তানহার সাথে আমার ছয় বছরের রিলেশন ছিল । ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম । কিন্তু আমার বাবা এই বিয়ে মানতে পারে নি । কারণ তিনি তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । বাবার ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারি নি কারণ তানহাকে খুব ভালোবাসি আর ওকে কথাও দিয়েছিলাম যে ওকেই বিয়ে করবো । ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে তানহার সাথে আমার পরিচয় হয় । তানহা তখন ব্যাংকক থাকে । এম.বি.বি.এস করছিলো, দ্বিতীয় বর্ষে ছিলো । তখন থেকেই আমাদের রিলেশনের শুরু হয়েছিল । তানহা দেশে আসার দুইবছর পরই আমার লেখাপড়া শেষ হয় আর কিছুদিনের মধ্যে আমি চাকরি ও পেয়ে যাই । বাবাকে বলেছিলাম তানহার কথা কিন্তু বাবা রাজি হয়নি । তাই বাবার কথা অগ্রাহ্য করেই বিয়ে করেছিলাম তানহাকে ।
তানহা সারাদিন চেম্বারে খাটাখাটনি করার পরও বাসায় এসে বাবা মা’র খেয়াল ঠিকই রাখতো । কিন্তু তারপরও বাবা ওকে দেখতে পারতো না । কারণে অকারণে ছোট করতো । তানহার বাবা মা এক রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় বছর পাচেক আগে । মেয়েটা আমার বাবা মা কেই নিজের বাবা মার মতো যত্ন করতো । মা ও তানহা কে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতো । কিন্তু বাবা কেন যেন তানহা কে সহ্য করতে পারতো না । এটা কি তানহার ওপর রাগ ছিল নাকি আমার ওপর সেটা আমি বুঝে ওঠতে পারছিলাম না । একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি তানহা রান্না করছে । আমি পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । আমার দিকে ঘুরতেই দেখি ওর গালে তিন আঙ্গুলের ছাপ, রক্ত জমে গেছে ওখানে । ওটা দেখে আমার মাথায় রাগ ওঠে গেল । তানহাকে বললাম, বাবা তোমাকে মেরেছে ?
তানহা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো । আমার কথা শুনে মা রান্নাঘরে এসে কেদে কেদে বলতে লাগলো। তানহা সন্ধ্যাবেলা বাবাকে চা দিতে গিয়েছিল । বাবা টি টেবিলের ওপর পেপার রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো । ভুলে তানহার হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে বাবার গায়ে পড়ে যায় । তাই বাবা তানহার গালে চড় বসিয়ে দিছে । আমি তখনই বাবাকে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম কিন্তু তানহা আটকে ফেললো । আমি ওকে আস্বস্ত করলাম, “বেশি কিছু বলবো না, শুধু একটু বুঝাবো ।’ এই বলে বাবার রুমে চলে গেলাম । গিয়ে দেখি বাবা ঠিক আগের মতোই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে । তার চোখ মুখ শক্ত । আমি গিয়ে বাবার পাশে বসলাম । বাবার ডান হাত আমার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, “বাবা,তুমি যে একটু ভূলের জন্য তানহাকে মারলা এটা কি ঠিক হলো ? আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তো তুমিই বলতে ক্ষমা মহৎ গুণ । এটুকু কি মাফ করে দেওয়া যেতো না ?
বাবা:(নিশ্চুপ)
আমি আবার বলতে লাগলাম, দেখো বাবা । তানহার বাবা-মা আজ থেকে পাচ বছর আগে মারা গেছে । মেয়েটা তোমাদেরকে বাবা-মা ডাকে । একটু ভালোবাসা,স্নেহ চায় তোমাদের কাছে । দিনের পর দিন তোমার বঞ্চনা, নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে শুধু তোমার স্নেহের জন্য । এটুকু কি ও পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না ? বাবা তখনো চুপ করেই রইলো । কিছু বললো না । আমি চুপ করে ওখান থেকে ওঠে গেলাম । রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ছাদে গিয়ে সিগারেট খেয়ে ঘুমাতে গেলাম । বিছানায় গিয়ে দেখি তানহা উল্টো ঘুরে শুয়ে আছে । আমি গিয়ে ওকে টেনে আমার দিকে ফেরালাম । দেখি ওর চোখের কোনে জল । আমি হাত দিয়ে ওর চোখ মুছে দিলাম । তারপর ওর মাথা আমার বুকে রেখে আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম ।
তানহা অনেক চেষ্টা করেও বাবার মন জয় করতে পারছে না । বাবাকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো, বুয়া থাকতেও বাবার জন্য নিজ হাতে রান্না করা, বাবাকে চা করে দেওয়া এতো কিছু করেও বাবার থেকে একটুও স্নেহ পায়নি । তারপরো ও চেষ্টা করে যাচ্ছিলো । যথারীতি একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি তানহার মাথায় ব্যান্ডেজ করা । এবার আমি সরাসরি মা’র কাছে গেলাম কারণ আমি জানি তানহাকে জিজ্ঞেস করলে ও কিছুই বলবে না । মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বলতে লাগলো, বাবা টয়লেটে যাওয়ার সময় পড়ে যেতে নিছিলো ।
তানহা পাশ থেকে ধরে ফেলে । কিন্তু বাবা ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় । দেয়ালে মাথা লেগে তানহার মাথা কেটে যায় । ওইদিন রেগে রেগে বাবাকে অনেকগুলো কথা বললাম । একট মানুষ যে কিনা দিনের পর দিন খেটে যাচ্ছে একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহ পাওয়ার জন্য তাকে এইভাবে অবহেলা করার কোন মানে হয় !!?? পরেরদিন ই নতুন বাসা খোজা শুরু করলাম । এক সপ্তাহের মধ্যে তানহাকে নিয়ে নতুন বাসায় ওঠে পড়লাম । তানহা আসতে চাইছিলো না, আমি জোর করে নিয়ে আসছি । মেয়েটা আর কত অত্যাচার সহ্য করবে !!?
একবছর পর তানহাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি । মেয়ে হয়েছে আমার, তানহা বেডে শুয়ে আছে । তানহার ইচ্ছা অনুযায়ী মেয়ের নাম রেখেছি ঝুম । মা কোলে নিয়ে আছে ঝুম কে । আজকে আমি অনেক খুশি, তানহাও অনেক খুশি । আমরা চেয়েছিলাম আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হোক । আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম ।
হাসপাতালের ফোন থেকে আমার ফ্রেন্ডদেরকে খবর টা দিলাম । রুমে এসে দেখি বাবা এসেছে, চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । আমি বাবাকে নিয়ে ভেতরে গেলাম । বাবা তানহার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে । তাইনা মা ?? আমাকে মাফ করে দে । আর কখনো কষ্ট দিবো না । তোদেরকে ছাড়া থাকতে আমার যে কি কষ্ট হয়েছে বলে বুঝাতে পারবো না। ফিরে আসবি না আমার ঘরে ?’
আমি আর মা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি । তানহার চোখে জল, বাবাও কাদছে । মা ঝুমকে বাবার কোলে দিলো । বাবা ঝুমের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,” দাদুভাই, আজকে থেকে আমরা দুই বন্ধু ।’ আজকে আমি অনেক খুশি, ডাবল খুশি । তানহার কষ্ট বৃথা যায় নি । তানহার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, ওর বাবা মাকে আবার ফিরে পেয়েছে ও ।
(সমাপ্ত)