– বাবা অদুলা তি ?
– অগুলা ? অগুলা রাজহাঁস আম্মু।
– ওলা পানিতে তেন বাবা ?
– ওরা পানিতে থাকতে ভালোবাসে। দলবেঁধে ওরা একসাথে পানিতে সাঁতার কাটে।
– ওওও। বাবা ওলা দুবে যায় না ?
– না আম্মু ওরা ডুবে যায় না।
– বাবা আমিও ওদের থাতে থেলা কলবো ?
– না আম্মু তুমি ছোট। বড় হও তারপর যেও।
– ওলা থোতদের নেয় না ?
– না আম্মু নেয় না।
– পঁতা ওলা, থুব পঁতা। বলেই রাগে মুখটা ঘুড়িয়ে নিলো আসফি।
‘আপনার মেয়েটাতো বড্ড চঞ্চল। খুব পাকা পাকা কথা বলে’। মেয়েকে নিয়ে পার্কের দিঘীর পাড়ে বসে ছিলাম।মেয়েলি কণ্ঠের কথাটি শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি বছর পঁচিশ কি তার বেশিও হতে পারে এমন একজন অপরিচিতা কথাটি বলে হাসি মুখে আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন । উত্তরে আমিও বললাম,
– হ্যাঁ, আমার পরীটা খুব পাকা পাকা কথা বলে। “আম্মু কি নাম তোমার”? অপরিচিতা জানতে চাইলো। তবে আসফি কোন কথাই বললো না। তাই আমিই বললাম,
– ওর নাম আরাবি জান্নাতি আসফি।
– বাহ! অনেক সুন্দর নাম তো। তোমার বলেই অপরিচিতা আসফির গাল টেনে দিলো।
অচেনা একজন বলে আসফি একটু ভীত হয়ে গেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর আমার কাছেও কেমন যেন লাগছে। চেনা নেই জানা নেই হুট করে এভাবে কথা বলা। আমার মনের ভিতরের কথা গুলো হয়ত বুঝে গেছেন অপরিচিতা। তাই তিনি বললেন,
– এভাবে হুট করে অপরিচিতা হয়ে এমন কথা বলছি ভেবে বিরক্ত হচ্ছেন না তো ?
– না ঠিক তা না। তবে অবাক হয়েছি কিছুটা।
আমি আরুশা আহমেদ। পাশেই একটা “শিশু একাডেমির” শিক্ষিকা হিসেবে আছি। অপরিচিতা তার পরিচয় দিলেন। আমি আসিফ আহমেদ। পাশেই কোন এক অফিসে চাকরি করি। বাসাও কাছেই। মেয়েটার বায়না রাখতেই এখানে আসা। অপরিচিতা কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
– বাসায় যেতে হবে। আসফিকে রেখে আবার অফিসে যেতে হবে। ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
পার্ক থেকে বাসায় ফিরে কেয়ারটেকার রহমত চাচার কাছে আসফিকে রেখে আমি অফিসে চলে গেলাম। পরদিন বিকেলে যথারীতি আসফির বায়না মতো ঐ পার্কের দিঘীর পাড়ের বেঞ্চিতে বসে বসে ওর হাজারো কথার উত্তর দিচ্ছি ঠিক তখনই কোন মেয়েলী কণ্ঠে কেউ বললো,
-কেমন আছেন ? পাশ ফিরে দেখি কালকের সেই অপরিচিতা। তাই মুচকি হেসে জবাব দিলাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?
-জ্বী ভালো। তা আজও এসেছেন যে?
-প্রতিদিনই আসতে হয়।
-আচ্ছা একটা কথা বলি?
-বলেন।
-মেয়েকে নিয়ে শুধু আপনি একাই আসেন?
ওর আম্মু আসে না?
-না মানে ওর আম্মু…..
– আম্মু তো এথানেই থাতে। আমার কথা শেষ না হতেই আসফি বলে দিলো। অপরিচিতা হয়ত অবাক হয়েছেন হয়ত। তাই বললেন,
– এখানে থাকে মানে?
– এথানে মানে ঐ পানির নীচে থাতে আম্মু। আমাল আম্মু জলপলী হু। আসফির কথা শুনে মিটমিট করে হাসছি আমি আর অপরিচিতা তো হতবাক। “জলপরী ওর আম্মু! এসব কেন বলছে ও” ? আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,
– আসলে আমিই ওকে বলেছিলাম যে তোমার আম্মু এই দিঘীতে থাকে জলপরী হয়ে। তুমি যখন বড় হবে তখন দেখা দিবে তোমার সাথে। তাই একথা বলছে।
-আপনার কথার কিছুই বুঝলাম না।
– বুঝতে চান?
– জ্বী বুঝিয়ে বলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলাম। এইতো বছর পাঁচেক আগের কথা। চাকরি পাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই বাবা-মা বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। জানতেও চাইলেন পছন্দের কেউ আছে কি না। আমি ছোট বেলা থেকেই খুব লাজুক ছিলাম তাই পছন্দ বলতে কেউ ছিলোও না আর প্রেম করার মত সাহস ও ছিলো না। তাই মা-বাবাই তাদের পছন্দের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন। মেয়েটা নাকি খুব সুন্দর এ’কথা বলে বিয়ের আগে সবাই খুব ক্ষ্যাপাতো। আমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম।খুব তাড়াতাড়িই বিয়েটা হয়ে গেল। ওহ্ একটা কথা বলতে ভুলে গেছি আসফির আম্মুর নাম হলো “আফিয়া জান্নাতি”। আফিয়া খুব চঞ্চল আর জেদি ছিলো। আর আমি ছিলাম লাজুক। এই নিয়ে খুব খুশি ছিলো ও।
ও বলতো ওর না কি এমন একটা ছেলেই দরকার ছিলো যাকে কি না ও নিজের মত করে গড়ে তুলে তারপর ভালোবাসবে। নিজের মত করে গুছিয়ে নেবে।ওর কথা শুনে আমিও মনে মনে প্রচন্ড রকমের খুশি ছিলাম। কারণ, আমারও খুব শখ ছিলো একটা চঞ্চল বউ পাওয়ার। ইচ্ছা ছিলো সে বউটা যেন আমাকে তার মত করে গুছিয়ে নেয়। আফিয়া খুব রাগিও ছিলো।অনেক শাসন করতো। তবে আমি ওর শাসনের মাঝেই ভালোবাসা খুঁজে পেতাম। দিন গুলো খুব সুন্দর ভাবে কেটে যাচ্ছিলো। প্রথমে একটু লাজুকতা কাজ করলেও পরে আমিও ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি। আফিয়া আমাদের পুরো পরিবারটা ভালোবাসা দিয়ে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখতো। ভালোবাসার চাদরে জড়ানো দিন গুলা এক এক করে চলে যেতে লাগলো। সেই সাথে আফিয়ার ভিতর আরেকটা নতুন প্রাণের আগমন ঘটলো।
যেদিন প্রথম ও কানে কানে আমাকে কথাটি জানালো সেদিন আমি আনন্দে ওকে কোলে করে সারা বাড়ি ঘুড়েছিলাম। দিন যেতে লাগলো, ওর ভিতর আরেকজন বড় হতে থাকলো। আমার মা, আমি, বাসার সবাই খুব যত্ন করতো ওর। খেয়ালে রাখতো খুব। রাতে যখন ঘুমাবো তখন প্রায় প্রতিদিনই বাবু ছেলে হবে না মেয়ে হবে এ নিয়ে ঝগড়া লাগতো আমাদের। তারপর যেদিন আলট্রাসনোগ্রাফি করে জানতে পারলাম আমাদের মেয়ে বাবু হবে সেদিন দু’জনেই আনন্দে কেঁদেছিলাম। রাত হলেই ঝগড়া লাগতো কি নাম রাখবো এই নিয়ে। অবশেষে দু’জন দু’জনের নামের সাথে মিল করে মেয়ের নাম রাখি “আরাবি জান্নাতি আসফি”। নামটা খুব পছন্দ হয়েছিলো ওর।
এক এক করে দিন এগিয়ে এলো। ওর ডেলিভারির সময় হয়ে এলো। যেদিন ওর প্রচন্ড ব্যাথা উঠলো আর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম সেদিন কেমন যেন খুব ভয় হচ্ছিলো আমার। ওর ব্যাথা অনুভব করে বুঝেছিলাম “মা” হওয়া কতটা কষ্টের। তবে যখন নরমালেই ওর ডেলিভারিটা ভালোভাবে হয়ে গেল আর বাচ্চা কোলে নিলো তখন বুঝেছিলাম “মা” হওয়া টা যতটা কষ্টের তার’চে অনেক অনেক বেশি আনন্দেরও। কয়েকদিন পর বাসায় চলে এলাম ওকে নিয়ে। বাড়িতে আসার পর থেকেই সব কিছু বদলে গেল। সারা বাড়ি মাতামাতি আর বাচ্চা নিয়ে সে কি আনন্দ! আমি তো অফিসে থাকা সময় টা ছটফট করতাম শুধু কখন বাসায় ফিরবো এই নিয়ে। তারপর এক এক করে মাস, বছর কেটে গেলো।আমাদের আসফি আধো আধো কথা বলা তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখে গেলো।সারা বাড়িটা ওর পদ চরনে মুখোরিত ছিলো। দেখতে দেখতে দু’টা বছর চলে গেল।আর আমাদের আসফি টাও বড় হতে লাগলো। তবে মহান আল্লাহ হয়ত আমাদের এত্ত খুশি আর দিতে চাইলেন না। তাই তো হঠাৎই আমাদের খুশিটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত উবে গেলো।
