আজকেও না বলে কয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ঢুকলো রিফাত । সে জানে যে আজকে মৌরি’র শরীরটা বেশ খারাপ, অফিসের যেতে পারেনি তবুও ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে রিফাত । সকাল বেলায় অফিস যাওয়ার মুখে ছোট্ট একটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো দুজনের আর তখনই রিফাত মনে মনে ঠিক করেছিলো, দাঁড়াও বিকেলে ফিরে তোমায় দেখাচ্ছি মজা । ঘরে ঢুকেই সবসময়ের মতো হৈচৈ করে মৌরিকে ডাকলো রিফাত – কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি এসো, দেখে যাও কারা এসেছে ।
মাথাব্যাথার ওষুধ খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো মৌরি । মাত্রই চোখটা লেগেছিলো আর ঠিক তখনই পায়ের অঙ্গুল ধরে রিহান নাড়া দিলো – মা, মা শুনছো, ওঠো মা । বাবা বাসায় এসেছে, সাথে আংকেলরাও আছে । বাবা তোমাকে ডাকছে তো । মৌরি’র মনে হলো খুব দুর থেকে যেন আওয়াজটা ভেসে আসছে । খুব কষ্টে চোখ মেলে ছেলেকে দেখে একটা হাসি দিলো সে – বাবা তুমি হোমওয়ার্ক করতে পেরেছো ? এতো অসুস্থতার মাঝেও ছেলের হোমওয়ার্কের টেনশন মাথা থেকে যায়নি মৌরি’র । মাত্র পাঁচ বছর বয়স রিহানের । মৌরি পাশে বসে একটু দেখিয়ে দিলেই সুন্দর সব লেখাপড়া করে নেয় বাচ্চাটা । রিহান ছুটে এলো মা’র কাছে – আমি ঠিক ঠিক সব কিছু লিখে নিয়েছি মা । লক্ষী সোনা আমার, বলেই ছেলেকে আদর করে দেয় মৌরি । বাবা ডাকছে মা, আংকেলও এসেছে।
মুখটা যেন তেতো হয়ে যায় মৌরি’র , জ্বরের ঘোরে যেমনটা লাগে ঠিক তেমনি । রিফাতের বন্ধুবান্ধব সবসময় চলে আসে তাদের বাসায় । কোনো কোনো সময় পরিবারসহ তো কখনো ব্যাচেলর পার্টির মতো আড্ডা চলে তার এখান । মৌরি’র কাজ হলো ফরমায়েশ অনুযায়ী খাবার তৈরি করা আর ডাক পড়লে সামনে যেয়ে হাসিমুখে দু’চারটে কথা বলা । মৌরি’র অবশ্য এরকম আড্ডা দিতে কখনোই ভালো লাগে না তাই রিফাত ওকে তেমন একটা ডাকেও না । সারাদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে একটু নিজের মতো থাকতে ভালো লাগে তার । সেই সময়টুকু সে রিহানের সাথে দারুণ উপভোগ করে । অবশ্য রাঁধতে আর আপ্যায়ন করতে তার খুব ভালো লাগে । তবে আজ তার ভালো লাগলো না বরং বিরক্তই লাগলো একটু ।
এলো চুলগুলোকে হাত খোঁপায় সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মৌরি । মাথাটা একটু ঘুরলো যেন, শরীরটা সত্যিই ভীষণ দুর্বল লাগছে । শরীরকে পাত্তা না দিয়ে ডাইনিংয়ে চলে এলো মৌরি । ফ্রিজ খুলে দেখলো, কাস্টার্ড আর টিকিয়া কাবাব রাখা আছে । নতুন করে কিছু আর করার দরকার নেই । দুধের হাঁড়িটা বের করে চুলোয় বসিয়ে গ্যাস জ্বালিয়ে দিলো মৌরি । ঝটপট সব রেডি করে দুধে লাচ্ছা সেমাই ঢেলে মোটামুটি ভদ্রগোছের নাস্তা তৈরি করে ফেললো সে । খাবারগুলো সাজিয়ে রেখে ওয়াসরুমে যেয়ে হাতমুখ ধুয়ে মাথায় একটু ঠান্ডা পানি ছোঁয়ালো । মাথার ভেতরটা একেবারে দপদপ করে লাফাচ্ছিলো । পানির ছোঁয়ায় একটু আরাম লাগলো যেন । চুলটা আঁচড়ে নিয়ে লিভিং রুমে এসে দেখলো বন্ধুদের নিয়ে এরমধ্যেই জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে রিফাত । সজলের হাতে সিগারেট ।
এই জিনিসটা খুব অপছন্দ মৌরি’র । কতোবার সে রিফাতকে না করেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘরের ভেতর সিগারেট জ্বালানো চলবে না তবুও কোনো কাজ হয়নি । সজল বোধহয় তাদের বিরক্ত করার জন্যই ইচ্ছে করে কাজটা করে । মৌরি অনেকবার রিফাতকে নিষেধ করেছে সজলকে ঘরে ঢোকাতে । এই মানুষটাকে কেন জানি প্রথম থেকেই ওর একদম ভালো লাগে না । ব্যক্তিত্বহীন হ্যাংলো টাইপ সজল যতোবারই বাসায় এসেছে, ততবারই রিফাতের সাথে মৌরি’র কথা কাটাকাটি হয়েছে । রিফাত সজলকে ছাড়তে পারেনি, ছোটবেলার বন্ধুকে নাকি সে ছাড়তে পারবে না । মৌরিকে দেখে সজল হেসে উঠলো – আরে ভাবি আপনি নাকি অসুস্থ? আমরা তো আজকে আসতেই চাচ্ছিলাম না, রিফাত জোর করে নিয়ে আসলো । কী করবো লোভ সামলাতে পারলাম না । আপনার হাতের রান্না খাওয়ার লোভ সামলানো যায়, বলেন?
মৌরি হাসলো শুধু, কোনো কথা বললো না । দিপন বলে উঠলো – ভাবি আপনি যান তো, কিচ্ছু করতে হবে না । খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো টেনশন করবেন না । আরে এমন কিছু না । ঐটুকু শরীর খারাপ কোনো ব্যাপার নাকি ? এই যাও তো ঝটপট তোমার স্পেশাল স্পাইসি পাস্তাটা বানিয়ে ফেলো । সজল ওটা খাওয়ার জন্যই এসেছে । অন্য সময় হলে মৌরি হয়ত বানিয়ে খাওয়াতো কিন্তু আজ আর আতিথেয়তার ধার ধারলো না ও – ওটা করতে তো প্রিপারেশন লাগে । এখন হবে না । কোনো কিছু নেই বাসায় । আমি নাস্তা রেডি করে রেখেছি, তুমি ওগুলো নিয়ে এসো । দিপন বললো – আরে না না, আপনি যান তো । এই সজল, রিফাত কী শুরু করলি তোরা ? কী লাগবে বলো? এখনই আনিয়ে দিচ্ছি, রিফাত বললো ।
দৃঢ় গলায় বললো মৌরি – আজ সত্যিই পাস্তা করতে পারবো না, সরি সজল ভাই । রিফাত অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মৌরি’র দিকে । মৌরি এভাবে মুখের ওপর না করে দিলো ! বন্ধুদের সামনে অপমানটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার । সজল হুট করে বলে ফেললো – বন্ধু কী দাওয়াত দিলি তুই ! ভাবি তো না করে দিলো । আমার বউ এমন বললে থাপড়িয়ে দাঁতগুলো ফেলে দিতাম । তাই নাকি ! সজল ভাই তাহলে তো আপনি বিশাল ভাগ্যবান । মানে কী ভাবি ?না মানে ভাবির সাথে কী সত্যিই আপনি এমন করতেন ! আরে কী বলেন? আমার ওপর কথা বলার সাহস আছে নাকি ওর ।এই জন্যই বললাম, আপনি ভাগ্যবান । কারণ আমার সাথে তেমন কিছু করার চিন্তা করলে রিফাতের হাতটাই আমি গুঁড়িয়ে দিলাম ।
বন্ধুর সামনে এতোটা অপমান ! সত্যিই ভীষণ বাড়াবাড়ি মনে হলো রিফাতের কাছে । মৌরিকে ধমকে উঠলো সে ।
মৌরি’র যেন আজ ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেছে । সে মুখ বুঁজে অনেক সহ্য করেছে রিফাতের এইসব অত্যাচার । রিফাতের ভালোলাগাকে সস্মান জানাতে গিয়ে সে হাসিমুখেই অনেক কিছু সহ্য করে নিয়েছে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ঐ সহ্য করাটাই ভুল ছিলো । প্রতিদিনের এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না তার । ছয়দিন অফিস করে একটা দিন ছুটি পায় তারা । অন্যদিন তো অফিস শেষে চলে আসে সবগুলো আর ছুটির দিনেও রিফাত তাকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখে । বন্ধুবান্ধব সক্কাল সক্কাল এসেই হাজির হয়ে যায় । বাচ্চাটাকে নিয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটানো হয় না অনেক দিন । এটা থামানোর একটা পথ খুঁজছিলো মৌরি । আজ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না সে ।
রিফাত ঘরে ডেকে এনে এমন পাচন খাওয়ালি দোস্তো ! সজল বললো । রিফাত আবারও ধমকে ওঠে – যাও ভেতরে যাও । কিচ্ছু বানাতে হবে না তোমার । আমি তো আগেই বলেছি, আজ কিছু বানাচ্ছি না আমি । আর তুমি তোমার বন্ধুদের সামনে এমন করে ধমকে না উঠলেও পারতে কারণ তোমার সাথে আমার সম্পর্কটাতো এমন না । তাহলে ওনাদের সামনে এমন দেখাতে চাইছো কেন? বন্ধুর মন রাখার জন্য ? তোমারও কী মন চাইছে থাপ্পড় দিয়ে আমার দাঁত ফেলে দিতে? পরিবেশটা এবার সত্যিই থমথমে হয়ে গেলো । সজলই উঠে দাঁড়ালো সবার আগে – না রে দোস্তো, একদিনে এতো বেশি হজম করতে পারতেছি না । আজ মনেহয় ভাবির সত্যি মেজাজ গরম । আড্ডা জমবে না আজকে আর । রিফাত রাগ রাগ চোখে তাকালো মৌরি’র দিকে ।
মৌরি রিফাতকে অগ্রাহ্য করে সজলকে বললো – জ্বী ভাই আবার আসবেন । আমাদের সবারই তো আসলে সংসার আছে । পরিবারের মানুষগুলো দিনশেষে নিজেদের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে । পরিবারকে সময় দেন আর জীবনসঙ্গীকে সন্মান করতে শেখেন । দেখবেন জীবনটা অনেক সুন্দর মনে হবে তখন । সময় কাটানোর জন্য এর তার বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে না । বন্ধুবান্ধব তো থাকবেই । বন্ধুবান্ধব ছাড়া জীবন চলে নাকি ! আমারও তো অনেক বন্ধু আছে । দু’চার মাসে দেখা করার চেষ্টা করি আমরা । ভীষণ ভালো লাগে । সবকিছুর একটা সীমারেখা টানতে হয়, কোথায় থামতে হবে জানতে হয় । এখন তো আপনি একা নন, আপনার সাথে আরো কতোগুলো মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে । তারা আপনার জন্য অপেক্ষায় আছে । বাড়ি যান আর হ্যাঁ এর পর যেদিন আসবেন, ভাবি আর বাচ্চাকে নিয়ে আসবেন। পাস্তা খাওয়াবো । কথাগুলো বলে মনটা অনেক হালকা লাগে মৌরি’র । কথাগুলো না বললে আর হচ্ছিলোই না । তাদের সুন্দর সাজানো জীবনটার মাঝে কেমন একটা বিষাদময় দুরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছিলো প্রতিদিন । এই দুরত্ব ওকে কষ্ট দিচ্ছিলো ভীষণ ।
খাবার সেভাবেই পড়ে রইলো । কেউ ছুঁয়েও দেখলো না । বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এসে রিফাত একটা বোঝাপড়া করবে বলে মৌরি’র মুখোমুখি দাঁড়ালো । ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মৌরি বললো – কথাগুলো আমি শুধু সজল ভাইকে শোনানোর জন্য বলিনি । এগুলো তোমার জন্যেও ছিলো । কারোকে দেখে তার মতো হতে চেষ্টা করো না । এই তুমি তো এমন ছিলে না । তুমি কী বুঝতে পারছো, ধীরে ধীরে কতোটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে আমাদের মাঝে? রিহানকে শেষ কবে সময় দিয়েছো, মনে পড়ে? টাকা দেয়া মানেই দায়িত্ব শেষ না রিফাত । সংসার শুধু টাকা দিয়ে চলে না । সংসার চলতে আরো কিছু রসদ লাগে । সেগুলোর জোগান আমি একা দিতে পারবো না । কোন সম্পর্কটা কোথায় থামাতে হবে নিশ্চয়ই তোমাকে শিখিয়ে দেয়ার কিছু নেই । তুমি ভালো বুঝতে পারবে ।
রিফাত চুপ করে কথাগুলো শুনলো ।
মৌরি জিজ্ঞেস করলো – কী কিছু বলবে? হুম কী? তোমার শরীর ভালো না । তুমি যেয়ে রেস্ট নাও । আমি খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে আসছি । মৌরি তাকিয়ে থাকে রিফাতের দিকে । রিফাত মৌরি’র হাতটা ধরে বলে -সরি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে । এবারের মতো মাফ করে দেয়া যায় না ?