ে গেছি।
এরকম দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।শুনলাম সামনে শুক্রবার নাকি আমার বিয়ে।হঠাত বুকের ভিতরে ধক করে উঠল।
মনে পড়ে গেল সেই অনেক বছর আগেরকার সেই কাব্যর কথা।ভালবাসা কাকে বলে তখন জানতাম না,কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওকে মনে হয় আমি খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম।তাই হয়ত এত বছর পর আবার ওর কথা মনে পড়ে গেল।আচ্ছা ও কি আমায় মনে রেখেছে??মনে হয় না,যদি মনে রাখত তাহলে নির্ঘাত একদিন না একদিন ফিরে আসত।হঠাত মনে পড়ে গেল সেই অনেক বছর আগেরকার সেই পদ্ম ফুলের কথা।ওটা আমি পরম যত্নে রেখেদিয়েছিলাম।যদি কখনো ওকে ফেরত দিতে হয় তাই কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি।
তারপর ও সেটা অনেক যত্ন করে আবার তুলে রাখলাম।ভাবলাম যেখানেই যাই না কেন এটা সাথে নিয়ে যাব।যদি কখনো জীবনে চলার পথে ওর সাথে দেখা হয় তাহলে দিয়ে দিব।ও আর আমাকে এই কথাটা বলতে পারবে না যে ওকে আমি ভুলে গেছি। যাই হোক দিনগুলো যেন খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল।এর মধ্যে একদিন ভাবি বলেছিল।আমার শহরে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আমার হবু স্বামী নাকি ব্যাংকার।আমার ফ্যামিলির সবাই খুব খুশি আমার এত ভালো ঘরে বিয়ে হচ্ছে ভেবে।কিন্তু আমি কোন মতেই ওকে ভুলতে পারছিলাম না।
এর মধ্য আমার সেই বান্ধবী এসে হাজির যার কাজিন ছিল কাব্য।এসেই বলতেছে জানিস মৃন্ময়ী কাব্য ভাইয়ার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।এই বলে ও মুচকি হাসতে লাগল। কয়েকদিন পর নাকি ওর বিয়ে।আমরা সবাই আজি ঢাকা যাচ্ছি।তোকে বলতে এলাম।ভালো থাকিস আর সরি রে তোর বিয়েতে থাকতে পারলাম না কষ্ট নিস না প্লিজ।ভালো থাকিস। এই বলে ও চলে গেল।আর আমি তখন পুরাই অবাক,কাব্য আমাকে ভুলে গেল? একটু কষ্ট পেয়েছিলাম।পরে ভেবে নিলাম,মানুষের জীবনে কত মানুষের সাথেই তো পরিচয় হয় সবাই কি আর সারাজীবন পাশে থাকে?ওর সাথে ও আমার ঠিক না হয় এমন সম্পর্ক হয়েছিল।ভালো থাকুক কাব্য আর ভালো থাকুক ওর মত ক্ষনিকের আগুন্তক গুলো।
তারপর সময়মত আমার বিয়ে হয়ে গেল।আমাকে নাকি এখন আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে।আচ্ছা আমি কিভাবে থাকব আমার বাবা মা,আমার গ্রাম আর গ্রামের মানুষদের ছাড়া?তারপরও আমার চলে যেতে হয়েছিল সবাইকে ছেড়ে।অনেক অভিমান হয়েছিল বাবা মার প্রতি,কি এমন দরকার ছিল আমাকে অন্যের বাড়ি সারাজীবনের জন্য পাঠানোর।আমার স্বামীর সাথে আমার সারাপথ কথা হয়নি,সে আমার সাথে কোন কথাই বলেনি।ভেবেছিলাম হয়ত সে আমার সাথে কথা বলতে আনইজি ফিল করছে।যাই হোক ও রাতে রুমে আসল আর এসে আমার পাশে বসল।হঠাৎ বলে উঠল মৃন্ময়ী তুমি কি জানো আমি তোমাকে অনেক বছর ধরে পছন্দ করি?জানো প্রথমে আমি তোমার গানের প্রেমে পড়েছিলাম পরে তোমার প্রেমে পড়েছি। তোমাকে খুব ভালবাসি তাই অনেক যত্নে গোপনে আগলে রেখেছিলাম তোমাকে যেন অন্যের ঘরনী না হও।আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে তোমাকে বিয়ে করলাম। তুমি কি হ্যাপি?
_আরে সে জানলো কিভাবে যে আমি ভাল গান গাই?আর সে কিভাবে আমাকে আগলে রাখল?আজব ব্যাপার!! আমার হঠাৎ কাব্যর কথা মনে পড়ে গেল আর অনেক কান্না পেল।শেষ পর্যন্ত ওকে আর দেখা হলো না।এটাই কি বিধাতা কপালে লিখেছিল।কেন কয়েকদিনের জন্য ওর সাথে আমার পরিচয় হল?আর আমি কেনই বা ওকে ভুলতে পারছি না।
_হঠাৎ আমার বর বলে উঠল মৃন্ময়ী আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো,আর তুমি এতদিন আমার প্রতিক্ষায় ছিলে।
_ব্যাটা বলে কি এগুলো?পাগল হইছে নাকি?আমি নাকি এর অপেক্ষায় ছিলাম।যার অপেক্ষায় ছিলাম তার দেখা নাই আর সে আসছে পটপট করতে।
_মৃন্ময়ী!!
_হুম
_তোমাকে যে একটা পদ্মা দিয়েছিলাম সেটা দাও আর বল ভালবাসি।
_হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।উনি এই পদ্মর কথা জানলো কিভাবে।
যাই হোক এতক্ষন তার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি এখন আর কোন সংকোচ নেই, হঠাৎ তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এ যে আমার কাব্য!! যাকে আমি অনেকবছর আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম!!!