_ আব্বার একটা বাইক ছিল। জংশেন ৮০ সিসি। বাইক কেনার ছয় মাস হয়ে গেল। কেউ চালানো শেখেনি। বাইক সারাদিন পড়ে থাকে। আব্বা চালাতে সাহস পান না। ছেলেদের চালাতে দিতেও সাহস পান না। তার বদ্ধমূল ধারণা, আজকাল সবাই এক্সিডেন্ট করছে। বাইক রাতে ঘরে পড়ে থাকে। তিনবেলা নিয়ম করে বাইক মোছামুছি চলে। সংসারের সর্বকনিষ্ট পুত্র হিসেবে আমার একমাত্র কাজ বাইকের সেবাযত্ন করা। প্রবল আনন্দ নিয়ে আমি এই কাজটি করি।
সপ্তাহে একদিন উঠোনে বের করে ধুয়ে শ্যাম্পু লাগানো হয়। এরপর ধান শুকানোর মত রোদে শুকানো হয়। রুটিন কাজ। বাইকের চাকা না ঘুরলেও প্রতিদিন দুই লিটার করে তেল খরচ হচ্ছে। আব্বা সন্ধাবেলা গম্ভীর হয়ে বোতলে করে পেট্রোল এনে ট্যাংকি ভরিয়ে রাখেন। বাইক কেনার পর আমরা সবাই বদলে গেলাম। সবাই ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হলাম। দেখা গেল মধ্যরাতে বড় ভাই আব্বার বালিশের নিচ থেকে বাইকের চাবি বের করে আনে। এরপর ‘ইয়ালি’ বলে হুমড়ি দিয়ে স্টার্ট করে বাইকের পিঠে চুপ করে বসে থাকে।
বাইকের শব্দে সবাই চমকে জেগে উঠি। চক্রবুহ্যের মত চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাইজান বাইকের পিঠে বসে আছে। পিক-আপ চাপছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দে ঘর কাঁপছে। আমরাও কাঁপছি। সবাই নির্বিকার, নির্বাক কিন্তু নিরাসক্ত নই। আব্বা ভ্রু কুঁচকে তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষন পরপর ঝাড়ি দেন। গলা যথাসম্ভব মোটা করে বলেন, ‘সবাই এখন ঘুমাবে। সবাই।’ কেউ ঘুমাতে যায় না। পিতৃ ঝাড়িকে সব সময় গ্রাহ্য করতে নেই। মাঝরাতে বাইকের পিঠে বসে থাকলে তো অসম্ভব। ভাইজান সবগুলো দাঁত বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দাঁত বের করা ভাইজানকে দেখে আব্বা বিড়বিড় করে বলেন,
-ছেলেগুলো সব পাগলা হল কিভাবে? কিভাবে হল?
দিনের বেলা আমার রুটিনবদ্ধ কাজ। বাইকের পিঠে ঘোড়ায় চড়ার মত করে দুই পা ছড়িয়ে বসে থাকা। স্টার্ট করে জোরে পিক-আপ টানাটানি। সাইলেন্সার দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হয়ে যায়। অসীম সুখকর একটা সময়। বাইক আছে। প্রতিদিন দুই লিটার করে তেল খাচ্ছে অথচ কেউ চালাতে পারছে না। হাস্যকর একটি সুখময় বৃত্তে পুরো পরিবার বন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তায় এখনো বাইকের চাকা একবারের জন্যেও ঘোরে নি। বাইকের প্রভাবে একটা পাগলা সংসারের মানুষ আরও পাগলা হয়ে গেছে। পরিবারের ছোট ছেলে হিসাবে আমার কর্তৃত্ব বেশি। সারাদিন বাইকের উপরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকি। মা প্লেটে করে খাবার দলাই-মলাই করে আমাকে খাইয়ে দেন। বই এনে দিয়ে যান। বাইকে চড়েই বই পড়ি। ত্যাংকির উপর খাতা রেখে অংক করি। মাঝেমাঝে বাইকের পিঠে চড়েই গোসল করি।
দীর্ঘকাল আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। বাইকের বদৌলতে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা হয়ে গেল। হেডলাইট জ্বালিয়ে রাতে সবাই একসাথে খাই, একসাথে গল্প করি। দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জংশেন-৮০ সিসি।
জংশেন ৮০ সিসির আলোয় আলোকিত একটা পরিবার। হঠাৎ সুখী হয়ে যাওয়া একটা পরিবার। এই পরিবারের চাকা ঘুরানোর জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয় অথচ বাইকের তেলের জন্য দিন শেষে দেড় দুশ টাকা বরাদ্দ থাকে।
বাইক কেনা হয়েছিল আব্বার হাতে লাগানো ত্রিশটা ইউক্যালিপটাস বিক্রি করে। মোটামুটি নগদ টাকার ব্যাপার-স্যাপার। এই পরিবার একসাথে পঞ্চান্ন হাজার টাকা দেখেছে, এমন মুহুর্ত খুবই কম এসেছে। একসাথে সবগুলো টাকা দিয়ে একদিন আয়োজন করে বাইক কেনা হল। বাইক কিনতে শো-রুমে গেল মামা-চাচা মিলে মোট তেইশজনের মতো জোয়ান মানুষ। দোকানদার এতোগুলো মানুষ একসাথে দেখে ভড়কে গেল। একসময় সবাই বাইক চালানো শিখে গেলাম। আমি বাইক নিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাই স্কুলে। স্কুল আর আমাদের বাড়ির সীমানা একই জমি। বাইকে স্টার্ট দিয়ে পিক-আপ না টানতেই স্কুলে পৌছাই। আমার মত ছেলের কাছে স্বপ্নের চাইতেও বেশি কিছু।
আব্বা বাইক চালালে ঠিকঠাক ব্রেক করতে পারেন না। রাস্তায় বের হলে চারপাশের মানুষজনদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চালাতে চালাতেই রাস্তার লোকজনদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। উচিনিচু দেখে স্পীড কমান না। একদিন সন্ধায় মা ঘোষনা করলেন, স্বামীর পেছনে বাইকে বসবেন না। মাকে ঘুরে বেড়ানোর দায়িত্ব চলে আসল আমার কাধে। মাঝেমাঝে ভোরবেলা মাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নানা বাড়ি রেখে আসতাম। আব্বা ভ্রু কুঁচকে দেখতেন। সম্ভবত স্ত্রীকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে বেড়ানোর অধিকারটা সন্তানের কাছে হারিয়ে ফেলেছেন এজন্য খারাপ লাগত। কয়েকবার আমাকে গোপনে ডেকে নিয়ে মধ্যাস্থতা করার চেষ্টা চালালেন। রাগীরাগী স্বরে বললেন,
-তুই তোর মাকে বল, তুই বাইক চালানো ভুলে গেছিস।
আমি মাকে বললাম, বাইক চালানো ভুলে গেছি। মা ঘোষণা দিয়ে বাইকে উঠাই বন্ধ করে ফেললেন। ভাইজান সখ করে বাইক বের করেন। সমতল এবং পাকা রাস্তা সহ্য করতে পারেন না। ধানী জমিতে, সিনেমার নায়কদের মত স্টান করার চেষ্টা করেন। ধুলাবালি, কাদামাটি বাছবিছার করেন না। সোল্লাসে নামিয়ে দেন। মাঝেমাঝে বিলের মাঝে শুকনো জমিতে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ান। বত্রিশদন্ত বিকশিত হাসাহাসি করেন। মানুষজন দূর থেকে ভাবে,
-এই ছেলেটার মাথায় গণ্ডগোল।
বিকেল হলে ভাইজান বাইক নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখি লাল রঙ্গের বাইক আর লাল নেই। কাদামাখা নিখুঁত ভাস্কর্য হয়ে আছে। আমি আর মা মহা উৎসাহে ধুলোমাখা-কাদামাখা বাইক ধুই। মা বালতিতে করে পানি আনে, আমি উচ্চস্বরে ‘খাইরুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ’ গান গাইতে গাইতে ধুয়ে ফেলি। মা গভীর ভালোবাসায় নিজের আঁচল দিয়ে বাইক মুছে দিচ্ছেন দেখলে খুব ভালো লাগে। বিচিত্র একটা অনুভূতি। একটা পরিবারের অতীত ভুলিয়ে দেবার অনুভূতি। একটা টালমাটাল পরিবারের কষ্টের পরিসমাপ্তির অনুভূতি।
বাইকটা একদিন বিক্রি করতে হল। আব্বা ব্র্যাক ব্যাংক থেকে লোন করা টাকা ফেরত দিতে পারছিলেন না। লোনের পরিমান ত্রিশ হাজার। একজন লোক এত টাকা লোন করতে পারে আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারলাম না।
বাইক বিক্রির পর ভাইজান প্রতিদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। সারা ঘর ঘুরে বেড়ান। আবার ঘুমিয়ে পড়েন। আব্বা ব্যাগবাধা পুরাতন সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। বিকেল বেলা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। মা আঁচল দিয়ে আব্বার ঘাম মুছে দেন। আমি সাইকেল নিয়ে বের হলে আব্বা বের হতে দেন না। গম্ভীর হয়ে বলেন,
-বাইক কিনি আগে। তারপর বের হবি। সাইকেল চালাতে আজকাল খুব কষ্ট। মা মাঝেমাঝে আমাকে এসে বলেন,
-তুই কি বাইক চালানো ভুলে গেছিস বাপ? আমি হেসে বলি,
-না মা।
মা হাসেন। নিষ্প্রান হাসি। সম্ভবত চান, আমি ভুলে যাই। কালের পরিক্রমায় আজ আমাদের পরিবারের পাঁচজনের পাঁচটা বাইক। ছোট-বড়-মাঝারী। দামী-অল্পদামী-কমদামী। আব্বা নিয়ে বেড়ান ডায়াং ১০০ সিসি। মেজোভাই ফেজার চালান। এর মাঝে একভাই চারচাকার বিশাল গাড়িও কিনে ফেললেন। অতীব আশ্চর্য যে সেই মুহুর্তটি ফিরে আসছে না। একটা জংশেন ৮০ সিসির ছোট্ট লাল রঙের গাড়িকে নিয়ে পাগল হয়ে যাবার স্মৃতিটা কোনভাবেই ফিরে আসছে না। আমি বাড়ি গেলে মা আজও নিজের আঁচল দিয়ে আমার বাইক মুছে দেন। অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও পায়ের জুতোগুলোও আঁচল দিয়ে মুছে পায়ে পরিয়ে দেন। তবুও সেই স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে না। কোনভাবেই আসছে না।
আগের মত এখনো সবাই রাস্তায় বাইকে ঘোরাঘুরি করি। চলতে চলতে সেই আশি সিসির লাল রঙের বাইকটির দেখা পাই। যাকে ঘিরে একটা পরিবারের সুখের পরিধি আবর্তির হয়েছিল, সেই স্মৃতিটির সাথে দেখা হয়। নতুন মালিক খুব একটা ভদ্রলোক নন। ব্যাপারী টাইপ। বাইকের পেছনে একটা লম্বা ক্যারিয়ার লাগিয়েছেন। সেখানে কাঁচা মাছ রেখে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। বসার সিটটা বেঁকে গেছে। সেখানে ঝালাই এর ক্ষতচিহ্ন। সম্ভবত ভেঙ্গে গিয়েছিল। নতুন মালিক তাকে কিভাবে রেখেছে, কিভাবে তাকে ঘিরে স্বপ্ন সাজাচ্ছে, জানতে ইচ্ছা হয়। নতুন মালিকের পরিবারটির কি নির্ঘুম রাত কাটে তাকে ঘিরে? আফসোস! একজনের সুখস্মৃতি আরেকজনের কাছে খুব একটা মূল্যবান নয়। খুব একটা নয়…