বিয়ের জন্য বাসা থেকে ছেলে দেখতেছে, কিন্তু বফ লেখাপড়া শেষ করে এখনও চাকরি খোঁজে যাচ্ছে। যার জন্য প্রতি বার আমার একটা না একটা ফন্দি করে বিয়েটা ভাঙ্গতে হয়। এই শুক্রবারেও আসবে পাত্রপক্ষ, তার মানে এইবারও তাদেরকে ভাগাতে হবে। বফরে ফোন দিতে একটু ঝেড়ে নিলাম, যাতে বেচারাটা আরও সিরিয়াস হয়।
শুক্রবারে যথারীতি আম্মুর কথামত রেডি হয়ে ইয়া লম্বা ঘোমটা দিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে গেলাম। পাত্রের মা টুকিটাকি জিজ্ঞেস করার পর বললো, বিয়েটা যেহেতু ওরা করবে তাই ওদের আলাদা করে একটু কথা বলা উচিত। এইতো এইবার লাইনে আসছে(মনে মনে বললাম) বারান্দায় আমাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো, আমি কি বলবো এটা আগে থেকেই ভেবে রেখেছি। ছেলেটাকে দেখে পাগলের মত হাসতে লাগলাম। ছেলেটা কিছুটা ইতস্ততবোবোধ করছিলো। নীরবতা ভেঙ্গে বললাম
–আপনি বুঝি আমার জামাই হবেন?
–জ্বী, না মানে (কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে)
— রান্নাবান্না কিছু জানেন নাকি আমাকে সব সময় বাইরে থেকে কিনে খেতে হবে?
— মানে, আমি রান্না করবো কেনো। সেটা তো বাড়ির মহিলাদের কাজ।
–কোন বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় লিখা আছে যে এটা মহিলাদের কাজ?
–তা লিখা নেই, কিন্তু যুগ যুগ ধরে এটাই চলে আসছে।
–যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নিয়মটা আমিই ভাঙ্গবো।
আমি ছোটো থেকেই ভেবে রেখেছি আমি আমার বরকে দিয়ে রান্না করাবো। মাঝে মাঝে বর পিটাবো। আমার একটা হবি বলতে পারেন। তাছাড়া আমার মেন্টালি একটা প্রবলেম আছে যেটা আপনাকে জানানো হয়নি। প্রবলেমটা যখন হয় তখন সামনে যারে পাই পিটাই।
–আপনি মজা করছেন তাই না?
— আপনি তো আমার বেয়াই লাগেন যে মজা করতে যাবো। যা যা বলছি যদি সম্ভব হয় তাহলে বলেন আর না হলে ফুটেন।
— কি দজ্জাল মেয়ে আপনি। আপনার কপালে তো বর জুটবে না।
–ও হ্যালো আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আগে নিজের বউ ঠিক করেন। এই বলে বিশাল এক ভেটকি দিয়ে চলে আসলাম।যা যা বলেছি মনে হয় না ছেলে রাজি হবে। সন্ধ্যায় আম্মুর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম কাজ হয়েছে। খুশিতে নাচতে নাচতে হেবলা কান্তরে ফোন দিলাম-
–তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে?
–বিয়েটা আটকায়তে পারছো বুঝি?
–কারো বিয়ে ভাঙ্গলে সেটা সুসংবাদ হয় বুঝি। এইবার বিয়েটা করেই নিচ্ছি। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তো বুড়িই হয়ে যাবো মনে হয়। তাই এইবার রাজি হয়ে গেলাম।
–না মায়া না, তুমি এটা করতে পারো না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবো না। আমি তো ট্রাই করতেছি। আমারে আর কিছুদিন সময় দেও প্লিজ।
–কতদিন বলছি বাংলা সিনেমা দেখা বাদ দেও। কিছু হইলেই বাংলা সিনেমার ডায়ালগ ঝাড়া শুরু করো। আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদো না তো, আমি বিয়ে করতেছি না। প্লিজ এইবার একটু সিরিয়াস হও। আমি আর কতদিন এভাবে পরিবারকে হেনস্ত করে যাবো বলো।
— বিশ্বাস করো আমি চেষ্টার কোনো কমতি রাখছি না, বাকিটা আল্লাহ্র হাতে।
— আচ্ছা ঠিক আছে, এখন রাখি।
এই হলো অর্ণব, একটা ছেলে এতটা হেবলা, গাধা হয় কিভাবে জানি না। ওর সাথে আমার কিচ্ছু মিলে না। আমি ডানে গেলে ও বাঁমে যায়। আমার সাদা রঙ পছন্দ আর ওর কালো পছন্দ। আমি মিষ্টি খেতে পছন্দ করি আর ও ঝাল খেতে ভালোবাসে। আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার আর ও আর্জেন্টিনার, এই নিয়ে যে কত ঝগড়া হয়। এতো কিছুর পরেও ওকে ভালোবাসি। এই একটা পয়েন্টে ওর আর আমার মিল রয়েছে। এই কয়দিনের জন্য চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো। কিন্তু বলা তো যায় না আবার কোন ঝামেলা এসে উপস্থিত হয়। প্রায় ১৫ দিন পরে আম্মু ডেকে বললো, তোমাকে আগামী পরশু দেখতে আসবে। ছেলে অনেক ভালো চাকরি করে। তোমার আব্বুর পরিচিত বলে আমরা এই ছেলেকে নিয়ে অনেক সিরিয়াস। খবরদার এইবার উল্টাপাল্টা কিছু করলে খবর আছে। না, এইবার আমার কাজটা এতোটা সহজ হবে না। মন খারাপ করে অর্ণবকে ফোন দিলাম-
— অর্ণব এইবার আব্বু আম্মু অনেক সিরিয়াস, প্লিজ তুমি কিছু করো। তোমার আব্বুকে বলে আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও।
–আমার আব্বু আমাকে মেরেই ফেলবে, তাছাড়া তোমার বাবাই বা কেনো রাজি হবে নিজের মেয়েকে একটা বেকার ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
–আহারে কি সুন্দর জ্ঞানীদের মত কথা। বেকার ছেলের কাছে দিবে না কিন্তু চাকুরীজীবীর কাছে তো দিবে। আমি বরং তাদের পছন্দেই বিয়ে করে নেই। এই বলে ফোন কেটে সুইচড অফ করে দিলাম। ওর ভ্যাঁ ভ্যাঁ শোনার মত মুড নাই। গাধাটা আর মানুষ হলো না। যাই হোক যা করার আমাকেই করতে হবে।
কিন্তু কি করবো, এইবার পুরনো ট্রিকে কাজ হবে না। নতুন কিছু ভাবতে হবে। পরের দিন ভার্সিটি যাওয়ার সময় দেখলাম গরমের জন্য পিচ্চি কাজিন দুইটারে আম্মু ন্যাড়া করে দিচ্ছে। আমার হাতে বেশি সময় নেই, কিন্তু এখনও কোনো উপায় পেলাম না। তাই মনের দুঃখে একটা ব্লেড কিনে আনলাম। বাসায় ফিরে সুন্দর করে সাজুগুজু করে অনেকগুলো সেলফি তুললাম। এর পর ওয়াশরুমে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লেডটার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছি। যা করতে যাচ্ছি অনেক ভেবে চিন্তেই করছি। যাকে ভালোবাসি তাকে না পেলে সারাজীবন একটা কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হবে। আর আমি সেটা হতে দিতে পারিনা।
এসব ভাবতে ভাবতে মাথায় সাবান লাগালাম, পরে সদ্য কেনা ব্লেডটা দিয়ে নিজের মাথা ন্যাড়া করলাম। চুলগুলোর জন্য কষ্ট লাগলেও মনে এক প্রকার ভালো লাগা কাজ করছে।এইবার কয়েক বছরের নামে আমার বিয়ের কথা তুলবে না। আম্মু আমাকে দেখে তো প্রায় সেন্সলেসই হয়ে গিয়েছিলো। সবাই ইচ্ছেমত বকাবকি করলো। আজকে বকাগুলো কেন জানি ভালোই লাগছে। পরের দিন ছেলেটা ওর পরিবারের সাথে আসলো। যেহেতু ছেলের পরিবার আমাকে আগে থেকেই চিনে তাই আর কোনো প্রশ্ন না করেই আমাকে আলাদা রুমে ছেলের সাথে কথা বলার সুযোগ দিলো। বরাবরের মত আমিই প্রথমে কথা বললাম-
— আচ্ছা আপনি কি কখনও ভেবেছেন যে ন্যাড়া মেয়েকে বিয়ে করবেন?
–মানে!মাথার ঘোমটা খুলে স্টেডিয়ামের মত ন্যাড়া মাথাটা তাকে দেখিয়ে বললাম এই দেখুন। ছেলেটা মোটামুটি ভড়কে গেলো।
–আচ্ছা আপনার কি কোনো প্রবলেম হয়েছিলো।যার জন্য মাথা ন্যাড়া করেছেন?
— তা আর বলতে, তা না হলে কেউ এতো বড় হয়ে ন্যাড়া করে বলুন।
— যদি কিছু না মনে করেন তাহলে প্রবলেম টা কি জানতে পারি?
— অবশ্যই অবশ্যই।
যেহেতু আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে সেহেতু আপনার হক আছে জানার। আসলে গরম আসলে আমার একটা মেন্টালি প্রবলেম দেখা দেয়, হাতের কাছে যারে পাই তাদেরকেই ন্যাড়া করে দিতে মন চায়, এই বলে পিচ্চি কাজিন দুইটারে দেখিয়ে বললাম এই দেখেন ওদেরকেও ন্যাড়া করে দিয়েছি। কালকে হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে নিজের মাথাই ন্যাড়া করলাম।
— তা এর জন্য সাইকোলজিস্টের কাছে যান নাই?
— গিয়েছিলাম, আর বলবেন না জোর করে সাইকোলজিস্টের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার পর সে আর চিকিৎসা করতে রাজি হয়নি। আপনার সাথে বিয়ে হলে নতুন একটা মাথা পাবো ন্যাড়া করে দেওয়ার জন্য। ভয় পাবেন না অনেক যত্ন করে প্রতি গরমে আপনার মাথা ন্যাড়া করে দিবো। আমার কথা শুনে ছেলে পারেনা দৌড়ে পালায়। আজকে আমার কপালে দুঃখ আছে।
যথারীতি রাতে আমাকে একগাদা কথা শুনতে হলো। যাই হোক বিয়েটা ভাঙ্গতে পেরে শান্তিতে ঘুম দিলাম। পরের দিন দুপুরে আম্মু আবার জানালো আগামীকাল আমাকে দেখতে আসবে। হায় আল্লাহ্ এটা কি হচ্ছে আমার সাথে। ভালোর জন্য ন্যাড়া করলাম, এতো হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। আগে একমাস বা পনেরদিন পর পর দেখতে আসতো এখন পর পর ২ দিন! আরে দূর এতো ভাবছি কেন, ন্যাড়া মাথা দেখলেই চলে যাবে। ছেলেপক্ষের সামনে গিয়ে আমি তো অবাক। ছেলে আসেনি সাথে, ছেলের বাবা আর মামা আসছে। হায় আল্লাহ্ তার মানে এদেরকে ন্যাড়া মাথা দেখাতে হবে। এ কোন বিপদে ফেললে আমাকে। যাই হোক ভালোবাসার খাতিরে ন্যাড়া মাথা দেখাতেই হলো, কিন্তু অবাক করা ব্যপার হচ্ছে তারা আমার কান্ড দেখে মিটিমিটি হেসে চলে গেলেন আর বাসার কেউ বকাও দিলো না। এর মধ্যে আর অর্ণবের সাথে যোগাযোগ করিনি। পরের দিন সকালে ও দেখা করতে বললো। সুন্দর করে ন্যাড়া মাথা ঢেকে খুশি খুশি মনে দেখা করতে গেলাম।।আমাকে দেখেই ও বলে উঠলো –
— তুমি এইটা কি করছো? বিয়েটা কেন ভাঙ্গলা, আর মাথাই বা কেন ন্যাড়া করছো?
–বিয়ে আমি শখে ভাঙ্গছি তো। আমি অন্য কাউরে বিয়ে করে নেই এটাই তো তুমি চাও তাইনা। ওকে ফাইন, তাহলে এটাই হবে, আমি গেলাম।
–তুমি না সবসময় বেশি বুঝো। গতকাল তোমাকে আমার আব্বু আর মামা দেখতে গিয়েছিলো, আর তুমি কিনা ন্যাড়া মাথা দেখিয়ে তাদেরকে ভাগিয়ে দিলা।
–কিইইইই! আমাকে আগে বলবা না গাধা, তুমি আসলে কোনো কাজেরই না।
— আমাকে বলতে মানা করা হয়েছিলো তাই বলিনি।
— এখন কি হবে? আর তুমি ভিতুর ডিম থেকে বাংলা সিনেমার হিরো হলে কিভাবে। মানে তোমার আব্বুকে কিভাবে রাজি করালে।
— গত পরশু তোমাকে ফোনে না পেয়ে তোমার বাসার সামনে যাই, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তোমাকে দেখতে পাই, কিন্তু তোমার এই রূপ দেখে ভয় পেয়ে যাই। আমার বুঝতে বাকি রইলো না বিয়ে ভাঙ্গার জন্যই তুমি এই কাজ করছো। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিলো। তাই বাসায় ফিরে আব্বুর পা ধরে কান্নাকাটি করে রাজি করালাম।
–বাহ্ আমাকে এতো ভালোবাসো তা তো জানতাম না। ন্যাড়া করে তাহলে তো ভালোই হয়েছে। এমন সময় বাসা থেকে দুইজনের ফোনেই কল আসলো। আমার আম্মু আমাকে আর ওর আব্বু ওকে আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য ফোন দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে দুজনে একসাথেই বাসায় ডুকলাম। সবাই আমাদের দেখে হাসছে, বিশেষ করে অর্ণবের বাবা।
অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো আমাদের পছন্দ অনুযায়ীই বিয়ে হবে তবে আমার মাথায় চুল গজানোর পর। নতুন বউ ন্যাড়া হলে বিষয়টা কেমন না। কেবলাকান্ত যদি এই কাজটা আগে করতো তাহলে আমার এতো সাধের চুলগুলো হারাতে হতো না। যাই হোক অবশেষে ন্যাড়া মাথার কল্যাণে আমি তাহাকে পাইলাম, আমার আর কি চাই!!