প্রচন্ড গরমে মুখের ভেতরটা তেতো লাগে। কি অসহ্য গরমটাই না পড়েছে। সূর্যটার দিকে একবার বিরক্তচোখে তাকিয়েই
আবার চোখ ফিরিয়ে নিতে হল। ভীষন চকচক করছে হলুদ দৈত্যটা। পারলে চোখ পুড়িয়ে ফেলে- অবস্থা।
হলুদ আগুনের ঝাপটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। খুব খারাপ একটা গালি ঠোঁটের আগায় চলে এসেছিল। দিতে গিয়েও সামলে নিলাম।
রমজান মাস; গালি দেয়া ঠিক না। রোজা রেখে গালি দিলে রোজা হালকা হয়ে যায়। এই গরমে এত কষ্ট করে হালকা রোজা রাখার কোন মানে হয় না।
গায়ের শার্টটা ঘামে ভিজে চটচটে হয়ে আছে। পিঠের কাছটায় শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। বাতাসে বায়বীয় আগুন ছড়ানো।
প্রচন্ড রোদে সবার দিশেহারা অবস্থা। চারিদিকের মানুষগুলো খুব দ্রুত চলে। যেন একটু থামলেই গায়ে আগুন লেগে যাবে।
রাস্তাজুড়ে গাড়ির লম্বা লাইন। এদিক থেকে ওদিক- যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি। তারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকের মত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
অধিকাংশই প্রাইভেট কার। অল্পকিছু বাসও আছে অবশ্য। এরা কখন গন্তব্যে পৌছাবে কে জানে।
অবশ্য তাতে তাদের খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না। গাড়ির কাচ উঠানো; ভেতরে এসি চলছে। বাইরের তাপ তাদের ত্বক স্পর্শ করতে পারে না।
বিশাল সূর্যটাও তাদের কাছে পরাজিত। কিশোর-কিশোরীর দল ফুল আর খবরের কাগজ নিয়ে শুকনো মুখে গাড়ির কাচের কাছে গিয়ে কিছু বলছে।
তাদের মিনতি কাচের অন্যপ্রান্তে পৌছায় না, কাচ নামে না, এবং তারা আগের চেয়ে
শুকনোমুখে অন্য কোন কাচের কাছে গিয়ে মিনতি ঝরায়।
এসব দেখতে দেখতে আমার ঘুম আসে। খুব গরমে শরীরটা অবশ যেন। প্রচন্ড ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে চায়।
ইচ্ছে করে প্রচন্ড গরমে এই ঘামেভেজা শার্টটা গায়ে জড়িয়েই ঘুমিয়ে যেতে। চোখটা ভারী ভারী লাগে। ভয়ংকর রোদের কারনে হয়ত।
আর মাথার দু’দিকের শিরা দপদপ করে। যেকোনমূহুর্তে ফেটে যাবে যেন।
রাস্তার সিগনাল ছেড়ে দেয়। সবুজ বাতিটা একটা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে জ্বলে ওঠে। আর সাথে সাথেই রাস্তার চিত্রটা চট করে বদলে যায়।
একটু আগের শান্ত রাস্তাটা যেন একটা উদ্দাম যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হয়। আর ড্রাইভাররা তাদের শব্দশক্তির প্রদর্শনীতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
কে কার চেয়ে বেশি জোরে আর বেশি সময় ধরে হর্ণ বাজাবে তাই নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। হর্ণের প্রচন্ড শব্দে দিশেহারা অবস্থা।
ভীষন রাগে আমার ভেতরের বিপ্লবী স্বত্ত্বাটা কাঁপতে থাকে। আমার খুব ভীষন ইচ্ছে করে রাস্তার ড্রাইভারগুলোকে লাইন ধরে দাঁড়
করিয়ে ঠাস ঠাস শব্দে চড় লাগাতে। সাথে এই সবকয়টা
বড়লোকের বাচ্চাগুলোকে। মনে মনে একটা গালি দিয়ে ফেলি ভুলে। প্রায় সাথে সাথেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। তিনি অসীম দয়ালু।
তার দয়ার কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
অল্পক্ষনেই রাস্তাটা আবার জমে যায়। সিগনাল পড়েছে। পরাজিত ড্রাইভাররা শান্তমুখে গালাগালি করছে।
স্থির রাস্তার পাশে আমি হাঁটতে থাকি। চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের চমক নিয়ে আমি হেঁটে যাই। পাশে পড়ে থাকে যন্ত্রদানবগুলো।
কিছুক্ষন আগের সেই ভীষন তেজ হারিয়ে অসহায়। পরাজিত ড্রাইভারগুলোর জন্য আমার একটু মায়া মায়া লাগে। আহা বেচারারা।
প্রচন্ড রোদে কুল কুল ঘামতে ঘামতে আমি পা চালাই।
গরম-ক্ষুদা-তৃষ্ণা। ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়।
‘এইত আর অল্প একটু পথ।’ মনে মনে নিজেকে স্বান্তনা দিই।
এই আগুনে ফার্মগেট থেকে আজিমপুর হেঁটে যেতে যথেষ্ঠ সাহস প্রয়োজন। মাইল তিনেক রাস্তাও এই সূর্য মাথায় নিয়ে তিরিশ মাইল হয়ে যায়।
তবে ইচ্ছা করলেই অবশ্য একটা রিকশা ডেকে চেপে বসা যেত। ইচ্ছে করলে হুডটাও তুলে দেওয়া যেত। আর হাতদু’টো কোলে নিয়ে বসে থাকা।
একেবারে নিশ্চিন্ত অবস্থা। পকেটের দিকে তাকিয়ে সাহস পাচ্ছিলাম না। মাসের শেষ দিকে একজন মধ্যমশ্রেনীর
মধ্যবিত্তের রিকশাওয়ালাকে ডাকতে যথেষ্ঠ সাহসের প্রয়োজন। আর হাঁটলে নাকি শরীর ভালো থাকে। রক্তের সুগার কমে।
বয়স হয়ে যাচ্ছে, এই সময় রক্তের সুগার কম থাকা দরকার।
‘ঐ মিয়া। চাইপা হাঁটেন। রিকশার নিচে পড়বেনতো মিয়া।’
বুড়ো রিকশাওয়ালার কথায় চমকে উঠে সরে গেলাম একটু। রিকশাটা পা ঘেঁষে সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যায়।
শরীরটা পুরোপুরি টেনে নেয়ার আগে সামান্য ঘষাও লাগে। তাতে রিকশার কিছুই যায়-আসে না।
রিকশাওয়ালাদের মাথাব্যথা থাকে অন্য কোন গাড়ীর বা রিকশার গা ঘেষে চলার সময়। তাদের দেখে মনে হয়
পরীক্ষার খাতায় কম্পাস দিয়ে অতিযত্নে সম্পাদ্য আঁকা কোন ছাত্র বোধহয়। সেটাই তাদের কাছে বড় ব্যাপার।
আমার মত মানুষের ব্যাপারে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। বুড়ো রিকশাওয়ালা এবং তার ছোকরাটাইপের প্যাসেঞ্জার
আমার দিকে বিরস দৃষ্টি মেখে যায়। প্যাডেলে দ্রুত পা ঘুরাতে ঘুরাতে হয়ত আরো কিছু বলে সে। পরিষ্কার শোনা যায় না ঠিক।
এরকম আনমনা হয়ে রাস্তায় হাঁটা কোন কাজের কথা না। নিজের উপর বিরক্তি লাগে খুব।
শরীফ ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম। আমার সাথেই চাকরি করত। নিরীহ-ভালোমানুষটাইপের মানুষ। মাসদুয়েক আগে হুট করে চাকরিটা চলে গেল।
দুই মেয়ে আর একমাত্র ছেলেটাকে নিয়ে ভীষন বিপদে পড়ে যায় বেচারা। প্রায় না খেয়ে থাকার যোগাড়। খুব দুরবস্থা হয়েছিল তখন।
সেসময় শরীফ ভাই কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। এর জন্যই শরীফ ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। যদি টাকাটা পাওয়া যায়। টাকাকটার বেশ দরকার।
