ছবি

ছবি

চাকরি পেয়েছি, খুব বেশিদিন হয়নি। সরকারি চাকরি, মাস শেষে বাইশ হাজার টাকা মাইনে পাই। জীবনটাকে এবার একটু গুছিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। ইচ্ছে ছিল মাইনের টাকা জমিয়ে, পুরো বাংলাদেশটা একবার হলেও ঘুরে দেখব। অন্তত এত তাড়াতাড়ি সাংসারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইনি। তবে বাবা মায়ের পিড়াপীড়িতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই বিয়ের জন্যে রাজি হয়ে বললাম, “আপনাদের যা ইচ্ছা করুন”।

বিয়ে আমি অবশ্যই করতে চাই। ছোটোবেলার সুপ্ত পুরুষ থেকে জাগ্রত পুরুষ হওয়া পর্যন্ত সকল পুরুষ মানুষই বিয়ে করবার এক অপার্থিব ইচ্ছা পোষণ করে। তবে ঠিক এখুনই না। আমার প্রায়সই মনে হয়, আমি বোধয় বিয়ে করার মত প্রাপ্তবয়স্ক হইনি। নিজের ভেতরে কৈশরের এক আধটু ভাবখানা যেন রয়েই গেছে। মা অবশ্য আমাকে বোঝেন। কিন্তু বাবা তা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ” ওসব কিছু না। বিয়ে করলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।” সে যাই হোক এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে বিয়ে না করে আর রক্ষা নেই।

সন্ধ্যে বেলায় পালঙ্কের উপর আয়েশ করে বসে, সাদা বালিশ খানার উপর পিঠ চেপে, হেলান দিয়ে রবী ঠাকুরের ডাকঘর পড়ছিলাম। ঠিক তখনই দোলা এসে আমার ঘরে ঢুকলো। এসে বলল ভাইয়া, “দেখ তোর বউয়ের ছবি।” দোলা আমার ছবছরের ছোটো বোন। এক মাত্র বোন বলে ও আমার এবং পরিবারের ভীষণ আদরের বোন। কিন্তু আজ কেন যেন ওর পাকামোটা আমার সহ্য হলো না। বললাম, “বিদেয় হ চোখের সামনে থেকে।” খানিকটা মন ভাঙানিয়া কষ্ট নিয়ে ও ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল।

জানিনা কি মনে করে ওকে আবার ডাক দিলাম, “দোলা শোন, ছবিটা টেবিলের উপর রেখে যা।” দোলা আমার দিকে একটা বিদ্রুপের মুচকি হাসি দিয়ে, আর চোখে এক অজানা জয়ের তাচ্ছিল্য নিয়ে ছবিটা টেবিলের উপর রেখে, ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি মনে মনে বললাম, ” ছবি দেখারই বা কি আছে। আমার মর্জিতে তো আর বিয়েটা হচ্ছে না। ছবি আমি দেখব না। পড়ে থাকুক টেবিলের উপরে।” আমি আমার বই পড়তে লাগলাম। কিন্তু কেবলই বইয়ের লাইন গুলিয়ে ফেলছি। বুঝতে পাড়লাম, আমি পড়ায় মন দিতে পারছিনা। আমার মন পড়ে আছে, টেবিলের উপর রাখা ছবিটার উপর। ছবিটা উলটে দেখার, এক প্রবল শক্তিশালী ও অদৃশ্য টান অনুভব করছি।

আমাকে যেন দেখতেই হবে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বাধ্য হলাম ছবিটা দেখতে। খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। পড়েছে লাল পাড়ের, হলদে শাড়ী, লম্বা কালো ঘন চুল, আর হাতে লাল রেশমী চুড়ি। চোখে দিয়েছে কাজল আর কপালে ছোট্ট লাল টিপ। চাপা চন্দ্রাকৃতির গোলাকার ফর্সা মুখখানির মাঝে ও এক ফুটো লাল টিপ যেন, সমস্ত জগত সংসার কে তার কেন্দ্রের দিকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করছে। মনের অজান্তেই অস্পষ্ট স্বরে বলে ফেললাম, ” অপূর্ব। সাড়া জীবন আমি তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।” ছবিটা রাখতে গিয়ে দেখলাম পেছনে লেখা আকলিমা। নামটা পছন্দ না হলেও মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

পরদিন থেকেই আমার ভেতর থেকে কিভাবে যেন সমস্ত কৈশরের ছাপ চলে গেল, হাটা চলনেও পুরুষ পুরুষ ভাব। পঞ্জিকার পাতা যেন আর উলটোতেই চাইছে না। বিবাহ তো সামাজিক বন্ধন, কিন্তু আকলিমাকে নিজের করে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনের মাঝে বাসা বেধে চলেছে। সমস্ত অধিকার নিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কাছে বলতে চাই, আকলিমা শুধুই আমার। শেষমেশ পঞ্জিকার পাতা উলটোতে উলটোতে সেই দিন চলে আসল। কবুল বলে আকলিমাকে আমার বউ করলাম। কিন্তু ওর এত লম্বা ঘোমটা আমাকে আরও বিচলিত করতে লাগল। বারবারই মন বলছিল, একটু ঘোমটা তুলুক। ছবি থেকে হয়ত সামনা সামনি আরোও অনেক সুন্দর।

বউ নিয়ে বাড়ী পৌছুতেই দেখলাম মা আর দোলা আমাদের বরণ করে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত। সেই আদি কাল থেকে চলে আসা রীতি নীতি মেনে আমাদের বরণ করে বাড়ীর চৌকাঠে প্রবেশ করানো হলো। তার পরেও বউয়ের সাথে চলল আরও অনেক রীতিনীতি পালন। বাসর ঘরে ঢুকে দেখি ঘর অত্যন্ত সুন্দর করে গোলাপ, গোলাপের পাপড়ি, রজনীগন্ধা ও আরো নাম না জানা আধুনিক ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর বিছানার মাঝে বিশাল ঘোমটা দেয়া বউ, তার আলতা রাঙা চরণ দুখানা বের করে বসে আছে।

পাশে গিয়ে বসে আকলিমার ঘোমটা উম্মোচন করলাম। অপূর্ব, যেন বিধাতা তার সমস্ত শৈল্পিক গুণ এ চেহারায় দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে পছন্দ হয়েছে তোমার?” সে মাথা নাড়িয়ে লাজুক চোখে হ্যা সূচক জবাব দিল। আমি বললাম, ” আজ থেকে এ আমি, আমার সংসার, আমার বাবা মা, বোন, সব তোমার। মানিয়ে নিতে পারবে তো ?” এবার সে ঘার কাত করে হ্যা সূচক জবাব দিল। আমি বললাম, তোমার মুখে একবার ভালোবাসি শুনতে চাই”। সে ইশারায় বোঝাল সে আমাকে ভালোবাসে। আমি বললাম ” ইশারায় বলছো কেন? মুখে বলো।” সে কিছু না বলে মাথা নুইয়ে রাখল। কেমন একটা খটকা লাগল। আমি বললাম, ” কি হয়েছে? তুমি কি কথা বলতে জানোনা নাকি?” সে ঘাড় নেড়ে বোঝালো সে কথা বলতে জানেনা।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তীব্র রাগ আর অভিমানে আমি ছুটে বেড়িয়ে আসলাম বাসর ঘর থেকে। এসে চিৎকার করে বললাম, ” বাবা, আপনি আমাকে এক বোবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন?” বাবা দড়াজ গলায় বললেন, “তাতে কি হয়েছে? মেয়ে সুন্দরী, লক্ষী আর সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।” এই প্রথম বাবার মুখের উপর বললাম,” এ তো আমার সাথে প্রতারণা হল। আমি এ মেয়ের সাথে সংসার করতে পারব না।” বাবা বললেন, “চুপ করো। বউমা শুনতে পাবে। রাত দুপুরে বাড়ী মাথায় তোলার কিছু নেই। বোবা মেয়েকে বিয়ে করলে পূণ্য হয়। এখন নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আর একটাও কথা না।”

বাবার উপর কথা বলার সাহস আমার কখনোই ছিল না। তাই ঘরে চলে এলাম। এসে দেখি আকলিমা ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেছে। আমি বিছানাতেও বসলাম না। পড়ার টেবিলের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটা কান্নার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম, আকলিমা সব শুনেছে। আর তাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। কিন্তু আমার এতটুকু মায়া হলো না। আমার সাথে প্রতারণা হয়েছে। তাছাড়া ওর সাথে কথা বলার জন্যে কতদিন অপেক্ষা করেছি। কেউ আমাকে জানাতে পারত অন্তত, আকলিমা বোবা। এই সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতে জানিনা কখন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছি। সকালে উঠে দেখি বিছানা শূন্য। বিছানার উপরে একটা চিঠি রাখা। তাতে লেখা,

