রঙের ছোঁয়া

রঙের ছোঁয়া

অনেকক্ষন যাবত কলিং বেল চাপছি, কেউ দরজা খোলার নাম’ই নাই। আজকেই এই বাসায় প্রথম আসলাম। কাগজে প্রাইভেট পড়ানোর বিজ্ঞাপন দেখেই যোগাযোগ করি। কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে চলে আসলাম এই বাসায়। কিন্তু কলিং বেল চাপতে চাপতে মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ধুর বলে যখন ই চলে যেতে নিবো, ঠিক তখনই একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিলো।কিন্তু মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন লাগলো। মেয়েটার বয়স তেমন হবেনা, এই আঠারো উনিশ! কিন্তু মেয়েটা সাদা শাড়ী পড়ে আছে। মুখটাও কেমন যেন ফ্যাকাসে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার মনের সব রং চুরি করে নিয়ে গেছে। দরজা খুলে মেয়েটা কোন কথাই বলল না, ভিতরে চলে গেল। কিছু না বলে আমিও তাকে অনুসরন করতে লাগলাম।

তিনটা রুম পরে কর্ণারের একটা রুমে ইশারা করে আমাকে যেতে বলল। ওই রুমে গিয়েই দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে টেবিলে বসে আছে, বয়স নয়-দশ হবে। আমি রুমে ঢুকতেই সালাম দিয়ে দাড়িয়ে পড়ল। আমি ও সালামের উত্তর দিয়ে বসে পড়লাম। আর ওকেও বসতে বললাম। তবে আমি নিজেও এখন একটু অন্যমনস্ক! কেন যেন আমার ভাবনায় শুধু সেই সাদা শাড়ী পড়া মেয়েটা। মেয়েটা দেখতে একটু বেশি সুশ্রী। কিন্তু সে এমন চুপচাপ কেন! তা জানতে মনটা ব্যকুল হয়ে আছে। ছাত্রীকে বললাম…

— আগে পরিচয় পর্বটা শেষ করি কেমন??
—- আচ্ছা স্যার।
—- একটা কথা বলো তো, এখন তো বছরের জুলাই মাস চলছে। আগের ছয়মাস কি তুমি প্রাইভেট পড়োনি??
— পড়েছি।
—- কার কাছে? আর হঠাৎ কেন টিচার পরিবর্তন করলে?তুমি কি জানো,এটা তোমার জন্য ক্ষতিকর।
—- হুম স্যার জানি। কিন্তু আগে যে স্যার আমায় পড়াত তিনিই আমার রায়হান ভাইয়া। আমার আপুর স্বামী।
কথাটা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। বললাম…

—- এখন পড়োনা কেন?
—- আসলে ভাইয়া একটা এক্সিডেন্টে ২মাস আগে মারা গেছে।

তার পর থেকেই আপু এমন চুপচাপ হয়ে গেছে। প্রথম একমাস আপু হসপিটালে ভর্তি ছিল।এখন বাসায় ই আছে। তবে কারো সাথেই কথা বলে না। এখন অল্প অল্প বলে, তাও দরকার পড়লে বলে।জানেন স্যার আমাদের এত বিশাল বাড়ির মধ্যে আমরা মাত্র তিনজন থাকি। তাও আব্বু সারাক্ষন অফিসেই থাকে। আর আপুতো তার বেডরুম আর বেলকনি ছাড়া আর বের ই হয় না। আমি যতক্ষণ স্কুলে থাকি, ততখন ই ভালো লাগে। বাড়িতে ভালোই লাগেনা। বুঝতে পারলাম এই ছোট মেয়েটার মাঝেও একধরণের নিঃসঙ্গতা ভর করে আছে। এতো বড় বাড়িতে তিনজনের মাঝে দুইজন বাসায় থাকে তার মাঝে আবার একজন বাসার থেকেও না থাকার মতো। যে কারনে বাসায় হয়তো মেয়েটার ভালোলাগেনা!

—- আচ্ছা তোমার নামটাই তো জানা হলো না?
—- আমার নাম,আশফি রহমান হাসি। আর আপুর নাম তানিয়া রহমান খুশি। আমার আর আপুর নামের মাঝে কেমন যেন একটা মিল আছে তাই আপুর নামটাও বলে ফেললাম স্যর।

—- আচ্ছা ঠিকাছে।

জানেন স্যর, আপু নাকি ছোটবেলায় খুবই হাসতো তাই ওর নাম রাখা হয়েছিল খুশি। বলেই হেসে দিল মেয়েটি।
কথাগুলো শুনেই কেমন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যদি এই খুশির খুশি ভরা মুখটা আবার ফিরিয়ে দিতে পারতাম! যদি তার সাদা কালো জীবনটাতে আবার রঙের ছোঁয়া দিতে পারতাম! এতো কিছু ভাবছি অথচ মেয়েটা’র সাথে আমার সাথে কখনও কথা হবে-কিনা তা নিয়ে রয়েছে ঢের সন্দেহ! তবে দেখা যাক কতদূর করা যায়। সময় বুঝে কথা বলা যায়-কিনা! হাসির ডাকে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরলাম…

—- স্যার, স্যার,,,,
—- ওহ! হা বলো।
—- কি এত ভাবছেন আপনি?
—- কই কিছু না তো।
—- স্যর আপনার নামটাই কিন্তু এখনও বলেননি!

কথাটা শেষে দেখলাম মেয়েটার ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসি। এতো সময় পরে মেয়েটার মুখে হাসি দেখলাম। হাসিটাতে যেন আকাশ থেকে ঘনকালো মেঘ কেটে নীল রঙের মেঘ উড়ছে আকাশে।

—- আমার নাম আকাশ।
—- স্যার,আপনার বাসায় কে কে আছেন?
—- কেউ নেই।

ছোটবেলায় একটা রোড এক্সিডেন্টে মা-বাবা দুজনই মারা গেছেন। তখন থেকেই আমি আমার মামার বাসায় ছিলাম। তিনিই আমার সব খরচ দিতেন। পড়ালেখা করিয়েছেন। বাবার আত্মীয় স্বজন কেউ কোন খোঁজ নেয়নি কখনও। এজন্য মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলে ও নিজেকে কোন একটা শান্তনা দিতাম। অনার্সে ভর্তি করে দেওয়ার পরে আমার আর কোন খরচ মামা দিতেন না। আর না দেওয়াটা অবশ্য স্বাভাবিক। আর কতো খরচইবা তিনি দিবেন! তখন থেকেই আমার পড়াশোনার খরচ আমিই চালাই।

আমি একটা পার্ট টাইম জব করি আর এইবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। মামা মামীর সাথে এখন কোন সম্পর্ক নেই। কারন মামী আমাকে একদমই পছন্দ করেন না ।মামা তাও আমায় এতদুর পড়ালেখা করিয়েছেন। কিন্তু মামীর কথায় মামা ত্যক্ত হয়ে আমায় চলে যেতে বলেন।
আমিও চলে আসি,আর কতদিন তাদের ঘাড়ে পড়ে খাবো। তাই চলে এসেছি। তবে এখন মাঝেমাঝে মামা’র সাথে যোগাযোগ রাখি। কারন হাজার হলেও আমাকে সে পড়াশুনা করিয়েছে বড় করেছে। তার কাছে আমি ঋণী। হাসি শুধু হা হয়ে আমার কথা গুলো শুনছিল। আমি হঠাৎই আড্ডা দেওয়ার ইমেজটা নষ্ট করে দিয়ে বললাম….

—- গল্প অনেক হলো এইবার বই খুল।
—-স্যার,স্যার! প্লিজ আজকে কিছুই পড়বোনা।
—- কেন? হাসি একটু মুচকি হেসে বললো,
—- আজকে তো আমাদের পরিচয় পর্ব চলবে। আমি ও হেসে দিলাম ওর কথায়। আমার হাসি দেখে বোধহলো ও বেশ খুশি।
—- আপনি কি জানেন! যারা আমাকে প্রাইভেট পড়াতো বা পড়াবে, তারা সবাই আমাদের বাসায় থেকে পড়াতো ও পড়াবে। আপনার ও আমাদের বাসায় থেকেই পড়াতে হবে।
—- হুম, আমি জানি। এ কথা প্রথমেই তোমার বাবা আমাকে বলে রেখেছেন।

প্রথম দিনটা পরিচয় হওয়া আর গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসলাম হাসিদের বাড়ি। আমি হাসিকে অফিস থেকে আসার পর সন্ধ্যায় পড়াই। আজ হাসিকে পড়ানো শেষ করে রুমে যাওয়ার সময় দেখি খুশি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।স্পষ্ট না দেখলেও, মনে হচ্ছে সে চোখ মুছতেছে। নাক টানার শব্দ কিছুটা পেলামও বটে। তার মানে সে কাদঁছে। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তার কাছে যাওয়া ঠিক হবে-কিনা তাও বুঝে উঠতে পারছিনা! সঙ্কোচবোধটা কাটিয়ে, ওর কাছে গিয়ে বললাম….

—- আসতে পারি? খুশি আমার দিকে তাকিয়ে একটু ভড়কে যাওয়ার মতো আমার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে বলল,

—- জ্বী আসুন।

আজকে তিনদিন হলো এই বাসায় আছি। তবে আজকেই প্রথম মেয়েটির কন্ঠস্বর শুনলাম। মেয়েটির কন্ঠও মেয়েটির মতই বেশ সুন্দর। বেশ চিকন কন্ঠ। আমি কাছে যেতেই ভালো করে চোখ দুটো মুছে নিলো। কিন্তু গালে কান্নার ছাপ টা স্পষ্ট লেগে আছে।

—- আপনি এখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন যে?
—- এমনি ই দাঁড়িয়ে আছি। আর আপনি হঠাৎ এখানে কেন এসেছেন?
—- বলতে পরেন অনিচ্ছাকৃত। তাছাড়া হাসিকে পড়িয়ে রুমে যাচ্ছিলাম। দেখলাম আপনি একা দাঁড়িয়ে আছেন তাই আসলাম একটু পরিচিত হতে।
—- আমার ভালো লাগছে না,আমি আসছি।

কথাটা বলেই রুমে চলে গেল খুশি। কি অদ্ভুদ মেয়েরে বাবা! স্বামী মারা গেছে বলে কি কারো সাথেই কথা বলা যাবেনা নাকি? হটাৎ অঘটনে মেয়েটা মেন্টালী বেশ আঘাত গ্রস্ত। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওদের বাসায় ভালোই যাচ্ছে দিনগুলি। হাসির সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু খুশিটা কে কোন মতেই খুশি করতে পারছিনা। তবে এখন আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক। আগে তো প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতো না। এখন প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় বটে আর হাসি কে পড়ানোর সময় পাশে বসে থাকে। এখন নাকি তার একা থাকতে ভালো লাগেনা। এটা একটা ভালো লক্ষণ। বোধহয় শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

প্রায় তিন মাস হয়ে গেল হাসি কে পড়াচ্ছি। খুশির মানুষিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। এখন ভার্সিটিতে ও যায়। খুশি এইবার অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী মারা যাওয়ায় মেয়েটা পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে মনে হয় ওর মনের কষ্ট টা মনেই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। ভার্সিটি যাওয়ার দিনগুলি ছাড়া বাকি দিনগুলি দরজা আটকে বসে থাকে। এখনো সাদা শাড়ী পড়ে থাকে! ভালো লাগেনা একদম। কি ভুত চাপে মাথায় সে-ই জানে! কিছুদিন পরে আমার খুব জ্বর হলো। অসুস্থ শরীরে বিকেলে অফিস থেকে আসার পর থেকেই শুয়ে আছি। হাসি কে পড়াতেও যাই নি। রাত ন’টার পরে হাসি খুশি দুজনই আমার রুমে আসল। তাদের রুমে আসতে কোন সমস্যাই হলো না কারন আমার রুমের দরজা কখনই লক করা থাকেনা। আমাকে ডাকতেই আমি একটু কষ্ট হলেও উঠে বসলাম। হাসি বলল,

—- স্যার আপনার কি শরীর খারাপ? আজকে পড়াতে আসলেন না যে?
—- হ্যাঁ কিছু টা অসুস্থ। কথা বলা শেষ করতেই হাসি কাছে এসে, কপালে হাত দিয়ে বলল,

—- ওরে বাবা! আপুরে স্যারের তো অনেক জ্বর। হাসি জ্বর কথাটা বলতেই খুশি বলল।
—- তুই বসে থাক তোর স্যারের কাছে, আমি আসছি।বলে বাইরে চলে গেল। একটু পর খুশি হাতে একটা ঔষধের বক্স আর বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো এবং সাথে কিছু খাবার। আমার মাথায় পানি ঢালতে লাগল। এমন করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারো টা বাজে প্রায়। আমি বললাম,
—- আপনার রুমে যান ।ঘুমিয়ে পড়ুন না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো। ততক্ষনে হাসি আমার বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ছে। খুশি বলল,

—- আপনি আগে খাবার আর ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তবেই আমি চলে যাব। আপনি এখন আমাদের বাসায় থাকেন। আপনার ভালো-মন্দ দেখাটা আমাদের দায়িত্ব। আমি খাবার খেয়ে ঔষধ খাওয়ার পর খুশি রুম থেকে হাসিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।এই সাদা শাড়ী পড়া গম্ভীর মেয়েটার মনে যে এত দয়ামায়া আছে তা আজ বুঝতে পারলাম।

পাঁচদিন পর আমি সুস্থ হলাম। এই পাঁচটা দিন হাসি ও খুশি দুজনই আমার অনেক সেবা-যত্ন করেছে। সুস্থ হওয়ার পর অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম আমার চাকরি টা আর নেই। পাঁচ দিন অনুপস্থিতির কারনে চাকরিটা চলে গেছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মনটা খুবই খারাপ। পড়াশোনার খরচ,খাওয়ার খরচ সব তো আর প্রাইভেটের বেতন দিয়ে হবেনা। কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। পড়ানোর সময়ও মন খারাপ করে পড়ালাম। আমার মলিন মুখ দেখে হাসি কি হয়েছে তা জানতে চাইল, প্রথমে বলতে না চাইলেও পরে হাসি কে সব খুলে বললাম। ও বোধহয় বলল,খুশি কে। আর সে বোধহয় গিয়ে বললো তার বাবাকে। পরের দিন ওর বাবা রহমান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কুশল বিনিময় ও হাসির পড়ালেখার খোঁজখবর নেওয়ার পর তিনি বললেন,

—- বাবা আকাশ, শুনলাম তোমার নাকি জবটা চলে গেছে?
—- জ্বী আঙ্কেল,জ্বরের কারনে পাচঁদিন যেতে পারি নি, তাই চাকরিটা চলে গেছে।
—- সমস্যা নেই, তুমি চাইলে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে পারো।

এতে তোমার ও আমাদের সবার ই ভালো হবে। কারন তোমাকে এখন আমরা আমাদের পরিবারের ই একজন ভাবি। আঙ্কেল আমার জন্য এতটা করবেন তা ভাবতে পারি নি। উনার মনটা আজ বোধহয় ভালো,তাই ভাবলাম আজ তাহলে কথাটা উনাকে বলেই দেই। খুশি’কে সেই প্রথমদিন থেকেই পছন্দ করি, যা এতদিনে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। কিন্তু খুশি কে কথাটা জানানো হয়নি, কারন ও কখনোই এটা মেনে নিবে না। তাই আঙ্কেলকে সবকিছু বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি খুব সাহস নিয়ে তখনই বলে ফেললাম,

—- আঙ্কেল আপনাকে একটা কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দেন তো!
—- অনুমতি নেয়ার কি কি আছে বাবা! তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার। বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললাম,

—- আপনি যদি রাজি থাকেন তো আমি খুশি কে বিয়ে করতে চাই। কথাটা বলা মাত্রই আমার বুকে যেন এক ধরনের ভয় জমাট বাঁধতে শুরু হলো। কথাটা শুনে আঙ্কেল খুবই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আঙ্কেল আমার অতীত বর্তমান সবই জানতেন। বললেন,

—- না বাবা, তা হয়না।
—- কেন হয়না আঙ্কেল? আমি খুশি কে খুব ভালো রাখব। আমি তার অতীত টা ভুলিয়ে রাখব। কোন কষ্ট পেতে দিব না। ওর কষ্টগুলো দূর করে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। দয়া করে আমায় ফিরিয়ে দিবেন না।
হাত জোর করে অনুনয় করে কথাগুলো বললাম। আমার আকুতি দেখে পরে বললেন,

—- আচ্ছা ঠিক আছে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে খুশি যদি রাজি থাকে! প্রয়োজনে তুমি সারাজীবন আমার মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়িতেই থেকে যাবা। কিন্তু খুশি কি রাজি হবে? আমি বললাম,

—- খুশি কে রাজি করার দায়িত্বটা না-হয় আমার। বলে উনার রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। পরের দিন সকালে,খুশির ডাকেই আমার ঘুম ভাঙলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১০টা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম।

—- আপনি আমার রুমে???
—- হুম আমি। কি শুরু করেছেন আপনি হা? আমি তো এমন কিছু কিন্তু আপনার কাছ থেকে আশা করিনি।
আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না খুশি কি বলতে চাইছে। আমি বললাম,

—- কেন? আপনি একজন বুদ্বিমতি এবং যথেষ্ট শিক্ষিত মেয়ে। আপনি কি এটা বুঝেন না যে মানুষ একদিন মারা যাবেই। তবে কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনা। জীবনকে একটা সুযোগ দিতে হয়।এভাবে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার আপনার নেই।

—- জীবনটা আমার। তাই কি করবো কি করবোনা সেইটা আমার ব্যাপার।
—- তাই বলে জীবন নষ্ট করা! এটা শুনে ও বলল,
—- কিন্তু আমি তো রায়হানকে কথা দিয়েছিলাম জীবনসঙ্গী হিসেবে ও কে ছাড়া আর কাউকেই গ্রহন করবোনা। সেটার কি হবে?

—- হুম বুঝলাম। কিন্তু আপনি তো রায়হান থাকাকালীন নতুন কাউকে গ্রহন করেন নি। আপনার বাচাঁর জন্য একটা আশ্রয় দরকার। আমি আপনার আগের খুশি মুখটা আবার দেখতে চাই। আপনার সাদা কালো জীবনটাতে আবার ও দিতে চাই রঙের ছোঁয়া। খুব ভালো রাখব আপনাকে, কখনো কষ্ট পেতে দিব না কথা দিচ্ছি। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। তারপরও খুশি রাজি হতে চায় নি। তবে হাসি ও রহমান আঙ্কেল অনেক বুঝানোর পর খুশি নিমরাজি হয়। জানি ওর হয়তো মন থেকে আমাকে মেনে নিতে সময় লাগবে, কিন্তু মেনে ও নিবেই। আজকে আমাদের বাসর রাত। রুমে ঢুকতেই দেখি খুশি চোখ মুছছে। ব্যাপারটা দেখে বোধহলো বুকের বা’পাশটাতে লাগলো আমার। আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন আর ও কিনা কাঁদছে। আর ওরই বা কি দোষ? চাইলেই তো আর এত সহজে অতীত কে ভুলে বর্তমান নিয়ে ভালো থাকা যায় না। আমি আস্তে করে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। হাতটা ধরে বললাম,

—- জানো খুশি। আজকে তোমাকে কত সুন্দর লাগছে? ও চুপ করে বসে রইল, কিছুই বলছেনা। বুঝলাম এভাবে হবে না অন্যভাবে বলতে হবে।

—- জানি তুমি রায়হান কে ভুলতে পারছনা। কিন্তু জানো তো, অতীত অতীতই! যা কখনই ভবিষ্যৎ বা বর্তমান হতে পারেনা। বুঝতে পারছি তোমার জীবনে একটা দুঃখজনক অতীত ঘটে গেছে। তাই বলে কি তুমি ওটার কথা ভেবে বর্তমানের জীবনের সময়টা নষ্ট করবে? তুমি কি এখন ওইসব মনে করে এমন কাউকে কষ্ট দিবে! যে কিনা সর্বদা তোমাকে খুশি দেখতে ব্যস্ত?এখন আমি তোমার জীবনে আছি। তোমার সব দায়িত্ব আমার। এরপরও যদি তোমার মনেহয় যে তুমি আমায় মেনে নিতে পারবে না। তাহলে কথা দিচ্ছি কখনো তোমার সামনে আসবো না, বহুদুর চলে যাব। কথাটা বলার সাথে সাথে চোখের পানি মুছতে মুছতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

—- আমি পারছিনা আকাশ, রায়হান কে ভুলতে পারছিনা। কি করবো আমি? ও যে আমার প্রথম ভালোবাসা। কিভাবে ভুলবো বলো। কথাটা বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলো খুশি। আমি আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—- জানি প্রথম ভালোবাসা কে ভোলা যায়না। তবে আমি চেষ্টা করবো ভুলিয়ে দিতে। প্রথম ভালোবাসার স্তরটা ঢেকে দিবো আমার ভালোবাসার চাদর দিয়ে।

জানোই তো কারো জীবনে প্রথম ভালোবাসা হওয়াটা তেমন কঠিন কিছু না। তবে কারো জীবনে শেষ ভালোবাসা হওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। সব শুনে খুশি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমি বাঁধা দিলাম না,কাঁদুক ও এখন। আর কখনো কাঁদতে দিব না মেয়েটাকে। আজকে আমাদের বিয়ের এক বছর গত হলো। এখন প্রতিদিন আমার খুশির খুশি মুখটা দেখেই ঘুম থেকে জাগি আবার রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। সুখেই কাটছে আমাদের দিনগুলি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত