দুপুর ১২টা, অফিসে বসে নভেম্বরের প্রজেক্টের ফাইলগুলোতে চোখ বুলাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ মা ফোন দিয়ে জলদি বাসায় যেতে বললেন, আমি মায়ের কথা শুনে একটু চিন্তিত। যে মানুষটা সব সময় কাজে মনোযোগ দিতে বলে সে হঠাৎ করে কেনই বা ডাকছে কাজ ছেড়ে! বাসায় মা আর মিহা(আমার স্ত্রী)। তাইলে কি দুজন মিলে ঝগড়া বাঝিয়ে ফেললো নাতো? নাহ কি সব ভাবছি আমি! আমার মা তো মিহাকে তার মেয়ের মতো ভালবাসে আর মিহাও তাই নিজের মায়ের মতো ভালবাসে মাকে। আমি যখনই অফিসের ফাকে বাসায় ফোন দেই খোজ খবর নিতে কিছু লাগবে কিনা জানতে তখনই তাদের দুজনের অভিযোগ থাকে অনেকটা এমন,
আমিঃ আস-সালামুয়ালাইকুম, মা কি করছেন?
মাঃ ওয়ালাইকুম আস-সালাম। এইতো বসে পান খাচ্ছি।
আমিঃ কিছু লাগবে মা বাসার জন্য?
মাঃ না কিছু লাগবে না আমার।
আমিঃ এভাবে বলছেন কেন কি হয়েছে?
মাঃ কি হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করিস কেন তোর বউরে জিগা, সকাল থেকে চুলার পাশে যেতে দেয়নি আমাকে।
আমিঃ এটা নিয়ে আপনার এই অবস্থা?
মাঃ রান্নাবান্না কাজ কাম না করে থাকতে পারি না তুই জানো না?
আমিঃ আচ্ছা আমি ওরে বলবো মা, রাখছি।
মাঃ ঠিক মতো বলিস কিন্তু।
আমিঃ আচ্ছা। আর মিহাকে ফোন দিলে ফোন ধরেই,
মিহাঃ আস-সালামুয়ালাইকুম।
আমিঃ ওয়ালাইকুম আস-সালাম। কি খবর জনাবা? কি করছেন?
মিহাঃ এইতো কাজ করছি আপনি?
আমিঃ আমিও। মা কি করে গো?
মিহাঃ তার তো একটাই কাজ, কিভাবে রান্নাঘর থেকে আমাকে বের করবে সেই ফন্দি আাঁটেন।
আমিঃ হা হা হা। কি করবে বলো তার তো কাজ করার অভ্যাস তাতো তুমি জানোই।
মিহাঃ আপনি হাসছেন? আর কি কাজের অভ্যাস শুনি?
আমিঃ তার তো রান্না…(আমাকে থামিয়ে দিয়ে)
মিহাঃ হইছে থাক আমার শুনতে হবে না। যা কাজ করার অভ্যাস ছিলো তা করে নিয়েছে এখন আমি থাকতে করার কি দরকার?
আমিঃ আচ্ছা আচ্ছা আমি বলবো।
মিহাঃ হুম মনে থাকে জানি।
আমিঃ হু।
এই হলো দুজনের অবস্থা, এতে আর যাইহোক ঝগড়া তো কোনো ভাবেই হওয়ার কথা না। এম ডি স্যারের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি তার মিটিং শেষ হলে আমি বাসায় যাওয়ার জন্য ছুটি নিবো। কিন্তু মা বার বার ফোন দিচ্ছে আর তাতেই আমার চিন্তা বারতে শুরু করলো, আমি আর দেরি করলাম নাহ। আর্জেন্ট লিভ লেটার লিখে রেখে চললাম বাসার দিকে, মোটরসাইকেল নিয়ে সোজা চলে গেলাম বাসায়।
গিয়ে দেখি বাসার দরজা খোলা, কেমন যেনো একটু লাগছে বুকের ভিতর। মিহার কোনো সমস্যা হলো নাকি! আর বাবা কই সে ঠিক আছে তো! এগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে দেখি আমার শ্বশুর-শাশুড়ী এসেছেন তারা সোফায় বসে নাশতা করছেন। আমি ঢুকে সালাম দিলাম তারাও হাসি মুখে সালাম নিলেন এই পাশে বাবা বসা আর ভিতর থেকে মা আর মিহার কন্ঠ পাচ্ছি, এখন যেনো দেহে প্রাণ ফিরে এলো আমার। সবাই আল্লাহর রহমতে ভালই আছে। তাইলে জরুরি ভাবে মা ডাকলেন কেন! আমি মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মা এমন ভাবে ডাকলে কি হয়েছে? “যা রুমে গিয়ে গোসল করে আয় আগে” আমিও মায়ের কথা মতো চলে গেলাম রুমে। মিহাও এলো আমার পিছে, মহারানী কে ধরে টেনে নিলাম বুকে।
আমিঃ এই কি হয়েছে গো সোনা?
মিহাঃ (আমার নাকটা টেনে দিয়ে) বাসায় আসলেই খালি রোমাঞ্চ তাইনা?
আমিঃ আহহ বলই না কি হয়েছে!
মিহাঃ আমি কিভাবে জানবো জনাব! হয়তো আপনার মা আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।
আমিঃ (ওরে ছেড়ে দিয়ে) মানে কেনো?????
মিহাঃ মাকে আমি কোনো কাজ করতে দেইনা এজন্য।
আমিঃ হায় রে মা! আচ্ছা দাড়াও দেখছি।
মিহাঃ হুম।
আমি গোসল করে বের হয়ে আব্বু আমি আর শ্বশুর মশাই মিলে চললাম মসজিদের দিকে। নামাজ আদায় করে বাসায় এসেই নাকে পোলাও মাংসের সুঘ্রাণে পেকে গেছি একদম। জলদি করে কাপড় বদলে ডাকার আগেই চলে গেলাম খাবার টেবিলের কাছে, সবাই মিলে বসেছি খেতে। খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায় মা বলে উঠলো, “হৃদয় মিহাকে তুই কিছু বলবি নাকি আমি ওরে ওর বাপের বাড়ি পাঠাবো? তোর আব্বুরে বলছি সে শুধু হাসে কিছু বলে না তুই কিছু করিস না তাই আজ বেয়াই-বেয়াইন কে এনেছি, আজ একটা বিহিত করতে হবে।”
মায়ের কথা শুনে সবাই মুচকি হাসে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না আর আমার ভাবখানা এমন যেনো আমি আজ বাসাতেই নেই। মা আমার শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ভাই আমিতো আমার ছেলের বউ এনেছি কাজের মেয়েতো আনিনি তাইলে এমন অবস্থা হবে কেন?” বাবা বললেন “আচ্ছা থাক না এসব! আগে সবাই খেয়ে নিক তারপর কথা হবে” আজ পরিবারের সবাই একইসাথে খেয়েছি তবে বড় আপুদের একটু শুন্যতা ছিলো। খেয়ে উঠার পর মা আবার শুরু করতেই এবার মিহা বলতে শুরু করলো,
মিহাঃ মা আপনার কথার জবাব দিচ্ছি বলে মাফ করবেন। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি, আমি কাজের মেয়ে হয়ে যেমন আসিনি ঠিক তেমনি শুধু আপনার ছেলের বউ হয়েও আসিনি। আমি আমার এক বাবা-মা ছেড়ে আরেক বাবা-মায়ের কাছে এসেছি তাদের মেয়ে হয়ে। আর আমার মা এই বয়সে ভারী-ভারী কাজ করবে আমি মেয়ে হয়ে তা মানতে পারবো না। এজন্য যে পরিকল্পনা করেছেন আমাকে পঠিয়ে দিবেন তাও পারবেন না কারণ আমি এখন সাবালিকা আমারও অগ্রাধিকার আছে কিন্তু হুম।
মাঃ আরে পাগলি মেয়ে! তুই মেয়ে হয়ে আসিসনি মা তুই আগে হয়তো আমার মা ছিলি, কিন্তু যাহোক আমাকে কিছুটা হলেও করতে দিস কারণ কোনো মা তো নিজে বসে থেকে সন্তানের কষ্ট দেখতে পারে না পাগলি। বলেই দুজন একটু কলাকলি করলেন আর কি(জরিয়ে ধরেছেন, আর দুজনই একটু পানি ফেলে নিলেন সুখের অশ্রু)। আমারা উপস্থিত দর্শক মন্ডলী মুহুর্তেই তাদের এহেন কার্কলাপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বৈকি কিন্তু আমার বুকটা যেনো কেমন করছিলো। সত্যিই আল্লাহ আমাকে অনেক ভাগ্যবান বানিয়েছেন এমন জীবন সঙ্গী আর এই পরিবারে জন্মদানের মাধ্যমে।