তৃণা তোরে কত দিন বলছি একটু ছোট গলার জামা পরবি, সমস্ত টা দেখা যায়, সাদা চামড়া দেখলে যে ও বাড়ির হাবলু টাও বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সে খেয়াল আছে তোর? হিয়ার কথা শুনে তৃণা ওড়না দিয়ে ডেকে ডানে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝতে পারলো আবির দাদা তার দিকে তাকিয়ে আছে,
হিয়াঃ বুঝলি তৃণা আমার মনে হয় আবির দা তোকে পছন্দ করে,
তৃণাঃ কৃষ্ণ কৃষ্ণ, এ কথা মুখেও আনিস না রে বুনি, আবির দার যে একটা দূর্গা টাইপ মা, সে যদি জানে তার ছেলে আমার দিকে নজর দেয় তাহলে আমাকেই বিসর্জন দিয়ে দিবে, কথা টা বলেই হিয়া আর তৃণা হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেলো।
হিয়া আর তৃণা আপন বোন আর আবির হলো ও বাড়ীর সুকন্যা দেবীর ছোট ছেলে। তবে আবিরের ব্যাপার টা অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা। এই যেমন- এলাকার অন্য ছেলেরা যে বয়সে মাঠে ফুটবল খেলে আবির তখন ঘরে বসে মায়ের সাথে ক্যারাম খেলে, যে বয়সে আবিরের অন্য মেয়েদের দেখে প্রেমে পরার কথা সেই বয়সে আবির মায়ের হাত ধরে কলেজে যায়, আপনার আমার এলাকায় সাধারণত মেয়ের বাবারা এসে বিচার দিয়ে যায় “এই যে মহাশয় নিজের ছেলেকে দেখে রাখবেন, আপনার ছেলে আমার মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে” এই এলাকায় এ হিসেব উল্টো, আবিরদার মা এসে বিচার দেয় “শুনছো বৌদি তোমার মেয়ে আজকে আমার ছেলেকে কথা বলার জন্য ডেকে ছিল” একবার বয় বাড়ীর ভাড়াটের মেয়ে অর্নিমা মোড়ে দাঁড়িয়ে মিনিট ২ আবিরদার সাথে কথা বলেছিল, তাতেই তাদের বিকালের মধ্যে এলাকা ছাড়তে হলো। এর জন্যই এলাকার সবাই আবির কে ছেলেতোমেয়ে বলে।
আপনারা ভাবছেন আবিরের শারীরিক / মানসিক সমস্যা আছে কিংবা আবিরের বাবার অনেক টাকা তাই তার মা এমন করে রাখে ছেলে কে! না মহাশয় কাহিনী হচ্ছে- আবির যখন ৮ মাসের পেটে তখন সুকন্যা দেবী কে এক সাধু বাবা বলেছিল “তোর পেটের ছেলের মেয়ে তেই মৃত্যু ” তাই সুকন্যা দেবী ছেলে কে সব কিছু থেকে দূরে রাখে। মায়ের এত বারণেও ছেলে তো প্রেমে পরেই গেছে,, দেখা যাক আগে কি হয়। কৃষ্ণ পূজা করার জন্য তৃনা অনেকক্ষণ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাকাচ্চা একটা আসলে গাছে উঠিয়ে দিবে কৃষ্ণচূড়া ফুল ছিঁড়ে দিবে তার পরে সেই ফুলে পূজা করবে কিন্তু কারও খোঁজ নেই, আবির তখন থেকেই দেখছিল ব্যাপার টা, বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে,
আবিরঃ কিরে তৃণা ফুল লাগবে বুঝি?
তৃণাঃ হ্যাঁ রঙদা ফুল লাগবে কিন্তু কেও নেই,
আবিরঃ আরে কত বার বলেছি রঙদা বলবি না, কথা টা বলেই আবির গাছে উঠে গেলো আর নিচে থেকে তৃণা বলতে লাগলো “ওও দাদা নামো নামো তোমার মা দেখলে আমাকে বকবে, কে শুনে কার কথা আবির মস্ত বড় ফুলের ঝাড় ভেঙে নিচে নেমে বলল,
আবিরঃ শোন মা মন্দির গেছে আর আমায় রঙদা বলবি না,আবির আর রঙ এক না
তৃণাঃ আমার কাছে সব ই এক দাদা,
আবিরঃ দাদা বলবি না,
তৃণা আর কথা বাড়াই না, মাথা নিচু করে চলে আসে, তৃণার বয়স এখন ১৫ আর আবিরের ২৫ চলে, তাই প্রেম হতে সময় লাগে নি তাদের, সেদিন বিকালে যখন আবির দাদা বলল ” তৃণা তোর সিথিটা শেষ বিকালের গোধূলির মতো রক্তিম আবির দিয়ে রাঙি দিতে চাই” সেদিন আর তৃণা ফিরিয়ে দিতে পারে নি, শুরু হয়ে যায় আবির আর তৃণার প্রেমের গল্প। রাস্তাঘাটে কথা হয় না তেমন যা কথা সব ফোনে তাও রাত ১ টার পরে। সাদা মেঘ আর কাশফুল নিয়ে দূর্গা পূজা চলে আসে, মহালয়ার দিন সকালে, কেও একজন মায়ের চোক্ষু দান করছে এলাকার সবাই সেখানে উপস্থিত শুধু তৃণা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার চেহারা তে ভেসে উঠছে রাজ্যর অভিমান।আবির সব কাজ রেখে আসে তৃণার কাছে,
আবিরঃ কিরে কি হয়ছে আমার ঘরের লক্ষ্মীর?
তৃণাঃ দাদা তুমি যাও তোমার মা দেখলে লঙ্কা কান্ড বেধে যাবে।
আবিরঃ পূজা টা শেষ হলে তোকে ঘরে তুলবো লক্ষ্মী করে,
তৃণাঃ রাখো তোমার ঘরের লক্ষ্মী,
কালকে তুমি ঠাকুর গড়ছিলে আমি বারান্দা থেকে দেখছিলাম তোমার মা এসে পর্দা টেনে দিলো, যে তার ছেলেকে একটু দেখতেই দেয় না সে আবার আমাকে লক্ষ্মী বানাবে, কথাটা বলেই রাগে ফুলতে ফুলতে অন্য দিকে চলে গেলো, আবির মুচকি হেসে মনে মনে বলল- পাগলী টা। আবির চিন্তা করে পূজার পরে মায়ের সাথে কথা বলতেই হবে। আজ অষ্টমী, আবির বেশ বেলা করেই উঠে ব্রাশ হাতে বারান্দা তে দাঁড়াতেই চোখ গেলো তৃণা দের উঠানে, সাদা লাল শাড়ী তে কি অপূর্ব লাগছে। আবির রান্নাঘর থেকে মা কে টেনে বারান্দা তে নিয়ে আসে আবির,
সুকন্যা দেবীঃ ছাড় না রে বাবা, কত কাজ হাতে
আবিরঃ(তৃণার দিকে ইশারা করে) মা ওই পরী টা কে আমার ঘরের লক্ষ্মী করে দিবে?
সুকন্যা দেবীঃ এটা তপস দাদার মেয়ে না?
আবিরঃহ্যাঁ, তৃণা,
সুকন্যা দেবীঃ বাহ্! মায়ের আচল ছেড়ে এত দূর,আচ্ছা পূজার পরে যাবো তপস দাদার দুয়ারে, আবিরের খুশি আজ আকাশ ছোঁয়া, বিকালে মন্দিরের পিছন টাই দেখা করে আবির আর তৃণা,
তৃণাঃ জলদি বলো কি বলবা,
আবিরঃ ভারী মিষ্টি লাগছে তোকে,
তৃণাঃ তারপরে,
আবিরঃকিছু না, যা
তৃণাঃ ভালবাসি
আবিরঃ জানি
তারপরে যে যার মতো চলে যায়, তৃণা অবাক হয় প্রায় ৬ মাস তাদের প্রেম তবে আবির এখনো তাকে ভালবাসি বলে নি। আজ দশমী, সবাই সিঁদুর খেলছে আর তৃণা দাঁড়িয়ে দেখছে,
আবিরঃ এ বছর দেখে নে, আসছে বছর তুই ও খেলবি,
তৃণাঃ ও আবির দাদা তুমি আমায় ভালবাসি বলো না কেন?
আবিরঃ যেদিন দাদা বলা ছাড়বি সেদিন বলবো
কথাটা বলেই আবির ঘুরে গেলো বিসর্জন এর সময় হয়ে গেছে,তৃণা পিছন থেকে ডাক দেয় “আবির শুনছো”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে বলে “তাকিস মন্দিরে বিসর্জন এর পরে কথা হবে” মন্দির থেকে ভাসান লেক মিনিট ২৫ এর পথ, শহরের প্রায় ১০/১২ টা মন্দির এই লেকে ডুবানো হয়। বিসর্জন শেষ প্রায় ঘন্টা দুই হলো কিন্তু আবিরের খোঁজ নেই, এদিকে তৃণা মন্দিরের সিঁড়ি তে পায়চারী করে যাচ্ছে অন্যদিকে সুকন্যা দেবী ঘরে পায়চারী করছে ছেলে যে বলে গেছে বিসর্জন শেষে ঘরে লক্ষ্মী নিয়ে আসবে কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য। আবিরের আসতে দেরি হওয়াতে বড় ছেলে সুদ্বীপ্ত কে খুঁজতে পাঠাই সুকন্যা দেবী, সুদ্বীপ্ত ভাসান লেকে আবির কে না পেয়ে মন্দিরে আসে, মন্দিরে তৃণা কে দেখে বেশ অবাক হয় সে,
সুদ্বীপ্তঃ কিরে তুই এখনো এখানে?
তৃণাঃ দাদা, আবির দাদা অপেক্ষা করতে বলে গেলো,
সুদ্বীপ্তঃ তুই বাসায় যা, আবির কোনো কাজে আটকা পরে গেছে হয়তো ফিরে এলে কথা বলিয়ে দিবো আমি।
তৃণা আর কথা বাড়াই না মাথা নিচু করে চলে আসে। সে রাতে আর আবির বাড়ী ফেরে নি, পরের দিন সকালে ভাসান লেকে এলাকার ২০/২৫ টা ছেলে কে নামানো হয়, হ্যাঁ এখানেই পাওয়া যায় আবির কে, বড় এক মূর্তির চাপায় লেকের নরম মাটিতে প্রায় অর্ধেক টা ডুবে রয়েছে আবিরের দেহ। লাশ টা উপরে তুলতেই সুকন্যা দেবী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- মেয়ে তেই মৃত্যু।
১৫ বছর পরে, ১৫ বছরের তৃণার এখন ৩০ চলে, ৪ বছরের একটা ছেলে আছে। প্রতি বছর দশমী আসে কিন্তু তৃণার আর সিঁদুর খেলা হয় না। প্রতিবার বিসর্জন শেষে তৃণা মন্দিরের সিঁড়ি তে অপেক্ষা করে এই বুঝি আবির দাদা ফিরে এলো, না আবিরদা আর ফিরে আসে নি। তবে আবিরের জন্য খুব যত্ন করে ভালবাসা গুলো গুছিয়ে রেখেছে তৃণা পরের জন্মে না হয় দিয়ে দিবে। ভালবাসা গুলো ভালো থাকুক তেপান্তর এর ওপান্তরে।