রাত ২.৩০ মিনিট গভীর ঘুমে ফারহা,এত রাতে ফারহা জেগে থাকবে প্রশ্নই আসেনা। খাওয়া দাওয়া,ঘুম, পড়াশোনা সব ব্যপারেই ফারহা নিয়ম মেনে চলে। পড়া শেষ করে রাত ১১ টার মধ্যে খেয়েই ঘুমিয়ে যায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হঠাৎ করেই ফারহার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো,কয়েকবার রিং হওয়ার পর ঘুম ঘুম চোখেই মোবাইল হাতে নিয়ে কল কেটে দিলো। কেটে দেওয়ার পর আবার রিং বেজে উঠলো, ফারহা আবার কল কেটে দিলো,কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। ফারহা কল কাটছে আর ওপাশ থেকে কল করেই যাচ্ছে মাহিম। অবশেষে ফারহা অসহ্য হয়ে কল রিসিভ করেই বলল ঃ বার বার কল দিচ্ছিস কেন? কেটে দিচ্ছি দেখতে পাচ্ছিস না?
_আরে জরুরি কথা আছে তাইতো বার বার কল দিচ্ছি,না হয় আমি পাগল নাকি এত রাতে বারবার তোকে কল দিবো (মাহিম)
_কথা শুনে ফারহা বিরবির করে বলল ঃ তুই সুস্থ ছিলি কবে?
_কিছু বললি (মাহিম)
_আরে না,কি জানি জরুরি কথা বলবি? (ফারহা)
_ওও হ্যা, তুই সকাল ১০ টার দিকে আমার সাথে রেস্টুরেন্ট দেখা করবি,আমি ঠিকানা মেসেজ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। (মাহিম)
_রেস্টুরেন্ট? কিন্তু কেন? (ফারহা)
_ফারহার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই মাহিম বলল ঃ এই এত্ত রাতে তোর ঘুম ভাঙ্গালাম। তোর নিশ্চয় ঘুম পাচ্ছে, ঘুমিয়ে পর বাই।
_বাই বলেই ফারহাকে আর কিছু বলতে দিলোনা,কল কেটে দিলো মাহিম।
_কি অদ্ভুত! প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কল কেটে দিলো। যাক, তবুও ফোনটা রেখেছে। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে এখন আমি ঘুমাই। ( ফারহা)
_ফারহা ১০টার দিকে রেস্টুরেন্ট গেলো,গিয়েই ফারহা অবাক! এত্ত এত্ত গিফটস আর কেক নিয়ে মাহিম বসে আছে। ফারহা’কে দেখেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। মাহিম ভেবেছিল এমন সারপ্রাইজ পেয়ে ফারহা খুব খুশি হবে কিন্তু হলো তার উলটা। ফারহা দেখেই রেগে গেলো।
_মানেহ কি? কার জন্মদিন আজ? (ফারহা)
_কার আবার,তোর? (মাহিম)
_আমার মানেহ? বছরে আমার কয়বার জন্মদিন আসে হ্যা? দুইদিন পর পরই তুই এইসব উদ্ভট কান্ড করিস,তোকে আমি কতবার বলবো আমার জন্মদিন ১২ ফেব্রুয়ারি। এই সাধারণ তারিখ টুকু তোর মনে থাকে না?
_মাহিম চুপ করে মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনলো তারপর বলল ঃ সরি দোস্ত, তুই তো জানিসই আমার কিচ্ছু মনে থাকেনা। তবুও তোর জন্ম তারিখ মনে রাখার খুব ট্রাই করি। ভুলে গেলে কি করবো বল?
_আচ্ছা ঠিক আছে, চল আমার সাথে? (ফারহা)
_কোথায়?
_তোকে একটা ডায়েরি কিনে দিবো। যেসব জিনিস গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো তুই লিখে রাখবি ডায়েরিতে,তাহলে ভুলে গেলেও ডায়েরি খুলে দেখে নিতে পারবি।
_হুম ঠিক বলেছিস কিন্তু কেক টা?(মাহিম)
_জন্মদিন না তাতে কি তবুও চল কেক কাটি।(ফারহা)
_দুজনের বন্ধুত্বটা এমনই, রাগ অভিমান দুই মিনিটও থাকেনা।
আর মাহিম বরাবরই এমন। সব কিছুতেই গোলমাল করে ফেলে। কিছুই ঠিক মত মনে রাখতে পারেনা। আর এইজন্যই মাহিম ছিল ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র। শত পড়লেও কিছুক্ষণ পর সব ভুলে যেতো। পড়াশোনা করার একদমই ইচ্ছা নেই,তবুও ফারহার জন্য ছাড়তে পারছেনা। ফারহা খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। কিন্তু তবুও খারাপ – ভালো ওদের বন্ধুত্বের মাঝে কখনো সমস্যার কারণ হতোনা। ক্লাস করা,ক্লাস থেকে বের হয়ে একসাথে ঘুরাঘুরি। এককথায় একজনের আরেকজনকে ছাড়া চলেই না। এইভাবেই চলতে থাকে ওদের দিন।
_রোহান বেশ সুদর্শন একটা ছেলে। ফারহার চেয়ে ২ বছরের সিনিয়র। হঠাৎ একদিন রোহান এসে ফারহার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়। ফারহা কোন উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে মাহিম বলে উঠে ফারহা আপনার সাথে কেন বন্ধুত্ব করবে?
_বন্ধুত্ব মানুষ কেন করে? (রোহান)
_মাহিম উত্তর দিলেও উলটাপালটা কিছু একটা বলবে এটা শিওর ছিল ফারহা। মাহিমের কথার কোন স্টেশন নেই, কখন কি বলে নিজেও জানেনা। ক্লাসে দুই বছরের সিনিয়র,উল্টাপাল্টা কিছু বললে বা বন্ধুত্ব না করতে চাইলে সমস্যা হতে পারে এটা ভেবে ফারহা বলল ঃ ঠিক আছে বন্ধুত্ব করবো। ফারহার কথাটা মাহিমের একদমই পছন্দ হয়নি, ফারহাকে কিছু বলতে যায় আর ফারহা চুপ করিয়ে দিয়ে বলে চল এখান থেকে।
_তুই ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ব করলি কেন?(মাহিম)
_সিনিয়র তো, বন্ধুত্ব করতে রাজি না হলে পরে যদি সমস্যা করতো। (ফারহা)
_সিনিয়র না যায় হোক ছেলেটা ভালোনা।
কথাটা বলেই মাহিম বলল ঃ তুই থাক আমি গেলাম। মাহিমের একবারেই রোহানের সাথে ফারহা বন্ধুত্ব করাতে হ্যা বলাটা পছন্দ হয়নি। তাই অনেকটা রেগেই চলে যাচ্ছে। ফারহা পিছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও সারা দিলোনা।
_তারপর থেকে প্রতিদিনই রোহান ফারহার সাথে ইচ্ছা করেই কথা বলতে আসতো। ফারহাও কথা বলতো,মাহিমের ব্যপারটা পছন্দ না হলেও কিচ্ছু করার নাই। ফারহাকে যখনই মাহিম নিষেধ করে ফারহা একটা বাহানা বানিয়ে দেখিয়ে দেয়। মাহিম মনে মনে বলে রোহানের সাথে তোর কথা বলতে ভালো লাগে এটা বলিস না কেন? কিন্তু কি করার জোরে বলতে পারেনা। নিশ্চিত ফারহাকে বললে বিশাল একটা কান্ড করবে। তখন সব দোষ মাহিমকেই দিয়ে দিবে।
_একটা সময় ফারহা রোহানের সাথে অনেক বেশিই কথা বলতো। মাহিমের পাশে থাকলেও রোহানকে দেখলে রোহানের সাথে গিয়ে কথা বলতো। একপ্রকার মাহিমকে ইগনোর করতে শুরু করে। মাহিম কিছু জিজ্ঞাস করলে খুব বিরক্তির ভঙ্গিতে উত্তর দিতো। কল করলে নাম্বার বিজি পেতো। যেই মেয়ে রাত ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতো রাত ১/২ টায় কল করলেও তার নাম্বার বিজি আসতো। মাহিম কখনো যদি রোহানের ব্যপারে ফারহাকে কিছু বলতো তাহলে রেগে যেতো। সেজন্য মাহিম ফারহা কে কিছুই জিজ্ঞেস করতো না। না রোহানের ব্যপারে না অন্য কোন ব্যপারে। মাহিম ক্লাস থেকে বের হয়েই দেখতো ফারহা রোহানের সাথে কথা বলছে। দূর থেকে দেখেই চলে যেতো। কাছে গিয়ে কিছু বলতে চাইলেই ফারহার বিরক্তি ভরা মুখ দেখতে হবে তাই।
_এইভাবে প্রায় তিন মাস চলে যায়। আর মাহিমের কাছে ফারহার এইভাবে অবহেলাটা খুব কষ্টের হয়ে উঠে। যার কথাতে এখনো ভার্সিটিতে আসে,না হয় কবে এই বিরক্তিকর পড়াশোনা ছেড়ে দিতো। সেই ফারহাই অর সাথে কথা বলে না। তাহলে আর ভার্সিটিতে এসেই বা কি করবে! তাই মাহিম সিন্ধান্ত নিলো আর পড়াশোনা, ভার্সিটিতে যাওয়া আসার ঝামেলা করবেনা। তার চেয়ে গ্রামে ফিরে যাবে বাবা-মায়ের কাছে। যেই ভাবনা সেই কাজ। পরেরদিনই গ্রামে চলে গেলো,যাওয়ার আগে ফারহাকে একটা চিঠি দিয়ে গেলো।
_ফারহার মাহিমের চিঠি টা দেখারও সময় হলোনা। বাসায় এসে ড্রয়ারে রেখে দিলো। মাহিম ভার্সিটিতে আসেনা। বিষয়টা ফারহা খেয়ালও করেনা। ততদিন ফারহা রোহানের সাথে রিলেশনশিপে চলে গেছে। ওদের সম্পর্ক খুব ভালোই চলছিল। হঠাৎ ফারহার কাছে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। অপর পাশ থেকে একটা মেয়ে ফারহাকে রোহানের ব্যপারে অনেক কিছুই বলেন।
এটাও বলে রোহান অনেক মেয়েদের সাথেই নাকি রিলেশন করে। ফারহার কথাটা বিশ্বাস হয়না। আর অপরিচিত কারো কথা বিশ্বাসই বা করবে কেন? তারপরেও কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনা। বারবারই ভাবছিল আসলেই কি রোহান খারাপ ছেলে? তখন হুট করেই মাহিমের বলা একটা কথা মনে পরে। প্রথমদিন যখন রোহানের সাথে দেখা হয়, সেদিন মাহিমও বলেছিল ছেলেটা ভালোনা। তার মানে কি রোহান আসলেই খারাপ? আসলেই অনেক মেয়ের সাথে রিলেশন করে? কি করে জানবে? _আর মাহিম! মাহিমই বা কোথায়? কাছে থাকলে হয়তো মাহিমকে জিজ্ঞাস করতে পারতো। কিছুই বুঝতে পারেনা ফারহা। তাই পরেরদিন লুকিয়ে লুকিয়ে রোহানের পিছু নেয়। তার পর দেখে রোহান রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করে। হাত ধরে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। ফারহা সেখানে গিয়েই রোহানকে জিজ্ঞাস করে ঃ কে এই মেয়েটা রোহান?
_ফারহা তুমি এখানে কি করছো? (রোহান)
_আমি এখানে কি করছি সেটা পরের ব্যপার। আগে বলো এই মেয়েটা কে?
_আমার গার্লফ্রেন্ড। (রোহান)
_আর আমি?
_তুমিও গার্লফ্রেন্ড।
_মানেহ? (ফারহা)
_একসাথে ৩/৪ টা গার্লফ্রেন্ড রাখা আমার স্টাইল।
_কথাটা শুনে ফারহার মাথায় রক্ত উঠে যায়। এইসব কি বলছে রোহান। কত্ত বাজে একটা ছেলে। একসাথে কিনা ৩/৪ রিলেশন করে। আর আমি না বুঝে,অর ব্যপারে না জেনে অর সাথেই রিলেশনে ছিঃ ছিঃ ( মনে মনে)
_ফারহা আর রোহান কে কিছুই বলেনা। এইরকম ছেলের সাথে কথা বলতেও অর ঘৃণা হচ্ছিল। তাই ওখান থেকে চলে আসে। সারারাত খুব কান্না করে। বারবার মাহিমের কথা মনে হচ্ছিল। মাহিম কখনো অর চোখে অশ্রু আসতে দিতো না। কত্ত পাগলামি করতো ভুলে গিয়ে। কত্তদিন মাহিমের সেই পাগলামি গুলো দেখেনা। কিন্তু মাহিম কোথায়? কত্তদিন অর সাথে দেখা হয়না? আচ্ছা তবে কি মাহিম ভার্সিটিতে আসেনা? ভার্সিটিতে আসলে তো কোন না কোনভাবে দেখা হতো। তখন ফারহার হঠাৎ মাহিমের দেওয়া সেই চিঠিটার কথা মনে পরে। কিন্তু চিঠিটা রেখেছে কোথায়? অনেক জায়গায় খোজার পর আলমারির ড্রয়ারে পেলো। খুলে দেখে তাতে লিখা _
__দোস্ত আমি চলে যাচ্ছি, তুই ভালো থাকিস। তোকে কারণে – অকারণে অনেক কষ্ট দিয়েছি মাফ করে দিস। তোর জীবনে আমার প্রয়োজন শেষ এটা বোঝা হয়ে গেছে। আমি তোর চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছি। ভালো থাকিস খুব বেশী ভালো।
_চিঠিটা পড়ার পর ফারহার মাথায় হাজার টা ভাবনা আসছে। কয়েকবার মাহিমের নাম্বারে কল দেয় কিন্তু ফোন অফ। কোথায় গেলো মাহিম? ফোনটাও অফ করে রেখেছে? রাত প্রায় ২টা বাজে। বারবার তাড়াতাড়ি সকাল হওয়ার দোয়া করছিল আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল ফারহা। সকাল হতেই মাহিম যেখানে থাকতো সেখানে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ফারহা জানতে পারে মাহিম গ্রামে গেছে। কোন কিছু না ভেবেই ফারহা মাহিমের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে গ্রামে গিয়ে যেন খুব সহজেই পেয়ে যায় মাহিমকে।
_গ্রামে চলে আসে। তেমন একটা কষ্ট করতে হলো না ফারহাকে। অনেক সহজেই মাহিমের বাড়ি পেয়ে গেলো। দুই-একজনকে জিজ্ঞাস করার পরেই বাড়ি দেখিয়ে দিলো। বাড়ি ঢুকেই ফারহা মাহিমকে খুজছিল। উঠানে অনেকে কাজ করছে। কয়েকজন মহিলা মিলে আবার গল্প করছে। কাকে জিজ্ঞাস করবে বুঝতে পারছিল না। তখন পিছন থেকে একজন মধ্যবয়সী মহিলা জিজ্ঞাস করলো ঃ এই মেয়ে কে তুমি? কাকে চাও?
_ফারহা ভয় ভয় স্বরে বলল ঃ আন্টি আমি ফারহা। মাহিম আর কিছু বলার আগেই মহিলাটা বলল ঃ ওও আচ্ছা মাহিম কে খুজো, ও তো বাড়ির পিছনের বাগানে কাজ করছে।
_আমাকে একটু দেখিয়ে দিবেন বাগান টা (ফারহা)
_আচ্ছা আসো,কিন্তু তুমি মাহিমের কি হও?
_আন্টি মাহিমের ক্লাসমেট। এরপর ফারহা কি ভাবলো কে জানে হুট করেই বলল ঃ আপনি মাহিমের পরিচিত?
_প্রশ্নটা শুনে মহিলাটা কোন জবাব না দিয়ে হেসেই যাচ্ছে। ফারহার কিছুটা রাগ হলো,কি এমন প্রশ্ন করেছে এর জন্য এত্ত হাসা লাগে? কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। তারপর বাগানের সামনে এসে মাহিমকে ডাকতেই মাহিম উত্তর দিলো ঃ কি হয়েছে মা বলো।
_ফারহা হা করে তাকিয়ে রইলো। তার মানে মাহিমের মা। ইসস ভাগ্যিস আর কিছু বলেনি। তখন মাহিমের মা ফারহাকে বললো যাও গিয়ে কথা বলো। ফারহা এতক্ষনে মাহিমের দিকে খেয়াল করলো। মাহিমের অবস্থা দেখে পুরাই অবাক!। শহরে যে ছেলে কত্ত স্মার্ট ভাবে চলতো সে কিনা এখানে লুঙ্গি আর মাথায় গামছা বেধে কাজ করছে। মাহিমের অবস্থা দেখে বেশ অনেক্ষন হাসলো তারপর হাতে থাকা ফোন দিয়ে কয়েকটা ছবিও উঠালো। কিন্তু কি ব্যপার মাহিম ফারহাকে এতক্ষনেও দেখলো না। ফারহা তাই মাহিমের সামনে গিয়ে ডাক দিলো ঃ এই মাহিম! তুই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছিস তাই না?
_মাহিম অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ঃ দেখেছি তো অনেকক্ষন মায়ের সাথে এসেছেন কিন্তু কে আপনি?
_কে আমি মানে,তুই আমাকে চিনিস না? (ফারহা)
_আরে বাবাহ! তুই তুকারি করছেন কেন? (মাহিম)
_তুই তুকারি করছি মানে,তুই তো আমাকে না চেনার ভান করছিস? দেখ ভাল্লাগেনা অনেক দূর থেকে এসেছি। (ফারহা)
_তো আমি কি করবো। আপনি দূর থেকে এসেছেন নাকি সামনে থেকে এসেছেন সেটা আপনার ব্যপার। যান তো কাজ করছি ডিস্টার্ব করবেন না। (মাহিম)
_ফারহার কাছে মাহিমের কথা গুলো কোন ভাবেই অভিনয় মনে হচ্ছে না। তাহলে কি মাহিম ফারহাকে ভুলে গেলো? তখন মাহিমের মা পিছন থেকে বলল ঃ কিরে মাহিম! তোর ক্লাসমেট এত দূর থেকে তোর সাথে দেখা করতে এলো। আর তুই পিছন ফিরে কাজ করছিস?
_মা প্লিজ। কিসের ক্লাসমেট আমি তো এই মেয়েকে চিনতেই পারছিনা। আর মেয়েটাও বেহায়ার মত আমাকে তুই তুকারি করে বলছে। (মাহিম)
_মাহিমের কথা শুনে ফারহা যেমন অবাক তেমন মাহিমের মাও অবাক। মাহিমের মা ভাবছে এতদিন জানতাম আমার ছেলের ভুলে যাওয়ার রোগ আছে তাই বলে মানুষকেও ভুলে যায়? কপালে হাত দিয়ে ফারহার দিকে তাকিয়ে বলল ঃ কিছু মনে করোনা মা, আমার ছেলের ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। সব কিছুই ভুলে যায় হয়তো তোমাকেও ভুলে গেছে।
_কথাটা শুনে ফারহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। কোন কিছু বলার আগেই মাহিমের মা বললেন চলো মা ঘরে চলো। অনেক দূর থেকে এসেছো। হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিবে।
_ফারহা ঘরে গেলো। দুপুরের খাবারও খেলো। কিন্তু মাহিম অর সাথে একটাও কথা বলল না। উলটা যখন ফারহা কথা বলতে যায় তখন চারটা কথা শুনিয়ে দেয়।
_ফারহা ঘর থেকে বাহিরে এসে দেখে উঠানের একপাশে বসার জন্য সুন্দর করে জায়গা বানানো। চার পাশে ফুল গাছ লাগানো। ফারহা সেখানে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে আগে মাহিমকে কত্ত কথা শুনাতাম। কোন কাজ করতে গিয়ে যদি ভুল টা আমায় দিয়েই হতো বেচারার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতাম। আর মাহিম হয়তো ভুলে গেছি,ভুল করে করে ফেলেছি এটা ভেবে সব দোষ নিজের ঘাড়েই নিয়ে নিতো। আর এখন আমাকেই কত্ত কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। ও কি সত্যিই ভুলে গেলো আমাকে। মানুষকেও ভুলে যায় এটা তো জানা ছিল না।
_ফারহার পাশে এসে মাহিমের মা বসে জিজ্ঞাস করলেন ঃ কি ভাবছো?
_কিছুনা আন্টি (ফারহা)
_মাহিম তোমাকে চিনতে পারছেনা এটা নিয়েই ভাবছো তো।
_হুম আন্টি। মাহিম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। ও যে আমাকে চিনতে পারছে না এটা বিশ্বাসই হচ্ছেনা। আর মাহিম যে অভিনয় করছে এটাও মনে হচ্ছে না। আচ্ছা আন্টি মাহিম কি অনেককেই ভুলে যায়?
_না মা এমনটা তো এর আগে কখনো হয়নি। তোমাকে চিনতে পারছেনা দেখে তো আমিও অবাক হচ্ছি। (মাহিমের মা)
_কি জানি! আমাকে কেন ভুলে গেলো। মাহিম যখন আমাকে চিনতেই পারছেনা তাহলে এখানে থেকে আর কি করবো? কালকেই চলে যাবো। (ফারহা)
_মাহিমের মা কিছুই বললেন না। খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে তার ছেলের এইরকম আচরণে। রাতের খাবার শেষে ফারহাকে তার সাথেই ঘুমাতে বললেন। ফারহা শুয়ে পড়ার পর উঠে মাহিমের রুমে গিয়ে দেখেন মাহিম চোখ বুজে আছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতেই উঠে গেলো।
_মা তুমি? (মাহিম)
_একটা সত্যি কথা বলবি?
_কি কথা মা?
_তুই কি সত্যিই ফারহাকে চিনতে পারছিস না? নাকি না চেনার ভান করছিস?
_প্রশ্নটা শুনে মাহিম খুব রেগে গেলো। কন্ঠের স্বর উচু করে রাগান্বিত হয়ে বলল ঃ কতবার বলবো চিনিনা চিনিনা চিনিনা। বারবার কেন বিরক্ত করছো? ভাল্লাগে না।
_পাশের রুম থেকে ফারহা সবটাই শুনলো। ফারহা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো তার মানে মাহিম আমায় সত্যিই ভুলে গেছে। ভেবেই ফারহার খুব কান্না পাচ্ছে। চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না। কাদতে কাদতে নিজেকে নিজেই বলল ঃ কি দরকার ছিল রোহানের মত একটা বাজে ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করার। সেদিন যদি বন্ধুত্ব না করে মাহিম কে বলতে দিতাম। তাহলে হয়তো আজকে এমনটা হতোনা। মাহিম আমায় ভুলে যেতো না। ভাবতে ভাবতে এক সময় গভীর ঘুম এসে ফারহার চোখে ভর করলো।
ঘুম যখন ভাঙলো ফারহার তখনো সকাল হয়নি। ঘড়ির কাটা ৪টা ছুই ছুই করছে। সময় দেখেই মনে হলো একটু পরেই সকাল হবে। আর সকাল হলেই চলে যাবো। কিছু একটা মনে করে বিছানা থেকে উঠে মাহিমের রুমে গেলো। গিয়ে দেখে বালিশ একদিকে,মাহিমের মাথা আরেকদিকে, কাথা আরেকদিকে, বিছানার চাদরও বিছানায় নাই। মাহিমের এই অবস্থা দেখে ভিষণ হাসি পেলো ফারহার। এইজন্যই মেসের ভাইরা ওকে এত্ত বকতো আর মাহিম রোজ ফারহাকে এসে বলতো মেসের বড় ভাই গুলো একটুও ভালোনা। যখন রুম থেকে বের হয়ে আসবে তখন হঠাৎ টেবিলের উপরে রাখা ডায়েরিটা চোখে পরলো।
_ফারহা ঃ এটা তো সেই ডায়েরি টা যেটা আমি মাহিম কে কিনে দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলো লিখে রাখতে।(মনে মনে)
_ফারহা তখন ভাবলো একটু পড়ে দেখি কি কি লিখে রেখেছে। ডায়েরি খুলতেই দেখে প্রথম পৃষ্টায় লেখা ফারহার জন্মদিন ১২ ফেব্রুয়ারি।
তারপরের পৃষ্টায় লেখা ফারহাকে প্রথম দেখা ২৪ আগস্ট ২০০। তারপরের পৃষ্টায় লেখায় ফারহার সাথে প্রথম কথা ২৬ আগস্ট ২০০। তারপরের পৃষ্টায় লেখা ফারহার সাথে বন্ধুত্ব ১২ সেপ্টেম্বর ২০০। এইভাবে পুড়া ডায়েরি ভরেই ফারহার কথাই লেখা। পড়তে পড়তে এক পৃষ্টায় চোখ আটকালো ফারহার সেখানে লেখা ফারহাকে ছেড়ে আসা ২ জুলাই ২০০। এরপরের পৃষ্টা থেকে সব ফাকা আর কিছু লেখা নেই।
_ফারহা ঃ ফারহা তোর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তুই কিনা ফারহাকেই চিনতে পারছিস না। আচ্ছা ডায়েরিতে যে লিখে রেখেছিস। এই লেখাগুলো পড়লেও কি মনে হয় না এই ফারহা টা কে? (মনে মনে)
_ডায়েরির সাদা পৃষ্টাগুলোই ফারহা উল্টাছে। হঠাৎ দেখে মাঝে কিছু একটা লেখা। পড়ে দেখে সেখানে লেখা ঃ কিছু মনে করিস না দোস্ত। তোকে না চেনার অভিনয় টা করে আমি বেশ আনন্দ পাচ্ছি। আর আমার ভুলে যাওয়ার রোগ টা খুব ভালোভাবেই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। তোর মুখে… আহা! কি বিষন্নতা…
_লেখাটা দেখেই ফারহার মাথায় রক্ত উঠে যায়। তার মানে মাহিম কাল থেকে আমাকে না চেনার ভান করছে। মাহিমকে যে ফারহার কি করতে ইচ্ছা করছে তখন বাহিরে গিয়ে বালতি ভরে পানি এনে মাহিমের মাথায় ঢেলে দেয়। আর তখনই মাহিম চিৎকার দিয়ে উঠে বলেঃ এই করছিস টা কি? ভিজিয়ে দিলি কেন আমায়?
_এই আপনি আমাকে তুই তুকারি করছেন কেন? (ফারহা)
_আরেহ! আসলেও তো তাই, বলেই মাহিম হাসতে শুরু করে আর বলে আসলে একটু প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম। (মাহিম)
_কিসের? (ফারহা)
_তুই আমাকে এত্ত কষ্ট দিলি তার। (মাহিম)
_ফারহা কথাটা শুনে মাথা নিচু করে বলল ঃ মাফ করে দে। খুব বুঝতে পারছি তোকে ছেড়ে থাকাটা ইম্পসিবল।
_আমারও তাই (মাহিম)
_তাহলে আমার সাথে তুইও ঢাকায় চল? (ফারহা)
_কি? মাথা খারাপ নাকি আমি আর ঢাকায় যাচ্ছিনা। আর তোকেও যেতে দিচ্ছি না। অই ঢাকাতে আরো দুই একটা রোহান থাকতে পারে।
_ফারহা মাহিমের কথাটা শুনে ভিষণ রেগে যায়,যেন চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। মাহিম কে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই মাহিমের মা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ঃ আমার বাড়িতে ফ্রিতে থাকা যাবেনা। অপশনে হিসেবে একটা অপশনই আছে আমার রামছাগল পোলাডারে বিয়ে করতে হবে?
_ফারহা কথাটা শুনে খুব লজ্জা পেলো। কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ততক্ষনে বাহিরে হালকা আলো হয়েছে। ফারহার পিছন পিছন মাহিমও ঘর থেকে বের হয়ে হাটতে লাগলো।
_অই পিছন পিছন হাটছিস কেন? (ফারহা)
_তাহলে কি করবো? (মাহিম)
_পাশাপাশি হাটবি এই দিকে আয়?
_মাহিম ফারহার পাশে গিয়ে দাড়ালো।
ভোরের আলোতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে দুজন হাটতে লাগলো। হঠাৎ মাহিম খেয়াল করলো ফারহা অর হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। ফারহা এর আগেও মাহিমের হাত অনেক ধরেছে। কিন্তু এর আগে কখনো এমন অনুভুতি হয়নি আজকের অনুভুতিটা অন্যরকম।