বাসস্টপের ছাউনী তে দাড়িয়ে মুষুলধারে বৃষ্টি পড়া দেখছি। আর ভাবছি আমার ও যদি একজন প্রিয়সী থাকতো তাহলে তাকে নিয়ে এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়ে বাসায় শুয়ে থাকতাম তবু ও ভিজতাম।গত একঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে থামার কোন নামগন্ধ নেই।আমি কত কিছু ভাবছি এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসস্টপের ছাউনীর দিকে আসছে।এই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ও মেয়েটির সৌন্দর্য্য জানান দিচ্ছে।মেয়েটি কাছে আসতেই আমি একটু জায়গা করে দিলাম তাকে দাড়ানোর জন্য।
মেয়েটির সমস্ত শরীর ভিজে গেছে।আমার ইচ্ছা হচ্ছে মেয়েটির হাত ধরে নিয়ে দুজনে আবার নতুন করে ভিজে একাকার হয়ে যাই।কিন্তু সেকি আর সম্ভব! অপরিচিত একটা মেয়ে চাইলে তার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা যাই না।মেয়েটি তার ভেজা চুলে হাত দিয়ে পানি ঝাড়ার চেষ্টা করছে।আহা! কি সন্দুর চুল মেয়েটির।তার চুলে বৃষ্টির পানি মুক্তার মত লাগছে।আমি মেয়েটির প্রতি একটু সহনুভুতিশীল হয়ে বললাম আরে আপনি তো একদম ভিজে গেছেন, এদিকে সরে দাড়ান।আর ভিজলে সর্দিজ্বর চলে আসবে যে। আমার কথা শুনে মেয়েটি সরে দাড়িয়ে বলল -ধন্যবাদ। আমি একটু আগ্রহী হয়ে জিঞ্জেস করলাম – তা এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে কোথা থেকে আসছেন?
-আর বলবেন না।রিক্সাওয়ালকে কত করে বললাম এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে কিন্তু তিনি আসবেই না,আমাকে ওই সামনের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি ওখানে কোন ব্যবস্থা না দেখে এখানে চলে আসলাম।
-ওহ,আসলে রিক্সাওয়ালা কাজটি খুব খারাপ করেছে। মেয়েটির সাথে কথা বলছি মেয়েটি ও বলছে। এরকম সুন্দরী মেয়েরা অহংকারী হয় কিন্তু এই মেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। মেয়েটি দেখলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার সাথে কথা বলছে। বৃষ্টি থেমে গেছে আকাশে এখন শরতের আকাশের মত পরিষ্কার সাদা সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি আর মেয়েটি বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। মেয়েটির নাম নবনিতা।থাকে ধানমন্ডি।যাক দুজনে এক সাথে যাওয়া যাবে। বাসের জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বাস আসলো, আমরা দুজনে উঠে পড়লাম বাসে।বাসে বসে বেশ কথা হলো দুজনার।আমি বললাম -আচ্ছা আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?
-হ্যাঁ,অবশ্যই।নবনিতা বলল।
-আজকের পর তোমার সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে?
-আমার ফোন নম্বর নিয়ে রাখতে পারেন।
আমি নবনিতার ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম।এবং সে ও আমার ফোন নম্বর নিয়ে নিল। এত সহজে সবকিছু হয়ে যাবে এটা ভাবতে পারিনি।এরকম সুন্দরী একটা মেয়ে প্রথম দেখায় তার ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছে সচরাচর এরকম টা দেখা যায়না।ধানমন্ডি এসে গেছে দুজনে বাস থেকে নেমে যে যার বাসার দিকে চলে যাচ্ছি। সেদিনের মত ঘটনা ওখানেই শেষ।তার কয়েকদিন পর আমি নবনিতার ফোন নম্বরে ফোন দিলাম-কয়েকবার রিং হয়ে ফোনটা ধরলো। হ্যালো,আমি কি নবনিতার সাথে কথা বলছি?
-জ্বী,আপনি কেমন আছেন? আপনার নম্বর আমার কাছে সেভ করা ছিল।
-ভালো আছি। তা কি করছো এখন?
-এই তো,একটু বের হবো
-ওহ,আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে। পরে আবার কথা হবে বলে ফোন কেটে দিলাম।
এভাবে প্রায় আমাদের কথা হতো কিন্তু দেখা হতো না। তো,আমি একদিন বললাম আমরা কি দেখা করতে পারি নবনিতা?
-কেন নয়। কবে দেখা করবে বলো?
-তুমি বললে কালই।
-আচ্ছা। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে-।
সেই প্রথম বাসস্টপে দেখা আর আজ দেখা হয়েছে দুজনার।অনেকদিন পর দেখলাম নবনিতাকে।আমি বললাম তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
-আমি আবার সুন্দর নাকি? নবনিতা বলল।
-না,তুমি একদম বিশ্রী দেখতে। আমার কথা শুনে হেসে ফেললো নবনিতা।ভাবলেশহীন হাসি যাকে বলে।নবনিতা চুপ করে আছে। আমি বললাম
-ফোনে তো খুব কথা বলতে সামনে এসে এরকম বোবা হয়ে গেলে যে?
-বোবা হয়নি তো,ভাবছি।
-কি ভাবছো?
-এই যে আমরা একসাথে বসে গল্প করছি।আসলে আমরা কি বন্ধু নাকি বন্ধুর চেয়ে ও বেশি কিছু?
-হয়তো বেশি কিছু আবার হয়তো না।আচ্ছা ঝালমুড়ি খাবে একটু বেশি ঝাল দিয়ে?
-হু,খেলে মন্দ হয় না।
নবনিতা আর আমি ঝালমুড়ি খাচ্ছি বেশ তৃপ্তি করে।বিকাল পেরিয়ে গোধুলী লগ্ন,আমাদের এবার ফেরা উচিত। দুজনে বাসার দিকে রওনা দিলাম-। রাতে শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে নবনিতাকে ভাবছি-তার এলোমেলো চুল বাতাসে উড়ে উড়ে তার মুখে পড়ছে আর বার বার সে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে।বড্ড জ্বালাতোন করছে নবনিতার চুলগুলো।আমি দেখে বেশ মজা পাচ্ছি।এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
এখন আমাদের প্রায়ই দেখা হয়। দুজনে অনেকক্ষন বসে গল্প করি। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়।কখন পার্কে তো কখন ও সিনেমা হলে আবার কখন ও মোড়ের টং দোকানে দুজন বসে আরাম করে এক কাপ চা খাওয়াতে মনে হয় ভালবাসার সৃষ্টি হয়।দেখতে দেখতে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম আমরা।তবে একে অপরকে ভালবাসি কথাটি বলা হয়নি।কিছু ভালবাসা না বলে ও পূর্ণতা পায় সেরকম ভালবাসা আমাদের। দুজনের খোঁজ খবর নেওয়া।তোমাকে না পেলে মরে যাব এই টাইপ ভালবাসা চলছে।একে অন্যের পরিপূরক হয়ে গেলাম আমরা।একজনকে ছাড়া অন্যজন যেন চলতে পারি না।একদিন পার্কে বসে দুজন গল্প করছি।আমি নবনিতার পিঠে আর নবনিতা আমার পিঠে হেলান দিয়ে বসেছি। অন্যরা কে কি ভাবছে সেদিকে লক্ষ্য করলাম না।নবনিতা বলল-আচ্ছা আমি যদি কোনদিন হারিয়ে যায় তাহলে তুমি কি করবে?
-তোমাকে খুজবো পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত।
-যদি খুজে না পাও?নবনিতা বলল।
-তাহলে আমি ও হারিয়ে যাব।
-আচ্ছা,ভালবাসির জন্য কি অনেক সময় লাগে?নবনিতা বলল। আমি বললাম -“ভালবাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই এক মুহূর্তই যথেষ্ট।”
-রাতের আকাশের তাঁরাকে যতটুকুন ভালবাসি তার থেকে তোমাকে অনেক ভালবাসি। নবনিতা বলল।
এভাবে চলতে থাকে না বলা ভালবাসা।ভালবাসাগুলো মুক্ত বিহঙ্গের মত। সারাক্ষন ভালবাসার আকাশে পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায়।হোক সবার থেকে আলাদা তাতে কি ভালবাসাই তো। ভালবাসার কোন নিয়ন যে থাকে না। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে ভোর রাতের দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।স্বপ্নে দেখলাম – আমি আর নবনিতা হেঁটে যাচ্ছি। আমাদের দুজনের মাঝখানে পুতুলের মত সুন্দর একটা মেয়ে। মেয়েটির একটি হাত আমি এবং অন্য হাত নবনিতা ধরে আছে।তিনজন গল্প করতে করতে একটি বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম। নবনিতা কি যেন বলল আর তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। না, এই স্বপ্নের কথা কাউকে এখন বলা যাবে না। শুনেছি স্বপ্নের কথা বললে নাকি স্বপ্ন পূরণ হয়না।সেদিন আর ঘুম হলো না।বিছানায় শুয়ে আছি হঠাৎ করেই নবনিতা ফোন দিল। হ্যালো,এত সকালে ফোন দিয়েছো কিছু বলবা?
-বাবা,আমার বিয়ে ঠিক করেছে।নবনিতা বলল।
-কি বলছো?কবে হলো এসব?(একটু আগে দেখা স্বপ্নটা বুঝি স্বপ্নই রয়ে যাবে মনে মনে বললাম)
-আমি তোমার সাথে দেখা করতে চায় আজই।পার্কের চিরচেনা বেঞ্চে অপেক্ষা করবো।নবনিতা বলল।
-আচ্ছা,ঠিক আছে।
ফোন রেখে দিলাম। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা।নবনিতাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।নবনিতা ও পারবেনা। বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে ভাবলাম নবনিতা আমার সাথে দেখা করবে তাহলে হয়তো নিশ্চয় সে বাবার দেখা ছেলেকে বিয়ে করবে না সেটাই বলার জন্য দেখা করতে বলেছে।যথা সময়ে পার্কে গিয়ে দেখি নবনিতা বসে আছে তাকে বেশ হাসি খুশি লাগছে।তাকে দেখতে ও সুন্দর লাগছে। লাল টুকে শাড়িতে তাকে একদম নতুন বউ এর মত লাগছে।তার হাতে একটা কার্ড।
-বিয়ে করবে এইজন্য এত খুশি বুঝি?আমি বললাম।
-হু,অনেক খুশি।এই কার্ডটি নাও আর হ্যাঁ, আমাকে ভুলে যেও। পারলে ক্ষমা করে দিও।আমি বাবার অবাধ্য হতে পারবো না।
নবনিতার মুখ থেকে এই কথা শুনে আমার ভিতরে মুহূর্তের জন্য প্রলয় বয়ে গেল।প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো।এই কথা বলার জন্য সে আমাকে দেখা করতে বলেছে।এর চেয়ে ভালো ছিল নিজেই নিজেকে শেষ করে দেই আমি। নবনিতা এটা আমার সাথে করতে পারবে!নিজেকে সামলে নিয়ে নবনিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে,দুজন দুজনের পথে হেঁটে চলেছি ।
নবনিতার বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাসার দিকে রওনা হয়েছি।বাসায় পৌঁছে প্রচন্ড রাগে কার্ড টা ছুড়ে ফেলে দিলাম।কিন্তু পরক্ষনে ভাবলাম একবার দেখি কার সাথে বিয়ে হচ্ছে নবনিতার।আমার ভালবাসা কার কাছে থাকবে জানতে ইচ্ছে হলো।কার্ডটি দেখার জন্য হাতে নিয়ে খুললাম।খোলার পর ভাবলাম দিবা স্বপ্ন দেখছি না তো!নাকি আমি ভুল দেখছি। কোথায় বিয়ের দাওয়াত পত্র? কোথায় কি? নবনিতার হাতে লেখা একটি চিরকুট।চিরকুট পড়া শুরু করলাম। তাতে যা লেখা ছিল সেটা হবুহু তুলে ধরলাম-
“কাল ভোর পাঁচটায় রেল স্টেশনে চলে এসো।আমরা হারিয়ে যাব,অনেক দুরে।তোমাকে ছাড়া আমি যে বড্ড নিঃসঙ্গ।আমাকে ছাড়া বৃষ্টিতে ভিজবে কিভাবে?পার্কে কথাগুলো বলার জন্য সরি। আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম বলবো।তোমাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম।আমি জানতাম তুমি কার্ডটি খুলে দেখবে।
-নবনিতা।”
স্বপ্নটা বুঝি পূরণ হবেই।ভোর পাঁচটা,আমি আর নবনিতা রেল স্টেশনে বসে আছি। একটু পরের ট্রেনে করে দুজন হারিয়ে যাব।অনেক দুরে হারিয়ে যাব।