সেদিন রাতে প্রতিদিনের মতোই খাওয়া-দাওয়ার পর আসফিকে নিয়ে শুয়ে ছিলো আফিয়া । আমি বসে বসে অফিসের কাজ দেখছিলাম। হঠাৎই কি হলো আফিয়া বললো ওর নাকি খারাপ লাগছে। বুকের ভিতর ব্যাথা করছে আর শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, ও কিছু না ঠিক হয়ে যাবে। তবে ও বারবারই আমাকে বলছিলো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি পাত্তা দেই নি।
যখন আর ও সইতে না পেরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিলো তখনই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে ওকে কোলে করে বাসার বাইরে এসে সিএনজি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।আমার তখন একটুও মাথা কাজ করছিলো না। চারদিক কেমন যেন ঝাপসা লাগছিলো। আফিয়ার কষ্ট দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি ওকে ভর্তি করলাম। ডাক্তার এসে ওর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়ে শুধু বললো, রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনারা আরো আগে কেন আনেন নি”? ডাক্তারের কথা শুনে আমি জমে গেছিলাম পুরো। ডাক্তার আশা দিয়ে বললো, আল্লাহ কে ডাকুন। বাঁচা মরা তার হাতেই। তবে নাহ। সেদিন আমার জীবনের বিনিময়ে আফিয়াকে চেয়েও পাই নি আমি। আল্লাহ আমার আফিয়াকে নিয়ে নিলেন। সেদিন আমি একটুও কাঁদতে পারি নি। নিজ হাতে ওকে একা করে মাটির কবরে রেখে আসলাম। অথচ ওকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “সারাজীবন দু’জন একসাথে থাকবো”। আমি পারি নি।
আফিয়ার চলে যাওয়াতে প্রচন্ড ভেঙে পড়ি আমি। সাথে মা-বাবাও। আমি জানি না এত্ত খুশির মাঝে আল্লাহ এভাবে আমার সব সুখ কেড়ে নিবেন। আফিয়া মারা যাওয়ার তেরো দিনের মাথায় স্ট্রোক করে বাবা মারা যান আর বাবার শোকে মা। আপন বলতে যা ছিলো আল্লাহ সব কিছুই নিয়ে নিলেন। তারপর অনেক ঝড়-ঝাপটা কাটিয়ে মেয়েকে নিয়ে এই তো আছি আলহামদুলিল্লাহ্ । চোখের পানি মুছে মুচকি হেসে তাকিয়ে দেখি অপরিচিতার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। আমি আবার মুচকি হেসে বললাম, তবে যাই বলেন আমার এই ছোট্ট পরীটাকে নিয়ে এখন খুব ভালো আছি। এখন ওই আমার বেঁচে থাকারা শেষ সম্বল। অপরিচিতা হয়ত এখনো ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। তাই আবার বললাম, এই যে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো তো আমাকে যেতে হবে।
অপরিচিতা চোখটা মুছে “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়ালো।আমিও বিদায় দিয়ে আসফিকে কোলে করে বাসায় ফিরে এলাম। অনেক দিনের জমানো কষ্ট গুলা উগলে দিয়ে খুব খারাপ লাগছিলো তাই আর অফিসে যাই নি। দুই দিন অফিসের প্রচন্ড ব্যস্ততা কাটিয়ে আসফির কান্নাকাটি থামাতে আজ আবার এসেছি সেই চিরচেনা পার্ক টার দিঘীর পাড়ে। যে বেঞ্চে বসতাম সেখানে এসে দেখি কেউ একজন বসে আছে। অন্যদিকে যাবো বলে ঘুড়তেই কেউ একজন বলে উঠলো, কি খবর আসফি কেমন আছো ? সামনে তাকিয়ে দেখি সেই অপরিচিতা।
– আরে আপনি এখানে!
– এইতো আসফির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তা গত দু’দিন দেখলাম না যে ?
– অফিসে কাজের খুব চাপ ছিলো তাই আসা হয় নি। তবে আজ আসফির কান্নার কাছে হার মেনে আসলাম।
“মামনি আমার কোলে আসো তো” বলে অপরিচিতা হাত বাড়াতেই আসফি তার কোলে চলে গেল। আমি তো অবাক! যে মেয়ে আমি আর রহমত চাচা ছাড়া কারো কোলে ওঠে না সে কি না একজন অপরিচিতার কোলে! আবার ভাবলাম, হয়ত এ কয় দিনে পরিচিত ভেবে নিয়েছে।
– বাবা আইতক্লিম খাবো। আসফির কথায় ঘোর কাটে আমার।
-বাবা, আমি আইতক্লিম খাবো। আচ্ছা রে বাবা আনতেছি। তুমি এই আন্টিটার কোলে বসো কেমন?
– হু।
পার্কের ক্যান্টিন থেকে আইসক্রিম এনে দিয়ে আসফির পাশে বসলাম ঠিক তখনই ফোন টা বেজে উঠলো।অফিস থেকে ফোন করেছে। ধরতেই বললো তাড়াতাড়ি আসতে জরুরী মিটিং আছে। কি আর করা আসফিকে কোলে করেছি চলে আসবো বলে তখনই শুরু করে দিলো মহা কান্না। এখান থেকে যাবে না তো যাবেই না।অনেক বলেও যখন লাভ হলো না ঠিক তখনই অপরিচিতা বললো,
– যদি কিছু না মনে করেন তো আসফি আমার কাছে থাক। আপনি অফিস থেকে ঘুড়ে আসুন।
অপরিচিত একজন বলে ঠিক মন থেকে কিছু বলতে পারছিলাম না ঠিক তখনই আবার বললো,
সমস্যা নেই বিশ্বাস রাখতে পারেন। আমি আসফির কপালে একটা চুমু দিয়ে অফিসে চলে এলাম। মিটিং চলাকালীন সময়টা মোটেও মনোযোগী ছিলাম না কারণ এই প্রথম আসফিকে অন্য কারো কাছে রেখে এসেছি। মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমি তাড়াতাড়ি পার্কে এসে দেখি আমার পাগলিটা অপরিচিতার সাথে খেলায় মেতে আছে। ওর হাসিখুশি মুখটা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেলো। অনেকদিন পর মেয়েটাকে এভাবে হাসতে দেখে ভালোই লাগলো।
-আপনার মেয়েটা বড্ড পাকা পাকা কথা বলে। খুব দুষ্টু। অপরিচিতার কথায় ঘোর কাটলো আমার।
– আপনাকে জ্বালায় নি তো ?
