প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ভালোবাসা

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ভালোবাসা

প্লাটফর্মের একটা কোণে আমি আর শ্রাবণী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর মাথা নিচু করে শ্রাবণী বললো,

– পিয়াস, তুমি আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না তো? আমি অন্য দিকে ফিরে বললাম,
— রোজ রোজ একটু একটু সম্পর্ক শেষ হওয়ার চেয়ে একে বারে শেষ করে দেওয়ায় ভালো…
শ্রাবণী আর কিছু না বলে শুরু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি তখন শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ভালো থেকো তুমি। শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
– ভালো থাকার জন্যই তো আলাদা হয়ে যাচ্ছি।

আমি আর কিছু বললাম না। ঢাকায় আবার ফিরে আসার জন্য ট্রেনে উঠে পড়লাম এই মুহুর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে ভালোবাসা ততক্ষণ পর্যন্ত সুন্দর যতক্ষণ পর্যন্ত ভালোবাসা শুধু ভালোবাসাতেই আবদ্ধ থাকে। ভালোবাসা যদি কখনো বিয়েতে রুপান্তরিত হয় তখন ভালোবাসার সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। ভালোবাসাটা হয়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় ডাল ভাতের মত…

কয়েকবছর আগেও শ্রাবণী আজকের মত এইভাবে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী যেতাম শুধু ওর সাথে একটু দেখা করার জন্য। দেখা শেষ করে যখন আমি আবার ঢাকায় ফিরতাম তখন শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে অনবরত কান্না করতো। আর আমি ওকে বুকে জড়িয়ে বলতাম, আরে পাগলি মেয়ে এত কান্নার কি আছে। আমি সামনের মাসে আবার ঠিক আসবো। আমি ট্রেনে উঠে বসতাম আর শ্রাবণী আমার দিকে চেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। ওর কান্না ভেজা চোখগুলো দেখে আমি আবার প্রথম থেকে ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করতো আর একটা সময় আমাদের দুজনকে আড়াল করে দিতো…

আজকেও ট্রেনটা আমাদের আড়াল করে দিলো। কিন্তু আগের মত শ্রাবণীর চোখে আজ পানি দেখি নি। বরং ওর মুখে মুচকি হাসি দেখেছি। এমন কি আগে ওর থেকে বিদায় নিলে আমার যতটা কষ্ট হতো আজ ততটা কষ্ট হচ্ছে না। তারমানে কি অন্য সাবার মত আমাদের ভালোবাসারও রঙ পাল্টে গেলো…

শ্রাবণীর সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। সময়টা তখন ২০১৪ সাল। বিভিন্ন গ্রুপে টুকটাক লেখালেখি করি এই যা। আমার গল্প মানুষ তেমন একটা পড়তো না। কিন্তু সবসময় খেয়াল করতাম একটা মেয়ে আমার সব গল্পেই কমেন্ট করে। আমার গল্পের খুব প্রশংসা করে। এইভাবে আস্তে আস্তে কমেন্টে টুকটাক কথা আর তারপর ইনবক্সে। কথা বলতে বলতে একসময় ভালো লাগা আর সেই ভালোলাগাটা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসায় রুপান্তরিত হওয়া। ফেসবুকে হাজারও টাইমপাস ভালোবাসার ভিড়ে আমার আর শ্রাবণীর ভালোবাসাটা ছিলো অলটাইম ভালোবাসা। কাউকে না দেখেও এতটা ভালোবাসা যায় সেটা আমার জীবনে শ্রাবণী না আসলে বুঝতেই পারতাম না।

শ্রাবণীর সাথে প্রথম দেখা করি ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর। আমার জন্মদিন ছিলো সেদিন। আমি ওর দেওয়া ঠিকানাতে সময় মত পৌঁছে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটু পর খেয়াল করলাম বোরকা পড়া মুখ ঢাকা একটা মেয়ে আমার পাশে বসেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মেয়েটি বললো, আমি শ্রাবণী, তোমার আসতে কোন সমস্যা হয় নি তো? আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম, না কোন সমস্যা হয় নি দুইজনে নানা বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলেছিলাম। একটা সময় ওকে বললাম, তুমি কি সবসময় বোরকা পড়ে মুখ ঢেকে রাখো? শ্রাবণী উত্তর দিয়েছিলো, কেন মুখ ঢেকে রাখলে কি কোন সমস্যা? আমি হেসে বলেছিলাম, কোন সমস্যা নেই শুধু শ্রাবণী নামের মানুষটা আমার পাশে থাকলেই হবে…

অনেকক্ষণ সময় শ্রাবণীর সাথে কাটানোর পর ওর থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠি। ট্রেনের জানালা দিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম শ্রাবণী প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। দুইজন দুইজনের দিকে চোখ পড়তেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। আর শ্রাবণী তখন বোরকার মুখোশটা খুললো। আর আমি শ্রাবণীকে দেখে কয়েকমিনের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পানির ঝাপটাতে যখন আমার জ্ঞান ফিরেছিলো তখন খেয়াল করেছিলাম আমার দিকে অনেকে হা করে তাকিয়ে আছে আর আমি বোকার মত তাদের দিকে চেয়ে বলেছিলাম, মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে?

তারপর থেকে আমার প্রতিমাসে ঢাকা টু রাজশাহী আসা যাওয়া শুরু হলো। টানা ৪ বছর প্রেম করার পর ২০১৮ সালে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে আমাদের ভালোবাসাটা কেমন যেন মলিন হতে শুরু হলো। আমি সারাদিন অফিস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতাম আর শ্রাবণী তখন আমার বিরুদ্ধে হাজারটা দোষ খুঁজে বের করতো। প্রতিদিন আমার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ জমা হতো। আমার নানা বিষয়ে সন্দেহ শুরু করলো। এইভাবে টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকতো। আর আজ যখন ও আমার মেসেঞ্জার চেক করতে চেয়েছিলো তখন রাগে ওকে একটা থাপ্পড় মারি আর অমনি শ্রাবণী বলে ওকে মুক্তি দিতে। তাই ওকে রাজশাহী পৌঁছে দিলাম আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে এইকথা গুলো ভাবছিলাম এমন সময় খেয়াল করলাম ৭০-৮০ বছর বয়স হবে এমন দম্পতি ঝগড়া করছে। বুড়ো বয়সে এত ঝগড়া করার শক্তি ওরা কোথায় পায় আল্লাহ জানে। আমি ওদের ঝগড়া শুনে বিরক্ত হয়ে নিজের সীট ছেড়ে অন্য কামড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পড় সেই বৃদ্ধলোকটি আমার কাছে এসে বললো,

~দাদা ভাই, টানার অভ্যাস আছে কি? আমি অবাক হয়ে বললাম,
–মানে?
~মানেটা হলো, সিগারেট টানার অভ্যাস আছে? যদি থাকে তাহলে একটা সিগারেট দাও.. আমি পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে উনার হাতে দিয়ে বললাম,
–এত যন্ত্রণা সহ্য করেন কিভাবে? আপনার অনেক আগেই স্ত্রীর এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেওয়া উচিত ছিলো। বৃদ্ধলোকটি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া বের করতে করতে বললো,

~ স্ত্রীর এই যন্ত্রণার আড়ালে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটা তোমার মত হাঁদারাম বুঝবে না। আমার স্ত্রী আমার সাথে ঝগড়া করছিলো কারণ আমি চায়ে চিনি দিয়ে খেয়েছিলাম তাই। আর এইযে সিগারেট খাচ্ছি সেটা যদি জানে তাহলে আমাকে এই বুড়ো বয়সে দৌড়াবে। এইগুলো শাসন না এইগুলো হলো স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ৪৮ বছরের সংসার আমার এখনো ইচ্ছে হয় এই যন্ত্রণা গুলো আরো ৪৮ বছর সহ্য করতে আর তুমি এই বয়সে মুক্তি নিতে চাইছো? আমি অবাক হয়ে বললাম,

— বউ যে সন্দেহ করে? বৃদ্ধলোকটি মুচকি হেসে বললো,
~ ভালোবাসায় টুকটাক সন্দেহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসা যত গভীর হয় সন্দেহ তত বাড়ে কারণ কেউ চাই না তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে বৃদ্ধলোকের কথা শুনে আমি ট্রেনের শিকল টেনে ধরলাম। বৃদ্ধলোকটি বললো,

~ আরে ট্রেন থামালে কেন? আমি বললাম,
— নিজের বউকে প্লাটফর্মে ফেলে এসেছি। ট্রেন থেকে নামার সময় বৃদ্ধ মহিলাটার কানে কানে বললাম,

— দাদী দাদা পাশের কামড়ায় সিগারেট খাচ্ছে স্টেশনে এসে দেখি এখনো শ্রাবণী প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সারামুখ চোখের কাজলে লেপ্টে আছে। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলতে লাগলো,

– আমি তোমার সংসার করবো না। যতই জোর করো না কেন আমি ফিরে যাবো না…

আমি এখন বুঝতে পেরেছি।আসলে ভালোবাসা কখনোই রঙ পাল্টায় না। শুধু আমরা মাঝে মাঝে রঙিন চশমা পড়ে ভালোবাসাকে দেখি। চোখ থেকে রঙিন চশমাটা খুলে উন্মুক্ত চোখে ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে ভালোবাসা এখনো সেই আগের মতই আছে প্লাটফর্মের হাজার মানুষের ভিড়ে একটি মেয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি ছেলে কানধরে উঠ বস করছে…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত