” দাদা ভাই চকলেট খাবি? ” মায়ার কথায় একটু ম্লান হেসে বললাম,
-চকলেট? তুই চকলেট পেলি কই?
মায়া ওর ছোট ছোট দাত বের করে খিলখিল করে হাসলো একবার। তারপর বললো,
– ভাবী দিয়েছে। ছোট্ট মায়ার হাসিমুখে ভাবী কথাটা শুনে বেশ চমকে উঠলাম। ভাবী ! ভাবী আসলো কোথা থেকে? শরৎ বাবুর চরিত্রহীন বইটা পাশে রেখে ওর দিকে তাকালাম। ওর হাতে বেশ কয়েকটা চকলেট। এর মধ্যেই একটা খেতে শুরু করেছে।
– ভাবী? ভাবী পেলি কোথায় রে ছুটকি? আমি তো বিয়েই করিনি এখনও। মায়া আরও একবার অাধ-খাওয়া চকলেটে কামড় দিয়ে খিলখিল করে হাসলো। তারপর বললো,
– নীলু ভাবী দিয়েছে, আর নীলু ভাবী বলেছে আমি যেন তাকে ভাবী বলে ডাকি। আপু বললে নাকি শুনতে ভালো লাগে না। আমি যতবার ভাবী বলব ততবার এত্তগুলো করে চকলেট দিবে।
কথাটা বলেই ওর হাতের আধ-খাওয়া চকলেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি চকলেট না নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
– অনেক রাত হয়েছে চল ঘুমাবি।
মায়া আমার কোলে শুয়ে পড়লাম। এটা ওর অনেক আগের অভ্যাস। ঘুম পেলে আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মাথা ঘুমিয়ে গেলে ওকে বালিশে শুয়ে দিয়ে জানালার কাছটায় গিয়ে দাড়ালাম। পাশের ফ্ল্যাটের তিন ত’লার জানালা আজকে বন্ধ। আলো জ্বলছে না। ” নীলু ভাবী তো নেই দাদাভাই, কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। দুইদিন পর আসবে। ” কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি মায়া উঠে বসে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।
– ঘুমাসনি কেন ছুটকি? রাত তো অনেক হলো।
– গোয়েন্দারা রাতে ঘুমায় নাকি? নীলু ভাবী বলেছে গোয়েন্দাদের রাত জাগতে হয়। না হলে অপরাধীকে ধরা যায় না। মায়ার কথা শুনে বেশ অবাকই হলাম। গোয়েন্দা ! ছুটকিটা আবার গোয়েন্দা হলো কবে থেকে। মনে মনে বেশ হাসিই পাচ্ছিল। জানালা ছেড়ে ওর পাশে এসে বসতেই এক লাফে আমার কোলে এসে বসলো।
– হি হি হি আমি তো গোয়েন্দা, তাই অপরাধী ধরার চেষ্টা করছি।
– ওই তুই আবার কখন গোয়েন্দা হলি? আর কে অপরাধী?
-এই তো আজ থেকেই, নীলু ভাবী বলেছে আমাকে ঘুমের ভান করে চুপিচুপি দেখতে রাতে তুই কি করিস সেটা দেখার জন্য। আমি জানি তুই প্রতিরাতে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার পর নীলু ভাবীর জানালায় তাকিয়ে তাকিস। হি হি আমি সব জানি। মায়ার কথা শুনে বেশ থথমত খেয়ে গেলাম। তার মানে প্রতিরাতে ঘুমের ভান করে থাকে? বাহ ছুটকিটাতো পাক্কা গোয়েন্দা হয়ে গেছে দেখছি।
– তা এই গোয়েন্দাগিরি কবে থেকে শুরু করেছেন আপা বলেন তো।
– যাক তুই যে আমাকে সম্মান করে কথা বলছিস খুব ভালো লাগছে।
– দিবো একটা কানের দিকে। পাকনামি শুরু হইছে তাই না? ঘুমা এবার। মায়া আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
– দাদা ভাই, তুই ভাবীকে খুব ভালোবাসিস তাই না? আমি জানি। ভাবীও জানে। আমি ভাবীকে সব বলে দিয়েছি। আর তারপর ভাবী চকলেট দিছে। বলছে আরও দিবে। খুব মজা খাবি তুই দাদাভাই?
– না তুই খা।
বছর পাঁচেক হলো এই এক তালা টিনসেটের বাসায় উঠেছি। ঢাকা শহরে এমন বাসাতেও খরচ অনেক। কাজের কাজ তেমন নেই, সারাদিনে টিউশনি করে যা পাই তাতেই দুই ভাই বোনের চলে যায় কোনো মতে। মায়ার সব আবদার মিটাতে পারি না। তবুও খুব ভালো আছি। নীলু নামের মেয়েটার সাথে পরিচয় এখানে আশার পর থেকেই। কখনও আন্তরিক ভাবে কথা হয়নি ঠিক কিন্তু তবুও যেন কত চেনা ঐ মুখটা। রোজ সকালে টিউশনিতে যাওয়ার সময় দেখি মেয়েটা পথ আগলে দাড়িয়ে আছে। সামনাসামনি যেতেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বড়লোক বাবার চোখে পড়েছিল হয়তো প্রথম দিকেই। তাই একবার ডেকে ভালোই শাসন করে দিয়েছিলো। তারপর থেকে চোখের আড়াল করলেও মন থেকে সরানো মুশকিল হয়ে যায়।
ভালোবাসি হয়তো তবে প্রকাশ করি না কখনও। রোজ রাতে জানালায় গিয়ে দাড়ালে পাশের ফ্ল্যাটে একটা জানালাতে আলো জ্বলতে দেখি, ঘরটা নীলুর। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখা যায় মেয়েটা জানালায় এসে দাড়িয়েছে। নজর আমার এই ছোট্ট চিলেকোঠার দিকে। ঘর অন্ধকার তাই এই চিলেকোঠার জানালাতেও যে তারই মত কেউ দাড়িয়ে থাকে সেটা বোঝায় উপায় নেই।
মায়া এতক্ষণে হয়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকাতেই হাসি পাচ্ছে। এই মেয়ে নাকি গোয়েন্দা হা হা হা। পাশের চেয়ারে বসে ডায়েরিটা লিখছি। তেমন কিছু লিখি না। যা লিখি সবাই নিত্যন্তই তুচ্ছ ঘটনা। সকাল টা কিভাবে কাটলো দুপুরটা আর রাতের অন্ধকার জানালায় দাড়িয়ে থাকা এই সবই স্থান পায় এই ছোট্ট কালো মলাটে মোড়ানো ডায়েরিতে।
সকাল সকাল উঠার অভ্যাসটা অনেক দিনের। মায়াও আমার সাথেই উঠে পড়ে। তারপর এক সাথে খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি কাজে। তারপর আবার দুপুরে আসি। আমি বাসায় না থাকলেও চিন্তা হয় না, কারণ আমি জানি, মায়া সারাদিন নীলুদের বাসাতেই থাকে। নীলুও যে আমার এই ঘরে আসে যেটাও জানি। গতকাল ডায়েরির পাতায় মেয়েলী পারফিউমের গন্ধ লেগে ছিলো। গন্ধটা খুব পরিচিত, নীলুর সাথে রাস্তায় দেখা হলে ওর শরীর থেকে ভেসে আসে। তার মানে নীলু ডায়েরিটা পড়েছে।
আজ দুই দিন থেকে মায়ার মনটা খুব খারাপ। আমি জানি মন খারাপের কারণ নীলু। সারাদিন মেয়েটা মায়াকে দেখে রাখে। আমি আসার আগেই রেখে যায়। ভালোবাসে হয়তো, হয়তো না একটু বেশিই ভালোবাসে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না। সারাদিন পর রাত নয়টার সময় বাড়ি ফিরলাম। জানি ছুটকিটা বেশ রেগে আছে। দুপুরেও আসিনি খেতে। হয়তো না খেয়েই বসে আছে। দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। “ছুটকি, ছুটকি ” দুইবার ডাকার পরও কোনো সাড়া শব্দ আসলো না। এত রাতে মায়া ঘরে নেই? বুকটা ধড়াস করে উঠলো। আজকেও খবরের কাগজে দেখলাম শহর থেকে বাচ্চা ছেলে মেয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। পাগলের মত ছুটে এলাম মজিদ কাকুর দোকানে, ছুটকি মাঝে মাঝে সেখানে যায়।
– কাকু মায়া এসেছে?
– কই না তো। আজকে সারাদিনই আসেনি।
আসেনি? তাহলে গেলো কোথায়? বাসায় সবাইকে ডেকে ডেকে প্রশ্ন করতেই বললো, ” না তো বাবা, মায়া তো সারাদিন বাসায় নেই। আমরা ভাবলাম হয়তো তুমি সাথে নিয়ে গেছো। “পায়ের নিচ থেকে ক্রমেই মাটি সরে যাচ্ছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। ” দাদাভাই, দাদাভাই। ” মায়ার কণ্ঠ শুনেই লাফ দিয়ে উঠলাম। দেখছি মায়া দাড়িয়ে আছে আর পাশেই নীলু। দৌড়ে গিয়ে কোলো তুলে নিলাম। নীলুর নিচু মাথা উচু হচ্ছিলো না। মাথা নিচু করেই কাঁপাকাঁপা ঠোটে বললো,
– দুঃখিত, আসলে মায়াকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি এতটা রাত হবে। কোনো কথা না বলেই মায়াকে নিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ালাম। মায়া বেশ ভয় পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।
– ভালোবাসেন?
পিছনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখে এই কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। পিছন ঘুরে একবার তাকালাম। চোখা-চোখি হয়ে গেলো। হালকা কাজল দেওয়া চোখটা ক্রমেই ভিজে উঠছো।
– কি হলো বলেন, ভালোবাসেন? ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলি, বাসি হ্যাঁ হ্যাঁ ভালোবাসি নীলু বড্ড বেশি ভালোবাসি। কিন্তু বলার সাহস হলো না। তার বদলে বললাম,
– রাত অনেক হয়েছে বাড়ি যান। সবাই চিন্তা করছে।
শুয়ে আছি, নীলুর বলা ভালোবাসি কথাটা বার বার কানে বাজছে।ভালোবাসেন? ভালোবাসেন? ভালোবাসেন? ছুটকি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। হুট করেই রাতে বাসায় এসে দেখি মাথায় ব্যথায় কাতড়াচ্ছে। সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। ডাক্তার এখনো কিছু বলেনি। বুকের মধ্যে কেউ ব্লেড দিয়ে কাটছে।
– দাদা ভাই,নীলু ভাবীকে ভালোবাসিস না? মায়া আমার হাতটা ধরে প্রশ্ন করলো। কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বললো,
– আমি জানি ভালোবাসিস। বজ্জাত বুড়োটার জন্য তুই বলিস না। আমার চোখ এড়াতে পারবি না হু। আমি তো গোয়েন্দা। হি হি হি
– ব্যথা কমেছে আপু?
– হুমম তবে কেমন যেন লাগছে। মনে হয় বাঁচবো না রে দাদাভাই। ভাবীকে বিয়ে করিস, আমার মত চকলেট খেতে পারবি।
কথাটা শুনেই হু হু করে কেঁদে দিলাম। পাশে নীলু দাড়িয়েছে একটু আগেই। সাথে ডাক্তারও। একটু দুরে ডেকে ফেকাসে মুখে বললো,
– নীল সাহেব, জানি না রিপোর্টটা শোনার পর কিভাবে নিবেন। তবে এটাই সত্যি যে আপনার বোনের মাথায় সব স্নায়ু অকেজো হয়ে গেছে। এখন চাইলেও কিছু করা যাবে না।
– কিন্তু আগে তো,…..
– স্যরি এটা এইভাবেই আসে।
ডাক্তার নিষ্টুরের মত কথাগুলো বলেই চলে গেলো। একবারও আটকালো না। বুকের মধ্যে কেউ হাতুরির আঘাত করছে। যেন হৃদপিণ্ডটা এখনই তার চালিকাশক্তি হারাবে। একবার মায়ার মুখের দিকে তাকালাম। নীলুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। হাতে নীলুর দেওয়া চকলেট। ছুটকি মারা যাবে? না না হয়তো ডাক্তারের কোথাও ভুল হচ্ছে। ছুটকি এখন মারা যাবে কেন? ওর কত শখ গোয়েন্দা হবে, আমার আর ওর নীলু ভাবীকে একসাথে দেখবে। মায়াকে শিখিয়ে দিবো বেশি বেশি ভাবী ডাকতে তাহলে নীলু অনেক চকলেট দিবে। আর সেইগুলো আমি আর মায়া ভাগ করে খাবো। সবই কি স্বপ্ন??
– দাদাভাই, এইদিকে আয়, দুরে কেন? মায়ার ডাকে ওর দিকে তাকালাম। চোখের পানি আড়াল করে ওর কাছে যেতেই বললো,
– কাদছিস? আমি গোয়েন্দা সব দেখতে পারি। কেউ ফাকি দিতে পারবি না হু।
ওর কথাটা শুনেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। হ্যাউ ম্যাউ করে কেঁদে দিলাম। বসে আছি, বেডে শুয়ে আছে ছুটকি। নার্স এসে মুখটা একটু আগে ডেকে দিয়ে গেল। একটা পিচ্চি গোয়েন্দা শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে তো। পৃথিবীর একমাত্র গোয়েন্দা যে কি না প্রেমের অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি হিসাবে ভাবী বানাবে। কানে বাজছে, “দাদা ভাই, আমি তো গোয়েন্দা, আর গোয়েন্দারা রাতে ঘুমায় না, অপরাধী ধরতে হয়। দাদা ভাই নীলু ভাবীকে বিয়ে কর অনেক চকলেট পাবি। তখন দুইজন একসাথে খাবো। দাদাভাই ,, আমি কিন্তু গোয়েন্দা, আমার চোখ ফাকি দিতে পারবি না।” ঠিকই বলেছিলো, গোয়েন্দাদের ফাকি দেওয়া যায় না, ওরা ফাকি দিয়ে চলে যায়।
সমাপ্ত