রমজান মাস শেষের দিকে। ঈদে আমার একটা ছোট নীল জামা কেনা খুব জরুরী। ছোট-সুন্দর নীল একটা ফ্রক। বুকের কাছটায় পুতির কাজ করা।
আলো পড়লে চিকচিক করে ওঠে।
সামান্য একটা কেরানীর চাকরীতে কয় পয়সাই বা পাওয়া যায়। এই আগুনের বাজারে তা দিয়ে বেঁচে থাকা যায়, ভদ্রভাবে বাঁচা যায়না।
যেদিকে তাকানো যায়- শুধু খরচ আর খরচ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় অন্ধ হয়ে যাই। খুব কষ্ট হয় কখনো কখনো।
মাঝরাত্তিতে ঘুম ভাঙ্গলে মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে।
টাকাটা পাওয়া যায় নি। শরীফ ভাইয়ের স্ত্রী অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। লিভারের দোষ। অপারেশনও করাতে হবে বোধহয়।
অনেক টাকার ব্যাপার। সেখানে আমার টাকা কয়টার কথা বলতে বাধছিল। শরীফ ভাই নিজ থেকেই বললেন টাকার কথা।
‘সামনের মাসেই তোমার টাকাটা দিয়ে দিব হাবীব। দেশের বাড়ির জমিটুকু বিক্রির চেষ্টা করছি।’
শুনে আমার মন খারাপ হয়। শরীফ ভাইয়ের চোখদু’টির দিকে তাকানো যায় না। কালিপড়া চোখে কি ভয়ংকর মৃতদৃষ্টি।
কোন জীবিত মানুষের চোখের দৃষ্টি কি এমন হয়? চোখজুড়ে শুকনো অশ্রু লেপ্টে আছে। ঘরটাও কেমন জানি হাহাকার করছে।
ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের মুখগুলো অসম্ভব করুন।
আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে আসি। মাঝে মাঝে স্রষ্টা এমন অন্যায় করে কিভাবে কে জানে। অবিচারের ভেতর অবিচার।
পা টা জ্বলছে। আমি থামলাম। রিকশাটার সাথে লেগে পায়ের বেশ খানিকটা ছড়ে গেছে। একটা ফার্মেসী থেকে তুলা নিয়ে ছড়ে যাওয়া
জায়গাটুকুতে চেপে ধরি। তুলার গায়ে লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়। শরীরটা ক্লান্ত লাগে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
ভাবতেই মনের ভেতর একটা দুঃখ-হাসি উঁকি দেয়। জীবন খুব অদ্ভুত জিনিস। বাঁচতেও কষ্ট, মরতেও আক্ষেপ।
অলস দুপুরের চারিদিকে এক ঘোর লাগা বিভ্রম যেন। সবকিছু যেন ক্লান্ত- থেমে আছে। ক্লান্তির হাত থেকে রেহাই পায় নি বেশরম সূর্যটাও।
আরেকটু জিরিয়ে নেব কিনা ভাবতে ভাবতেই উঠে পড়লাম। গোড়ালীর দিকটা ব্যথা করছে অল্প অল্প। পাত্তা দিলাম না।
আরেকটু এগুলেই বাসায় পৌঁছে যাব।
আমার মনে একজোড়া শুকনো হাতের ছবি মনে ভেসে ওঠে। আর দু’টো মায়াঘেরা চোখ। আমার অভিনয়সঙ্গী। বেঁচে থাকার জন্য একটা ছোট
চাকরি করলেও আমি মূলত একজন অভিনেতা। আমাকে অভিনয় করে করে বাঁচতে হয়। আর আমার মায়া মায়া বৌটাও আমার সাথে পাল্লা দিয়ে
অভিনয় করে যায় সারাবেলা। আমরা নিজেদেরকে বোঝাই- এইতো আমরা বেশ আছি, আমরা বেঁচে আছি।
‘তুমি ঈদে একটা শার্ট নাও না। এই শার্টটা অনেক পুরনো হয়ে গেছে।’
‘আরো ক’টা দিন যাক নাহয়। বেশতো চলছে।’
নীরবতা। খোদা যেন দু’টি মানুষের কথা বলার ক্ষমতা হঠাৎ করে কেঁড়ে নেয়। আমার বুকটা টিপটিপ করে। শার্টের গলার কাছটায় ছোট একটা
ফুটোমত আছে। শাহানা সেটার কথা বলে যদি? খুব লজ্জা পেয়ে যাব।
‘আচ্ছা তোমাকে একটা শাড়ি কিনে দেই? একটা শাড়ী নাও।’
‘থাক। শুধুশুধুই টাকা নষ্ট করতে হবে না। গতবারের শাড়ীটতো প্রায় নতুনই আছে। দরকার হলে পরে কিনে নেওয়া যাবে।’ বৌটা হাসে। ফ্যাকাসে
হাসিটুকু ওই নরম গালে ঠিকভাবে ফোটে না।
***
সিঁড়ির গোঁড়ায় মনসুর সাহেবের সাথে দেখা হল। মাথায় বিশাল টাকপড়া এই লোকটাই আমাদের বাড়ীওয়ালা। তাকে দেখেই আমার মুখটা হাসি
হাসি হয়ে গেল। মধ্যবিত্তের কাছে বাড়ীওয়ালা হল দ্বিতীয় ঈশ্বর। সেই হিসেবে আমার দ্বিতীয় ঈশ্বরটা খুব একটা সুবিধার না।
দু’একদিন ভাড়া দিতে দেরী হলেই দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলেন। আমি মুখে একটা তেলতেলে হাসি ঝুলিয়ে গলাটা যথাসম্ভব কোমল করে সালাম দিলাম।
‘আফজাল সাহেব, এইবার কিন্তু ভাড়া নিয়ে কোন উল্টাপাল্টা করা চলবে না। ঈদের বাজার।’
আমি একজন দক্ষ অভিনয়শিল্পীর মত মুখটাতে আরেকটু তেলতেলে ভাব আনতে চাইলাম।
আর মনসুর সাহেব তার প্যাঁচার মত মুখটায় আরেকপোচ বিরক্তি মেখে নিচে নেমে যান। ‘ব্যাটা চামার।’
আমি মুখ থেকে তেলতেলে ভাবটা ঝেড়ে ফেলে উপরে উঠতে থাকি।
দরজা খুলতেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ছোট বাবুই পাখিটা। আমার এতক্ষনের তপ্ত বুকটা শান্ত হয়ে যায়।
এইমূহুর্তটাতে নিজেকে একজন সুখী মানুষ ভাবতে খুব ইচ্ছে করে আমার। একজন সত্যিকারের সুখী মানুষ।
লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া ছোট বুড়িটা আমার কোলে উঠে
আসে।
‘এতদেরী করলে কেন বাবা?’ আধো আধো কথাগুলো শুনতে আমার ভীষন মায়া লাগে।
‘রাস্তায় অনেক জ্যাম যে বাবা। তাই দেরী হয়ে গেল।’ আমি অহনাকে নিয়ে বসতে বসতে জবাব দেই।
‘মা বলেছে তুমি নাকি আমার জন্য ঈদের ড্রেস কিনতে ঘুরছ।’ অহনা থামে। ‘আমারতো জামা আছেই।
মা বলেছে আমার হলুদ জামাটা ধুয়ে দিবে। তারপর সেটাও নতুন জামা হয়ে যাবে। তাই না বাবা?’
আমি জবাব দিলাম না। বুকের ভেতরটা চিন চিন করে ওঠে। বুকের ভেতর নাম না জানা একটা সুর বেজে যায়, একঘেয়ে।
সেই সুরটা বুক বেয়ে চোখের কাছটায় এসে আলতো করে টোকা দেয়।
‘বাবা তোমার চোখে পানি কেন? তোমার চোখে কি পোকা পড়েছে বাবা?”
নিজেকে আমি বেশ ভালো অভিনেতা ভাবতাম। জীবনের প্রতিটি বাঁকে আমাকে অভিনয় করতে হয়। সুখী থাকার অভিনয়, বেঁচে থাকার অভিনয়।
বৌটার সাথে অভিনয়, অফিসের বসের সাথে অভিনয়, বাড়ীওয়ালার সাথে অভিনয়, বাসের কন্ডাক্টর বা বাজারের তরকারিওয়ালাটার সাথে অভিনয়।
শুধু মেয়েটার সামনে আমি ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারি না। আমি ধরা পড়ে যাই।
আমি লোকটা একজন ব্যার্থ মানুষ। একজন ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ বাবা। তবু এই সময়টাতে আমার একজন ভালো অভিনেতা না হওয়ার ব্যর্থতাটা
বাকীসব ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে যায়। আমার বুড়ো বুকটা হু হু করে ওঠে। বেঁচে থাকায় এত কষ্ট কেন?
ছোট একটা পুতুলকে বুকে জড়িয়ে রাখে একজন ব্যর্থ অভিনেতা