কালো মেয়েদের ভালবাসাও কি কালো হয়? যদি তাই না হবে তাহলে কালো মেয়েদেরকে কেনো ছেলেরা পছন্দ করে না? তবে আমি এটা বিশ্বাস করি যে এক মাত্র কালো মেয়েরাই খাঁটি ভালবাসা পায়। চোখ ধাঁধানো রূপে তো সবার চোখই ঝলসে যায়। কিন্তু যে মুখ দেখে চোখ ঝলসে না গিয়েও ভালবাসার স্পন্দন স্পন্দিত হয় সেটাই প্রকৃত ভালবাসা।
আমার গায়ের রঙ কালো। এটা নিয়ে ছোট বেলা থেকেই আমার মাঝে একটা হিনমন্নতা কাজ করে।নিজেকে খুব তুচ্ছ একটা মানুষ মনে হয়। আমার আপুর গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। সে আমার মায়ের মত দেখতে হয়েছে। কিন্তু আমি হয়েছি বাবার মত। বাবা আমাকে কালো মা বলে ডাকে। আপু আমার এক বছরের বড়। আমরা সমবয়সীর মতই। তাই আমি ওকে যুথী বলেই ডাকি। আমরা দু’জন সেই স্কুল থেকে ভার্সিটি অব্দি এক সাথেই যাওয়া আসা করি। আপুর গায়ের রঙ ফর্সা তাই ওর পেছনে ছেলের অভাব নেই। কিন্তু আমি কালো বলে যেনো আমার কোনো দামই নেই। পৃথিবীটা বড়ই আজব! গায়ের রঙের উপর depend করে একটা মানুষের জীবণ। অথচ আমার চুল গুলো আপুর চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর।
আমার চোখ দুটোও আপুর চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর। আমি লেখা পড়াতেও আপুর চেয়ে ভালো কিন্তু আমি কালো। এই কালোটাই যেনো আমার জীবণের সব আলো কেড়ে নিয়েছে। ছোট বেলা থেকেই মা আমাকে হলুদ চঁন্দন মধু ইত্যাদি লাগাতে বলতো। কিন্তু আমি কখনো এসব মুখে লাগাইনী। কেউ যদি আমার কালো রঙ দেখেই আমাকে ভালবাসে তবে সেটাই প্রকৃত ভালবাসা হবে। আমি চাই আমি যেমন তেমনই কেউ আমাকে ভাবুক। তেমন ভেবেই ভালবাসুক।
আমাকে কেউ পছন্দ করে না। কলেজ ভার্সিটিতে আমার মেয়ে বন্ধু থাকলেও কোনো ছেলে বন্ধু নেই। অবশ্য আপুর বন্ধুর অভাব ছিল না। কলেজে ভর্তি হবার পর একটা ছেলেকে আমার বেশ ভালো লাগতো। ওর নাম কোমল। ছেলেটা আপুর সাথে পড়তো। ওকে ভেবে ভেবে আমি কেমন যেনো মুগ্ধ হতাম। সারাক্ষণ শুধু ওর কথাই মনে পড়তো। আর ওর জন্যই কলেজে যাবার প্রতি আমার আগ্রহটা বেশ তীব্র ছিল। কিন্তু ওকে এই ভাললাগার কথাটা বলার সাহস ছিল না। এমনকি কোনো ভঙ্গিমাতেও তাকে কিচ্ছু বুঝাইনী। কিন্তু যুথী মনে হয় একটু একটু বুঝে ছিল।
এক সময় দেখলাম যুথীর সাথে ওর ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে। বুঝা যেতো ছেলেটা যুথীর প্রতি বেশ দূর্বল। সে যুথীকে খুব পছন্দ করতো। যুথীও ওকে বেশ পছন্দ করতো। যুথী যখন ওর সাথে ঘুরতে যেতো তখন আমাকেও সাথে নিয়ে যেতো। আমার ইচ্ছে করতো না ওদের সাথে যেতে কিন্তু যুথী সুন্দরী বলে বাবা মা ওকে তো একা বাহিরে যেতে দিত না তাই ওর পাহারাদার হয়ে আমাকে যেতেই হতো। আমি ওদের মিষ্টি মিষ্টি প্রেম গুলো দেখতাম। ওরা হাত ধরে হাটতো, একটা আইসক্রীম দু’জনে খেতো। আমার আইসক্রীমটা অবশ্য আমি একাই খেতাম। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাগা ভাগিটা বেশ রোমাঞ্চকর হয়।
কোমল আমাকে শালীকা বলে ডাকতো, আমার অবশ্য খারাপ লাগতো না। কারণ কালো মেয়েদের কি সব কিছুতেই খারাপ লাগতে আছে? যুথী কোমলকে ভালবাসতো জেনেও আমি কোমলকে ভালবাসা থেকে বিরত থাকতে পারিনী। কি করবো আমি? মনটাকে কি সব সময় বস্ এ রাখা যায়। মাঝে মাঝে মন নিজের গতিতেই চলে। কারণ মন বড় স্বার্থপর। কিন্তু কখনোই চাইনী যুথীর ভালবাসাকে কেড়ে নিতে। যদি আমি ওর মত সুন্দরী হতাম তাহলে কি করতাম সেটা অবশ্য জানি না। কিন্তু পছন্দের মানুষটার সাথে হাত ধরে অন্য কাউকে দেখে অনুভূতিটা কেমন হয় সেটা না হয় না-ই প্রকাশ করলাম। ইন্টার পাশ করার পর যুথী ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরের বছর আমিও ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। তারপর কি কারণে ওদের মাঝে ব্রেকআপ হয়ে ছিল সেটা আমি জানি না। এর পর থেকে কোমলের সাথে আর কখনো দেখা হয়নী।
আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার ভাইয়ার একটা ফ্রেন্ড মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় আসতো। ছেলেটার নাম রেজওয়ান। ছেলেটা তখন মাস্টার্সে পড়তো। ছেলেটাকে আমার ভালোই লাগতো। কিন্তু আমার এই ভাল লাগার দাম যে আমি পাবো না সেটা আমি খুব ভাল করেই জানতাম। তাই ভাললাগাকে কখনোই ভালবাসায় গড়াতে দিইনী। যুথী রেজওয়ানকে খুব পছন্দ করতো। ওকে কে পছন্দ করবে না? অমন হিরো হিরো চেহারা দেখে যে কোনো মেয়েই ক্রাশ খাবে। তবে আমার মত কালো মেয়ের কি ক্রাশ খাওয়া উচিত? একদম উচিত নয়। যে মেয়েটার দিকে কেউ কখনো ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকায়ই না তার আবার প্রেম!
রেজওয়ান বাসায় এলেই আপু নানান রকমের নাস্তা নিয়ে ওর সামনে যেতো। বসে বসে ওর সাথে গল্প করতো। আর আমার কাজ ছিল রেজওয়ানের জন্য নাস্তা তৈরী করা। যদিও রেজওয়ান জানতো যে সব নাস্তা যুথীই তৈরী করে। কিন্তু আমার স্বার্থকতাটা কোথায় জানেন? আমার রান্না করা খাবার রেজওয়ান খুব পছন্দ করতো এবং তৃপ্তিসহকারে খেতো, এটাই আমার স্বার্থকতাসমেত প্রাপ্তি। না জানুক রাঁধুনীটা কে, তাতে বা কি ক্ষতি? দূর থেকে এই টুকু ভাল লাগাতেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আমাদের বাসার সবাই রেজওয়ানকে খুব পছন্দ করতো। সে খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। রেজওয়ানের ব্যাংকে চাকরী হয়ে যাবার পর আমাদের বাসা থেকে যুথীর বিয়ে নিয়ে গুন গুন শুরু হয়ে গেলো। যুথী বেশ খুশি খুশি, আমিও ওদের খুশিতে শামিল হলাম।
রেজওয়ানদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হলো। কিন্তু আজব একটা ব্যাপার হলো যে রেজওয়ান এই বিয়েটা করতে রাজী হলো না। এমনকি সে বললো যুথীকে সে কখনো ওরকম দৃষ্টিতে দেখেইনী। আর রেজওয়ান নাকি অন্য একটা মেয়েকে ভালবাসে, আর বিয়েটা নাকি তাকেই করবে। সেদিন যুথী খুব কষ্ট পেয়ে ছিল। কিন্তু আমাদের বাসার সবাই এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ে ছিল।কারণ রেজওয়ানের নিজের পছন্দ থাকতেই পারে। দু’মাসের মধ্যে যুথীকে অন্য এক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। যুথীর বিয়ের তিন মাস পর রেজওয়ান আমাদের বাসায় এলো এবং তারপর সে যা কিছু বললো তাতে আমিসহ সবাই হতভম্ব হয়ে গেছিলাম।
