ছেলেটির নাম হিমু। চট্টগ্রাম জেলার ছোট্ট একটা গ্রামে বাস করে ছেলেটি। ছেলেটির কেউ নেই এই পৃথিবীতে। পড়া লেখা করে পাশাপাশি একটা হোটেলে কাজ করে। খুব ছোট থেকে সে তার মা এবং বাবার কাছ থেকে দূরে থাকে। ছেলেটি বড় হয়েছে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা আশ্রম থেকে। বড় হওয়া মাত্রই সে বের হয়ে, এসেছে সেই আশ্রম থেকে। যখন আশ্রমে ছিল তখন সে খুব সুন্দর এবং হাসি খুশির মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়ে ছিল। যখনি সে আশ্রম থেকে বের হয়ে এল তখন সে বাস্তবতার সাথে মিশে গিয়েছে।
এখন সে আনন্দ খুঁজে পায় এই বাস্তবতার মধ্যে। ছেলেটির এই ছোট্ট জীবনে ভালোবাসা নামক অনুভূতি গুলো নিয়ে আসল এই গ্রামের একটা মেয়ে, নাম নিহা। নিহার সাথে হিমুর দেখা হয়েছে আজ থেকে দুইমাস আগে রেস্টুরেন্টে। সেদিন হিমু রেস্টুরেন্টে কাজ করছিল। হঠাৎ কিছু মেয়ে ঢুকল তাদের রেস্টুরেন্টে। হিমু মেয়েগুলোকে দেখে এগিয়ে গেল তাদের দিকে, অর্ডার নিতে। তাদের পাশে যেতেই সে থমকে গেল। মেয়েগুলোর মধ্যে একটা মেয়ে ছিল খুব মায়াবী, মেয়েটির হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। তার চোখ দুটি অসম্ভব মায়ায় ভরা।
হিমু অর্ডার নিয়ে চলে আসল তাদের সামনে থেকে। অর্ডার করা জিনিস তাদেরকে দিয়ে এসে আড়াল থেকে দেখতে লাগল মেয়েটিকে। মেয়েগুলো সবাই মুখে হাসি নিয়ে কথা বলছিল। হিমুর দৃষ্টিতে সবার হাসিটা বাধল না, কিন্তু সেই মেয়েটির হাসিটা তার মনে লাগল। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই মেয়েটির দিকে। মেয়েটি যখন হাসে তখন দেখে মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর হাসি হল এই মেয়েটির হাসি। হিমু যখন বিল নিতে তাদের সামনে গেল তখন তারা একে অপরের সাথে কথা বলছে। তাদের কথা শুনে হিমু বুঝতে পারল মেয়েটির নাম নিহা। হিমু মেয়েটির নাম শুনে বিল নিয়ে তাদের সামনে থেকে সড়ে অন্য টেবিলে গেল অর্ডার নিতে। সেদিন হিমুর কাজে মন বসে নি, সারা দিন শুধু নিহার কথা ভেবেছে। বার বার নিহার হাসিটা ভেসে আসছে হিমুর চোখের সামনে।
এভাবেই দেখা হয়েছিল নিহার সাথে হিমুর। সেদিনের পর তাদের আবার দেখা হয় রাস্তায়। হিমু রাস্তা দিয়ে হেঁটে তার বাসায় যাচ্ছিল ঠিক তখনি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল নিহা। হিমু নিহাকে দেখে তার পিছু নিল। অর্ধেক হেঁটে নিহা দাঁড়িয়ে পিছনে হিমুর দিকে তাকাল এটা দেখে হিমুও দাঁড়িয়ে গিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। এভাবে নিহা অনেকবার তাকাল হিমুর দিকে। নিহা হয়তো বুঝতে পেরেছে যে ছেলেটি তাকে ফলো করছে। তবুও সে কিছু বলল না, নীরবে হেঁটে গেল সামনের দিকে। নিহা তার বাসার গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। ঢুকার আগে সে একবার হিমুর দিকে তাকাল। একবার তাকিয়ে সে ভিতরে ঢুকে গেল। আর হিমু বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটা তার ধরল বাসার দিকে। এভাবে প্রাই অনেকদিন কেটে গেল। প্রতিদিন দেখা হত নিহার সাথে হিমুর। তবে কোন কথা হত না তাদের মাঝে। হিমু রাতে তার বাসার ছাদে বসে আছে। তার পাশে বসে আছে হিমুর ফ্রেন্ড সানভি। সানভি বলল,
– তুই কি তাকে বলেছিস যে তুই তাকে ভালোবাসিস?
– না,
– তাহলে কখন বলবি?
তাড়াতাড়ি বলে দে, ভালোবাসার কথাট বেশি দিন না বলে থাকতে নেই। বেশি দিন সময় নিলে সেই ভালোবাসাটা হারিয়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি বলে দেওয়া উচিত তোর। সানভির কথাটা হিমুর মনে লাগল। সে ভাবছে কখন বলবে ভালোবাসার কথাটা। কথাটা না বলে সে আর শান্তিতে থাকতে পারছে না।
আজ হিমু ফুল হাতে দাঁড়িয়ে নিহার জন্য অপেক্ষা করছে রাস্তার পাশে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে হিমু কিন্তু নিহার আসার কোন নাম নেই। হিমু এদিক থেকে ঐদিকে পায়চারী করছে আর ভাবছে কীভাবে বলবে কথাটা। অনেকক্ষণ পর হিমু দেখল নিহা আসছে। হিমু কথাটা বলার জন্য তৈরি হয়ে নিল। নিহা হিমুর সামনে দিয়ে যেতেই, হিমু গিয়ে নিহার সামনে দাঁড়াল। হিমুকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে নিহা থমকে গেল। সে বুঝতে পারছে না কেন হিমু এভাবে তার সামনে আসল। হিমু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে নিহার সামনে, কী বলবে সেটা ঘুচিয়ে নিচ্ছে সে। এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে নিহা বলল,
– কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ একটা কথা ছিল আপনার সাথে।
– কী কথা বলেন? হিমু আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
আপনার হাসিটা আমার খুব ভালো লাগে, আপনার মায়াবী চোখ দুটি আমার খুব ভালো লাগে, আপনার সব কিছুই আমার খুব ভালো লাগে। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকেই আপনার প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করছিল মনে। সেই ভালো লাগা থেকেই শুরু হয় ভালোবাসা। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। কথাগুলো বলে হিমু থামল। হিমু তাকিয়ে আছে নিহার দিকে তার উত্তরের অপেক্ষায়। নিহা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে হিমুর হাত থেকে ফুল গুলো নিয়ে বলল,
– আমিও খুব ভালোবাসি তোমাকে।
কথাটা শুনেই হিমুর মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। সেদিন থেকেই শুরু হয় তাদের ভালোবাসার এই জীবন। খুব ভালোই চলছিল তাদের জীবন। কিন্তু এই জীবন বেশি দিন স্থায়ী হল না হিমুর। একটা কথা আছে পৃথিবীর কোন জিনিস স্থায়ী না, ঠিক তেমনি তাদের প্রেমটাও স্থায়ী হল না। দুই মাস পর। হিমু রেস্টুরেন্টে কাজ করছিল ঠিক তখনি তার মোবাইলটা ভেজে উঠল। মোবাইল বের করে দেখল সানভি কল দিয়েছে। হিমু কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সানভি বলল,
– তুই কি নিহাকে ভালো করে জানিস?
– হ্যাঁ জানি তো। কেন কী হয়েছে?
– আমার মনে হচ্ছে তোর সাথে ছাড়াও, আরও একটা ছেলের সাথে তার রিলেশন আছে। কথাটা শুনে হিমু থমকে গেল। হিমুর মনে অস্থিরতা বেড়ে গেল। সে অস্থির হয়ে বলল,
– মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?
– এই মাত্র দেখলাম নিহা একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছে। কথাটা হিমুর হৃদয়ে গিয়ে লাগল। তার হাত পা কাঁপছে।
– তুই কি শিওর ওটা নিহা ছিল?
– হ্যাঁ শিওর মেয়েটাই নিহা। বিশ্বাস না হলে এসে দেখে যা।
– ঠিক আছে, কোথায় দেখেছিস?
– পার্কের সামনে।
– ঠিকানা দে।
হিমু ঠিকানা টা নিয়ে কলটা রেখে তাড়াতাড়ি বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। পার্কের পাশে আসতেই দেখল সত্যিই নিহা একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছে। এটা দেখে হিমুর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। হিমু বিশ্বাস করতে পারেনি এভাবে নিহা তাকে ধোকা দিবে। ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে তার এতদিন একটা ধোকাবাজ মেয়েকে সে ভালোবেসে এসেছে। হিমু দাঁড়িয়ে তাদের প্রেম দেখতে পারল না সেখানে। তার চোখের কোণাই জল এসে ভিড় করেছে যেকোন সময় তা গড়িয়ে পড়তে পারে। হিমু মন খারাপ আর চোখের কোণাই জল নিয়ে সেখান থেকে চলে আসল বাসায়। বাসায় এসে সে রুমে বসে অনেকক্ষণ কান্না করল। অনেকক্ষণ কান্না করার পর সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিহাকে কল দিল। নিহা কল রিসিভ করতেই সে বলল,
– নিহা তোমার সাথে জরুরী একটা কথা আছে, তুমি কি এখন আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
– এখন?
– হ্যাঁ এখন খুব জরুরী কথা।
– ঠিক আছে, কোথায় আসতে হবে?
হিমু একটা পার্কের ঠিকানা দিল নিহাকে। মোবাইলটা রেখে হিমু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেল পার্কের উদ্দেশ্যে। নিহা আর হিমু দাঁড়িয়ে আছে পার্কের ভিতর। নিহা বলল,
– কী জরুরী কথা বল?
– ছেলেটা কে ছিল?
– কোন ছেলে? অবাক হয়ে বলল নিহা।
– কয়টা ছেলের সাথে রিলেশন আছে তোমার?
– মানে কী বলতে চাইছ তুমি?
– বলতে চাইছি কিছুক্ষণ আগে যার হাত ধরে হাঁটছিলে সে কে ছিল? কথাটা শুনে নিহা অবাক হয়ে গেল।
– ওহ তাহলে আমাদের দেখেছ?
– হ্যাঁ দেখেছি, কে ছিল সে?
– সে আমার বয় ফ্রেন্ড। কথাটা শুনে হিমু অবাক হয়ে গেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– বয় ফ্রেন্ড মানে?
– বয় ফ্রেন্ড মানে বয় ফ্রেন্ড আমি তাকে ভালোবাসি।
– তাহলে আমি?
– তোমার সাথে তো কিছুদিন টাইম পাস করেছিলাম।
তার সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় অনেক আগের। তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে তার সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে যাই। তখন আমার সময় যাচ্ছিল না, তখন আমার পাশে একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল। আর ঠিক তখনি তুমি আমাকে প্রপোজ করে বসলে। ভেবে দেখলাম টাইম পাস করার জন্য তোমার সাথে কিছুদিন অভিনয় করা যাই। প্রয়োজনিয়তা এবং টাইম পাস করার জন্য তোমার সাথে ঠুনকো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। কিছু দিন আগে আবার সে আমার জীবনে ফিরে আসতে চাইলে আমি তাকে আবার গ্রহণ করে নিই। কারণ আমি তাকে এখনও ভালোবাসি। কথাটা শুনে হিমু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ পর সে বলল,
– ওহ তাহলে তুমি প্রয়োজনের জন্য এবং টাইম পাস করার জন্য ভালোবাসার অভিনয় করেছিলে আমার সাথে?
– হ্যাঁ, তা নয় তো কী? তোমার মতো একজন পরিবারহীন গরীব ছেলের সাথে আমি প্রেম করব?
কথাটা শুনে হিমু আরও বেশি কষ্ট ফেল। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।
– আমি পরিবারহীন বলে আমাকে ভালোবাসা যাবে না? আমি গরীব বলে আমার সাথে প্রেম করে যাবে না। তাই না?
– হ্যাঁ তাই।
– খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। আমার সাথে এই রকম না করলেও পারতে, প্রথমে বলে দিলেই পারতে আমার মতো পরিবারহীন ছেলেকে তুমি পছন্দ কর না সেটা। এভাবে আমাকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।
কথাটা বলেই হিমু চোখের জল মুছল। চোখের জল মুছে সে আবার বলল,
– জানো নিহা আমি পরিবারহীন ছিলাম না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা মা দুইজনে আমাকে আশ্রুমে রেখে চলে যান দুইজনে দুই দিকে। তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছিল আমি থাকার কারণে তারা আর একটা বিয়ে করতে পারছে না, তাই তারা দুইজনে আমাকে একটা অনাথ আশ্রমে রেখে চলে যান, মা বাবা থাকতেও আমি অনাথ হয়ে গেলাম। হয়ে গেলাম পরিবারহীন। আসলে আমাদের মতো গরীব ছেলেদের ভালোবাসতে নেই। তারা তাদের ভালোবাসার কোন মূল্য পায় না।
ছোট থেকেই আমি আমার ভালোবাসার মূল্য পাই নি। আজও পেলাম না তোমার কাছে। সমস্যা না আমি কষ্টকে মেনে নিতে পারব। বাবা মা যখন ছোট বেলায় আমাকে রেখে চলে গেছিলেন তখন সে কষ্টকে যখন মেনে নিতে পেরেছি এটাকেও মেনে নিতে পারব। সৃষ্টি কর্তা আমার মতো ছেলেদের একটা শক্তি দিয়েছেন সেটা হল কষ্ট মেনে নেওয়ার শক্তি। আমিও এই কষ্ট মেনে নিব। ভালো থেক তুমি। আর হ্যাঁ আর একটা কথা, প্রয়োজনের কারণে কোন ছেলের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করিও না। কেননা তুমি হয়তো তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করবে কিন্তু সেই ছেলেটি করবে না।
অভিনয় করে কাউকে কষ্ট দিও না প্লীজ। যদি কাউকে তেমন পাশে পাওয়ার মতো প্রয়োজন হয় তাহলে অভিনয় না করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিও। নিজের প্রয়োজনের কারণে আর টাইম পাস করার কারণে একটা ছেলের জীবনকে নষ্ট করিও না প্লীজ। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল। কথাগুলো বলেই চোখ ভরা জল নিয়ে হাঁটা দিল সামনের দিকে। হিমুদের মতো ছেলেদের চোখের এই জল ছাড়া আর কিছু পাওয়ার নেই জীবনে। তাদের ভালোবাসা মূল্য হল চোখের জল। কাউকে যত বেশি ভালোবাসবে তত বেশি তাদের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে