ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্ট ছাত্র ছিলাম আমি। এক কথায় যাকে বলে লাড্ডু মার্কা ছাত্র। পড়া শোনা তো করতাম-ই না,সবসময় শুধু দুষ্টুমি আর ফাইজলামি নিয়ে থাকতান। কখনও স্কুলের স্যার,ম্যাডামদের সাথে ভালো ব্যবহার করতামনা। স্যার,ম্যাডামদের কাছে সবসময় বেয়াদব হিসেবে-ই পরিচিত ছিলাম। ক্লাস চলাকালীন সময়ে অনেক আজে বাজে কথা বলতাম। স্যার,ম্যাডামদের বিকৃত নামে ডাকতাম। যার ফলে অনেক পিটুনিও খেতাম।
প্রত্যেকদিন নিয়ম মাফিক প্রত্যকটা ক্লাসে পড়া না হওয়ার কারনে দারিয়ে থাকতাম। এ নিয়ে স্যাররা অনেক কথাই বলতো,কিন্তু আমি সেগুলো তেমন একটা আমলে নিতাম না। বেহায়ার মতো হাসতাম। আমি সবসময় দুষ্টুমি,ফাইজলামি নিয়েই থাকতাম। রাস্তা ঘাটে যদি কখনও স্যারদের সাথে দেখা হতো কখনই তাদের সালাম দিতামনা,ভালো করে একটু কথাও বলতামনা।
আমি ৯ম শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী উত্তীর্ণ হই কোনরকম টেনে-টুনে পাশ করে। তাও আবার বন্ধুর খাতা দেখে। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী ছিলো ৫৬ জন। আর আমার রোল ছিলো ৫৬। স্যাররা যখন ক্লাসে ভালো ভালো কথা বলতো,আমি তখন হাসাহাসি করতাম। আমাদের ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রী ১০ম-এ পড়াশোনার প্রতি খুবই সিরিয়াস ছিলো। শুধু আমি ছাড়া। সামনে ছিলো আমাদের এস এস সি পরীক্ষা। কিন্তু আমার সে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিলো না। সেদিন ছিলো শনিবার। আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন। সেদিন ৩য় ক্লাস ছিলো ইংরেজি। আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতো ফরহাদ স্যার। তো সেদিনও স্যার নিয়ম অনুযায়ী ক্লাস নিচ্ছিলো। আমি ছিলাম এক বারে লাস্ট বেঞ্চে। স্যার পড়াচ্ছিলো আর আমি হাসাহাসি করছিলাম। হঠাৎ একপর্যায়ে স্যার আমায় বলল…
-এই রুবেল দাড়া। বল আমি কি পড়াচ্ছিলাম?
–(নীরব)
-কি হলো বল?
–স্যার জানি না।(মাথা নিচু করে)
জানিনা সেদিন স্যারের কি হয়েছিলো। রাগে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর আচমকা আমার গালে ঠাসসসস করে থাপ্পড় মেরেছিলো। স্যার ক্লাসে বেত নিয়ে আসতো,কিন্তু কাউকে মারতোনা। আর সেদিন আমায় ইচ্ছামতো পিটিয়ে ছিলো। আর বলেছিলো “তোদের মত জানোয়ারের জন্য আজকে পড়িয়ে শান্তি পাওয়া যায়না। নিজেতো পড়াশোনা করবিনা,অন্যদেরও পড়তে দিবিনা। যা বের হয়ে যা ক্লাস থেকে। তোর মতো ছাত্রের এই স্কুলে পড়ার দরকার নেই। ”
আরো অনেক কথা বলেছিলো। স্যারদের কাছে অনেক বকুনি,পিটুনি খাইছি, কিন্তু সেদিন কেনো জানি ফরহাদ স্যারের কথা গুলো বুকের মধ্যে তীরের মতো বিধছিলো। লজ্জায় মাথা উচু করতে পারছিলামনা। চোখ ভিজে গেছিলো। কথা গুলো কেমন জানি স্যার কাপা গলায় বলেছিলো। তারপর রাগ করে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেছিলো। টানা তিনদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাতর হয়ে পরেছিলাম। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো। চোখ মেলে তাকাতে পারতাম না। হঠাৎ অনুভব করলাম কে যেন আমার কপালে হাত দিছে। তাকিয়ে দেখি ফরহাদ স্যার। স্যারের চোখ ছলছল করছে। কি যেনো বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছেনা। হঠাৎ স্যার আমার হাত ধরে বলল….
–আমাকে মাফ করে দে রুবেল,আমি তোকে সেদিন ওভাবে মারতে চায়নি। খুব রাগ হয়েছিলোরে…..
আমি কিছু বলতে পারিনি। স্যারের চোখে ছিলো অপরাধ করার ভাষা। ছলছল নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আর খুব শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছিলো। আচমকা সেদিন আমি স্যারকে জরিয়ে ধরেছিলাম। হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানিনা। স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। কি যে শান্তি অনুভব করেছিলাম সেদিন বলে বোঝাতে পারবনা। মনে হয় আমি স্বর্গে আছি।
তারপর থেকে কেনো জানি আর ক্লাসে দুষ্টুমি করতে মন চায়তো না। খুব চুপচাপ বসে থাকতাম ক্লাসে। স্যারদের কাছে পড়া দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারতাম না। ফরহাদ স্যার ক্লাসে আসলে আমাকে সবার আগে পড়া ধরতো। না পারলে বার বার বুঝাতো। যদি না বুঝতাম,,তাহলে আলাদা ভাবে একা একা বুঝাতো। আমিও স্যারের পড়ানো মনোযোগ দিয়ে বুঝতাম। না পারলে স্যারকে বলতাম। স্যার খুশি মনে বুঝিয়ে দিতেন। সেবার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ৫৬ থেকে সরাসরি ৩ নাম্বারে এসেছিলাম। স্যাররা অনেক চমকে গেছিলো। ফরহাদ স্যার সেদিন আমায় নিয়ে হোটেলে নাস্তা করালো। কি যে ভালো লাগছিলো বলার মতোনা। তারপর থেকে স্যাররা খুব ভালোবাসতেন আমায়। বিশেষ করে ফরহাদ স্যার,উনি সবসময় আমাকে সাপোর্ট করেছেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতাম। দেখতে দেখতে আমাদের এস এস সি পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষা ইনশাল্লাহ ভালোই হলো। প্রত্যেকটা পরীক্ষা শেষ হলে স্যার আমাকে নিয়ে হোটেলে যেতেন। কখনও চা খাওয়াতেন,কখনও সিঙ্গারা। পরীক্ষা শেষ হলো।
যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে সেদিন কেমন জানি লেগেছিলো। টানটান উত্তেজনা ছিলো আমার মাঝে। আমি লক্ষ করছি সেদিন আমার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলো ফরহাদ স্যার। যখন রেজাল্ট বের হলো স্যার আমাকে জরিয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। আমি এ প্লাস ( A+) পেয়েছি সেই খুশিতে। আমিও স্যারকে জরিয়ে ধরে সেদিন কেঁদেছিলাম। সেদিন সবাই অবাক চোখে আমায় আর ফরহাদ স্যারকে দেখেছিলো। তারপর পড়াশোনার জন্য চলে আসি ঢাকায়। স্যারের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতাম। উনি আমায় অনেক কথা বলতেন। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। কখনও বিকাশ করে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। কিছু বলতে পারতামনা..শুধু ভাবতাম,একটা মানুষ কিভাবে পারে এসব করতে। স্যারের জন্য আলাদা একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিলো আমার মাঝে।
তারপর কলেজেও ভালো রেজাল্ট হয়। ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই। স্যারের সাথে কথা হয়। স্যারের কন্ঠটা কেমন জানি ভারি হয়ে যায়। স্যার রিটার্ন করে। অনেক বয়স হয়ে গেছে। বাসা থেকে বাবা ফোন করেছিলো। ফরহাদ স্যার নাকি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। কেনো জানি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম। ছুটে চলে গিয়েছিলাম স্যারের কাছে। কিন্তু সত্যি স্যার আর নেই । অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। যে মানুষটার কারনে আমি আজ এতদূর এসেছি সেই মানুষ টা আজকে আমায় রেখে চলে গেলো। স্যারের পা ধরে কেঁদেছিলাম।
স্যারের পা জরিয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে স্যার এখন আর কেউ আমায় বকুনি দেয়না,,কেউ আর আপনার মতো আমায় ভালবাসবে না। কেউ আর বলবেনা রুবেল তুই আমার ছাত্রনা,বন্ধু। কেউ আর হুটহাট বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বলবেনা,,এই টাকা দিয়ে তোর যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নিস। কিন্তু খবরদার সিগারেট খাসনা। সিগারেট খেলে কিন্তু আর কথা বলবনা। তখন কিন্তু আর আমায় সরি বলে লাভ হবেনা। তারপর উচ্চস্বরে খিলখিল করে হাসবে। আই মিস ইউ স্যার।আই লাভ ইউ স্যার। আই লাভ ইউ সো মাচ। অনেক অনেক ভালোবাসি আপনাকে স্যার।