রেজওয়ান আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রোপজ করে ছিল। তার সেই পছন্দের মেয়েটা নাকি আমি ছিলাম, যার জন্য সে যুথীর মত একটা সুন্দর মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে ছিল। কিন্তু এখানে আমার ঘোর আপত্তি ছিল কারণ যুথী ওকে ভালবাসতো। কিন্তু যুথীর যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তাই বাবা মা এই বিয়েতে আর আপত্তি করেনী। কিন্তু বেঁকে বসে ছিলাম আমি। আমাকে যদি সে ভালই বেসে ছিল তবে যুথীর হাব ভাব দেখে তখন কেনো সে তাকে বলেনী যে সে যুথীকে নয় বীথিকে ভালবাসে? তাহলে হয়ত যুথী ওকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতো না! এই সব নানান কিছু ভেবে আমি এই বিয়েতে না বলে দিয়ে ছিলাম।
কয়েক দিনপর রেজওয়ান আমার সাথে দেখা করে ছিল কিছু বলার জন্য। আমরা দু জন দাড়িয়ে আছি চুপচাপ। কারো মুখ দিয়ে যেনো কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। নিরবতা ভেঙে রেজওয়ান বললো-“বীথি তোমাকে প্রথম দেখেই ভালবেসে ছিলাম। পৃথিবীতে হাজার হাজার সুন্দরী মেয়ে আছে কিন্তু আমার চোখে তুমিই সেরা সুন্দরী।”
ওর কথা শুনে আমি কিছুই বললাম না। কারণ আমার খুব রাগ হচ্ছিল। কালো মেয়ে সেরা সুন্দরী হয় কি করে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। রেজওয়ান আরো কাছে এসে দাড়িয়ে বললো -“তুমি কিন্তু খুব দারুণ রান্না করো” আমি ওর কথা শুনে খুব অবাক হয়ে ছিলাম কারণ সে তো জানেই না যে ঐ রান্না গুলো আমি করতাম! তাহলে জানলো কি করে? যে ভাবেই জানুক তাই বলে আমি ওকে বিয়ে করতে পারি না।
সে বললো-“তুমি যে আমাকে চুপি চুপি দেখতে সেটা কিন্তু আমি দেখেছি। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালবাসো”
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না তাই বললাম-“যদি এত কিছুই আপনি বুঝে থাকেন তবে যুথী যে আপনাকে ভালবাসতো সেটা বুঝার পরে কেনো ওকে বলেননী যে আপনি অন্য কাউকে ভালবাসেন? একটা মেয়ের মন কেনো এ ভাবে ভাঙলেন?”
সে-“আমি ওকে বলে ছিলাম যে আমি বীথিকে ভালবাসি কিন্তু সে বার বার আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করেছে। আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, যে মেয়েটা তোমার জন্য রাখা ভালবাসাকে জোর করে কেড়ে নিতে চেয়ে ছিল তার জন্য তুমি আমাকে রিফিউজ করছো?”
আমি ওর কথা শুনে সত্যিই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যুথী সবটা জেনেও এমনটা কি ভাবে করতে পেরে ছিল? তাহলে কোমলকে আমি পছন্দ করতাম বলেই কি যুথী ওকে ভালবেসে ছিল? কিন্তু কেনো সে এমনটা করেছে? আমার প্রতি কিসের এত আক্রশ তার? সেদিন আমি রেজওয়ান কে জিজ্ঞেস করে ছিলাম যে, আপুর মত সুন্দরীকে বাদ দিয়ে সে আমাকে কেনো পছন্দ করেছে? সে উত্তরে বলে ছিল-“সবার প্রিয় ফুল লাল গোলাপ নয়, কেউ কেউ কালো গোলাপও ভালোবাসে।”