অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছি অনেক্ষণ ধরে! নার্স বলে গেলো স্যার রাত ৩ টা হয়ে যেতে পারে।
আমার অনেক ঘুম আসছে, ঘড়ি দেখি রাত ১ টা বাজে মানে এখন ও দুই ঘণ্টা! ভাবছি ঘুমিয়ে যাবো নাকি? হটাৎ এক জনের ডাকে ঘুম ভাংলো।
।
তামান্না! আমার বউ!
তামান্না- এই চলো! হয়ে গেছে।
আমি- ঘড়ি দেখলাম, রাত ৪ টা! হ্যাঁ চলো।
তামান্না- এই ডাইভার কোথায়?
আমি- রাতে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।
তামান্না- কি আজব তুমি?
।।
আমি- কেন? আমি আমার বউয়ের সাথে সময় দিতে পারি, তো কি ডাইভারের কি বউ বাচ্চা নাই? ওর মেয়েটাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করে।
আচ্ছা আমাদের কবে বাচ্চা হবে বলতো।
তামান্না- হবে হবে, আল্লাহ্ চাইলে খুব তাড়াতাড়ি হবে তা এখন ড্রাইভ কে করবে শুনি?
আমি- কেন আমি কি করতে আছে?
তামান্না- লাইসেন্স আছে?
আমি- এই ভোর রাতে কে লাইসেন্স নিবে?
।।
বাসায় গিয়ে আমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম, তামান্না গোসল করলো, তারপর ফজরের নামায পড়ে দুজনে শুয়ে গেলাম।
।।
তামান্না আমার বউ! একজন ডাক্তার, আর আমি এখন একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চুক্তি ভিত্তিক ক্লাশ নেই।
আর এই রুটিং যখন আমার বউয়ের রাতের অপারেশন থাকে, তখন আমিও তার সাথে হাসপাতালে থাকি।
।।
এটা কোন অবিশ্বাস না এটা ভালোবাসা। আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগের কথা, তামান্নার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে,
আমি মাঝে মাঝে গল্প লিখতাম, মেয়েটা সেই গল্প পড়তো, আমার সাথে তেমন কথা হতো না, মাঝে মাঝে হাই! হ্যালো। এর বেশি কিছু না,
একদিন দেখি সে একটা অপারেশন থিয়েটারের ছবি আমাকে দিলো, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে নার্স নাকি? সে একটু রেগে বলল,
জি না স্যার ডাক্তারি পড়ছি, আমি বললাম, সরি বুঝতে পারিনি।
।
এরপর আমাদের মাঝে মাঝে কথা হতো।
একদিন আমি ওদের হাসপাতালে যায়, পরে রাতে বলি, যে আজ আপনাদের হাসপাতাল গেছিলাম,
তামান্না- তো আগে বললেন না কেন?
আমি- আগে বলে কি হতো?
তামান্না- দেখা করতাম।
আমি- তাই নাকি? তো ৩ দিন পর আবার যাবো।
তামান্না- ঠিক আছে আসেন।
।
৪ দিন পর আমার বোনকে হাঁসপাতালে ভর্তি করলাম, বাচ্চা হবে এজন্য। আমি তামান্নাকে একটা ম্যাসেজ দিলাম।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সারাদিনেও কোন রিপ্লে পেলাম না। পরের দিন আমার বোনের অপারেশনের কথা বলল,
আমাদের হাঁসপাতালে পরিচিত তেমন কেউ ছিল না, তাই তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পেলাম না।
।।
পরের দিন রাতে আমি আর আমার পরিবার অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছি।
হটাৎ একজন বলল, আপনি ইমরান?
আমি- হ্যাঁ আপনি তামান্না নাকি?
তামান্না- হ্যাঁ। তো এখানে কেন?
আমি- আমার বোনকে ভর্তি করেছি,
তামান্না- আপনি তো বলেননি আগে?
আমি- দুই দিন আগে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম।
তামান্না- পরীক্ষা আর কাজের চাপের জন্য ফেসবুকে আসিনি। আচ্ছা আপনার বোন তো, আমি দেখছি।
।।
রাত ৩ টা পর্যন্ত অপারেশন হলো, যেহেতু আরও রুগী ছিল তাই সময় এতো লাগলো।
অপারেশন শেষ করে আমার বোন বের হলো, আপুর ছেলে হয়েছে।
তামান্না- আপনার আপু সুস্থ আছে, বেডে আপুর পাশে ১-২ জন থেকে বাকিরা বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন।
।।
তামান্নার আন্তরিকতার জন্য আমার আপুর অনেক সেবা করা হলো।
তারপর থেকে তামান্না আমার ভালো বন্ধু হয়ে গেছিলো, সে সব সময় ব্যাস্ত থাকতো, তাই অনেক সময় আমি তাকে ফোন করে গল্প শুনাতাম,
আমার পড়া শেষ করে আমি ঢাকা চলে গেলাম, একটা কোম্পানিতে জয়েন্ট করলাম, এভাবে ১ বছর পর তামান্নার পড়া শেষ হলো,
একদিন আমি তামান্নার সাথে দেখা করলাম, যদিও এর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। সে বলল, আমি ছুটিতে আসলে তাকে ১ দিন সময় দিতে।
।।
রোজার ঈদের পরের দিন ছিল!
আমি সকালে তার ওখানে গেলাম, সে, সে দিন শাড়ি পড়েছিলো, অনেক সুন্দর লাগছিলো,
আমি- কি ব্যাপার ম্যাডাম! এতো সেজে গুজে কোথায়?
তামান্না- এমনি ইচ্ছা হলো তাই। আচ্ছা তুমি তো গল্পে বলো, যে টাকাতে আসল সুখ আসে না। ছোট ছোট সুখ ই আমাদের জীবনে বড় সুখ হয়ে যায়,
যেমন নদীর পাড়ে খালি পায়ে হাঁটা, রাতের আকাশের তারা দেখা, নৌকাই চড়া, রাস্তার পাশে ফুচকা খাওয়া।
।।
আমি- জীবন চলতে টাকার প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভালোবাসার মানুষদের কথা ভুলে যায়।
তামান্না- আচ্ছা এর একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি তোমাকে ৫০০ টাকা দিচ্ছি, আজ সারাদিন আমি তোমার সাথে থাকবো,
তুমি আমাকে ঘুরাবা এই ৫০০ টাকার মধ্যে, আর আমি অবশ্যই এই ৫০০ টাকার হিসাব নিবো।
।।
আমি- টাকা তো আমার কাছেই আছে।
তামান্না- না তুমি এটা নাও।
আমি- ঠিক আছে।
।।
এরপর তামান্না কে নিয়ে সারা দিন ঘুরলাম, দুপুরে এক সাথে খেলাম, খারাপ খায় নি, তার পর তাকে রিক্সায় নিয়ে নদীর পাড় গেলাম,
ওখানে বিকেল পর্যন্ত বসে থেকে তার পর নৌকা ভ্রমন করলাম তার তাকে নিয়ে ফুচকা খেলাম, তারপর শহরে একটা মেলা হচ্ছিলো,
ওখানে গেলাম। অনেক কিছুই কিনার ইচ্ছা হচ্ছিলো কিন্তু যেহেতু আমার সারাদিনের বাজেট ৫০০ টাকা তাই সাহস পেলাম না,
অবশেষে হিসাব করে এক জোড়া কাচের চুরি কিনলাম ওর জন্য।
।
রাত তখন ৯ টা একটা হোটেল থেকে আমরা ৪ টা রুটি আর ১০ টাকার ভাজি কিনলাম, রাতের খাবার শেষ করলাম,
তারপর রাস্তায় হাঁটার সময় দেখলাম, কারেন্ট চলে গেলো, আমার জন্য ভালোই হয়েছে, সামনে একটা স্কুল এর ফাকা মাঠ,
আমি তামান্নাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে বললাম বসতে, মাঠের এক পাশে চায়ের দোকান, দুইটা লেবু-চা নিয়ে তামান্নার কাছে গেলাম, তামান্না দেখে বলল,
তামান্না- চা? আমি তো চা খাই না।
আমি- আর ১০ টাকা বেঁচে ছিল, বাজেট এ এর চাইতে বেশি কিছু নাই।
।।
তামান্না আর কিছু বলল না, চুপ করে চা খেয়ে নিলো। তারপর বলল,
তামান্না- চা টা অনেক টেস্টি ছিল, আমরা বিয়ের পর এখানে এসে রোজ চা খাবো।
।।
কথা শুনে আমার গলায় চা আঁটকে গেলো।
আমি- মানে? কার বিয়ে? কার সাথে?
তামান্না- কেন তোমার কি প্রেমিকা আছে নাকি?
আমি- না নাই।
তামান্না- তাহলে আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা কি?
আমি- তুমি কোথায় আর আমি কোথায়? এটা তোমার পরিবার মেনে নিবে না।
।।
তামান্না-আমি জানি আমার পরিবার মেনে নিবে না, চলো।
আমি-কোথায়?
তামান্না- বিয়ে করবো আজকেই
আমি- পাগল নাকি? এভাবে বিয়ে করলে তোমার পরিবার আমাকে কোন দিন ও মেনে নিবে না। ওনারা ভাব্বে আমি তোমাকে ফাসিয়ে বিয়ে করেছি।
আর আমি কাউকে দুঃখ দিয়ে আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে চাই না।
তামান্না- আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে সুখে রাখবা।
আমি- তোমাকেও আমার অনেক ভালো লাগে, অনেক ভালো মেয়ে তুমি! কিন্তু এভাবে বিয়ে করলে তোমার মা বাবাকে ঠকানো হবে,
আল্লাহ্ যদি আমার ভাগ্যে তোমাকে লিখে রাখে তবে তুমি আমারই হবে।
।।
৩ মাস মেয়েটা অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে তার পর তার বাবা-মাকে রাজী করায়, তারপর আমাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের ৬ মাস পর আমি ঢাকা থেকে চলে আসি, কারণ আমি তামান্নাকে সময় দিতে পারছিলাম না, আর সে আমাকে টাকার জন্য বিয়ে করে নি,
করেছে শুধু ভালোবাসা আর সময়ের জন্য।
।।
এখানে এসে প্রথম দুই মাস বেকার ছিলাম, পরে আমি তামান্নাকে বলি, আমি বেকার থাকলে সবাই খারাপ ভাব্বে, আর এটা ঠিক ও না।
এরপর সে ওনার এক ভাইকে বলে আমার এই চাকুরীটার ব্যাবস্থা করে দেয়।
।।
কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নাই, অ্যালার্ম বেজে উঠলো, দ্রুত সেটা বন্ধ করে দিলাম, কারণ তামান্না ঘুমাচ্ছে,
উঠতে যাবো দেখি সে হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে, কি পাগলী! এখনও প্রথম রাতের মতোই বুকের মধ্যে না ঘুমালে হয় না।
।।
আস্তে করে উঠলাম তারপর ব্রাশ করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে সামনে হোটেল থেকে রুটি আর সবজি নিয়ে আসলাম,
তার পর আমি খেয়ে একটা চিরকুটে লিখলাম, সরি গো! টেবিলের ওপর রুটি রাখা আছে, আমার ইউনিভার্সিটিতে একটা মিটিং আছে,
আর ২ টা ক্লাশ, দুপুরের মধ্যেই চলে আসবো। তারপর বিকেলে নদীর পাড়। আর সন্ধ্যায় মেলা! তুমি নীল শাড়ি টা পড়ো।
……………………………….সমাপ্ত……………………………………..