“আমি জানতাম না আমার বাক প্রতিবন্ধকতার কথা তোমাকে জানানো হয়নি। যেদিন তোমার ছবি দেখেছিলাম, আমি সেদিনই তোমাকে ভালোবেসেছি। আর অনেক স্বপ্ন নিয়ে তোমার সংসার করতে এসেছিলাম। কিন্তু এমন হবে আমি ভাবিনি। তবে বিশ্বাস করো, ভালোবাসি কথাটা শুনতে না পেরে তোমার যতটা কষ্ট হয়েছে, ভালোবাসি বলতে না পারাতে তার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার। কারণ আমি কতটা ভালোবাসি, তা কখনোই মুখে প্রকাশ করতে পারব না। ভালো থেকো।” আমি বললাম,” গেলে যাক। আপদ বিদেয় হয়ছে।” বাবাকে শুনিয়েই বললাম, “আপদ চলে গেছে আমার মুক্তি হয়েছে।” বাবা মাথা নুইয়ে পত্রিকায় মন দিল। আমি ঘর থেকে বেড়িতে গেলাম।

সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপড়ে বেড়িয়েছি ঘর থেকে। দেড় ঘন্টা লাগল। সেভাবেই শশুড়বাড়ি এসে উপস্থিত হলাম। শাশুড়িকে দেখেই কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, “মা আকলিমা কোথায়?” উনি উপরের ঘরের দিকে ইশারা করে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। আমি সুযোগ না দিয়ে ছুটে গেলাম দোতলার ঘরে। ধপাস করে কাঠের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম। আকলিমা পালঙ্কে বসে কাঁদছিল। আর আমার শ্যালিকারা তাকে ঘিরে কারণ জানার চেষ্টা করছিল। কি হয়েছে, কেন কাঁদছে, কেন বিয়ের পরদিন সকাল বেলা চলে এলো ইত্যাদি। আমাকে দেখে সবাই একটা হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি গিয়ে আকলিমার সামনে দাড়ালাম। সে একবারও আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। শুধু অশ্রু মুছে মুখটাকে শক্ত করে রাখল। আমি ওর সামনে হাটু গেড়ে বসলাম। ওর হাত দুটো আমার বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে বললাম, “আমি যখন প্রথম তোমার ছবি দেখি, সে ছবিতে তুমি কথা বলোনি। আমি তাই দেখে ভালোবেসেছিলাম। আমার চাইনা তোমার গলার স্বর।

আমি বুঝে গেছি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। বিশ্বাস করো, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। গতকালের জন্যে আমায় ক্ষমা করে দাও।” সে এক কঠিন মুখ করে অপর দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম, “আকলিমা, আমি তোমায় নিতে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাড়ী ফিরে চলো।” সে আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। আমি নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাঞ্জাবীর কোণায় একটা টান অনুভব করি। ফিরে দেখি আকলিমা আমার পাঞ্জাবীর কোণা খাঁমচে ধরে আছে। আর অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমি কাছে এসে বসলাম। আর কানের কাছে ফিস ফিস করে বললাম, “কাঁদলে কিন্তু তোমাকে আরোও সুন্দর লাগে।” এ কথা শুনে আকলিমা ফিক করে হেসে দিল। ওর হাসিটা যেন আমার অন্তরে এক স্বস্তির সঞ্চার করল।

শশুড়বাড়ির সবার সামনে ওকে কোলে করে নিয়ে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলেও আমাকে কেউ কিছু বলল না। এমনকি খেয়ে যাওয়ার কথা বলারও সাহস হচ্ছিল না। কারণ আমি যখন আকলিমাকে কোলে নিয়ে হাটছি, আমাদের চোখ ছিল একে অপরের চোখের দিকে। ঠোঁটে ছিল হাসি। এমন ভালোবাসার মুহূর্তে কেউ তৃতীয় পক্ষ হয়ে কথা বলে বিরক্ত করবার সাহস বা মন, কারো হবার কথা নয়। গাড়ীতে করে বাড়ী ফেরার আগ পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা আকলিমা আমার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বসে ছিল। তখন রবী ঠাকুরের শুধু একটাই কথা মনে পড়ছিল আমার। “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত