চায়ের কাপটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই রিমি বললো, ‘দেখ, তোমার মাকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও। না হলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো। আমি আর তাকে সহ্য করতে পারছি না।’ রিমির মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝলাম বেশ রেগে অাছে। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, ‘কোথায় যাবে মা? আমি ছাড়া তো তার এ জগতে কেউ নেই। এমন কথা আর বলো না। যে কয়েকদিন বেঁচে আছেন এখানেই থাকবেন উনি।’ ‘নিজের মা তো না- সৎ মা। সৎ মায়ের জন্য দরদ দেখি উথলে পড়ছে। দেখ, হয় তোমার মাকে দু’দিনের মধ্যে বিদায় করে দিবে, নাহয় আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাব।’ রিমি আমার কথা বুঝতে না চেয়েই রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। আমি নির্বিঘ্নে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলাম।
রিমির বেঁধে দেয়া সময় শেষ হওয়াতে আমার সাথে কোনো কথাই বলছে না। অফিস থেকে ফিরে এসে নিজেকেই খাবার নিয়ে খেতে হয়েছে। এমনিতে ওই ভাত বেড়ে দেয়, আজ তার ব্যতিক্রম। বিছানায় শুয়ে বই পড়ছি। রিমি চুল আচড়াতে আচড়াতে বললো, ‘তোমাকে যা বলেছি তা করছ না কেন? তুমি কি আমার সাথে সংসার করতে চাও না?’ বই থেকে মনোযোগটা রিমির কথার উপর দিয়ে বললাম, ‘এত ছোট্ট একটা বিষয়ে সংসার ভাঙার কথা বলছো কেন? এমনিতেও উনি এ বাড়ি থেকে কোথাও যাবেন না।’ রিমি আমার দিকে রাগী ভঙিমায় তাকালো। আমি মনে মনে একটু হেসে বই পড়াতে মনোযোগ দিলাম। রাতে আর কিছুই বললো না রিমি। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। আমার বই পড়া হলে আমিও লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে রিমির সাথে তেমন কথা হয়নি। ব্যস্ততার কারণে খাবার না খেয়েই অফিসে আসতে হয়েছে। লাঞ্চ টাইমে বাসায় এসে দেখি রিমি ঘরে নেই। মা এসে বললো, ‘বাবা, বউমা তো একটা বড় ব্যাগে কাপড়-চোপর গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।’ আমি এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে বললাম, ‘ওহ।’ ‘তোমাদের মধ্যে কোনো মান-অভিমান হয়েছে বাবা? হলে আমাকে বলো, সেরকম হলে বউমাকে আমি নিয়ে আসব।’
সমস্যাটা মাকে আর বললাম না। শুধু বললাম,’তেমন কিছু নয় মা। চলে গেছে আবার ফিরেও আসবে। ভাত দাও। লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ মা ভাত-তরকারি নিয়ে এসে দিলেন। ‘তুমি খেয়েছ মা?’ ‘আগে তুমি খাও।’ ‘বসো, এক সাথে খাই।’ মা মুচকি হেসে আমার পাশে বসলো। আমি মাকে ভাত তুলে প্লেটে দিলাম। রিমিকে আমি কেমনে বুঝাবো যে, যখন আমার জন্মদাত্রী মা আমাকে ফেলে একটু সুখের আশায় অন্যের হাত ধরে চলে গিয়েছিল তখন এই সৎ মায়েই আমাকে তার বুকে আগলে রেখেছে। আমার ভালোবাসার কমতি হবে বিধায় কখনো বাচ্চাই নেয়নি। সেই মাকে কেমনে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি?
পনেরো দিন পর, আমি রিমিদের বাসায় এসেছি। রিমি আমাকে দেখে মুখ ভার করে ঘরের দরজা দিয়েছে। রাগ তাহলে এখনো কমেনি। শ্বাশুড়ি মা এসে বললেন, ‘রিমির কী হয়েছে বাবা?’ ‘সেটা তো ওই ভালো বলতে পারবে মা। কেন ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন।’ ‘ও তো কিছু বলে না। শুধু বলে তোমার বাড়িতে ও ফিরবে না।’ ‘দেখেন মা, পৃথিবীতে যেমন স্ত্রীর প্রয়োজন আছে তেমনি প্রয়োজন আছে মায়ের। কিছু জন্মদাত্রী মা যেমন তার সন্তানকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তেমনি সকল সৎ মায়েই খারাপ হয় না। ও আমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে বলে। যেটা আমি কোনদিনই পাবো না মা।’ আমার কথা শুনে শ্বাশুড়ি মা রেগে আগুন। ঘর থেকে রিমিকে বের করে এনে সবকথা বলে বললো, ‘এজন্য তুমি চলে এসেছিস?’ রিমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
‘দেখ রিমি, তোর বাবা একথা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না। তুই আমার মেয়ে হয়ে একথা কেমন করে ভাবিস? ধর তোর ভাই আমাকে আর তোর বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলো, তখন তোর কেমন লাগবে?’ রিমি কোনো কথা বলে না। শ্বাশুড়ি মা আমাদের দুজনের কাছ থেকে চলে গেলেন, যাবার সময় বললেন, ‘তুই জামাইয়ের সাথে কথা বল, আমি তোর কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছি।’ রিমি আমার সামনে নিশ্চুপ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আছে। মুখে কোনো কথা নেই। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,’মাকেও যেমন ভালোবাসি তেমনি তোমাকেও ভালোবাসি রিমি। মাকেও যেমন ছাড়তে পারব না তেমনি তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ। প্লিজ তুমি ফিরে চলো, তোমাকে ছাড়া আমার সময় কাটে না।’
আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। রিমি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভুলটা আমারই। আমার স্থান থেকে তোমার মাকে বিচার কারলে হয়তো এমনটা বলতে পারতাম না। আমাকে মাফ করে দাও তুমি। এমনটা আর কখনো হবে না।’ রিমিও কাঁদছে। আমি রিমিকে কাছে টেনে বললাম, ‘তাহলে বলো ভালোবাসি?’ চোখের পানি মুছে কিছুক্ষণ পর বললো, ‘হ্যাঁ ভালোবাসি।’ আমি রিমির কপালে চুমু এঁকে দিলাম।
(সমাপ্ত)