– তুমি সকালে আমার ফোন রিসিভ করো নাই কেন?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টির চাহন ছিল নীলিমার নয়নের দিকে। নয়ন অপরাধী ব্যক্তিদের মত নীলিমার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আজ মেয়েটা তাকে খেয়েই ফেলবে। পার্কের বিকাল সবসময় অনেক সুন্দর হয়। চারপাশ শুধু গাছ আর গাছ। তার মাঝখানে একটা বেঞ্চি। বেঞ্চিটার দৈর্ঘ্য একটি মানুষের শরীরের প্রায় লম্বার সমান। সকাল আর বিকেল হলেই বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতি বা মধ্যবয়স্ক মানুষরা চলে আসে হাটাহাটি বা দৌড়াদৌড়ি করতে। পরিবেশের অবস্থার উপর ছোটখাট একপ্রকার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবে একটু পর নীলিমার কলরবে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে নয়ন বলে উঠল,
– জ্বি, আসলে, আমি দুঃখিত।
– এই নিয়ে তুমি আমাকে ১৫৭৬ বার সরি বলছ, এটা তুমি জানো?
– (চোখ কপালে তুলে) আমি তো গুনি নাই। এতগুলা কবে হইলো।
– ইয়ার্কি করো? হ্যা??? তুমি আমার সাথে প্রতিবার অন্যায় করো, আর প্রতিবার সরি বলো, আর প্রতিবার আমি তোমাকে ক্ষমা করি। আর, তোমার কি মনে হয় আমি আমার এই কষ্টগুলোর হিসাব রাখব না? আমি কি ছেড়ে দিব তোমাকে ভাবছো। সবগুলোর হিসাব নিব আমি, বুজছো। গুনে গুণে সবগুলার হিসাব নিব।(একদম চিল্লায়ে কথাগুলো বলল নীলিমা নয়নকে)
– ( এরকম আচরনে নয়নের অভ্যাস আছে। কারণ, ওকে প্রায়ই এই চিল্লানো শুনতে হয় নীলিমার মুখ থেকে। তাই,ও একদম ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল) আচ্ছা শুনো, আমি আসলে তখন ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ তুমি ফোন দিলা। তাই…..
– (কথা পুরোটা বলতে না দিয়েই) তাই, তুমি আমার ফোন না ধরে ঘুমাইছো!!! তাই তো?!
নয়ন আর কোন কথা বাড়ায় না। একদম কাঠগড়ায় দাড়িয়ে থাকা নিরুপায় অপরাধীর মত দাড়িয়ে রইল। নীলিমা যে সবসময় এরকম করে, তা না। যখন নয়ন নিজ থেকে নীলিমার সাথে যোগাযোগ করা কমিয়ে দেয় তখনই নীলিমা মাথা গরম করে ওর উপর দিয়ে টর্নেডো, ঘুর্ণিঝড়, সুনামি বইয়ে ফেলে। আর নয়ন আবার আগের মত হয়ে যায়। নয়নের ধৈর্য আছে বলা যায়। নয়ন নীলিমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু, নীলিমার চেয়ে বেশি না। নীলিমা খুব দুষ্ট মিষ্ট স্বভাবের, প্রাণচঞ্চল আর আহ্লাদি একটি মেয়ে। আর নয়ন তার উল্টোটা। খুব শান্ত, চুপচাপ আর গম্ভীর ধরণের ছেলে। ওদের জুটিতে, নয়ন সবসময় নীলিমার নির্যাতন সহ্য করে। খুব সহ্য করে। কেনই বা করবে না। পাগলীটা যে তাকে অনেক বেশি ভালবাসে। নয়ন মনে করে, এই দিক দিয়ে সে খুব স্বার্থপর। সে ওকে ছাড়তে পারবে না।
কারণ, এরকম কাউকে সে ছাড়তে চায় না যে কিনা নয়নের সাথে ঝগড়া করে, নয়নকেকে মারে, নয়নকে নিজের সব কথা শেয়ার করে, নিজে অসুস্থ থাকলেও নয়নের খেয়াল রাখে, নয়নের সাথে একটু কথা বলার জন্য হলেও নয়নের পিছন পিছন ঘুরে, নয়নের অসুস্থতার সময় ওকে নিয়ে সারাদিন টেনশন করে যত দূরেই থাকুক না কেন নয়ন ওকে ছেড়ে। নয়ন কখনও নীলিমার উপর বিরক্ত হয় না, বিরক্ত হয়ে গেলে নীলিমা চুপ হয়ে যায়। আর নয়ন এটা সহ্য করতে পারে না। কারণ, নয়ন ওর দুষ্ট মিষ্ট আচরণে অভ্যস্ত। পুরোপুরি অভ্যস্ত।
এসবকিছু বোঝার পর যে ছেলেটি এরকম একটি মেয়েকে ছাড়তেচাইবে তার চেয়ে দূর্ভাগা, মনে হয় নাপৃথিবীতে আর একটিও হবে। এবার বাস্তবে আসা যাক নয়ন দেখছে নীলিমা কাদঁছে। নয়ন ভাবছে, “এই যা! এখন কি করবো। এখন কান্না না থামালে, একটুপর তো আমার উপর দিয়ে আবার জলোচ্ছাস বইয়ে নিয়ে যাবে।” মেয়েরা কান্না করা শুরু করলে ছেলেরা দুর্বিধায় পড়ে যায়। কি রেখে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আর মেয়েদের কেন জানি এই বিষয়টি করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। কেননা, তার চোখের পানি থামানোর জন্য তার ভালবাসার মানুষটি তার কাছে এসে একদম বাচ্চা হয়ে যায়, তাই।
– এই! কাদঁছো কেন? থামো না, প্লিজ। (আহ্লাদি গলায় নয়ন বলল)
– তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো।
– আমি বলছি তো সরি।
– সরি? কিসের সরি। এই সরির মেয়াদ কতদিন? তুমি ছেলে, কোনদিন বদলাবা না।
– পরবর্তীতে আর এমন হবে না।
– কতবার বলছ এই কথা????
– ১৫৭৬ বার। নয়নের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে, “আমার চোখের পানি দেখে মজা পাচ্ছ তুমি, না?”
– একদমই না। কে বলছে???
তুমি এমনভাবে কাঁদো, আমি তো সবসময় ভাবি, আমাদের বিয়ের পর যদি আমাদের দুটো বাচ্চা হয়, তোমাকে নিয়ে হবে তিনটা বাচ্চা। তুমি নিজে তো এক বাবু, তুমি কি বাচ্চা পালবা। তোমাকেই তো উল্টা আমার পালা লাগবে। ( হাসি দিয়ে)
– এরকম দাত কেলায়া হাসবা না তুমি। বিয়ের আগে তুমি আমার সাথে এমন করো, বিয়ের পর তো তুমি আমাকে আরো কষ্ট দিবা। আজ তোমার জন্য আমি আমাদের ভার্সিটির বেস্ট স্টুডেন্ট তৌফিকের সাথে ঝগড়া করছি, তুমি জানো?
– না তো! কেন? কি হইছে??
– ঐ ছেলে আমাকে প্রপোজ করছে। নীলা এসে না ধরলে মারামারিই লাইগা যাইত ওই ছেলের সাথে আমার। এই ছেলের সাহস কত বড়, আমাকে প্রপোজাল পাঠায়। কানের নিচে দুইটা থাপড়া লাগাইলে হুস আসত ও কাকে প্রপোজ করছে। আর তুমি কি না mআমার গুরুত্বই বুঝো না।
– আরে বুঝি তো।
– (বেঞ্চ থেকে উঠে গর্জে উঠা সিংহীর মত করে, থ্রী কোয়ার্টার হাতা কনুই পর্যন্ত উঠাতে উঠাতে, নয়নের দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে বলল)…
—কি বুঝো তুমি???? আমি গতকাল কতগুলা বান্ধবীদের সাথে নিয়ে ফেসবুক ছবিআপলোড দিছি, দেখছ তুমি? লাইক দিছো সবগুলা??? শুধু অ্যালবামে লাইক দিয়ে রাইখা দিছো। তাও আবার আজকে সকালে লাইক দিছো। তোমারে তো ধইরা কাচ্চা চাবায়া খাওয়া উচিত আমার, কারাগার পাঠানো উচিত। নয়ন মনে মনে ভাবে, “তোমার চেয়ে বড় কারাগার মনে হয় না পৃথিবীতে আমার জন্য আর দ্বিতীয়টি আছে।”
— কি হইছে? উত্তর নাই কেন কোন????
—আসলে, এত্ত ছোট্ট একটা বিষয় নিয়া এভাবে চিল্লাইতে হয়।
– (হতাশ সুরে নীলিমা বলে) তোমার কাছে ছোট্ট বিষয় লাগতেছে??? তুমি কি বুঝবা লাইকগুলোরমাঝখান থেকে তোমার লাইক খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট কি। মেসেজ দিয়েওমেসেঞ্জারে তোমার মেসেজের রিপ্লাই না পাওয়ার কষ্ট কি। তুমি কি বুঝবা। (কাদঁতে কাঁদতে বসে পড়ল) তুমি কখনই বুঝবা না। কখনও না।
– (নয়ন আস্তে আস্তে বলে) আসলে, আমার কাছে তো ছোট বিষয়ইমনে হচ্ছে। কেন যে মনে হচ্ছে, ওটাই তো বুঝতেছি না।
– (খুব রেগে গিয়ে, চোখের পানি এক ঝটকায় মুছে নীলিমা বলে,) ঐ তুই ওঠ!!!! ওঠ বলতেছি। আমার চেখের সামনের থেকে সর। সর!!!! হাত টেনে উঠাতে যায় নীলিমা নয়নকে।
– আরে বাবা! শুনো তো।তুমি জানো আমি সরাদিন কত ব্যস্ত থাকি। অফিসের কাজ আবার মাঝে মাঝে ভার্সিটির ক্লাস। সময় কই। আর তুমি কি না….
– এই ব্যস্ততাই আমার সতীন। তুই উঠবি কি না এইখান থিকা বল। আমি তোর চেহারা দেখতে চাই না। অনেকক্ষণ হাতে ধরে টানাটানির পর বেঞ্চি থেকে উঠাতে যখন ব্যর্থ হয় নীলিমা তখন সে নিজেই হাটা ধরেগাছাপালায় ঘেরা রাস্তার মাঝখান দিয়ে।
– তুই থাক এখানে। আমি ঐ তৌফিক ফৌফিকের সাথেই প্রেম করব। লাগবে না তোকে আর আমার। খুব ভালবাসি তাই বুঝিস না তো। থাক তুই!!!! কথা গুলো বলেই নীলিমা চলে যাচ্ছে কাদঁতে কাদঁতে। নয়ন পিছন থেকে ওর বাম হাত হেচকা দিয়ে ওর কাছে টেনে আনে।
– (খুব বিরক্ত নিয়ে) ছাড়বি তুই? মানুষ দেখতেছে, প্লিজ!!!
– আমি দুঃখিত। আমি আর এমন করব না।
– আর মিথ্যা বলিস না। এখন আমিসত্যি তোকে অনেক অনেক অনেক অনেক ঘৃণা করি। ঘৃণা করি, ঘৃণা ক আর কিছু বলতে না দিয়ে নয়ন নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। নড়বা না, চুপ! অনেক ভালবাসি। সত্যিই অনেক ভালবাসি।” ভালবাসি কথাটি বলতে বলতে যখন নয়ন নীলিমার পিঠ চাপ দিয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তখন নীলিমার পা মাটি থেকে আলগা হয়ে উপরে উঠে যায়। অনেক শক্ত করে ধরে নয়ন। ছাড়বে না বলে। নীলিমা তারপরও কাদঁতে কাদঁতে বলে,
—মিথ্যা কথা,তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না ! আমি তোমাকে অনেক ঘৃণা করি। অনেক!!!
– নাহ্! চুপ। এটা বলবা না। বলো ভালবাসো।
– নাহ্। ঘৃণা করি।
– নাহ্, ভালবাসো। অনেক ভালবাসো।
আমিও অনেক ভালবাসি। নীলিমা আর কাদঁতে পারে না। আস্তে আস্তে ওর অভিমান ফুরিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও ও বারবার বলতে থাকে, ঘৃণা করি। কারণ, প্রতুত্তরে শুধুই নয়নের মুখ থেকে ভালবাসি শব্দটি শোনতে পায় সে। এই কথাটুকু শোনার জন্য, নীলিমা বারবার রাগ করতে রাজি, বারবার কষ্ট পেতে রাজি, বারবার অভিমান করতে রাজি। এই টাইপ জুটিগুলোতে যতই ছোট খাটো বা বড় ধরণের ঝগড়া হোক না কেন, কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে আপনিতারপরও এই জুটিদের মুখে এই বাক্যটি শুনতে পাবেন, “হোক ও এমন! তবুও ওকে ভালবাসি।”