-আরে নাহ। বরং খুব ভালোই সময় কেটেছে আমার।
-সন্ধ্যা তো হয়ে এলো আপনি বাসায় যান। আম্মু আসো বাসায় যাই।
– বাবা আর একতু থেলা কলবো।
-না আম্মু সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর তোমার আন্টি বাসায় যাবে।
– ওও। আন্তি তুমি তিন্তু তালতেও আসবে।
– ঠিক আছে মামনি আসবো। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখনই অপরিচিতা বললো,
– আসিফ সাহেব আপনার নাম্বার টা দেবেন ? না মানে আসফির সাথে কথা বলতাম।
আমি মুচকি হেসে নাম্বার টা দিয়ে চলে এলাম। পথে মেয়েটা আমার সে কি বকবক করা! আন্টির সাথে এই করেছে সেই করেছে চকলেট খেয়েছে আরো নানান কথা। মন টা আমারও একটু ভালো লাগছিলো ওর খুশি দেখে।
দেখতে দেখতে প্রায় দু’টো মাস কেটে গেল। মা, বাবা আর আফিয়া মারা যাওয়ার পর এই দু’টো মাসই হয়ত ভালো কেটেছে আমার । তবে এতে সবটুকু অবদান সেই অপরিচিতার। প্রায় প্রতিদিন দেখা হওয়া আর কথা বলার সাথে সাথে আসফি অপরিচিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে খুব । যেন তাকে ছাড়া চলেই না। আমি অফিসে থাকলেও আসফি তার সাথে ফোনে মাঝে মাঝেই কথা বলে। আবার পার্কে এসে আমাকে লাগেই না আর। সারাক্ষণ তার সাথে খেলা করে। এমন কি আমি না থাকলে অপরিচিতা বাসায় এসে রহমত চাচার সাথে কবে মিল করে ফেলেছিলো আমি জানিই নি।অপরিচিতা নাকি আসফিকে গোসল করিয়ে খাইয়ে তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তারপর যেত।
তবে আমি অবাক হয়েছি যে, আসফি এর কিছুই বলেনি আমাকে।
এই দু’মাসের মাঝে তার সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছে আসফির। এখন আর একা থাকতে চায় না। সব সময় সেই আন্টি আন্টি করে। আমার কাছেই এখন আর থাকতে চায় না। বিষয় টা নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেছি। কারণ সে তো আর আমার আপন কেউ না।তারও তো পরিবার আছে। হয়ত সংসার ও থাকতে পারে। অনেক ভেবে দেখলাম অপরিচিতার সাথে বিকেলে দেখা করবো। তাকে বলবো যেন আর আসফির কাছে না আসে। কারণ এতে আসফি আরো ভালোবেসে ফেলবে আর পরে এতে খুব প্রভাব পরবে। অপরিচিতাকে দেখা করতে বললে সেও রাজি হয় আর বলে তারও নাকি একটা কথা আছে। ভাবলাম হয়ত বলবে সে আর সময় দিতে পারবে না। অবশ্য এটা বললে আমারই ভালো।
অফিস থেকে বিকেলে সরাসরি পার্কে এলাম।আসফিকে আনি নি। কারণ যদি না যেতে চায়। মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? যে মায়া টিকবে না। সেই বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসলাম। পাশেই অপরিচিতা বসে আছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বললো, আসিফ সাহেব আজ আপনাকে ছোট্ট করে একটা গল্প শোনাবো। তারপর আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো। গল্পটা শোনার পর যদি মনে হয় আমি সেই জিনিস টা পাওয়ার যোগ্য তো দিয়েন। আর না হলে না করে দিয়েন। আমি কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে ই বলতে শুরু করলো,
এইতো বছর সাতেক আগের কথা। ভার্সিটিতে পড়া সময়ে মেহরাবের সাথে খুব সখ্যতা হয় আমার। সেই থেকে ভালো লাগা আর ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। কোন কিছুরই কমতি ছিলো না আমাদের ভালোবাসায়। ভালোবাসা এতটাই মজবুত ছিলো যে সেটা বিয়ে অবধি পৌঁছে গেলো তাও পরিবারের মতামত নিয়েই। আমাদের তিন বছরের প্রণয়ের পর সারাজীবনের জন্য আরেক দফা প্রণয় হলো। ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবনের জন্য পাওয়া চার’টে খানি কথা নয়। বিয়ের পর মেহরাব ভালো একটা চাকরি করতো তবে আমাকে কিছু করতে দিতো না। শুধু বলতো তুমি তো আমার রাণী। তাই কোন কাজ করতে দেবো না।
ওর মা-বাবা আর আমরা দু’জন এই নিয়েই ছিলো আমাদের সংসার। ভালোবাসায় ঘিরে খুব সুখেই দেড়টা বছর চলে গেলো। তখনই আমার শ্বাশুড়ি মা বলা শুরু করলেন, বৌ মা, অনেক দিন তো হলো এবার একটা নাতিপুতির মুখ দেখতে দাও। শ্বাশুড়ি মা’র কথা শুনে সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। কথাটা আমারও ভালো লেগেছিল। তাই মেহরাব কে বললাম। ও তো শুনেই হেসে কুটিকুটি হয় আর বলে, আমিও একটা নাতিপুতি নেব। এরপর আরও একটা বছর কেটে গেলো তবে নাতিপুতির কোন খবর না পাওয়ায় শ্বাশুড়ি মা বারবার তাগাদা দিতে লাগলেন আর বলতেন, আমরা মরে গেলে কি নাতিপুতি নেবে ?
আমি কথাটা শুনে একটু ভয়ই পেয়ে যাই। আসলেই তো একটা বাচ্চা তো নিতেই চাই তবে হচ্ছে না কেন কে জানে। প্রতিদিন শ্বাশুড়ি মায়ের খোটা শুনে শুনে বিরক্ত হয়েই মেহরাব কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা আর নানান রকমের টেস্ট করে ডাক্তার জানান আমি না কি বন্ধ্যা। আমি না কি কখনোই মা হতে পারবো না। কথাটা শুনে খুব কান্না করেছিলাম সেদিন। কোন পাপের ফল আল্লাহ আমাকে এভাবে দিলো কে জানে। অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। তবে মেহরাব আমাকে সব সময় সান্তনা দিতো। আমি জানতাম মেহরাব যাই হোক না কেন আমার পাশে সব সময় থাকবে। অন্যদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের নাতিপুতির কথা শোনা। আমি চুপি চুপি খুব কান্না করতাম। অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে মোনাজাত করতাম আর একটা বাচ্চা চাইতাম।
মেহরাবের মায়ের কথা শুনতে শুনতে যখন আমি ক্লান্ত তখন মেহরাব ওর মা-বাবাকে আমার অসুখের কথা জানায়। ভেবেছিলাম এটা শোনার পর হয়ত তারা একটু সদয় হবেন। তবে হলো তার বিপরীত। আমি মা হতে পারবো না জানার পর থেকেই বিভিন্ন আজেবাজে কথা বলতো আমায়। আমি না কি অভিশাপ এটাও বলতো। আর উঠতে বসতে বন্ধ্যা কথা টা তো আছেই। এসব শোনার পর রাতে যখন মেহরাবের কোলে শুয়ে কান্না করতাম তখন ও আমাকে অভয় দিতো। তবে কে জানতো এই অভয় দেয়া মানুষ টাও পাল্টে যাবে। সেদিন রাতে মেহরাবই বললো, আরুশা আমি বাবা- মা’র একমাত্র সন্তান। আর সব মা-বাবাই চান শেষ বয়সে নাতিপুতির মুখ দেখতে। আর বংশের প্রদীপ হিসেবেও তো একটা বাচ্চা দরকার না কি ? যেহেতু তুমি আমাকে বাবা ডাক শোনাতে অপারগ তাই আমি চাইছি আমাদের আলাদা হওয়াই ভালো।
সেদিনের মেহরাবের কথা শুনে আমি হতবাক হয়েছিলাম। সুখের সংসারে আমার আর তখন সুখ বলতে কোন শব্দই ছিলো না। যাকে ভরসা করতাম সেও অবহেলায় ভাসালো। তাই অনেক ভেবে দেখলাম ভালোবাসার মানুষ টা যদি আমাকে ছাড়া ভালো থাকে তো ক্ষতি কি? আর অপারগ তো আমিই । আমাদের সুখের সংসারের ইতি হলো মাত্র একটা সাক্ষরে। এরপর অনেক ভেঙে পড়েছিলাম তবে সেটা কাটিয়ে এইতো বছর কয়েক হলো একটা শিশু একাডেমিতে চাকরি করি। সারদিন বাচ্চাদের সাথে সময় দিয়ে আবার এখানে আসি। তবে খুব ভালোই আছি। এইতো আমার জীবনের ছোট্ট এক গল্প। আমি তাকিয়ে দেখলাম অপরিচিতার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। আর হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তা আসিফ সাহেব এবার আমার আবদার টা করি ? কিছু বলার আগেই সে বললো,
– এই কয়টা মাস আমি আসফিকে একটু হলেও সময় দিয়েছি। আমি বুঝেছি যে আপনি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসা, সময় দেন। তবে মায়ের অভাবটা মা ছাড়া কেউই দিতে পারে না। আর আমি এই কয়টা দিনে আসফিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তাই বলছি কি আমাকে ওর মায়ের জায়গা টা দেবেন ? আমি আপনার কাছে কিছুই চাই না শুধু ওর মা হবার একটা সুযোগ দিন। আমি-আমি কথা দিচ্ছি আমার হৃদয় নিংরে ওকে ভালোবাসবো। আমি ওর মা হয়ে বাকি টা জীবন বুকে আগলে রাখতে চাই। কি দেবেন না একটা সুযোগ ? অপরিচিতার কথায় আমি ক্ষানিক ক্ষণ অবচেতন ছিলাম। এও কি হয় ! মনের ভিতর ঝড় বইছে। আমি আফিয়ার জায়গা টা কাউকেই দিতে পারবো না তবে মেয়েটার যে একটা মা খুব দরকার। আর বড় হয়ে যখন জানবে ওর মা নেই তখন আমাকে ভুল বুঝবে। এই কয়টা দিনে মেয়েটাও আমার অপরিচিতা কে ভালোবেসে ফেলেছে।
‘আপনি কি আমার আসফির আম্মু হবেন’ ? নিজের অজান্তেই মুখ থেকে কথাটা কখন যে বেড়িয়ে গেল বুুঝলাম ই না। যখন বুঝলাম তখন দেখি অপরিচিতার চোখে আনন্দ অশ্রু। ভাবলাম, হঠাৎ এমন কথায় যদি কারো মুখে হাসি ফুটানো যায় তো দোষের কিছু নাই। একটা মাস পর আজ আবার সেই পার্কের দিঘীর পাড়ের বেঞ্চি টাতে বসেছি। তবে আজ কেন জানি সব কিছু পূর্ণ পূর্ণ লাগছে। বেঞ্চি টার বাঁ পাশে আমি, ডান পাশে আরুশা আর মধ্যখানে আমাদের আসফি। চকলেট খেতে খেতে ফোকলা দাঁত বের করে আসফি বললো, বাবা তুমি না বলেথিলে আম্মু জলপলী হয়ে উথে আসবে। তিন্তু আম্মু তো গালিতে কলে এলো।
তুমি পঁতা বাবা। মিথ্যে বলো। আমাল আম্মু থুব ভালো। তুমি তো তকলেত থেতেই দেও না আল আম্মু আমাকে এত দুলা তকলেত কিনে দেথে। তুমি পঁতা বাবা আম্মু ভালো। আরুশা আসফির সাথে খেলা করছে আর বুড়িটার পাকা পাকা কথা শুনে মিটমিট করে হাসছি আমি। আরুশা সত্যি পেরেছে আসফির মায়ের অভাবটা পূরণ করতে তাও এত তাড়াতাড়ি। স্বপ্নেও ভাবি নি জীবনের এমন এক প্রাণ্তে এসেও আবার জীবন টাকে উপরওয়ালা পূর্ণতা দান করবেন। আসফি পেয়েছে মা আর আরুশা পেলো মা হওয়ার স্বাদ। বেলা শেষে আজ সত্যিই আমি খুব সুখি, খুব ।