লাল ভালবাসার গল্প

লাল ভালবাসার গল্প

— আবির শনিরআখড়া যাওয়া লাগবে দোস্ত?

— শনিরআখড়া যেতে হবে কেন?

— একজনের ইমার্জেন্সি এ নেগেটিভ রক্ত লাগবে। তোর তো এ নেগেটিভ।

— তো আমি কি করবো?

— কি করবি মানে? রক্ত দিবি তুই। চল আমার সাথে।

— আমি যাবো না। আমার ভয় লাগে।

— বাচ্চা পোলাপান নাকি তুই? রক্ত দিতে ভয় পাওয়ার কি আছে তোর?

— নাহ আমি যাবো না। আমার অনেক কাজ আছে।

— তোর কাজের গুল্লি মারি। এখনই চল আমার সাথে। নয়তো থাপড়াইয়া কানের তলা ফাটিয়ে দেব।

আবির আর কোন কথা না বলে আমার সাথে হাঁটতে শুরু করলো। থাপ্পড় খাওয়ার ভয়ে আমার সাথে আসছে নাকি এমনিতেই আসছে বুঝতে পারলাম না। আমি আবিরের এক হাত চেপে ধরে ওকে বাসে উঠালাম। তারপর রোগীর আত্মীয়কে ফোন দিয়ে বললাম রক্তের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। লোকটা আমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবে তা নাকি ভেবে পাচ্ছে না। আমি খট করে ফোন রেখে দিলাম। লোকটার এখন তার আত্মীয়ের পাশে থাকাটাই জরুরী, আমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবে তা ভাবা জরুরী নয়।

— দোস্ত আমার ভয় লাগে সুই দেখলে। আমি যদি ভয়ে মরে যাই তাহলে সব দোষ তোর।

— আচ্ছা সব দোষ আমার। চেপে বসে থাক। রক্ত দেয়া শেষ হলে আমরা বিরিয়ানি খাবো। টাকা তুই দিবি।

— রক্ত দিবো আমি আবার বিরিয়ানির বিলও আমার? মগের মুল্লুক নাকি?

— না এটা জগের মুল্লুক।

আবিরকে নিয়ে শনিরআখড়া নামলাম। সাদার উপর কালো চেকশার্ট পরা এক মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে।

— আপনার নাম আরমান? আমার মেয়েটাকে রক্ত দেয়ার কথা হয়েছিল আপনার সাথেই?

— হ্যা আমার নামই আরমান। তাড়াতাড়ি চলুন।

লোকটা আর কথা বললো না। রাস্তার পাশেই একটা সিএনজি দাঁড় করানো ছিল। লোকটা আমাদেরকে সিএনজির ভেতরে বসতে বললেন। আমরা বসে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে জানতে পারলাম যে লোকটার মেয়ে প্রেগনেন্ট। ডেলিভারি ডেটের আগেই নাকি ব্যাথা উঠেছে। এখন মেয়েটা হাসপাতালে আছে। ব্লাড ব্যাংক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় হয়ে গেছে। তবে ডাক্তার বলেছে যে আরো রক্ত লাগতে পারে। তাই আরো রক্ত জোগাড় করার জন্য তারা ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে পোষ্ট করে। আমিও তাদের খবর পেয়েছিলাম ফেসবুক থেকেই। হাসপাতালে রোগীর স্বামী, শাশুড়ি, শশুড় আর ননদের সাথে পরিচিত হলাম। আমরা আমাদের নাম বললাম। সবার মুখে শঙ্কার কালো মেঘ।

হাসপাতালে এসে পৌছানোর একটু পরেই রোগীকে ওটিতে নেয়া হলো। আমি আর আবির বাইরে অপেক্ষা করছি। হাসপাতালের ভেতর নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না বলে আমি মোবাইলে একটা বই পড়তে শুরু করলাম। আর আবির বসে বসে নখ কামড়াতে লাগলো। ছেলেটা নার্ভাস হয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে। আমি যখন প্রথমবার রক্ত দিয়েছিলাম তখনও আমি এমন নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু দেয়া শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এর চেয়ে সহজ আর কোন উপায় হতে পারেনা।

এরই ফাঁকে একজন নার্স এসে আবিরের কাছ থেকে এক সিরিঞ্জ রক্ত নিয়ে গেছে পরীক্ষা করানোর জন্য। সুঁই দেখে আবিরের মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। নিত্যন্তই বাধ্য হয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বসে ছিল। যদি রোগীর ননদ না থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো। এরপর বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল। আমরা ভেবেই নিলাম যে রক্ত আর লাগবে না। কিন্তু আমাদের ভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে হঠাৎ একজন নার্স এসে বললো রোগীর অবস্থা ভাল না। আরো রক্ত লাগবে। আমি আবিরকে দেখিয়ে দিয়ে নার্সকে বললাম,

— ইনিই ডোনার। পারলে উনার শরীর থেকে সব রক্ত নিয়ে নিবেন। ও যে পরিমান খায় একদিনে আবার রক্ত হয়ে যাবে।

আমার কথায় নার্স অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। এমন সিরিয়াস মূহুর্তে এমন জোকস তিনি হয়তো মেনে নিতে পারেননি। নার্স যখন আবিরকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি হাসি দিয়ে সাহস যোগানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হলে চেষ্টা সফল হয়নি। অবশেষে অপারেশন শেষ হলো। মা আর সন্তান দুজনেই সুস্থ। ডাক্তার বলে গেল যে শেষের রক্তটুকু না পেলে নাকি বিপদ হতে পারতো। একথা শুনে রোগীর আত্মীয় স্বজন পারেনা আমাদের মাথায় উঠিয়ে বসিয়ে রাখে। রোগীর স্বামী আর বাবা তো বারবার এসে আমার আর আবিরের হাত ধরে চাপাচাপি করছে। আমাদের ধন্যবাদ দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেল। রোগীর শাশুড়ি এসে আবিরের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিল। আমরা একটু পর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। মাঝবয়সী লোকটা আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললো,

— বাবা কিছু মনে করোনা। তোমার বন্ধুর জন্য ফলমূল কিনে নিয়ো। আমার উচিত ছিল তোমাদের জন্য কিনে নিয়ে আসা। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছো!

— আঙ্কেল টাকাটা আপনার কাছে রেখে দিলেই খুশি হবো। এই টাকাটা আপনারই এখন বেশি দরকার। কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল, বিনিময়ে কিছু পাওয়ার জন্য রক্ত দিতে আসিনি। তবে আপনি কিছু দিতে চেয়েছেন খুশি হলাম। তবে এই টাকাটা আমরা নিতে পারবো না।

আরো কিছু কথা বলে আমরা চলে এলাম বাইরে। আবিরের নাকি মাথা ঘুরছে। প্রথম বার রক্ত দিচ্ছে তো তাই ভয়ে ওর মাথা ঘুরছে। ওকে নিয়ে বিরিয়ানির হোটেলে ঢুকে দুজনে মিলে সাড়ে পাঁচ প্লেট বিরিয়ানি সাবড়ে দিলাম। যদিও বিলটা আবিরের দেয়ার কথা ছিল কিন্তু মাথা ঘোরার ফলে নাকি সে মানিব্যাগ বের করতে পারছে না। আমি ওর লজিক শুনে মুচকি হেসে বিল দিয়ে বের হলাম হোটেল থেকে। পাঁচদিন পর একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। অপরিচিত নাম্বারটাকে আবার একটু পরিচিতও মনে হচ্ছিল। চট করে ফোন ধরে ফেললাম,

— হ্যালো!

— তুমি আরমান না? আমার কথা মনে আছে? কিছুদিন আগে আমার মেয়েকে রক্ত দেয়ার জন্য তোমার বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলে।

— ওহ আঙ্কেল! কেমন আছেন? আপনার মেয়ে আর বাবু কেমন আছে?

— তোমাদের দোয়ায় ভাল আছে। সেদিন তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেলা। আমার নাতিটাকে দেখে গেলা না। আগামী শুক্রবার নাতির আকিকা হবে। তোমরা দুজনে এসে আমার নাতিকে দেখে যাবে কিন্তু। আমি শনিরআখড়া থাকবো। তোমরা আসবে কিন্তু। এটা আমার অনুরোধ।

— আচ্ছা আঙ্কেল আসবো। এটা আপনারই নাম্বার?

— হ্যা এটাতে ফোন দিলেই আমাকে পাবে। সেভ করে রাখো।

আমি ফোন কেটে দিয়ে আবিরকে ফোন দিলাম। বলে রাখলাম শুক্রবারে দাওয়াত আছে। দাওয়াতের কথা শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলো। শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষ করে আমি আবিরকে নিয়ে বাসে উঠলাম। শনিরআখড়া যাওয়ার কথা শুনে আবির বললো,

— আবারো রক্ত দেয়া লাগবে নাকি? তুই না বললি চারমাসের আগে রক্ত দিতে পারবো না।

— আরে রক্ত দেয়া লাগবে না। আঙ্কেলের কথা মনে আছে? উনার নাতির আকিকায় যাচ্ছি আজকে।

কথা বলতে বলতে আমরা শনিরআখড়া চলে এলাম। সেই আঙ্কেল রাস্তার পাশেই ছিলেন। আমাদের দেখে এগিয়ে আসলেন। আমরা তাকে সালাম দিলাম। তিনি আমাদের পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন। তারপর একটা সিএনজি নিলেন। দশমিনিটে আমরা তাদের বাড়ি পৌছে গেলাম। ছোটখাটো সামিয়ানার নিচে চারটা টেবিল আর চেয়ার পাতা। ছোটখাটো আয়োজন করেছেন বোধহয়। আমরা চেয়ারে গিয়ে বসতে যাবো এমন সময় আঙ্কেল বললো,

— আমার নাতিকে দেখবা না?

— ওহ আঙ্কেল চলেন দেখে আসি।

আঙ্কেলের সাথে ঘরে গেলাম। রোগীর শাশুড়ি, ননদ আরো কয়েকটা মহিলা ছিল ঘরে। আর বাচ্চা কোলে একটা মেয়ে ঘোমটা টেনে বসে ছিল। বুঝতে পারলাম ইনিই সেই রোগী যাকে আবির রক্ত দিয়েছিল। আমরা দুজনেই মেয়েটার সাথে পরিচিত হলাম। মেয়েটা আমার কোলে বাচ্চাটাকে দিল। বাচ্চাটা পিটপিট করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। কি নিষ্পাপ চাহনি। আমি আমার কোল থেকে বাচ্চাটাকে আবিরের কোলে দিলাম। আবির সাবধানে কোলে তুলে নিয়ে মেয়েটাকে বললো,

— ওর নাম কি রেখেছেন?

— ওর নাম আরমান আহমেদ আবির।

নাম শুনে আমরা দুজনেই চমকে তাকালাম মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তখন মুচকি হাসছে। আঙ্কেল আমার আর আবিরের কাঁদে হাত রেখে বললো,

— তোমাদের নামেই নাম রাখলাম। হয়তো এই নামের গুণে আল্লাহ আমাদের নাতিটাকে তোমাদের মতই পরোপকারি বানাবেন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত