বেশ তো

বেশ তো

মেয়েটার সেদিন বিয়ের পনেরো দিন ছিল। ফাঁকা বাসায় মনে কেমন যেন ঢেউ উঠলো প্রেমের। শ্বশুর শাশুড়ি গ্রামে গেছেন। এই সময়টা যেন একান্তই তার নিজের জগৎ। মেয়েটার স্বামী ছুটির সকালে ড্রয়িংরুমে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে ব্যস্ত। মেয়েটা বিয়েতে উপহার পাওয়া একটা শাড়ি পরলো। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো। খোলা চুলে কিছুটা পার্ফিউম দিয়ে হাত ভর্তি করে কাঁচের চুড়ি পরলো।

বুকের ভিতরে আনচান। এমন সাজে হুট করে ওর স্বামী ওকে দেখে কি করবে ভেবেই লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তখনই মনে হলো লিপস্টিক তো দেওয়া হয়নি। লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরের আলোয় যখন নিজেকে আয়নায় দেখলো; নিজেই চোখ সরিয়ে নিলো মুগ্ধতায়। না জানি ওর স্বামী কেমন পাগল হয়। মানুষটা যদিও চাপা স্বভাবের। মুখে বলে না তেমন কিছুই। বিয়ে হয়েছে সবে তো দুই সপ্তাহ। এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। বিয়ের আগে তিন বার দেখা হয়েছিলো। মেয়েটার মনে হয়েছিলো, লোকটা তো মন্দ নয়। এর সাথে ঘর বাঁধাই যায়।

আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের পর্দা আবার টেনে দিলো। ভাবছে ওকে দেখে ওর স্বামী কি করবে। জাপটে জড়িয়ে ধরবে নাকি আলতো করে ওর গালে হাত রেখে কপালে চুমু খাবে। বাসর রাতে তো হাদারামের মতো ঘুমিয়েছিল লোকটা। সারা রাত লোকটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলো। মনে মনে ভাবলো- মানুষটা হয়তো একটু কেমন কেমন। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এরপরের দিন… ভাবতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে মেয়েটার। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল বন্যা বয়ে যায়। চুপচাপ স্বভাবের মানুষ গুলো হঠাৎ এমন বন্য হয়ে উঠলে সহজে মেলানো যায় না। কারণ সকাল বেলায় আবার সেই শান্ত মানুষটা। রাতে যেন সে কিছু করেনি। ভাবতেই মেয়েটার লজ্জা পেলো।

মেয়েটা চুপিচুপি পায়ে ড্রয়িংরুমে গেলো। লোকটা এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। মেয়েটা আস্তে করে সোফার হাতলে বসে শাড়ির আঁচল ঠিক করলো। কাঁচের চুড়ি টুংটুং করে বেজে উঠলো। লোকটা ঈষৎ ঘাড় ঘুরালো। বুঝলো পাশে এসে মেয়েটা বসেছে। আর তেমন তাকালো না। ল্যাপটপের কিবোর্ডে দশ আঙুলে আবার কাজে ডুবে গেলো। মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে আর ভাবছে- চোখ তুলে তাকিয়ে একটিবার বউকে তো দেখেন মিস্টার! আপনার চোখ ঘুরে যাবে।

মেয়েটার আলতো করে স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘শুনো না…’ মেয়েটা কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে বলল, ‘আহ দেখছো না কাজ করছি। এই কয়দিনে অনেক কাজ জমে গেছে। এখন আমি ব্যস্ত।’ মেয়েটার মায়াবী উজ্জ্বল মুখে এই রোদেলা সকাল বেলায় কোথা থেকে যেন এক পশলা কালো মেঘ চলে এলো। খুব অভিমান হলো। একবার তাকালো না পর্যন্ত। মেয়েটি শাড়ির আঁচলে লিপস্টিক মুছতে মুছতে বলল, ‘বেশ তো।’

মেয়েটা সোফার হাতল থেকে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দেখছে ওর স্বামী কাজ করে যাচ্ছে। চোখের পাতায় কোথা থেকে যেন একটা শিশির বিন্দু চলে এলো। টুপ করে ঝরে পরলো কাঁচের চুড়ির উপরে। আস্তে আস্তে বেডরুমে চলে এলো। ড্রেসিংটেবিলের সামনে টুলে বসে নিজের থমথমে মুখটা দেখলো। পর্দা সরিয়ে বাইরের আলোতে আর নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। বুকের ভিতরে এক আকাশ অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করলো। মেয়েটা বুঝে গেলো আজ থেকেই শুরু হলো ওর একেকটা স্বপ্নের মৃত্যু। তবুও কি এক হাহাকারে বেডরুম থেকেই গলা উঁচু করে স্বামীকে জিগ্যেস করলো, ‘আজ বিকেলে আমায় একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে?’ কয়েক সেকেন্ড পরে জবাব এলো, ‘না পারবো না। হাতে অনেক কাজ। অনেক ব্যস্ত।’ মেয়েটা চোখের কাজল মুছে নিয়ে আলতো করে বলল, ‘বেশ তো।’

মেয়েটা আয়নায় নিজেকে দেখে ভাবে, সে কি এই দুই সপ্তাহেই পুরাতন হয়ে গেলো। হানিমুনে গিয়েও তো মানুষটার মাঝে অনেক রোমান্স দেখতে পেয়েছে। হুট করে কি সব রোমান্স গায়েব হয়ে গেলো। আবার ভাবছে হয়তো সত্যিই সে অনেক কাজের চাপে আছে। তাই অন্যদিকে সময় দেওয়ার সময় নেই। বউয়ের সাজ দেখার সময় নেই। বউকে নিয়ে একটু আহ্লাদ করার সময় নেই। হয়তো ব্যস্ততা কমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েটা তাও নিজেকে বোঝাতে পারে না। কোনো যুক্তি সে মানতে চায় না। আজকের এই সময়টা আজকেই চলে গেলে আর কখনো তো আসবে না। আজ যে মনটা ভেঙ্গে গেলো এই মন তো আর কখনোই জোরা লাগবে না।

ভালো সম্পর্ক আর আর ভালবাসার সম্পর্কের মাঝে যে অনেক তফাৎ। মেয়েটা খুব করে তা বুঝতে পারছে। তার স্বামীর সাথে ভালো সম্পর্কটা আজীবন থাকবে। কিন্তু সেখানে কোথাও ভালবাসা থাকবে না। ভালবেসে আহ্লাদ করে বলা হবে না, ‘তুমি ঘুমাবার সময় তোমার হাতটা আমার পেটের উপরে রাখতে পারো না?’ ভালো সম্পর্কে এসব বলা যায় না। এসব বলতে হলে যে বুকের ভিতরে ভালবাসার ঢেউ লাগে। সেই ঢেউ যেন আস্তে আস্তে গতি হারাচ্ছে। মেয়েটা একটা একটা করে হাত থেকে কাঁচের চুড়ি খুলছে। লিপস্টিক মুছে শাড়িটা নষ্ট হয়েছে তো হোক। এই শাড়ি মেয়েটা আর কখনোই পরবে না। শাড়ি পালটে সালোয়ার কামিজ পরলো মেয়েটা। চুল খোঁপা করে বাধতে বাধতে রান্নাঘরের দিকে গেলো দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে। যাওয়ার সময় স্বামীকে জিগ্যেস করলো চা দিবে কিনা। স্বামী ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘দাও।’

চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে ভাবছে মেয়েটা। এটাকেই বুঝি সংসার বলে। একজন স্বপ্নের আয়োজন করবে আর অন্যজন সেই স্বপ্ন ভাঙবে। একজন কাজের চাপে ডুবে থাকবে আর অন্যজন ভাববে, সে পাশে এসে যদি বসতো কাঁধে মাথা রাখতে পারতাম। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে মেয়েটা চমকে উঠলো। মেয়েটার স্বামী পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটাকে। জড়িয়ে ধরে কাঁধে আলতো চুমু দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘শাড়ি খুলে ফেললে কেন। দেখতে বেশ লাগছিলো তো।’ মেয়েটার অভিমান যেন আরো তীব্র হলো, ‘ছাড়ো তো কাজ করছি। আমি এখন ব্যস্ত।’

মেয়েটার স্বামী সেভাবেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পেটে হাত রেখে বলল, ‘বেশ তো। তুমি কাজ করো না। বাধা দিচ্ছে কে?’ মেয়েটা নড়াচড়া করছে ঠিক কিন্তু ছাড়া পাওয়ার জন্য সেটা খুব একটা জোড়ালো না। আহ্লাদী গলায় বলল, ‘তুমি তো একবার ফিরে তাকালেও না।’ মেয়েটার স্বামী নিজের দিকে মেয়েটাকে ফিরিয়ে দুই গালে আলতো করে দুই হাত রেখে কপালের সিথানে চুমু দিয়ে বলল, ‘কে বলল দেখিনি।’ চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলল, ‘এই চোখে ছিল গাঢ় কাজল।’ ঠোঁটে চুমু দিয়ে মেয়েটাকে পুরো মাতাল করে দিয়ে বলল, ‘এই ঠোঁটে ছিল লাল লিপস্টিক। আর…।’ মেয়েটা চোখ বন্ধ করে আছে। চোখ বন্ধ করেই বলল, ‘আর?’ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে ওর স্বামী কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘আর আমার অভিমানী বউটার বুকে এই এতো গুলা ভালবাসা।’

মেয়েটার হঠাৎ সব অভিমান কোথায় যে গেলো। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে কেন স্বামীর উপরে রাগ করতে পারছে না। একটু আগেই তো অভিমানে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু স্বামীর বুকে ডুবে গিয়ে ওর বুকটা একাবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। এই ভালবাসা যে উপেক্ষা করা যায় না। মেয়েটা মনে মনে ভাবে, এটাই মনে হয় সংসার। এই মেঘ। এই বৃষ্টি। এই রোদ। এভাবেই হয়তো জীবন কাটাতে হয়। মেয়েটার ইচ্ছা হয় না স্বামীর বুক থেকে সরে যেতে। ইচ্ছে করে হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই বুকে মাথা রেখে সময়টা পার করে দিতে।

তখনই মেয়েটা ভাবে, শাড়ির আঁচলটা ধুয়ে দিলেই তো হবে। পুরো শাড়ি না ধুলেও চলবে। ঐ শাড়িটা ও আরো হাজারবার পরবে। কত কত কি যে ভাবে মেয়েটা সেটা ও নিজেও জানে না। ওর স্বামী ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে ছাড়তে চাইলো। ও আরো শক্ত করে ওর স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উঁহু আমার এখান থেকে এখন সরতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখন অনেক সুখের নিঃশ্বাসে ব্যস্ত।’ মেয়েটার স্বামী মেয়েটার কোমর খামচে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বেশ তো।’

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত