গায়ে জ্বর নিয়ে বসে আছে অনিন্দিতা। বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর জ্বর লাগে। খাওয়ার ইচ্ছে নেই।হুট করে ওজন কমেছে।কান দিয়ে রক্ত আসে। মুসিবত একটা। সংসদ ভবনের সামনেটায় বসে থাকতে ওর কেন জানি খুব ভালো লাগে। এত রকম মানুষ, এত এত গল্প। চাদরটা টেনেটুনে বসলো । ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু আলসেমি করেই যাওয়া হচ্ছে না। দুই তিনটা পিচ্চি এসে ঘিরে ধরলো ওকে।
-আপু আপনি আইছেন? অনিন্দিতা হাসলো।
-হ্যা। কি অবস্থা তোদের?
-আপনের গায়ে তো জ্বর খুব। রইদে বসি আছেন ক্যা?
-ভালো লাগছে।
ব্যাগ থেকে টাকা বের করলো অনিন্দিতা। পিচ্চি তিনটা নিল না।এই পিচ্চি গুলা কখনোই অনিন্দিতার থেকে কিছু নেয় না। কেন কে জানে? ওদের সাথে গল্প করতেও ভালো লাগে অনিন্দিতার। শীতের এই সময়টাতে চিকড়িমিকড়ি রোদে চাদর গায়ে বসে থাকলে কেমন মৌতাতের মত আবেশ হয়।আচমকা সামনে ভীড় জমে গেল।এক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ছোটাছুটি করছে। অনিন্দিতা পিচ্চিকাচ্চাদের সাথে এগিয়ে গেল। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাউকাউ চিল্লাফাল্লা করছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না দেখে এগোলো ও। একজন মধ্যবয়স্ক আর একজন তরুণ। পাঠাওয়ের রাইডার। তরুণের হাঁটু ছিলে গেছে মারাত্মকভাবে। আর মধ্যবয়স্ক লোকটির হাঁটুতে চোট লেগেছে ভয়ানক। অনিন্দিতার ব্যাগে ফার্স্ট এইড থাকেই সবসময়। যতটুকু করার করে উঠতেই দুজনেই থ্যাংক ইউ জানালো। অনিন্দিতা মৃদু নড করে চলে গেল। ফারাবী বাসায় ফিরতেই সবাই একেবারে উদ্বিগ্ন হয়ে গেল। ছেলের হাঁটু অব্দি প্যান্ট গোটানো। হাঁটুর কাছে ছড়ে গেছে। বড়পা এগিয়ে এসে ধরলো,
-কি হয়েছে রে ভাইসোনা তোর? বাবা, মা,ছোটপাও এগিয়ে এসেছে।
-কি হলো?
-আরে আপু তেমন কিছু না। হালকা এক্সিডেন্ট ছিল।
ওকে সোফায় বসিয়ে শুরু হয়ে গেল পরিচর্যা। ফারাবী সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।ওর কানে আর কিছু যাচ্ছে না। ও মেয়েটির কথা ভাবছে। মেয়েটির চোখ দুটো এত কেন কথা বলে। কি গভীর! যেন তাকালেই সমুদ্র দেখা হয়ে যায়। ফারাবী মনে মনে প্রার্থনা করলো ‘উপরওয়ালা, মেয়েটার সাথে যেন আর একবার দেখা হয়। ‘
কতক্ষন ধরে ঘুরে ঘুরে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে অনিন্দিতার। পাঁচশো টাকার নোটের ভাংতি নেই কারো কাছে। আজব শহর আর তারচেয়ে আজব এই শহরের লোক মাইরি। অনিন্দিতা আচমকা শাহবাগের কোনো সিগন্যাল না মেনে হাঁটা ধরলো ট্রাফিক পুলিশের কাছে। হাইকোর্টের দিক থেকে বাস আসছিল। ওকে বাঁচাতে যেয়ে হার্ড ব্রেক কষলো। শাহবাগ একেবারে নরক গুলজার হয়ে গেল। দুই ট্রাফিক পুলিশ চা খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে একবার অনিন্দিতাকে একবার পেছনের জ্যাম দেখছে। কারণ এই জ্যাম ছুটাতে পাক্কা তিন ঘন্টা লাগবে। পাগলি মেয়েটা তেড়েফুঁড়ে আবার তাদের কাছেই আসছে।অনিন্দিতা একেবারে বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে বিচার দিল,
-আংকল দ্যাখেন না।কেউ টাকা ভাঙতি দিচ্ছে না। কারো কাছে নাকি নেই।দিন টাকা ভাঙিয়ে। অনিন্দিতার কথা বলার ভঙ্গীতে দুই ট্রাফিক পুলিশই হেসে উঠলো।একজন ভাঙতি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
-কি করবে আম্মু?
-ওই যে ভিক্ষুকদের দেব।
দুজন চোখ কপালে তুলে দেখলো অন্তত দশজন ভিক্ষুক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা কেন জানি দুই ট্রাফিক পুলিশের মন ভাল হয়ে গেল। হাসিমুখে বললো,
-আবার দেখা দিও আম্মু।
অনিন্দিতা মৃদু হেসে চলে গেল।দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছিল ফারাবী। ওর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আজ ওর আইটেম ছিল এনাটমির। সেসব ভুলে ও অনিন্দিতাকেই দেখছে।ভিক্ষুকগুলো বিদায় নেয়ার পর কাছে এলো।
-হাই
-আপনাকে চিনলাম না তো।
-আমি ফারাবী। ওই যে মানিক মিয়া এভিনিউ তে এক্সিডেন্ট হলো। আপনি ফার্স্টএইড ট্রিটমেন্ট দিলেন।
-ও আচ্ছা! আপনার পায়ের কি অবস্থা?
-ভাল। শুনুন
-জ্বি
-এক কাপ কফি খাবেন আমার সাথে?
-কেন?
-আসলে সেদিন ভালোভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। কিছুক্ষন ভেবে রাজি হলো অনিন্দিতা। কিন্তু শর্ত বিল ও দেবে। গাঁইগুঁই করে মেনে নিল ফারাবী। কফি অর্ডার দিয়ে দুজনই চুপ করে আছে। নিরবতা ভাঙলো ফারাবী।
-আমি ফারাবী
-অনিন্দিতা
– আমি ডিএমসি তে আছি।
-আমি চারুকলায়। আপনি তাহলে ডাক্তার?
-হইনি।ফিউচার। আর আপনি তো আর্টিস্ট । অনিন্দিতা কিছু না বলে হাসলো।
-অবশ্য আপনাকে দেখে আর্ট সম্পর্কে ধারণা করা যায়।বিশেষত আপনার টিপ।
-ওটা আমার বন্ধু।
-মানে?
-মানে যখন আমি এই শহরে অনার্স করতে আসি ,
তখন খুব একা অনুভব করতাম। টিপ পড়ার অভ্যাস তখন থেকেই। টিপ ছুঁলেই মনে হয় সব কিছু ঠিক আছে। যেদিন আমার কপালে টিপ আর চোখে কাজল থাকবে না সেদিন বুঝতে হবে আমার পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেছে।
-বাহ!আপনি তো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন।
কফি আসলো।অনিন্দিতার কাজ দেখে থমকে গেল ফারাবী। কফির কাপ দুহাতে ধরে ঘ্রাণ নিল বুক ভরে। আচ্ছা!মেয়েটির সবই কি আর্ট? এত ভয়াবহ কেন মেয়েটি? ভাবলো ও।
-অনিন্দিতা
-বলুন
-আপনি কি সবসময়ই এইরকম করে ঘ্রাণ নেন।
-হ্যা
-যতবার খান ততবার?
-হ্যা বলেই হেসে ফেললো মেয়েটি। ফারাবী চমকে গেল। মেয়েটির হাসির শব্দে বেলোয়ারী কাঁচের শব্দ মনে করায়।
-আচ্ছা আপনার নম্বর বা ফেইসবুক নেইম পাওয়া যাবে?
-কেন?
-না মানে আবার হেসে ফেললো অনিন্দিতা।
-আমার ফোন নম্বর নিয়ে কিচ্ছু হবে না।আমি সবসময় ফোনের ইনকামিং অফ রাখি। এইটা মজার একটা বিষয়। ফেইসবুকে কানেক্ট থাকতে পারেন।কিন্তু আজাইরা মেসেজ দিলে ব্লক।
-আজাইরা কিরকম?
-এই খাইছেন কিনা, কি দিয়া খাইছেন, খাবারের কালার কেমন ছিল, কেমন আছেন,কি করেন এইসব হাবিজাবি।
এবার হেসে ফেললো ফারাবী৷
-মনে হচ্ছে অনেকেই প্রশ্ন করে?
-ইগনোর মেসেজ করে রেখে দিই।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এইগুলা নিয়ে কথা বলবো না।
-আচ্ছা। এখন উঠবো।
ফারাবীর মন খারাপ হয়ে গেল।মনেহচ্ছে মাত্রই বসেছে ওরা। অথচ দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেছে । আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি। মেয়েটা কি জীবন্ত! অনিন্দিতার ম্রিয়মাণ অবয়বের দিকে তাকালো। মাথা ঝুঁকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কেমন ক্লান্ত লাগছে মেয়েটিকে।আচ্ছা? মেয়েটি কি ক্লান্ত?
পাখির ডানায় ভর করে সময় চলে যায়। এরমধ্যে কেটে গেছে অনেকটা সময়। ফারাবী বিসিএসের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। ভরসা হচ্ছে অনিন্দিতা। মেয়েটার সাথে ও জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মেয়েটার কোনো রাগ নেই, জিদ নেই, চাওয়া নেই, অভিমান নেই। মেয়েটা যেন ভালোবেসেই খুশি। মেয়েটাকে যেদিন প্রপোজ করেছিল সেদিনের কথা ভাবলো। মানিক মিয়া এভিনিউ তে বসে অনেক কথা বলতে বলতে বলেছিল
-অনিন্দিতা, তোমার হাতটা কি ধরতে পারি? দুমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল,
-উইথ কমিটমেন্ট অর উইদাউট কমিটমেন্ট?
-উইথ কমিটমেন্ট
অনিন্দিতা হাত এগিয়ে দিয়েছিল। এরপর যে টানা ভালইবেসেছে তা নয়। মাঝে অন্য রিলেশনে জড়িয়ে অনিন্দিতাকে ছেড়েও গিয়েছিল।যখন ফিরে এসেছে তখনও অনিন্দিতা ওকে ঠিক আগের মতই ভালোবেসেছে। কেয়ার করেছে।জ্বর আসলে ফারাবী জানতো ফোনের ওপাশে আরেকজন জেগে বসে আছে। এটাই ছিল তীব্র ভালোবাসা। অনিন্দিতা ফারাবীকে তীব্রভাবে ভালবাসতো।
মাঝে অনেক দিন ফারাবী অনিন্দিতার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। পড়া, পরীক্ষা নিয়ে ডুবে ছিল। অবসরে মনে পড়লো অনিন্দিতার কথা। নাহ! মেয়েটি তো অনেক দিন ফোন দেয় না।এতদিন তো মেয়েটি যোগাযোগ না করে থাকে না। দিনে একবার হলেও ফোন দেয়।ফোন দিল, ফোন সুইচড অফ। নাহ! ফারাবীর অস্থির অস্থির লাগছে। মেয়েটি কোথায় যেন থাকতো? মোহাম্মদপুর, নজরুল ইসলাম রোডে । দুবার ওর বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে। হুডিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।এবার শীত আগেভাগেই জাঁকিয়ে বসেছে। দরজা নক করতেই খুলে দিল একটি ছেলে।
-অনিন্দিতাদের বাসা এটা? ছেলেটি চুপচাপ মাথা ঝাঁকালো।
-ও আছে? আমি একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম।
-আপনি?
-ফারাবী
-ভেতরে আসুন ফারাবী ভেতরে এসে বসলো।ছেলেটি ওকে বসিয়ে রেখে ভেতরে গেছে।ফারাবী দেখল ঘরটি অনিন্দিতার আঁকা ছবি দিয়ে গোছানো। খানিকপর ফিরলো ছেলেটি।হাতে নীল খাম।ছেলেটির চোখ ভেজা। আর্দ্র কন্ঠে বললো,
-আমি ওর ভাই ঋণো। অনিন্দিতা মারা গেছে তিনমাস আগে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটা স্তম্ভিত হতো না ফারাবী।ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। বুঝতে পারছে গাল বেয়ে নামছে লোনা পানি।
-কিভাবে?
-লাস্ট টু ইয়ারস ও ক্যান্সারের সাথে বাঁচছিল।আমাদের কাউকে বুঝতেও দেয়নি।একদম লাস্ট মোমেন্টে যখন আমরা ধরতে পারি তখন আর চান্স ছিল না।ফারাবী আর কিছু শুনছে না। ওর টুকরো টুকরো কথা গুলো মনে পড়ছে,
-অনি,তোমার গা তো গরম খুব।
-বুঝো নাই? আমি তো খুব হট। আবার যদি বলতো,
-এত শুকায়ে যাচ্ছ কেন?
-আমি মোটা তো।সবাই বাচ্চা হাতি বলে। বুঝতে হবে।শুকাতে হবে।ডায়েট করছি।
অনিন্দিতা ওকে ভুলেও বুঝতে দেয়নি ও ধীরে ধীরে প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে মৃত্যুকে আলিংগন করেছে ভালোবেসে৷ঝাপসা চোখে অনিন্দিতাদের বাসা থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে এসে বসলো মানিক মিয়া এভিনিউতে। অনিন্দিতার প্রিয় জায়গায়। বুকপকেট থেকে খাম বের করে চিঠি খুললো । ‘অ-প্রিয় ফারাবী, তোমাকে কতটা ভালোবাসি জানতে চেয়েছিলে একবার মনে আছে? শেষ পর্যন্ত রফা করেছিলাম যে বেশি ভালোবাসে সে আগে মারা যাবে । কথা রাখলাম তো বলো? জানো ফারাবী, আমার মাঝে মাঝে তোমার উপর তীব্র অভিমান হতো।কিন্তু সেটাকে গিলে ফেলতাম।জানতাম আমার জন্য তোমার সময় নেই। আমার ছোট ছোট অভিমান তোমার বিরক্তির কারন। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো তোমার কলার চেপে ধরে বলি আমাকে ভালবাসতেই হবে।কিন্তু যখন তোমার চোখের দিকে তাকাতাম আমি সেখানে আমার জন্য স্পেস খুঁজে পেতাম না।
আমি আমার লাইফে কখনো সেকেন্ড হইনি৷ শুধু তোমাকে জিততে দেয়ার জন্য আমি সেকেন্ড রোল বেছে নিয়েছিলাম। জানো ফারাবী, এই একজীবনে কিছু মানুষ পাশে থাকলেই সব পাওয়া হয়ে যায়।কিছু মানুষ চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটলেও অনেক কথা বলা হয়ে যায়।জীবনের পথটা অনেক লম্বা । সবাই পাশাপাশি হাঁটার জন্য থাকে কি না শেষ পর্যন্ত সেইটেই দেখার বিষয়।হাসপাতালের দিনগুলোতে আমার খুব ইচ্ছে করতো তোমাকে একবার স্পর্শ করি।মনে হতো একবার তোমার গায়ের ঘ্রাণ নিই।একবার কথা বলি।থাকুক না কিছু অপূর্ণতা। অ এর স্থানে অসম্ভব বসালেই বুঝবে তুমি আমার ঠিক কতটা প্রিয়। ভালো থেকো, ভালোবাসায়।।
ইতি
অনিন্দিতা ফারাবীর গাল বেয়ে ঝরছে লোনা পানি। উত্তুরে বাতাস দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে নিয়ে গেল কোথায়, কে জানে।।